Ajker Patrika

পান্থকুঞ্জ ও হাতিরঝিল ধ্বংসকারী এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে সংযোগ সড়ক বাতিলের দাবি গাছ রক্ষা আন্দোলনের

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

পান্থকুঞ্জ পার্ক ও হাতিরঝিলের পরিবেশ ধ্বংস করে নির্মিতব্য ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের এফডিসি থেকে পলাশী পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ বাতিলের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ গাছ রক্ষা আন্দোলন। একই সঙ্গে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের রাষ্ট্রীয় আইন অমান্য, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, জনভোগান্তি, হতাহতের ঘটনা, স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতির অভিযোগ উদ্‌ঘাটনে একটি তদন্ত কমিশন গঠনের দাবিও জানিয়েছে তারা। এই দাবিতে আন্দোলনকারীরা আজ সোমবার (৫ মে) প্রধান উপদেষ্টা এবং সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টা ও দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বরাবর চিঠি পাঠিয়েছেন।

এফডিসি থেকে পলাশী পর্যন্ত প্রাণ-প্রকৃতি ও জনবিরোধী এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের সংযোগ সড়ক বাতিল এবং পান্থকুঞ্জ পার্ক ও হাতিরঝিল রক্ষার দাবিতে বাংলাদেশ গাছ রক্ষা আন্দোলনের চলমান লাগাতার অবস্থান কর্মসূচির আজ ছিল ১৪৩তম দিন। তীব্র দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া এবং বায়ু ও শব্দদূষণ উপেক্ষা করে ২০২৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর থেকে পান্থকুঞ্জ পার্কে এই অহিংস আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন আন্দোলনকারীরা।

আন্দোলনকারীদের মতে, বিগত সরকারের দৃশ্যমান উন্নয়ন মডেলের একটি নিকৃষ্টতম উদাহরণ এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প। এটি প্রধান উপদেষ্টার ‘থ্রি-জিরো তত্ত্বের’ গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য জিরো নেট কার্বন নিঃসরণের পরিপন্থী। কারণ, এটি গণপরিবহনের উন্নয়ন না ঘটিয়ে ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচলের জন্য নির্মিত হচ্ছে। তাঁরা অভিযোগ করেন, এই প্রকল্প ঢাকা শহরের প্রাকৃতিক পরিবেশের শেষটুকুও কেড়ে নিচ্ছে; বিশেষ করে কাঁঠালবাগান, সেন্ট্রাল রোডসহ দিলু রোডের পানি নিষ্কাশনের একমাত্র পথ হাতিরঝিল ভরাট করে এবং পান্থকুঞ্জ পার্কের ৪৫ প্রজাতির ২ হাজার গাছ ধ্বংস করে এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের রাস্তার নির্মাণকাজ চলছিল, যা তাদের কর্মীদের প্রচেষ্টায় সাময়িকভাবে স্থগিত রয়েছে।

প্রকল্পের নকশাতেও জনভোগান্তি বাড়বে বলে আন্দোলনকারীরা মনে করেন। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মূল করিডরের দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার হলেও ৩১টি র‍্যাম্পসহ প্রকল্পের মোট দৈর্ঘ্য ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। তাঁদের অভিযোগ, মূল প্রকল্পের চেয়ে র‍্যাম্পের দৈর্ঘ্য (২৭ কিলোমিটারের বেশি) সাত কিলোমিটার বেশি। দ্রুতগতির এই উড়ালসড়ক শহরের ভেতর থেকে গাড়ি বের করার কথা থাকলেও ৩১টি র‍্যাম্প এটিকে শহরের সাধারণ সড়কে পরিণত করেছে, যা চালু হওয়া র‍্যাম্পগুলোর আশপাশে যানজট বাড়াচ্ছে।

তাঁরা বলেন, এফডিসি থেকে পলাশী পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণের উদ্যোগের কারণে হাতিরঝিল জলাধার ও পান্থকুঞ্জ পার্কের পরিবেশ এরই মধ্যে ধ্বংস হয়েছে। ভবিষ্যতে এটি কাঁঠালবাগান, কাঁটাবন, নীলক্ষেত, পলাশী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সামগ্রিক পরিবেশ ও পরিবহনব্যবস্থায় সীমাহীন সংকট তৈরি করবে। এই সংযোগ সড়ক বাতিল না করা হলে সার্ক ফোয়ারা, বাংলামোটর, কাঁটাবন, এলিফ্যান্ট রোড, নীলক্ষেত ও পলাশী মোড়গুলোতে যানজট মারাত্মকভাবে বেড়ে যাবে। এ ছাড়া নকশা পরিবর্তনের মাধ্যমে এক্সপ্রেসওয়ের রাস্তা বাণিজ্যিক এলাকা থেকে ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকায়, এমনকি বাচ্চাদের স্কুলের পাশে নিয়ে আসা হয়েছে। রাজউক, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনসহ নগর-পরিকল্পনাবিদ, পরিবেশবিদ, বিশেষজ্ঞ ও এলাকাবাসী এই সংযোগ সড়কের তীব্র আপত্তি জানালেও বিগত সরকার এটি বাতিল করেনি বলে তাঁরা জানান।

আন্দোলনকারীরা অভিযোগ করেন, এই এক্সপ্রেসওয়ে একটি অন্যায্য চুক্তির মাধ্যমে দেশীয় বিনিয়োগ ও অর্থ খাতকে পাশ কাটিয়ে বিদেশি কোম্পানির মুনাফাকে প্রাধান্য দিয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় অর্থ, শ্রম ও পরিকল্পনার অপচয় করেছে। তাঁরা বলেন, ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১১ সালে অনুমোদন পাওয়া পিপিপি মডেলের এই প্রকল্প অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতির কারণে এক যুগেও সম্পন্ন করা যায়নি। পিপিপি চুক্তি অনুযায়ী মূল কাঠামো নির্মাণের ৭৩ শতাংশ বিনিয়োগকারীর এবং ২৭ শতাংশ বাংলাদেশ সরকারের দেওয়ার কথা থাকলেও জনগণ ও রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতারণা করে জমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন, সেবা সংস্থার লাইন সরানো এবং পরামর্শকদের ব্যয় মেটানোর জন্য ‘সাপোর্ট টু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পিপিপি প্রজেক্ট’ নামে আরেকটি প্রকল্প নেয় সেতু বিভাগ কর্তৃপক্ষ। শুরুতে এই প্রকল্পের ব্যয় ৩ হাজার ২১৬ কোটি টাকা ধরা হলেও তা বেড়ে ৪ হাজার ৯১৭ কোটি টাকায় দাঁড়ায়, যার পুরোটাই বহন করবে দেশের জনগণ। এই দুই প্রকল্পের ব্যয় যুক্ত করলে দেখা যায়, মোট প্রাক্কলিত ১৩ হাজার ৮৫৭ দশমিক ৫৭ কোটি টাকার মধ্যে ৫২ দশমিক ৯ শতাংশ বা ৭ হাজার ৩৩০ দশমিক ৫৭ কোটি টাকা বহন করবে বাংলাদেশের জনগণ। আন্দোলনকারীরা এই প্রচেষ্টাকে জনগণের সঙ্গে স্রেফ প্রতারণা বলে অভিহিত করেন। এ ছাড়া ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের চুক্তিতে বাংলাদেশ রেলওয়ের দেওয়া ১২৮ একর জমির আনুমানিক মূল্যমান ৬ হাজার কোটি টাকা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি এবং বাংলাদেশ রেলওয়ে টোলের কোনো অংশও পাবে না। এই প্রকল্পের কারণে ঢাকা-টঙ্গী তৃতীয় ও চতুর্থ লাইন রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পও আটকে আছে বলে তাঁরা জানান।

আন্দোলনকারীরা পান্থকুঞ্জ পার্ক ও হাতিরঝিলের পরিবেশ পুনরুদ্ধার এবং ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের সব অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির সঠিক ও নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য প্রধান উপদেষ্টা এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত