Ajker Patrika

কীটনাশক ব্যবহারে বিপন্ন সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য

  • সহজেই মিলছে বিষাক্ত নানা কীটনাশক।
  • বিষ প্রয়োগে মাছ ধরা সহজ হলেও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ভোক্তারা।
  • মারাত্মক হুমকিতে ঝিনুক, শামুক ও জলচর পাখি।
  • ভেঙে পড়তে পারে সুন্দরবনের খাদ্যশৃঙ্খল।
আবুল আহসান টিটু, সুন্দরবন থেকে ফিরে
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

সুন্দরবনের নদী-খাল-বিলে এখন মাছ ধরার নতুন কৌশল কীটনাশক নামের বিষ। পূর্ব সুন্দরবনসংলগ্ন দোকান কিংবা অনলাইনে অর্ডার করলেই মিলছে রিপকার্ড, রোটেনন, কার্বোফুরানসহ নানা কীটনাশক। এগুলো ব্যবহার করে একসঙ্গে প্রচুর মাছ ধরছে জেলেরা। এতে মাছ ধরা সহজ হলেও হুমকির মুখে পড়ছে পুরো বনের জীববৈচিত্র্য। নদী থেকে বাজার হয়ে খাবারের প্লেটে পৌঁছানো এই মাছ খাদ্যনিরাপত্তার জন্যও বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

বাগেরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. মোতাহার হোসেন বলেন, ‘অনেক কীটনাশক ফসলে প্রয়োগ করার পর অন্তত ২১ দিন ওই ফসল না খাওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। অথচ সেই একই বিষ দিয়ে ধরা মাছ কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বাজারে চলে যাচ্ছে।’ তিনি জানান, জেলায় প্রায় সাড়ে সাত শ লাইসেন্সধারী কীটনাশক বিক্রেতা আছে। কৃষি বিভাগ তাদের মনিটর করছে। অনেকে ভারত থেকে চোরাই পথে এসব পণ্য এনে ঘরে রাখে। কোনো দোকানে এসব বিষ পাওয়া গেলে তার লাইসেন্স বাতিল করা হবে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব বিষ কিনতে কোনো কৃষি কার্ড বা জাতীয় পরিচয়পত্রের প্রয়োজন নেই। চাইলে যে কেউ ইচ্ছেমতো কিনতে পারছে। পূর্ব সুন্দরবনের নদী ও খালে অনেক অসাধু জেলে সরাসরি এসব কীটনাশক প্রয়োগ করছে। এতে একসঙ্গে প্রচুর মাছ মারা যায় এবং সহজে সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। এই বিষের ফলে নদী ও খালের অন্যান্য জলজ প্রাণী; যেমন ঝিনুক, শামুক, জলচর পাখি, এমনকি ডলফিন, কুমিরও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

অভিযোগ আছে, স্থানীয় মাছের ডিপোগুলো বেশি লাভের আশায় জেলেদের কীটনাশক ব্যবহারে উৎসাহ দিচ্ছে। জেলেরা দ্রুত মাছ তুলতে পারলেও সেই মাছ ডিপো হয়ে বাজারে যাচ্ছে। ভোক্তারা অজান্তেই খাচ্ছে বিষাক্ত খাবার।

পরিবেশবিদেরা সতর্ক করেছেন, এভাবে মাছ ধরা চলতে থাকলে সুন্দরবনের খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে পড়বে। কেননা, বিষ প্রয়োগে মাছ ধরার ফলে মাছের ডিম, ছোট-বড় মাছ, অন্যান্য জলজ প্রাণীসহ গোটা বনজ প্রতিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দীর্ঘ মেয়াদে মাটির গুণাগুণও বিনষ্ট হচ্ছে।

বনসংলগ্ন এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় কিছু প্রভাবশালী লোক এসব কর্মকাণ্ডকে প্রশয় দিচ্ছেন। বন বিভাগের কিছু কর্মীও টাকার বিনিময়ে খালে বা অভয়ারণ্যে এমন সুযোগ করে দিচ্ছেন। তবে বন বিভাগের দাবি, নিয়মিত টহল ও অভিযান চালিয়ে তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে।

গত তিন মাসে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগ ১৭৯টি অভিযানে ১৪৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এ সময় জব্দ করা হয়েছে ৪২ মণ বিষযুক্ত মাছ, ২২ বস্তা শুঁটকি, শত শত জাল ও বড়শি, নৌকা ও ট্রলার। উদ্ধার করা হয়েছে রিপকার্ড ও রোটেননসহ নানা কীটনাশক। তবুও থেমে নেই বিষ দিয়ে মাছ ধরার প্রবণতা।

বাগেরহাট জেলা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. অসীম কুমার সমাদ্দার বলেন, ‘এসব মাছ খেলে দীর্ঘ মেয়াদে লিভার, কিডনি, ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া ক্যানসারসহ জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।’

স্থানীয়রা বলছেন, কীটনাশক নামের এসব বিষের অবাধ বিক্রি বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। তবে জেলেদের বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা না করলে এই সংকটের টেকসই কোনো সমাধান আসবে না।

সুন্দরবন রক্ষায় সবার সহযোগিতা কামনা করেন পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘সীমিত জনবল নিয়ে তিন মাসে ২৪ হাজার ফুট হরিণ ধরার ফাঁদ, বিপুল বিষ এবং বিষাক্ত মাছ জব্দসহ ১৪৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ড্রোনসহ বিভিন্ন প্রযুক্তির মাধ্যমে বনে অনুপ্রবেশকারী শিকারিদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। বনরক্ষীদের দায়িত্বে অবহেলা পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত