মিডল ইস্ট আই–এর নিবন্ধ
আজকের পত্রিকা ডেস্ক
কিছুদিন আগে ভারত ইসরায়েলের সঙ্গে একটি ঐতিহাসিক বিনিয়োগ চুক্তি করেছে। দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ চুক্তি বা বিআইএ নামে পরিচিত এই সমঝোতা দুই দেশের বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াতে এবং দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য সহজে সহায়তা করবে।
৮ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এই চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মতরিচ বলেন, ‘এই চুক্তি ভারতীয় ও ইসরায়েলি বিনিয়োগকারীদের জন্য নতুন দ্বার খুলে দেবে, ইসরায়েলি রপ্তানি জোরদার করবে এবং দুই দেশের ব্যবসায়ীদের জন্য নিশ্চিত পরিবেশ ও উন্নয়নের হাতিয়ার দেবে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল বাজারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভারত একটি উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি, আর সহযোগিতা ইসরায়েলের জন্য এক বিশাল সুযোগ।’
ভারত সরকার এক বিবৃতিতে জানায়, এই চুক্তি দুই দেশের ‘অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরদার ও বিনিয়োগ পরিবেশকে আরও দৃঢ় ও সহনশীল করে তোলার যৌথ প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন’। সহজভাবে বললে, এটি এমন চুক্তি, যা দীর্ঘ মেয়াদে ভারত ও ইসরায়েলের অর্থনীতিকে যুক্ত করে রাখবে।
শুধু তা-ই নয়, এটি ভারতের সঙ্গে কোনো ‘পশ্চিমা দেশ’ তথা অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার (ওইসিডি) সদস্য রাষ্ট্রের প্রথম চুক্তি। এ ছাড়া, এটি দুই দেশের মধ্যে ভবিষ্যতে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির পথও তৈরি করছে। এবং অতি অবশ্যই, এই চুক্তির মূল বিষয় অর্থনীতি ও নিরাপত্তা।
অনেকে মনে করছেন, ভারতের তরফ থেকে এর অন্যতম উদ্দেশ্য হলো আদানির হাইফা বন্দর বিনিয়োগকে সুরক্ষা দেওয়া এবং একই সঙ্গে ভারত-মধ্যপ্রাচ্য অর্থনৈতিক করিডর (আইএমইসি) টিকিয়ে রাখা। যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত আইএমইসি ভারতের জন্য পশ্চিমা বাজারে পণ্য পাঠানোর প্রধান রুট, যা চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) বিকল্প হিসেবে কল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যা শুরুর পর থেকে করিডরটি নানা বাধার মুখে পড়েছে।
তবু চুক্তি স্বাক্ষরের সময় বিবেচনা করলে বোঝা যায়, এটি শুধু অর্থনীতি নয়, রাজনীতি, কূটনীতি এবং শক্তি ও আস্থার প্রদর্শনও বটে। এটি ভারত ও ইসরায়েলের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের বিস্তৃত অর্থনৈতিক একীকরণের চলমান প্রকল্পেরই একটি অংশ।
২০২৩ সালের অক্টোবরে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরায়েল গাজায় প্রায় দুই লাখ মানুষকে হত্যা, আহত বা পঙ্গু করেছে। প্রায় ২০ লাখ মানুষ এখন দুর্ভিক্ষের মধ্যে জীবন কাটাচ্ছে ইসরায়েলি অবরোধ ও অবরুদ্ধ নীতির কারণে। গাজায় যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে সারা বিশ্বে লাখো মানুষ রাস্তায় নেমেছে।
অনেক দেশ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) গণহত্যার অভিযোগ তুলেছে। কোনো কোনো অস্ত্র নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, কলম্বিয়া ইসরায়েলে কয়লা রপ্তানি বন্ধ করেছে। অন্যদিকে, শত শত সাধারণ মানুষ এখনো নৌকায় করে খাদ্য ও ওষুধ গাজায় পাঠাতে চেষ্টা করছে অবরোধ ভাঙার আশায়।
এই পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থী অর্থমন্ত্রী স্মতরিচকে আতিথ্য দিয়ে এবং চুক্তি স্বাক্ষর করে নয়াদিল্লি শুধু ইসরায়েলকে সমর্থনই জানায়নি, বরং নিজের অর্থনীতি ও রাজনীতিকে দেশটির সঙ্গে বেঁধে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে।
সবচেয়ে বড় কথা, স্মতরিচ হচ্ছেন সেই ইসরায়েলি নেতা যিনি অধিকৃত পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে সহিংসতায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে অন্তত পাঁচটি পশ্চিমা দেশে প্রবেশ নিষিদ্ধ। তাঁর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি রয়েছে। ফলে ভারত সরকারের এই পদক্ষেপ আরও ভয়ংকর হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ইউরোপে ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতার মুখে ইসরায়েলকে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিতে ভারত কার্যত এগিয়ে এসেছে। গত এক দশক এবং চলমান গণহত্যার সময়কালেও ভারত-ইসরায়েল সম্পর্ক শক্তিশালী হয়েছে। ফিলিস্তিনিদের কাজের অনুমতি বাতিলের পর ভারতীয় শ্রমিক পাঠানো থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর, শিক্ষার্থী বিনিময় এবং মূলধারার ভারতীয় গণমাধ্যমের মাধ্যমে গাজায় হত্যাযজ্ঞ ঢেকে দেওয়া—সব ক্ষেত্রেই সম্পর্ক এগিয়েছে।
দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারত ইসরায়েলি অস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। গাজার গণহত্যা সেই সম্পর্ক বদলায়নি। গত দুই বছরে দুই দেশ পানি প্রযুক্তি, সাইবার নিরাপত্তা ও কৃষি খাতে একাধিক চুক্তি করেছে—যেখানে ইসরায়েল ফিলিস্তিনি দখলদারিত্বের ওপর দাঁড়িয়ে পুরো শিল্প গড়ে তুলেছে।
২০২৪ সালে ভারত-ইসরায়েল বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ৪০০ কোটি ডলার। পারস্পরিক বিনিয়োগের পরিমাণ আনুমানিক ৮০০ মিলিয়ন ডলার, যার বেশির ভাগই প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় হয়েছে। ভারত থেকে ইসরায়েলে রপ্তানি হয়েছে রত্ন, গয়না, রাসায়নিক ও প্রকৌশলপণ্য। অন্যদিকে ইসরায়েল থেকে এসেছে অস্ত্র, সার ও যন্ত্রপাতি।
কিন্তু ভারত এখন ক্রমেই নিজ দেশে ইসরায়েলি অস্ত্র উৎপাদন করছে। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ভারতীয় কোম্পানিগুলো ইসরায়েলি সেনাদের জন্য ড্রোন, রকেট ও বিস্ফোরক পাঠাচ্ছে। ২০২৪ সালের শেষ দিকে মিডল ইস্ট আই জানায়, গাজায় ইসরায়েলি সেনাদের ব্যবহৃত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক অস্ত্র ব্যবস্থা একটি ভারতীয় ও ইসরায়েলি কোম্পানি যৌথভাবে তৈরি করেছে।
অস্ত্র বাণিজ্য নিয়ে সমালোচনার জবাবে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেন, রপ্তানি সব সময়ই ‘জাতীয় স্বার্থে’ নিয়ন্ত্রিত। তিনি বলেন, ‘ইসরায়েল এমন একটি দেশ, যার সঙ্গে আমাদের দীর্ঘদিনের নিরাপত্তা সহযোগিতা রয়েছে। আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়লে ইসরায়েল সব সময় পাশে দাঁড়িয়েছে।’
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত যখন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্তের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে, তখন জয়শঙ্কর জানান, ভারত আইসিসির সদস্য নয়, তাই এ বিষয়ে ভারতের আনুষ্ঠানিক কোনো অবস্থান নেই।
এই বিনিয়োগ সুরক্ষা চুক্তি (বিআইটি) মূলত এমন একটি পরিবেশ তৈরি করছে যেখানে অর্থনৈতিক চুক্তিগুলো আরও কার্যকর হতে পারে। সব মিলিয়ে, এটি একটি বড় চিত্রের অংশ।
সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ—জায়নবাদ ও হিন্দুত্ববাদ—দ্বারা চালিত রাষ্ট্র হিসেবে ভারত ও ইসরায়েল একই ধরনের বর্জনবাদী ও সম্প্রসারণবাদী অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। দখলকৃত পশ্চিম তীরে শুধু ইসরায়েলিদের জন্য বসতি গড়া থেকে শুরু করে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে হিন্দুদের জন্য বিশেষ বসতি তৈরির প্রচেষ্টা পর্যন্ত এর প্রমাণ মিলছে।
এ ছাড়া, ইসরায়েলের ‘ল অব রিটার্ন’ বা ‘নেশন স্টেট ল’ এবং ভারতের ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) ’—সবই ধর্মের ওপর ভিত্তি করে নাগরিকত্ব দেওয়ার উদাহরণ। দুই দেশের স্বৈরাচারী প্রবণতা প্রকাশ পাচ্ছে ব্যাপক নজরদারি, বিরোধীদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদবিরোধী আইন প্রয়োগ এবং সেনাদের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ওপর সহিংসতার মধ্য দিয়ে।
কাশ্মীরে ভারত সরকার সিসিটিভি ক্যামেরা, স্থানীয় সংবাদদাতা ও সাংবাদিক-অ্যাকটিভিস্টদের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে ভয়ভীতি ছড়াচ্ছে। সাধারণ মানুষকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা, বাড়িঘর ভাঙা এবং ধর্মীয় স্থাপনা টার্গেট করেও জনসংখ্যাগত পরিবর্তনের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। ভারত ও ইসরায়েল এই পদ্ধতিগুলোকে নিজেদের জাতিগত জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র গড়ার অগ্রগতি হিসেবে দেখে।
এই চুক্তির মাধ্যমে সেই বন্ধন আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেল। এটি বিনিয়োগকারীদের বার্তা দিচ্ছে: গণহত্যা চালানো রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবসা করতে ভারতের কোনো সমস্যা নেই। এই চুক্তির মাধ্যমে ভারত ইসরায়েলের ভবিষ্যতের সঙ্গে আত্মীয়তা প্রকাশ করছে। হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের কাছে এটি একটি বড় মাইলফলক।
কিন্তু যারা মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের পক্ষে, তাদের কাছে এটি স্পষ্ট করে দিয়েছে—গ্লোবাল সাউথের তথাকথিত নেতা হিসেবে পরিচিত ভারত আসলে বেছে নিয়েছে বাণিজ্য, অস্ত্র ও সাম্প্রদায়িক মতাদর্শকে, ফিলিস্তিনিদের জীবনের চেয়ে। বিশ্বের কাছে এটি সেই বার্তা দেয় যে নিপীড়ন শুধু লাভজনক নয়, বরং গাজার গণহত্যার ক্ষেত্রে এটি এমন কিছু যা সংরক্ষণ করাও জরুরি মনে করছে ভারত।
লেখক: আজাদ ইসা, মিডল ইস্ট আইয়ের সিনিয়র রিপোর্টার। তিনি মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি, মুসলিম ও আরব সম্প্রদায়ের ওপর এর প্রভাব থেকে শুরু করে ভারত ও হিন্দু জাতীয়তাবাদ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। তিনি ২০১০-২০১৮ সাল পর্যন্ত আল-জাজিরার দক্ষিণ ও মধ্য আফ্রিকার প্রতিনিধি ছিলেন। তাঁর লেখা বইয়ের নাম, ‘হস্টাইল হোমল্যান্ডস: দ্য নিউ অ্যালায়েন্স বিটুইন ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইসরায়েল।’
অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান
কিছুদিন আগে ভারত ইসরায়েলের সঙ্গে একটি ঐতিহাসিক বিনিয়োগ চুক্তি করেছে। দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ চুক্তি বা বিআইএ নামে পরিচিত এই সমঝোতা দুই দেশের বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াতে এবং দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য সহজে সহায়তা করবে।
৮ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এই চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মতরিচ বলেন, ‘এই চুক্তি ভারতীয় ও ইসরায়েলি বিনিয়োগকারীদের জন্য নতুন দ্বার খুলে দেবে, ইসরায়েলি রপ্তানি জোরদার করবে এবং দুই দেশের ব্যবসায়ীদের জন্য নিশ্চিত পরিবেশ ও উন্নয়নের হাতিয়ার দেবে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল বাজারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভারত একটি উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি, আর সহযোগিতা ইসরায়েলের জন্য এক বিশাল সুযোগ।’
ভারত সরকার এক বিবৃতিতে জানায়, এই চুক্তি দুই দেশের ‘অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরদার ও বিনিয়োগ পরিবেশকে আরও দৃঢ় ও সহনশীল করে তোলার যৌথ প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন’। সহজভাবে বললে, এটি এমন চুক্তি, যা দীর্ঘ মেয়াদে ভারত ও ইসরায়েলের অর্থনীতিকে যুক্ত করে রাখবে।
শুধু তা-ই নয়, এটি ভারতের সঙ্গে কোনো ‘পশ্চিমা দেশ’ তথা অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার (ওইসিডি) সদস্য রাষ্ট্রের প্রথম চুক্তি। এ ছাড়া, এটি দুই দেশের মধ্যে ভবিষ্যতে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির পথও তৈরি করছে। এবং অতি অবশ্যই, এই চুক্তির মূল বিষয় অর্থনীতি ও নিরাপত্তা।
অনেকে মনে করছেন, ভারতের তরফ থেকে এর অন্যতম উদ্দেশ্য হলো আদানির হাইফা বন্দর বিনিয়োগকে সুরক্ষা দেওয়া এবং একই সঙ্গে ভারত-মধ্যপ্রাচ্য অর্থনৈতিক করিডর (আইএমইসি) টিকিয়ে রাখা। যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত আইএমইসি ভারতের জন্য পশ্চিমা বাজারে পণ্য পাঠানোর প্রধান রুট, যা চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) বিকল্প হিসেবে কল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যা শুরুর পর থেকে করিডরটি নানা বাধার মুখে পড়েছে।
তবু চুক্তি স্বাক্ষরের সময় বিবেচনা করলে বোঝা যায়, এটি শুধু অর্থনীতি নয়, রাজনীতি, কূটনীতি এবং শক্তি ও আস্থার প্রদর্শনও বটে। এটি ভারত ও ইসরায়েলের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের বিস্তৃত অর্থনৈতিক একীকরণের চলমান প্রকল্পেরই একটি অংশ।
২০২৩ সালের অক্টোবরে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরায়েল গাজায় প্রায় দুই লাখ মানুষকে হত্যা, আহত বা পঙ্গু করেছে। প্রায় ২০ লাখ মানুষ এখন দুর্ভিক্ষের মধ্যে জীবন কাটাচ্ছে ইসরায়েলি অবরোধ ও অবরুদ্ধ নীতির কারণে। গাজায় যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে সারা বিশ্বে লাখো মানুষ রাস্তায় নেমেছে।
অনেক দেশ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) গণহত্যার অভিযোগ তুলেছে। কোনো কোনো অস্ত্র নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, কলম্বিয়া ইসরায়েলে কয়লা রপ্তানি বন্ধ করেছে। অন্যদিকে, শত শত সাধারণ মানুষ এখনো নৌকায় করে খাদ্য ও ওষুধ গাজায় পাঠাতে চেষ্টা করছে অবরোধ ভাঙার আশায়।
এই পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থী অর্থমন্ত্রী স্মতরিচকে আতিথ্য দিয়ে এবং চুক্তি স্বাক্ষর করে নয়াদিল্লি শুধু ইসরায়েলকে সমর্থনই জানায়নি, বরং নিজের অর্থনীতি ও রাজনীতিকে দেশটির সঙ্গে বেঁধে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে।
সবচেয়ে বড় কথা, স্মতরিচ হচ্ছেন সেই ইসরায়েলি নেতা যিনি অধিকৃত পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে সহিংসতায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে অন্তত পাঁচটি পশ্চিমা দেশে প্রবেশ নিষিদ্ধ। তাঁর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি রয়েছে। ফলে ভারত সরকারের এই পদক্ষেপ আরও ভয়ংকর হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ইউরোপে ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতার মুখে ইসরায়েলকে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিতে ভারত কার্যত এগিয়ে এসেছে। গত এক দশক এবং চলমান গণহত্যার সময়কালেও ভারত-ইসরায়েল সম্পর্ক শক্তিশালী হয়েছে। ফিলিস্তিনিদের কাজের অনুমতি বাতিলের পর ভারতীয় শ্রমিক পাঠানো থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর, শিক্ষার্থী বিনিময় এবং মূলধারার ভারতীয় গণমাধ্যমের মাধ্যমে গাজায় হত্যাযজ্ঞ ঢেকে দেওয়া—সব ক্ষেত্রেই সম্পর্ক এগিয়েছে।
দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারত ইসরায়েলি অস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। গাজার গণহত্যা সেই সম্পর্ক বদলায়নি। গত দুই বছরে দুই দেশ পানি প্রযুক্তি, সাইবার নিরাপত্তা ও কৃষি খাতে একাধিক চুক্তি করেছে—যেখানে ইসরায়েল ফিলিস্তিনি দখলদারিত্বের ওপর দাঁড়িয়ে পুরো শিল্প গড়ে তুলেছে।
২০২৪ সালে ভারত-ইসরায়েল বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ৪০০ কোটি ডলার। পারস্পরিক বিনিয়োগের পরিমাণ আনুমানিক ৮০০ মিলিয়ন ডলার, যার বেশির ভাগই প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় হয়েছে। ভারত থেকে ইসরায়েলে রপ্তানি হয়েছে রত্ন, গয়না, রাসায়নিক ও প্রকৌশলপণ্য। অন্যদিকে ইসরায়েল থেকে এসেছে অস্ত্র, সার ও যন্ত্রপাতি।
কিন্তু ভারত এখন ক্রমেই নিজ দেশে ইসরায়েলি অস্ত্র উৎপাদন করছে। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ভারতীয় কোম্পানিগুলো ইসরায়েলি সেনাদের জন্য ড্রোন, রকেট ও বিস্ফোরক পাঠাচ্ছে। ২০২৪ সালের শেষ দিকে মিডল ইস্ট আই জানায়, গাজায় ইসরায়েলি সেনাদের ব্যবহৃত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক অস্ত্র ব্যবস্থা একটি ভারতীয় ও ইসরায়েলি কোম্পানি যৌথভাবে তৈরি করেছে।
অস্ত্র বাণিজ্য নিয়ে সমালোচনার জবাবে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেন, রপ্তানি সব সময়ই ‘জাতীয় স্বার্থে’ নিয়ন্ত্রিত। তিনি বলেন, ‘ইসরায়েল এমন একটি দেশ, যার সঙ্গে আমাদের দীর্ঘদিনের নিরাপত্তা সহযোগিতা রয়েছে। আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়লে ইসরায়েল সব সময় পাশে দাঁড়িয়েছে।’
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত যখন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্তের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে, তখন জয়শঙ্কর জানান, ভারত আইসিসির সদস্য নয়, তাই এ বিষয়ে ভারতের আনুষ্ঠানিক কোনো অবস্থান নেই।
এই বিনিয়োগ সুরক্ষা চুক্তি (বিআইটি) মূলত এমন একটি পরিবেশ তৈরি করছে যেখানে অর্থনৈতিক চুক্তিগুলো আরও কার্যকর হতে পারে। সব মিলিয়ে, এটি একটি বড় চিত্রের অংশ।
সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ—জায়নবাদ ও হিন্দুত্ববাদ—দ্বারা চালিত রাষ্ট্র হিসেবে ভারত ও ইসরায়েল একই ধরনের বর্জনবাদী ও সম্প্রসারণবাদী অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। দখলকৃত পশ্চিম তীরে শুধু ইসরায়েলিদের জন্য বসতি গড়া থেকে শুরু করে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে হিন্দুদের জন্য বিশেষ বসতি তৈরির প্রচেষ্টা পর্যন্ত এর প্রমাণ মিলছে।
এ ছাড়া, ইসরায়েলের ‘ল অব রিটার্ন’ বা ‘নেশন স্টেট ল’ এবং ভারতের ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) ’—সবই ধর্মের ওপর ভিত্তি করে নাগরিকত্ব দেওয়ার উদাহরণ। দুই দেশের স্বৈরাচারী প্রবণতা প্রকাশ পাচ্ছে ব্যাপক নজরদারি, বিরোধীদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদবিরোধী আইন প্রয়োগ এবং সেনাদের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ওপর সহিংসতার মধ্য দিয়ে।
কাশ্মীরে ভারত সরকার সিসিটিভি ক্যামেরা, স্থানীয় সংবাদদাতা ও সাংবাদিক-অ্যাকটিভিস্টদের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে ভয়ভীতি ছড়াচ্ছে। সাধারণ মানুষকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা, বাড়িঘর ভাঙা এবং ধর্মীয় স্থাপনা টার্গেট করেও জনসংখ্যাগত পরিবর্তনের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। ভারত ও ইসরায়েল এই পদ্ধতিগুলোকে নিজেদের জাতিগত জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র গড়ার অগ্রগতি হিসেবে দেখে।
এই চুক্তির মাধ্যমে সেই বন্ধন আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেল। এটি বিনিয়োগকারীদের বার্তা দিচ্ছে: গণহত্যা চালানো রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবসা করতে ভারতের কোনো সমস্যা নেই। এই চুক্তির মাধ্যমে ভারত ইসরায়েলের ভবিষ্যতের সঙ্গে আত্মীয়তা প্রকাশ করছে। হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের কাছে এটি একটি বড় মাইলফলক।
কিন্তু যারা মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের পক্ষে, তাদের কাছে এটি স্পষ্ট করে দিয়েছে—গ্লোবাল সাউথের তথাকথিত নেতা হিসেবে পরিচিত ভারত আসলে বেছে নিয়েছে বাণিজ্য, অস্ত্র ও সাম্প্রদায়িক মতাদর্শকে, ফিলিস্তিনিদের জীবনের চেয়ে। বিশ্বের কাছে এটি সেই বার্তা দেয় যে নিপীড়ন শুধু লাভজনক নয়, বরং গাজার গণহত্যার ক্ষেত্রে এটি এমন কিছু যা সংরক্ষণ করাও জরুরি মনে করছে ভারত।
লেখক: আজাদ ইসা, মিডল ইস্ট আইয়ের সিনিয়র রিপোর্টার। তিনি মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি, মুসলিম ও আরব সম্প্রদায়ের ওপর এর প্রভাব থেকে শুরু করে ভারত ও হিন্দু জাতীয়তাবাদ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। তিনি ২০১০-২০১৮ সাল পর্যন্ত আল-জাজিরার দক্ষিণ ও মধ্য আফ্রিকার প্রতিনিধি ছিলেন। তাঁর লেখা বইয়ের নাম, ‘হস্টাইল হোমল্যান্ডস: দ্য নিউ অ্যালায়েন্স বিটুইন ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইসরায়েল।’
অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান
নেপালে তরুণ বেকারত্বের হার অত্যন্ত বেশি ও মাথাপিছু জিডিপি কম। ফলে বিপুলসংখ্যক তরুণ কাজের খোঁজে বিদেশে চলে যাচ্ছেন। এতে ক্ষোভ আরও বেড়েছে। তবে মনে হচ্ছে, এই বিক্ষোভে বাইরের লোকজন ঢুকে পড়ে সহিংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে।
১ দিন আগেআওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনকালে দমন ও হয়রানির শিকার জামায়াতে ইসলামী এখন পুনরায় আত্মপ্রকাশ ও প্রভাব শক্তিশালী করার জন্য উর্বর ভূমি পাচ্ছে। ঢাকার মতো ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল রাজনীতির জমিনে জামায়াতে ইসলামী-সমর্থিত ছাত্রসংগঠনের এ জয় দলটির ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার প্রমাণ।
৪ দিন আগেরক্ষণশীল ইনফ্লুয়েন্সার ও টার্নিং পয়েন্ট ইউএসএর প্রতিষ্ঠাতা চার্লি কার্ককে একটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনা ঘিরে অনলাইনে একটি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছড়িয়ে পড়েছে।
৪ দিন আগেমার্কিন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রও হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে খুব একটা পিছিয়ে নেই। তবে বাস্তবতা হলো—যুক্তরাষ্ট্র আসলেই এই খাতে পিছিয়ে আছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংকট্যাংক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো টম কারাকো বলেন, ‘আমরা (যুক্তরাষ্ট্র) যখন...
৪ দিন আগে