ফজলুল কবির
ভারতের সশস্ত্র বাহিনীতে সেনা নিয়োগের নতুন প্রকল্প ‘অগ্নিপথ’ নিয়ে উত্তাল হয়ে উঠেছে দেশটি। দেশটির ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার প্রতিরক্ষা বাজেটে ব্যয় সংকোচন ও যুব সমাজের কর্মসংস্থানের কারণ দেখিয়ে এই অস্থায়ী সেনা নিয়োগ প্রকল্পকে সামনে আনলেও খোদ যুবসমাজই অসুখী। তারা বিক্ষোভ করছে। রীতিমতো জ্বালাও-পোড়াও শুরু করেছে। বিশ্লেষকেরা এতে বড় বিপদ দেখছেন। সব মিলিয়ে এই অগ্নিপথ ইস্যুতে সত্যিকার অর্থেই এক অগ্নিপরীক্ষার সামনে ভারত।
ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় গত মঙ্গলবার নতুন এ প্রকল্পের ঘোষণা দেয়। সেখানে বলা হয়, এই অগ্নিপথ প্রকল্পের মাধ্যমে ১৭ থেকে ২১ বছর বয়সী ৪৫ হাজার তরুণকে সশস্ত্র বাহিনীতে নেওয়া হবে। তারা চার বছর ‘অগ্নিবীর’ হিসেবে ভারতের সশস্ত্র বাহিনীতে থাকবে। বেতন হবে ৩০ থেকে ৪০ হাজার ভারতীয় রুপি। এর মধ্যে এক-চতুর্থাংশ আবেদন ও তা অনুমোদনের ভিত্তিতে বাহিনীতে থেকে যেতে পারবে। বাকিরা এককালীন ১১-১২ লাখ রুপি নিয়ে ঘরে ফিরে যাবে। বাহিনীতে টিকে যাওয়া ২৫ শতাংশ ১৫ বছর বাহিনীতে সেবা দিতে পারবে। তাহলে এত হইচই কেন? তরুণেরা এত বিক্ষুব্ধ কেন?
অগ্নিপথ নিয়ে মুশকিল অন্য জায়গায়। অগ্নিপথ প্রকল্প নিয়ে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বক্তব্যের মধ্যেই আছে এর ইঙ্গিত। সেখানে বলা হয়েছে, যে ৪৫ হাজার তরুণকে অগ্নিবীর হিসেবে এই প্রকল্পের আওতায় সশস্ত্র বাহিনীতে নেওয়া হবে, তাদের মধ্যে ৭৫ শতাংশই ঝরে পড়বে। এই ৭৫ শতাংশ তরুণ চার বছর একটি বাহিনীতে থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আবার সাধারণ জীবনে ফিরে আসবে। এটা তাদের জন্য তেমন সুখকর কিছু হবে না। কারণ, সাধারণ জীবনে ফিরে আসা মানে তাদের কাছে বেকার জীবনে ফিরে আসাই। অর্থাৎ, সাময়িক কর্মসংস্থানের পর ১১-১২ লাখ রুপি হাতে ধরিয়ে রাষ্ট্র আবার তাদের ভুলে যাবে।
প্রতিরক্ষা বাজেটের বড় অংশ দিয়ে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এখন অস্ত্রশস্ত্রে আরও উন্নত হওয়ার দিকে মনোযোগ দিতে চায়। বেতন-ভাতা ও ভবিষ্য তহবিল বাবদ তারা সেনাদের পেছনে আর ব্যয় করতে আগ্রহী নয়। এই অবহেলাই তরুণদের ভীষণভাবে পোড়াচ্ছে। তারা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে রাষ্ট্রের এমন নির্বিকার মনোভাবে আহত হয়েছে। এই আহত বোধ থেকেই তারা ফুঁসে উঠেছে। বিক্ষোভ করছে। এদিকে নরেন্দ্র মোদি সরকার বলছে, ‘ওহে থাম, এ তোমাদের ভালোর জন্যই।’
কিন্তু তরুণেরা এই প্রবোধ মানতেই রাজি নয়। ‘অগ্নিপথ’ ইস্যুতে দক্ষিণ ভারতের তেলেঙ্গানা ছাড়াও দেশটির বিহার, উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। টানা তিন দিন ধরেই আন্দোলন-বিক্ষোভ চলছে এসব রাজ্যে। এখন পর্যন্ত একজন নিহত ও ১৫ জন আহতের খবর পাওয়া গেছে। তবু আন্দোলন থেকে তারা পিছু হটছে না। যত উচ্চ বেতনই হোক না কেন তারা চার বছরের ভাড়াটে সৈনিক হিসেবে থাকতে চায় না। এদিকে ভারত সরকারও চাইছে যেকোনোভাবে হোক, বেতন-ভাতা বাবদ তাদের ব্যয় কমাতে।
কিন্তু এই কমাতে চাওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন ভারতের রাজনৈতিক নেতারাই। দেশটির সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমসের খবর বলছে, হরিয়ানা কংগ্রেস নেতা ভূপিন্দর সিং হুডা নতুন এ প্রকল্প নিয়ে নতুন করে ভাবার জোর দাবি জানিয়েছেন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, এই পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় এর দীর্ঘসূত্রী প্রভাব বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। এতে দেশের বা তরুণদের—কারও স্বার্থকেই বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। কোভিড পরিস্থিতির কারণে দীর্ঘদিন সেনাবাহিনীতে নিয়োগ বন্ধ ছিল। এর মধ্যে তরুণদের অনেকের বয়স বেড়ে গেছে। এখন এমন এক প্রকল্প হাজির করা হলো, যা তাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎকে আরও বেশি অনিশ্চিত করে দিল।
এ তো গেল একটি দিক। অন্য দিকটি তবে কী? একটু পরিসংখ্যানে চোখ বোলানো যাক। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা জানাচ্ছে, ভারতের সামরিক বাজেট ৭০ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর অর্ধেকের বেশি চলে যায় বাহিনীর সদস্যদের বেতন-ভাতা, পেনশন ইত্যাদি বাবদ। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পর এ খাতে ভারতই সবচেয়ে বেশি ব্যয় করে। এ ব্যয় কমানোই এখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতেই তারা ‘অগ্নিপথ’ প্রকল্প হাজির করেছে। এটি চালুর ঘোষণার আগে এমনকি এ নিয়ে ভারতের পার্লামেন্টে তারা বিন্দুমাত্র আলোচনা পর্যন্ত করেনি। পার্লামেন্টের সংশ্লিষ্ট স্থায়ী কমিটিতেও এর ওপর কোনো আলোচনা হয়নি।
কেন এভাবে এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্প নেওয়া হলো? আল-জাজিরার বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে, গত আট বছরে সশস্ত্র বাহিনীর মোট চাহিদার ৭৫-৮০ শতাংশ পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে ভারত সরকার। বাকি ২০-২৫ শতাংশ অপূরণীয়ই থেকে গেছে। আর গেল বাজেটে এই ঘাটতির পরিমাণ ৫৩ শতাংশ। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকীকরণের বিষয়টি। চীন ও পাকিস্তানের মতো বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে যা এক বড় ঝুঁকি তৈরি করছে। এই ঝুঁকি কমাতে সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকীকরণের অর্থ জোগান দিতে মোদি সরকার এখন তাকাচ্ছে পেনশন ও বেতন-ভাতার মতো বিষয়ের দিকে।
