Ajker Patrika

চীন-ভারত-রাশিয়াকে কাছে আনছে ইউক্রেন সংকট

আব্দুর রহমান
আপডেট : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১১: ০৯
চীন-ভারত-রাশিয়াকে কাছে আনছে ইউক্রেন সংকট

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্ব-রাজনীতির পরিবর্তিত সমীকরণে দূরত্ব কমানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে চীন-ভারত। দেশ দুটির সঙ্গে পশ্চিম বিশেষ করে ইউরোপের সম্পর্কও এখনো উষ্ণ। তবে তাইওয়ান ইস্যুকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের সম্পর্কে তিক্ততা বাড়ছে। এসবের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, রাশিয়ার সঙ্গে এ দুই দেশেরই সম্পর্ক ক্রমশ ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। 

ইউক্রেন সংকটের শুরু থেকেই নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখার চেষ্টা করেছে ভারত। তবে রাশিয়ার কাছ থেকে কম মূল্যে জ্বালানি তেল কেনার বিষয়টি পশ্চিম ভালোভাবে নেয়নি। কিন্তু পশ্চিমের ভালো লাগুক বা না লাগুক, ভারতের জন্য রাশিয়া গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। ভারত নিজ স্বার্থেই রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। বাণিজ্যিক কারণ ছাড়াও রাশিয়া ভারতের কাছে তিনটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ—

পোল্যান্ডভিত্তিক সাময়িকী নিউ ইস্টার্ন ইউরোপের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে—প্রথমত, রাশিয়ার সঙ্গে চীন ও পাকিস্তানের সখ্যের বিষয়টি ভারসাম্যপূর্ণ করা। দ্বিতীয়ত, জম্মু-কাশ্মীর ইস্যুতে রাশিয়ার সমর্থন আদায় এবং তৃতীয়ত, রাশিয়ার সমরশিল্প। ভারত বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমরাস্ত্র ক্রেতা দেশ। দেশটির একটি বড় সরবরাহকারী দেশ রাশিয়া। এখানে এসেই দিল্লি-মস্কো সম্পর্কের বিষয়টি একই রেখায় মিলেছে। যদিও ভারত নিজস্ব সমরশিল্প গড়ে তুলতে চায়। তবে যত দিন না হচ্ছে, তত দিন রাশিয়ার মতো বড় দেশগুলোই ভরসা। 

রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ইউরোপীয় ইউনিয়ন কীভাবে মূল্যায়ন করবে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। চলতি বছরের এপ্রিলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান উরসুলা ভর ডার লেয়ন ভারত সফরে গিয়েছিলেন। তাঁর সফরের উদ্দেশ্য কী, সেটা খোলাখুলি না বললেও এটা স্পষ্ট যে তিনি ভারতকে রুশবিরোধী শিবিরে টানতেই গিয়েছিলেন। তবে তাঁর সফরের পরও অবস্থান দৃশ্যমানভাবে বদলায়নি দিল্লি। 

সি-মোদির হাস্যোজ্জ্বল এই ছবি আগামী বছরগুলোতে দুই দেশের সম্পর্কের প্রতীক হতে থাকবে?ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভারতের তৃতীয় বৃহৎ রপ্তানির বাজার। ফলে রাশিয়ার সঙ্গে সখ্য রাখতে কি ভারত তার রপ্তানি বাজার হারাবে? এমন প্রশ্নও সামনে আসতে পারে। আবার কোভিডের কারণে ভারত থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাণিজ্যের পরিমাণ অনেকটাই কমে গেছে। ফলে ভারতের জন্য বাজার ধরে রাখারও তাগিদ রয়েছে। আর তাই হয়তো কৌশলী নরেন্দ্র মোদি গণতন্ত্রের কার্ড খেলেছিলেন ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্কের কথা বলতে গিয়ে। তিনি বলেছিলেন, ‘ইউরোপীয় সহযোগীরাই ভারতের উন্নতি ও সমৃদ্ধির অন্যতম অংশীদার।’ মোদির এই বাকচাতুর্য কতটা কাজে দিয়েছে বা দেবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে এখনো পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে শীতল মনোভাব দেখায়নি ইউরোপীয় ইউনিয়ন। 

ইউরোপ আপাতত জ্বালানিসংকট ও মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় হিমশিম খেতে থাকায় কৌশলগত সম্পর্কগুলো সেভাবে স্পষ্ট হতে পারছে না। তবে ভারত কোয়াডের মতো সামরিক সহযোগিতা এবং ব্রিকসের মতো অর্থনৈতিক জোটের সদস্য ও বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ হওয়ায় পশ্চিম, চীন ও রাশিয়ার কাছে তার গুরুত্ব স্বাভাবিকভাবেই অনেক বেশি। এ ছাড়া দেশটির ভূরাজনৈতিক অবস্থান তো রয়েছেই।