এই উদ্দেশ্য নিরাপত্তা বাহিনীতে কাজ করতে ইচ্ছুক ভারতীয় তরুণদের বুঝতে কষ্ট হয়নি। সঙ্গে রয়েছে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা। এ দুই মিলেই তারা বিক্ষোভে নেমেছে। বিহারের বাস্তবতার দিকে তাকালেই বিষয়টি কিছুটা বোঝা যাবে। বিহারে শিল্পায়ন সেভাবে হয়নি। কর্মসংস্থানের অবস্থাও বেশ নাজুক। ফলে সেখানকার তরুণদের মধ্যে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়াটা একটা স্বপ্নের মতো বিষয়। নিয়োগ হয়ে গেলে পরিবার ও নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুর্ভাবনা ঘোচে। কিন্তু নতুন প্রকল্প তাদের হতভম্ব করে দিয়েছে। কারণ, এটি তাদের কিছুদিনের জন্যই কেবল নিশ্চয়তা দিতে পারে।
এটি শুধু বিহারের বাস্তবতা নয়। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি যখন প্রথম ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন, তখন প্রতি বছর ২ কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এটি যে বাস্তবায়ন হয়নি, তার প্রমাণ রয়েছে ম্যাকিনসে গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের ২০২০ সালের প্রতিবেদনে। সেখানে তারা জানিয়েছে, বেকারত্ব সামাল দিতে ভারত সরকারকে ২০৩০ সালের মধ্যে ৯ কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। ফলে বিহার শুধু নয় এ বাস্তবতা এখন অনেক রাজ্যেরই। তাই বিক্ষোভে উত্তর প্রদেশ থেকে শুরু করে বহু রাজ্যের তরুণেরাই যোগ দিয়েছে।
এ তো গেল তরুণদের দিক। কিন্তু ভারতের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি কী হবে? হ্যাঁ, পাকিস্তান বা চীনের মতো প্রতিপক্ষের সঙ্গে সামরিক সরঞ্জামে আধুনিক হওয়ার দৌড়ে টিকে থাকতে ভারত খোদ সেনাদেরই বেতন ভাতার তহবিলে হাত দিচ্ছে। উদ্দেশ্য, সামরিক দিক থেকে ভারতকে আরও শক্তিশালী করা। কিন্তু এই উদ্দেশ্য নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, পাইলট ভিত্তিতে যে সেনাদের নেওয়া হবে, তাদের কাছ থেকে একজন নিয়মিত সেনার মতো সেবা পাওয়া যাবে না। কারণ, অগ্নিপথ প্রকল্পে নিযুক্ত সেনাদের একটি বড় অংশই প্রতিনিয়ত ক্ষণ গুনবে, কবে তাদের চার বছরের মেয়াদ শেষ হয়। অক্ষত অবস্থায় ১১-১২ লাখ রুপি নিয়ে সাধারণ জীবনে ফিরে পেতে চাইবে তারা। তাদের প্রশিক্ষণ নিয়েও প্রশ্ন থাকছে। কারণ, দ্রুততম সময়ে বাহিনীর সঙ্গে অগ্নিবীরদের যুক্ত করতে চায় ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। ফলে তাদের প্রশিক্ষণে ঘাটতি থেকে যেতে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে। এ ছাড়া বাহিনীতে নতুন নামে একটি দল যুক্ত হলে, মূল বাহিনীর সঙ্গে তাদের মিশে যাওয়াতেও একটা সংকট তৈরি হবে।
এ তো গেল ‘অগ্নিপথ’ প্রকল্পে নিযুক্ত অগ্নিবীরদের প্রশিক্ষণ ও সম্ভাব্য নিবেদন নিয়ে ওঠা প্রশ্ন। এবার আসা যাক, চার বছর পর বাহিনী থেকে বের হয়ে যাওয়া ৭৫ শতাংশ সেনার প্রশ্নে। সংখ্যার হিসাবে তারা বেশ বড়, ৩৩ হাজার ৭৫০। এই বিপুলসংখ্যক তরুণ সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে বেসামরিক জীবনে ফিরে আসবে। তারা কোথায় যাবে? কর্মসংস্থান প্রশ্নের সমাধান না হলে, তারা সশস্ত্র কোনো গোষ্ঠীতে ভিড়বে না তো? এ ধরনের সশস্ত্র গোষ্ঠী কারা আছে ভারতে?
বিরোধী পক্ষ বলছে, বিজেপি তার রাজনীতির স্বার্থেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দল হিসেবে বিজেপি মনে করে, তার কর্মীদের ন্যূনতম সামরিক প্রশিক্ষণ থাকা জরুরি। ফলে এদের একটি অংশকে তারা নিজ দলেই ভেড়াবে বলে মনে করছেন বিজেপিবিরোধী রাজনৈতিক পক্ষগুলো।
হরিয়ানার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী হুডা সরাসরিই বলেছেন এ কথা। তিনি ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার প্রশ্নটি বেশ সোজাসাপ্টা করে তুলেছেন। বলেছেন, এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার প্রশ্নটিকে পাশ কাটিয়ে নেওয়া সিদ্ধান্ত। তরুণদের ভবিষ্যৎ প্রশ্নে এতে কোনো গুরুত্বই দেওয়া হয়নি। এই সিদ্ধান্ত সেনাবাহিনীর নীতি-নৈতিকতা, ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের পরিপন্থী।
অগ্নিপথ প্রশ্নে ভারত সরকারের কাছে মুখ্য সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকীকরণ এবং সেই সূত্রে বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয় সংকোচন। তরুণদের কাছে ইস্যুটি তাদের রুজিরোজগার, ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্ন নিয়ে হাজির। আর নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও রাজনৈতিক নেতাদের কাছে এটি অভ্যন্তরীণ ও সীমান্ত নিরাপত্তার প্রশ্ন। দল হিসেবে বিজেপির কাছে অগ্নিপথ প্রশিক্ষিত তরুণদের দলে টানার একটি সরবরাহ চেইন বলে মনে করছেন তার প্রতিপক্ষের রাজনীতিকেরা। ফলে এটি বিজেপির কাছে সম্ভাবনাও বটে। আর অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এক বড় সংকট। সব মিলিয়ে এটি গোটা ভারতের সামনে এক অগ্নিপরীক্ষা নিয়ে হাজির, যা বলে দেবে তার রাজনৈতিক, সামরিক এবং সামাজিক ভবিষ্যৎ।
ভারতের সশস্ত্র বাহিনীতে সেনা নিয়োগের নতুন প্রকল্প ‘অগ্নিপথ’ নিয়ে উত্তাল হয়ে উঠেছে দেশটি। দেশটির ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার প্রতিরক্ষা বাজেটে ব্যয় সংকোচন ও যুব সমাজের কর্মসংস্থানের কারণ দেখিয়ে এই অস্থায়ী সেনা নিয়োগ প্রকল্পকে সামনে আনলেও খোদ যুবসমাজই অসুখী। তারা বিক্ষোভ করছে। রীতিমতো জ্বালাও-পোড়াও শুরু করেছে। বিশ্লেষকেরা এতে বড় বিপদ দেখছেন। সব মিলিয়ে এই অগ্নিপথ ইস্যুতে সত্যিকার অর্থেই এক অগ্নিপরীক্ষার সামনে ভারত।
ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় গত মঙ্গলবার নতুন এ প্রকল্পের ঘোষণা দেয়। সেখানে বলা হয়, এই অগ্নিপথ প্রকল্পের মাধ্যমে ১৭ থেকে ২১ বছর বয়সী ৪৫ হাজার তরুণকে সশস্ত্র বাহিনীতে নেওয়া হবে। তারা চার বছর ‘অগ্নিবীর’ হিসেবে ভারতের সশস্ত্র বাহিনীতে থাকবে। বেতন হবে ৩০ থেকে ৪০ হাজার ভারতীয় রুপি। এর মধ্যে এক-চতুর্থাংশ আবেদন ও তা অনুমোদনের ভিত্তিতে বাহিনীতে থেকে যেতে পারবে। বাকিরা এককালীন ১১-১২ লাখ রুপি নিয়ে ঘরে ফিরে যাবে। বাহিনীতে টিকে যাওয়া ২৫ শতাংশ ১৫ বছর বাহিনীতে সেবা দিতে পারবে। তাহলে এত হইচই কেন? তরুণেরা এত বিক্ষুব্ধ কেন?
অগ্নিপথ নিয়ে মুশকিল অন্য জায়গায়। অগ্নিপথ প্রকল্প নিয়ে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বক্তব্যের মধ্যেই আছে এর ইঙ্গিত। সেখানে বলা হয়েছে, যে ৪৫ হাজার তরুণকে অগ্নিবীর হিসেবে এই প্রকল্পের আওতায় সশস্ত্র বাহিনীতে নেওয়া হবে, তাদের মধ্যে ৭৫ শতাংশই ঝরে পড়বে। এই ৭৫ শতাংশ তরুণ চার বছর একটি বাহিনীতে থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আবার সাধারণ জীবনে ফিরে আসবে। এটা তাদের জন্য তেমন সুখকর কিছু হবে না। কারণ, সাধারণ জীবনে ফিরে আসা মানে তাদের কাছে বেকার জীবনে ফিরে আসাই। অর্থাৎ, সাময়িক কর্মসংস্থানের পর ১১-১২ লাখ রুপি হাতে ধরিয়ে রাষ্ট্র আবার তাদের ভুলে যাবে।
প্রতিরক্ষা বাজেটের বড় অংশ দিয়ে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এখন অস্ত্রশস্ত্রে আরও উন্নত হওয়ার দিকে মনোযোগ দিতে চায়। বেতন-ভাতা ও ভবিষ্য তহবিল বাবদ তারা সেনাদের পেছনে আর ব্যয় করতে আগ্রহী নয়। এই অবহেলাই তরুণদের ভীষণভাবে পোড়াচ্ছে। তারা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে রাষ্ট্রের এমন নির্বিকার মনোভাবে আহত হয়েছে। এই আহত বোধ থেকেই তারা ফুঁসে উঠেছে। বিক্ষোভ করছে। এদিকে নরেন্দ্র মোদি সরকার বলছে, ‘ওহে থাম, এ তোমাদের ভালোর জন্যই।’
কিন্তু তরুণেরা এই প্রবোধ মানতেই রাজি নয়। ‘অগ্নিপথ’ ইস্যুতে দক্ষিণ ভারতের তেলেঙ্গানা ছাড়াও দেশটির বিহার, উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। টানা তিন দিন ধরেই আন্দোলন-বিক্ষোভ চলছে এসব রাজ্যে। এখন পর্যন্ত একজন নিহত ও ১৫ জন আহতের খবর পাওয়া গেছে। তবু আন্দোলন থেকে তারা পিছু হটছে না। যত উচ্চ বেতনই হোক না কেন তারা চার বছরের ভাড়াটে সৈনিক হিসেবে থাকতে চায় না। এদিকে ভারত সরকারও চাইছে যেকোনোভাবে হোক, বেতন-ভাতা বাবদ তাদের ব্যয় কমাতে।
কিন্তু এই কমাতে চাওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন ভারতের রাজনৈতিক নেতারাই। দেশটির সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমসের খবর বলছে, হরিয়ানা কংগ্রেস নেতা ভূপিন্দর সিং হুডা নতুন এ প্রকল্প নিয়ে নতুন করে ভাবার জোর দাবি জানিয়েছেন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, এই পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় এর দীর্ঘসূত্রী প্রভাব বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। এতে দেশের বা তরুণদের—কারও স্বার্থকেই বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। কোভিড পরিস্থিতির কারণে দীর্ঘদিন সেনাবাহিনীতে নিয়োগ বন্ধ ছিল। এর মধ্যে তরুণদের অনেকের বয়স বেড়ে গেছে। এখন এমন এক প্রকল্প হাজির করা হলো, যা তাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎকে আরও বেশি অনিশ্চিত করে দিল।
এ তো গেল একটি দিক। অন্য দিকটি তবে কী? একটু পরিসংখ্যানে চোখ বোলানো যাক। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা জানাচ্ছে, ভারতের সামরিক বাজেট ৭০ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর অর্ধেকের বেশি চলে যায় বাহিনীর সদস্যদের বেতন-ভাতা, পেনশন ইত্যাদি বাবদ। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পর এ খাতে ভারতই সবচেয়ে বেশি ব্যয় করে। এ ব্যয় কমানোই এখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতেই তারা ‘অগ্নিপথ’ প্রকল্প হাজির করেছে। এটি চালুর ঘোষণার আগে এমনকি এ নিয়ে ভারতের পার্লামেন্টে তারা বিন্দুমাত্র আলোচনা পর্যন্ত করেনি। পার্লামেন্টের সংশ্লিষ্ট স্থায়ী কমিটিতেও এর ওপর কোনো আলোচনা হয়নি।
কেন এভাবে এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্প নেওয়া হলো? আল-জাজিরার বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে, গত আট বছরে সশস্ত্র বাহিনীর মোট চাহিদার ৭৫-৮০ শতাংশ পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে ভারত সরকার। বাকি ২০-২৫ শতাংশ অপূরণীয়ই থেকে গেছে। আর গেল বাজেটে এই ঘাটতির পরিমাণ ৫৩ শতাংশ। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকীকরণের বিষয়টি। চীন ও পাকিস্তানের মতো বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে যা এক বড় ঝুঁকি তৈরি করছে। এই ঝুঁকি কমাতে সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকীকরণের অর্থ জোগান দিতে মোদি সরকার এখন তাকাচ্ছে পেনশন ও বেতন-ভাতার মতো বিষয়ের দিকে।
এই উদ্দেশ্য নিরাপত্তা বাহিনীতে কাজ করতে ইচ্ছুক ভারতীয় তরুণদের বুঝতে কষ্ট হয়নি। সঙ্গে রয়েছে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা। এ দুই মিলেই তারা বিক্ষোভে নেমেছে। বিহারের বাস্তবতার দিকে তাকালেই বিষয়টি কিছুটা বোঝা যাবে। বিহারে শিল্পায়ন সেভাবে হয়নি। কর্মসংস্থানের অবস্থাও বেশ নাজুক। ফলে সেখানকার তরুণদের মধ্যে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়াটা একটা স্বপ্নের মতো বিষয়। নিয়োগ হয়ে গেলে পরিবার ও নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুর্ভাবনা ঘোচে। কিন্তু নতুন প্রকল্প তাদের হতভম্ব করে দিয়েছে। কারণ, এটি তাদের কিছুদিনের জন্যই কেবল নিশ্চয়তা দিতে পারে।
এটি শুধু বিহারের বাস্তবতা নয়। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি যখন প্রথম ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন, তখন প্রতি বছর ২ কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এটি যে বাস্তবায়ন হয়নি, তার প্রমাণ রয়েছে ম্যাকিনসে গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের ২০২০ সালের প্রতিবেদনে। সেখানে তারা জানিয়েছে, বেকারত্ব সামাল দিতে ভারত সরকারকে ২০৩০ সালের মধ্যে ৯ কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। ফলে বিহার শুধু নয় এ বাস্তবতা এখন অনেক রাজ্যেরই। তাই বিক্ষোভে উত্তর প্রদেশ থেকে শুরু করে বহু রাজ্যের তরুণেরাই যোগ দিয়েছে।
এ তো গেল তরুণদের দিক। কিন্তু ভারতের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি কী হবে? হ্যাঁ, পাকিস্তান বা চীনের মতো প্রতিপক্ষের সঙ্গে সামরিক সরঞ্জামে আধুনিক হওয়ার দৌড়ে টিকে থাকতে ভারত খোদ সেনাদেরই বেতন ভাতার তহবিলে হাত দিচ্ছে। উদ্দেশ্য, সামরিক দিক থেকে ভারতকে আরও শক্তিশালী করা। কিন্তু এই উদ্দেশ্য নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, পাইলট ভিত্তিতে যে সেনাদের নেওয়া হবে, তাদের কাছ থেকে একজন নিয়মিত সেনার মতো সেবা পাওয়া যাবে না। কারণ, অগ্নিপথ প্রকল্পে নিযুক্ত সেনাদের একটি বড় অংশই প্রতিনিয়ত ক্ষণ গুনবে, কবে তাদের চার বছরের মেয়াদ শেষ হয়। অক্ষত অবস্থায় ১১-১২ লাখ রুপি নিয়ে সাধারণ জীবনে ফিরে পেতে চাইবে তারা। তাদের প্রশিক্ষণ নিয়েও প্রশ্ন থাকছে। কারণ, দ্রুততম সময়ে বাহিনীর সঙ্গে অগ্নিবীরদের যুক্ত করতে চায় ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। ফলে তাদের প্রশিক্ষণে ঘাটতি থেকে যেতে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে। এ ছাড়া বাহিনীতে নতুন নামে একটি দল যুক্ত হলে, মূল বাহিনীর সঙ্গে তাদের মিশে যাওয়াতেও একটা সংকট তৈরি হবে।
এ তো গেল ‘অগ্নিপথ’ প্রকল্পে নিযুক্ত অগ্নিবীরদের প্রশিক্ষণ ও সম্ভাব্য নিবেদন নিয়ে ওঠা প্রশ্ন। এবার আসা যাক, চার বছর পর বাহিনী থেকে বের হয়ে যাওয়া ৭৫ শতাংশ সেনার প্রশ্নে। সংখ্যার হিসাবে তারা বেশ বড়, ৩৩ হাজার ৭৫০। এই বিপুলসংখ্যক তরুণ সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে বেসামরিক জীবনে ফিরে আসবে। তারা কোথায় যাবে? কর্মসংস্থান প্রশ্নের সমাধান না হলে, তারা সশস্ত্র কোনো গোষ্ঠীতে ভিড়বে না তো? এ ধরনের সশস্ত্র গোষ্ঠী কারা আছে ভারতে?
বিরোধী পক্ষ বলছে, বিজেপি তার রাজনীতির স্বার্থেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দল হিসেবে বিজেপি মনে করে, তার কর্মীদের ন্যূনতম সামরিক প্রশিক্ষণ থাকা জরুরি। ফলে এদের একটি অংশকে তারা নিজ দলেই ভেড়াবে বলে মনে করছেন বিজেপিবিরোধী রাজনৈতিক পক্ষগুলো।
হরিয়ানার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী হুডা সরাসরিই বলেছেন এ কথা। তিনি ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার প্রশ্নটি বেশ সোজাসাপ্টা করে তুলেছেন। বলেছেন, এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার প্রশ্নটিকে পাশ কাটিয়ে নেওয়া সিদ্ধান্ত। তরুণদের ভবিষ্যৎ প্রশ্নে এতে কোনো গুরুত্বই দেওয়া হয়নি। এই সিদ্ধান্ত সেনাবাহিনীর নীতি-নৈতিকতা, ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের পরিপন্থী।
অগ্নিপথ প্রশ্নে ভারত সরকারের কাছে মুখ্য সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকীকরণ এবং সেই সূত্রে বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয় সংকোচন। তরুণদের কাছে ইস্যুটি তাদের রুজিরোজগার, ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্ন নিয়ে হাজির। আর নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও রাজনৈতিক নেতাদের কাছে এটি অভ্যন্তরীণ ও সীমান্ত নিরাপত্তার প্রশ্ন। দল হিসেবে বিজেপির কাছে অগ্নিপথ প্রশিক্ষিত তরুণদের দলে টানার একটি সরবরাহ চেইন বলে মনে করছেন তার প্রতিপক্ষের রাজনীতিকেরা। ফলে এটি বিজেপির কাছে সম্ভাবনাও বটে। আর অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এক বড় সংকট। সব মিলিয়ে এটি গোটা ভারতের সামনে এক অগ্নিপরীক্ষা নিয়ে হাজির, যা বলে দেবে তার রাজনৈতিক, সামরিক এবং সামাজিক ভবিষ্যৎ।
ভারত-পাকিস্তান সাম্প্রতিক সংঘাতের পেছনে একটি নীরব কিন্তু রক্তাক্ত যুদ্ধক্ষেত্র রয়ে গেছে—বেলুচিস্তান। এ প্রদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দমন-পীড়ন, গুম, অর্থনৈতিক শোষণ ও জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে বেলুচ বিদ্রোহীরা আবারও সশস্ত্র প্রতিরোধে নেমেছে। চলমান সংঘাতের প্রেক্ষাপটে বেলুচিস্তান শুধু একটি আঞ্চলিক
১৪ মিনিট আগেভারতীয় নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসীদের গুলিতে ২৬ পর্যটক নিহত হওয়ার দুই সপ্তাহ পর ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নিয়ে পাল্টা জবাব দিয়েছে। কেবল তাই নয়, এর আগে ভারত এই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে দেশটির বিরুদ্ধে ব্যাপক কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে।
১ দিন আগেভারত ও পাকিস্তান—দুই প্রতিবেশী পারমাণবিক শক্তিধর দেশ বর্তমানে এমন এক উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মুখোমুখি, যা সহজে ভয়াবহ যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। ভারতের কাশ্মীরে গত মাসে (এপ্রিল) ঘটে যাওয়া নৃশংস হামলায় ২৫ জন ভারতীয় পর্যটক এবং এক গাইড নিহত হওয়ার পর থেকে অঞ্চলটিতে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল...
২ দিন আগেকাশ্মীর হলো একটি নানান জাতিগোষ্ঠীতে ভরপুর হিমালয়ের অঞ্চল। এই অঞ্চলটি হ্রদ, উপত্যকা এবং বরফে ঢাকা পাহাড়ের সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত। পারমাণবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তান কাশ্মীর অঞ্চল নিয়ে এখন পর্যন্ত দুটি যুদ্ধ এবং একাধিকবার সীমিত সংঘাতে জড়িয়েছে। কিন্তু কেন এই অঞ্চল নিয়ে তাদের বিরোধ
২ দিন আগে