কেবল ইউরোপ নয়, পশ্চিম যখন চীনকে তাইওয়ান ইস্যুতে উসকে দিচ্ছিল, তখন কোয়াডের অন্যতম সদস্য হয়েও ভারতের নীরবতা ছিল চোখে পড়ার মতো। চীনের তাইওয়ান নিয়ে ব্যস্ত থাকার সুযোগ নিয়ে ভারত লাদাখ, অরুণাচল কিংবা অন্যান্য বিতর্কিত সীমান্তে কোনো সাংঘর্ষিক অবস্থানে যায়নি। উল্টো সম্প্রতি দেশ দুটি লাদাখ সীমান্ত থেকে সেনা প্রত্যাহার করেছে। 

দুই দেশের এমন পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে ভারত-চীন সম্প্রীতি নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে বলে সংবাদমাধ্যম এশিয়া টাইমসের এক প্রতিবেদনে মন্তব্য করেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ এম কে ভদ্রকুমার। নিজেদের স্বার্থেই দেশ দুটি সমঝোতা করে চলতে চাইছে। চীন চাইছে তাইওয়ান ইস্যুতে ভারতের মতো নিকট শক্তিধর রাষ্ট্রকে পথের কাঁটা না বানাতে। আবার ভারতের জন্যও সময়টা পরিবর্তিত বিশ্বরাজনীতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার। বিশ্বের অন্য রাষ্ট্রগুলোকে রাশিয়া ও চীনের বিরুদ্ধে একজোট করতে চাইছে পশ্চিমারা। 

তবে ভারত চাইছে এই মেরুকরণ থেকে বের হয়ে নিজস্ব একটি পরিচয় ও বলয় গঠন করতে। তাই অর্থনৈতিক কার্যক্রম আরও বেগবান করতে দুই দেশই চাইছে কেউ কাউকে বিরক্ত না করতে। অর্থনৈতিক জোট ব্রিকসকে কাজে লাগিয়ে এই কার্যক্রম চালাতে চাইছে দেশ দুটি। 

বর্তমান অবস্থা আশার আলো দেখালেও এই আলো কতটা স্থায়ী হবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে রাশিয়া যে এই দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক উষ্ণ করতে ভূমিকা রেখেছে তা সহজেই অনুমেয়।

মোদি–পুতিনের এই হাসিই নির্দেশ করে দুই দেশের সম্পর্কের গভীরতাগত ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরুর ঠিক আগমুহূর্তে বেইজিং সফরে সি চিন পিংয়ের সঙ্গে পুতিন দীর্ঘ সময় বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে মস্কো-বেইজিং সম্পর্ককে ‘অন্তহীন বন্ধুত্ব’ বলে উল্লেখ করা হয়। চীন এখনো পর্যন্ত রাশিয়াকে সেই বন্ধুত্বের মর্যাদাই দিয়েছে। বিগত ছয় মাসে দেশ দুটির কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার হয়েছে। গত মে থেকে জুলাই পর্যন্ত তিন মাসে রাশিয়া থেকে সবচেয়ে বেশি জ্বালানি তেল কিনেছে চীন। এ ছাড়া ইউক্রেনে যুদ্ধের জন্য পশ্চিমাদের গোঁয়ার্তুমি, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের নীতিকে দায়ী করেছে বেইজিং। 

পরিবর্তিত আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে বেইজিং তার উত্তরের শক্তিশালী প্রতিবেশী রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক নিবিড় করতে চায় বলে মনে করেন ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংক ট্যাংক স্টিমসন সেন্টারের চীন প্রোগ্রামের পরিচালক ইয়ুন সান। বার্তা সংস্থা এএফপিকে তিনি বলেন, ‘ইউক্রেনে রাশিয়ার পরিণতি যা-ই হোক, রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে চীন বদ্ধপরিকর। যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বর্তমান সম্পর্ক বেইজিংকে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে প্ররোচিত করেছে।’ 

সব মিলিয়ে এক জটিল সমীকরণ উদ্ভূত হয়েছে। পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতি রাশিয়া-চীন-ভারতের নৈকট্য বাড়িয়েছে। তবে এই নৈকট্য আগামী দিনে বাড়তে থাকবে নাকি বিবর্ণ হবে, তা নিয়ে দুই ধরনের মতই আছে। তবে ওয়াশিংটন ভিত্তিক থিংক ট্যাংক জেমসটাউন ফাউন্ডেশনের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, ইউক্রেন-সংকট এবং তাইওয়ান ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের সম্পর্কের অবনতির বিপরীতে ভারত-চীন সম্পর্কের উন্নতি এই তিন দেশের সম্পর্ক আরও গভীর করার ইঙ্গিতই বহন করে। 

তথ্যসূত্র: এশিয়া টাইমস, দ্য ডিপ্লোম্যাট, এএফপি, জেমসটাউন ফাউন্ডেশন, এনডিটিভি, নিউ ইস্টার্ন ইউরোপ, স্টিমসন সেন্টার

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত