আজকের পত্রিকা ডেস্ক
এক দশকেরও বেশি আগে, যখন মুখতার আলম কিষানগঞ্জের সরকারি স্কুলে পড়তেন, তখন তাঁর বন্ধুদের বেশির ভাগই ছিল হিন্দু। কিষানগঞ্জ ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় বিহার রাজ্যের একমাত্র মুসলিম-অধ্যুষিত জেলা। মুখতারের বিশেষ ঘনিষ্ঠ ছিল এক হিন্দু বন্ধু। দুজনে একসঙ্গে পড়াশোনা করতেন, স্কুলের প্রজেক্ট করতেন। মুখতার তাঁর বন্ধুর খেয়াল রাখতেন। একসঙ্গে খাওয়ার সময় তিনি মাংস খেতেন না, কারণ তাঁর বন্ধু ছিলেন নিরামিষাশী।
কিন্তু দুই বছর আগে ঘটে যাওয়া এক ঘটনার পর সেই বন্ধুত্বে ফাটল ধরে। এখনো সেই সম্পর্ক জোড়া লাগেনি। ঘটনাটা ঘটে জিতনরাম মাঞ্জির এক বক্তব্যকে ঘিরে। তিনি বিহারের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) জোটসঙ্গী। কিষানগঞ্জ এক সমাবেশে মাঞ্জি মুসলিম শেরশাহবাদি সম্প্রদায়কে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ বলে অভিহিত করেন। বাংলাদেশ ভারতের পূর্ব সীমান্তের প্রতিবেশী, যেখানে ৯১ শতাংশের বেশি মানুষ মুসলিম এবং প্রধান ভাষা বাংলা।
শেরশাহবাদি নামটি এসেছে ঐতিহাসিক শেরশাহবাদ অঞ্চল থেকে। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের কিছু এলাকা অন্তর্ভুক্ত। আর ‘শেরশাহবাদ’ শব্দটির উৎপত্তি বলা হয় আফগান শাসক শেরশাহ সূরির নাম থেকে। তিনি শক্তিশালী মুঘলদের পরাজিত করে ষোড়শ শতকে অল্প সময়ের জন্য বিহার ও বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশসহ) শাসন করেছিলেন।
বিহারে হিন্দি ও উর্দু বেশ প্রচলিত। কিন্তু শেরশাহবাদি মুসলিমরা কথা বলেন বাংলার এক বিশেষ উপভাষায়, যেখানে উর্দু ও হিন্দির অনেক শব্দ মিশে আছে। তাঁদের অনেকে ‘বাদিয়া’ বা ‘ভাটিয়া’ নামেও পরিচিত। ভাটিয়া শব্দটি এসেছে স্থানীয় উপভাষার ‘ভাটো’ থেকে—যার অর্থ, নদীর স্রোতের বিপরীতে যাওয়া। ইতিহাস বলে, শেরশাহবাদিরা পশ্চিমবঙ্গের মালদা থেকে মুর্শিদাবাদ হয়ে গঙ্গার উজান বেয়ে এসে শেষ পর্যন্ত বিহারের সীমাঞ্চলে বসতি গড়েন। সীমাঞ্চলকে বলা হয় ভারতের সবচেয়ে দরিদ্র এলাকা।
মুখতার আলম বলেন, মাঞ্জির বক্তব্যের পর ‘আমরা হুমকির মুখে পড়েছি।’ মুখতার শেরশাহবাদি মুসলিম এবং ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক। চুপ না থেকে তিনি ফেসবুকে প্রতিবাদ করেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে তাঁর পোস্টের নিচে হিন্দিতে এক মন্তব্য ভেসে ওঠে—‘তোরা বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী।’ আর সেই মন্তব্যটি করেছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। তিনি বলেন, ‘ওই মন্তব্য পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার শরীর কেঁপে ওঠে।’
মুখতার সীমাঞ্চল এলাকায় একটি প্রাথমিক স্কুল চালান। সেই স্কুলের খড়ের ছাউনির তলায় বসে আল–জাজিরাকে বলেন, ‘সেই মন্তব্য আমাদের সম্পর্ক ভেঙে দেয়। আমাদের মধ্যকার বিশ্বাস–আস্থা হারিয়ে যায়। ভ্রাতৃত্ব, বন্ধুত্ব—সব শেষ হয়ে যায়।’
বিহার রাজ্য সরকারের প্রকাশিত ২০২৩ সালের জাতিভিত্তিক শুমারির তথ্য বলছে, বিহারে শেরশাহবাদি মুসলিমের সংখ্যা ১৩ লাখ। এঁদের বেশির ভাগ থাকেন—কিষানগঞ্জ ও কাটিহার জেলায়।
ভারতের তৃতীয় জনবহুল রাজ্য বিহার এখন গুরুত্বপূর্ণ বিধানসভা নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে। নির্বাচনের ফল জাতীয় রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে। আর এই প্রেক্ষাপটেই কিষানগঞ্জ ও কাটিহারকে কেন্দ্র করে বিজেপি জোরালো প্রচারণা চালাচ্ছে। কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলটির অভিযোগ, এখানে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা’ বসবাস করছে।
শেরশাহাবাদি মুসলিমরাই টার্গেট কেন
গত ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসে নরেন্দ্র মোদি দিল্লির লালকেল্লা থেকে দেশের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ঘোষণা করেন, অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করার জন্য একটি ‘উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন জনসংখ্যা মিশন’ গঠন করা হবে। তিনি বলেন, ‘কোনো দেশই নিজেকে অনুপ্রবেশকারীদের হাতে তুলে দেয় না। বিশ্বের কোনো দেশ তা করে না—তাহলে ভারত কীভাবে তা মেনে নেবে?’
তবে তিনি স্পষ্ট করে বলেননি যে, এই অনুপ্রবেশকারীরা কারা। তাঁর দাবি, এই মিশনের মাধ্যমে দেশকে ঘিরে থাকা ‘গুরুতর সংকট’ নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সমাধান করা হবে। এখনো সরকার বিস্তারিত কিছু জানায়নি।
ভারতের হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো প্রায়ই ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ শব্দ ব্যবহার করে বাংলাভাষী মুসলিমদের নিশানা করে। এদের প্রধানত বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে টার্গেট করা হয়। আসামে বিজেপি ২০১৬ সাল থেকে ক্ষমতায়। সেখানকার সরকার বহুদিন ধরে বাংলাভাষী মুসলিমদের ‘বহিরাগত’ বলে প্রচারণা চালাচ্ছে। অভিযোগ করা হচ্ছে, তারা নাকি রাজ্যের জনসংখ্যার ভারসাম্য পাল্টে দিতে চাইছে।
আসামের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মুসলিম। ভারতের অন্য কোনো রাজ্যে মুসলিমের হার এত বেশি নয়। শুধু কেন্দ্রশাসিত জম্মু-কাশ্মীর ও আরব সাগরের লাক্ষাদ্বীপে এর চেয়ে বেশি মুসলিম বাস করেন। বিহারের মুসলিম জনসংখ্যা ১ কোটি ৭০ লাখ, যা রাজ্যের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৭ শতাংশ (২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী)। এই মুসলিমদের প্রায় ২৮ দশমিক ৩ শতাংশ বসবাস করেন সীমাঞ্চল এলাকায়। এখানে কিষানগঞ্জ, কাটিহার, আরারিয়া ও পূর্ণিয়া জেলা রয়েছে। কিষানগঞ্জ, কাটিহার ও পূর্ণিয়া পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত। আর সীমাঞ্চল থেকে বাংলাদেশের সীমান্ত কয়েক কিলোমিটার দূরে।
আগামী ৬ ও ১১ নভেম্বর দুই দফায় বিহারে বিধানসভা নির্বাচন হবে। ফল ঘোষণা করা হবে ১৪ নভেম্বর। বিজেপি কখনোই বিহারে এককভাবে সরকার গঠন করতে পারেনি। গত ২০ বছরের বেশির ভাগ সময়ই আঞ্চলিক দলের সঙ্গে জোট বেঁধে ক্ষমতায় ছিল। সমালোচকদের অভিযোগ, এবার বিজেপি ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ ইস্যু সামনে এনে সীমাঞ্চলের ভোটারদের ধর্ম ও ভাষার ভিত্তিতে বিভক্ত করার চেষ্টা করছে।
গত দুই বছরে স্থানীয় মুসলিমদের আশঙ্কা আরও বেড়েছে। কারণ, এখন স্বয়ং মোদি এই প্রচারণার নেতৃত্ব দিচ্ছেন। গত বছর ভারতের জাতীয় নির্বাচনের আগে পূর্ণিয়ায় এক সমাবেশে মোদি বলেছিলেন, ‘ভোটব্যাংকের রাজনীতি করা লোকেরা পূর্ণিয়া ও সীমাঞ্চলকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের ঘাঁটিতে পরিণত করেছে। এতে এই অঞ্চলের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে।’
এ বছর বিহারের বিভিন্ন জেলার নির্বাচনী জনসভায়ও তিনি একই সুরে কথা বলেছেন। সাম্প্রতিক এক সমাবেশে মোদি বলেন, ‘আজ সীমাঞ্চলসহ পূর্ব ভারতের বহু জায়গায় অনুপ্রবেশকারীদের কারণে ভয়াবহ জনসংখ্যাগত সংকট তৈরি হয়েছে।’ তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, ‘প্রতিটি অনুপ্রবেশকারীকে দেশ থেকে তাড়ানো হবে।’ ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে এ অভিযান ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে।
‘দানব/অসুর এসেছে বাংলাদেশ থেকে’
ভারতের বিজেপি শাসিত কয়েকটি রাজ্যে সম্প্রতি কথিত ‘অবৈধ বাংলাদেশি’দের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছে প্রশাসন। আসাম, গুজরাট, মহারাষ্ট্র ও রাজধানী দিল্লি থেকে শত শত বাংলাভাষী মানুষকে বিতাড়িত করা হয়েছে। অথচ তাঁদের অনেকের কাছেই ভারতীয় নাগরিকত্বের বৈধ কাগজপত্র ছিল। সমালোচকেরা বলছেন, এই অভিযানের মূল লক্ষ্য মুসলিমদের টার্গেট করা।
চলতি মাসের শুরুর দিকে বিজেপির আসাম শাখা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে তৈরি ভিডিও প্রকাশ করে। ‘আসাম উইদআউট বিজেপি’—শিরোনামের ৩০ সেকেন্ডের ভিডিওটিতে দাবি করা হয়, রাজ্যে মুসলিম জনসংখ্যা দ্রুত ৯০ শতাংশে পৌঁছে যাবে এবং তারা চা বাগান, বিমানবন্দর, স্টেডিয়ামের মতো সব জনসমাগমস্থল দখল করে নেবে। ভিডিওতে দেখানো হয়, মুসলিমরা কাঁটাতারের বেড়া ভেঙে অবৈধভাবে প্রবেশ করবে এবং গরুর মাংস খাওয়া বৈধ করবে। উল্লেখ্য, ভারতের বেশির ভাগ রাজ্যে গরুর মাংস বিক্রি বা খাওয়া নিষিদ্ধ, আর উচ্চবর্ণের অনেক হিন্দুই নিরামিষাশী।
তবে সীমাঞ্চলের মুসলিমদের কাছে বাংলাদেশি ‘অনুপ্রবেশকারীর’ এই বুলি নতুন নয়। সীমাঞ্চলে মুসলিম জনসংখ্যা অনেক বেশি এবং ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ কাছেই হওয়ায় এই অভিযোগকে ঘিরে রাজনীতি হয়। সীমাঞ্চলের বাসিন্দাদের অভিযোগ, বিজেপি বহু বছর ধরে এ অঞ্চলকে ‘হিন্দুত্ববাদের ল্যাবরেটরি’ বানানোর চেষ্টা করছে। এই শব্দটি বেশি ব্যবহার হয় গুজরাটকে বোঝাতে, যেখানে নরেন্দ্র মোদি ২০০১ সালের ডিসেম্বরে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর মাত্র দুই মাসের মাথায় ভয়াবহ দাঙ্গায় প্রায় ২ হাজার মুসলিম নিহত হয়েছিলেন।
সীমাঞ্চলের এক বাসিন্দা মুখতার আলম বলেন, ‘যখনই কোনো হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতাকে এখানে দেখি, আমরা আতঙ্কে থাকি তিনি আমাদের নিয়ে কী মন্তব্য করবেন এবং তার প্রভাব কী হবে।’ গত মাসে কেন্দ্রীয় বস্ত্রমন্ত্রী ও বিহারের বিজেপি নেতা গিরিরাজ সিং পূর্ণিয়ায় এক সমাবেশে বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে অনেক দানব এসেছে, আমাদের সেই দানবদের মারতে হবে।’
এর আগেও গত বছরের অক্টোবরে গিরিরাজ সিং সীমাঞ্চল ও পার্শ্ববর্তী ভাগলপুর জেলায় একটি ‘হিন্দু প্রাইড মার্চ’ আয়োজন করেছিলেন। ওই এলাকায়ও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মুসলিম বাস করেন। সমাবেশে তিনি বারবার বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের কথা বলেন। পাশাপাশি রোহিঙ্গা শরণার্থী ও ‘লাভ জিহাদ’–এর মতো ইস্যু তোলেন। ‘লাভ জিহাদ’—হলো হিন্দু ডানপন্থী গোষ্ঠীর প্রচারিত একটি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, যেখানে বলা হয়—মুসলিম পুরুষেরা হিন্দু নারীদের প্রেম বা বিয়েতে প্রলুব্ধ করে ধর্মান্তরিত করছে।
গত বছরের কিষানগঞ্জের সমাবেশে তিনি সমর্থকদের উদ্দেশে বলেন, ‘এই বাদিয়া (শেরশাহবাদি), অনুপ্রবেশকারী আর মুসলিমরা যদি আমাদের একবার থাপ্পড় মারে, আমরা একসঙ্গে হয়ে তাদের হাজারবার থাপ্পড় মারব।’ তাঁর এই মন্তব্যে ভিড় উল্লাসে ফেটে পড়ে।
আল–জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিজেপির বিধায়ক হরিভূষণ ঠাকুর বলেন, তাঁর দলের সীমাঞ্চলের শেরশাহবাদি মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রচারণা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নয়। তিনি দাবি করেন, ‘এটা কোনো ভোট বা মেরুকরণের বিষয় নয়। সীমাঞ্চলে মুসলিম জনসংখ্যা বাড়ছে অনুপ্রবেশের কারণে। তাই ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। যদি অনুপ্রবেশ বন্ধ না হয়, ২০–২৫ বছরের মধ্যে সীমাঞ্চল বাংলাদেশে পরিণত হবে।’
মুম্বাইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেসের সাবেক অধ্যাপক পুষ্পেন্দ্র মনে করেন, বিজেপির এই মেরুকরণের কৌশল সীমাঞ্চলে তেমন কার্যকর হবে না। তিনি বলেন, ‘বিজেপি ঝাড়খণ্ডের ২০২৪ সালের বিধানসভা নির্বাচনের সময়ও বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীর ইস্যু তুলেছিল। কিন্তু কাজ হয়নি, কারণ অভিযোগের কোনো ভিত্তি ছিল না। একই ঘটনা বিহারেও ঘটবে। কারণ সীমাঞ্চলে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ আদৌ নেই। আর কীভাবে হবে? সীমাঞ্চলের সঙ্গে তো বাংলাদেশের সীমান্তই নেই।’
দশক পুরোনো প্রচারণা
ভারতের বিহারের সীমাঞ্চলে বাংলাভাষী মুসলমানদের ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ বলে অভিযুক্ত করার প্রচার নতুন কিছু নয়। কয়েক দশক আগে আসাম থেকে শুরু হয়েছিল এ প্রচার। সত্তরের দশকের শেষ দিকে আসামের এক ছাত্র সংগঠন রাস্তায় নেমে বাংলাভাষী মুসলমানদের বহিষ্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। এর ফলেই হাজারো মুসলমান হয় দেশ থেকে বিতাড়িত, নয়তো ‘সন্দেহভাজন নাগরিক’ ঘোষিত হয়। এতে তাঁদের আইনি অবস্থান অনিশ্চিত হয়ে পড়ে এবং নিপীড়নের ঝুঁকিতে পড়ে যান তাঁরা।
আসাম থেকে শুরু হওয়া এ আন্দোলন দ্রুত বিহারেও ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে বিষয়টি প্রথম সামনে আনে অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এবিভিপি)। এটি চরম ডানপন্থী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) ছাত্র সংগঠন। ১৯২৫ সালে জন্ম নেওয়া আরএসএস শুরুর দিকে ইউরোপের ফ্যাসিস্ট দলগুলো থেকেও অনুপ্রেরণা নিয়েছিল। বিজেপির আদর্শিক পথপ্রদর্শক সংগঠনটি ভারতের সংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষতাকে বদলে জাতিগত হিন্দু রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছে। সারা ভারতে তাদের হাজারো শাখা আছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপির শীর্ষ নেতারাও এই সংগঠনের আজীবন সদস্য।
আশির দশকের শুরুতে এবিভিপি দাবি করে, সীমাঞ্চলে ২০ হাজার বাংলাদেশি আছে, যারা স্থানীয় ভোটার তালিকায় নাম তুলেছে। এরপর আসামের মতো ভোটার তালিকা যাচাইয়ের দাবি তোলে তারা। ১৯৮৩ সালে ভারতের নির্বাচন কমিশন এবিভিপির দাবি মেনে নেয়। প্রায় ৬ হাজার মুসলমানকে নাগরিকত্ব প্রমাণের নোটিশ পাঠায় কমিশন। তাঁদের সবাই শেরশাহবাদি সম্প্রদায়ের সদস্য।
সেই সময় তরুণ মুসলিম অধিকারকর্মী জাহাঙ্গীর আলম ছিলেন এবিভিপির এ প্রচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের অন্যতম সংগঠক। এখন তিনি সত্তরোর্ধ্ব প্রবীণ। তিনি বলেন, ‘তাদের জমির কাগজপত্র দেখাতে বলা হয়েছিল। আমরা ক্যাম্প বসিয়ে কাগজ সংগ্রহ করি। পরে একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে রাজ্যের রাজধানী পাটনায় যাই।’ তিনি জানান, শেষ পর্যন্ত কাউকেই নাগরিকত্ব থেকে বাদ দেওয়া যায়নি। তাঁর ভাষায়, ‘পুরো ঘটনাই এবিভিপির সাজানো নাটক ছিল।’
কিন্তু সেই পুরোনো প্রচারণা ফের জোরদার হয়েছে সীমাঞ্চলে। একাধিক বিজেপি নেতা আসাম মডেলের মতো সীমাঞ্চলেও জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) চালুর দাবি তুলছেন। এনআরসি হলো—ভারতের সব নাগরিকের একটি তালিকা, যার মূল লক্ষ্য হলো অবৈধ অভিবাসী শনাক্ত করা।
সর্বপ্রথম ২০১৯ সালে আসামে এনআরসি তালিকা প্রকাশ করা হয়। এতে প্রায় ২০ লাখ মানুষকে নাগরিক তালিকার বাইরে রেখে দেওয়া হয়। তাঁদের ‘অন্য দেশের নাগরিক’ বলে চিহ্নিত করা হয়। মোদি সরকার বারবার জানিয়েছে, সারা দেশেই এনআরসি চালু করা হবে।
২০২৩ সালে পার্লামেন্টে দেওয়া বক্তৃতায় বিজেপি এমপি নিশিকান্ত দুবে বলেন, ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীর কারণে কাটিহার, কিষানগঞ্জ, আরারিয়া, পূর্ণিয়া ও ভাগলপুরের জনসংখ্যার চিত্রই বদলে গেছে। আমি সরকারের কাছে অনুরোধ করছি, এনআরসি কার্যকর করে সব বাংলাদেশিকে তাড়িয়ে দিতে হবে।’
কাটিহারের শেরশাহবাদি অধ্যুষিত জাংলা তাল গ্রামের বাসিন্দা আকবর ইমাম বলেন, তাঁদের গ্রামে হিন্দুদের মধ্যে আগেই আলোচনা চলছে, মুসলমানদের যদি বাংলাদেশি আখ্যা দিয়ে তাড়ানো হয়, তাহলে কারা কোন মুসলমানের বাড়িঘর দখল করবে। ৪৬ বছরের এ কৃষক বলেন, ‘আসামে যখন এনআরসি চালু হলো, তখন থেকেই হিন্দুদের মধ্যে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল—কোন মুসলমানের বাড়ি কে নেবে। আমাদের সবকিছুর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তবে নাগরিকত্ব প্রমাণে পুরোনো জমির কাগজ জোগাড় করা কঠিন হবে।’
স্বাভাবিক করা হচ্ছে সাম্প্রদায়িক বিভাজন
ভারতের নির্বাচন কমিশন সম্প্রতি বিহারে ভোটার তালিকা সংশোধনের নামে এক বিতর্কিত পদক্ষেপ নিয়েছে। এই উদ্যোগ বিজেপিকে নতুন করে সীমাঞ্চলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করার সুযোগ দিয়েছে। স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন বা এসআইআর নামের এই প্রক্রিয়ায় প্রায় ৮ কোটি ভোটারের তালিকা সংশোধন করা হয়।
নাগরিকদের ভোটার তালিকায় নাম তুলতে খুব কম সময়ের মধ্যে একগাদা কাগজপত্র দিতে বলা হয়। সমালোচকেরা বলছেন, এটি ছিল সরকার সমর্থিত এক কৌশল, যাতে মুসলমান ও অন্যান্য দুর্বল গোষ্ঠীকে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যায়। বিজেপি মরিয়া হয়ে এই রাজ্য জিততে চায়।
এসআইআর প্রক্রিয়ার সময় বিহারের উপমুখ্যমন্ত্রী চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘কেবল প্রথম সাত দিনে কিষানগঞ্জ আবাসিক সনদের আবেদন বেড়ে গেছে ১০ গুণ। এর মানে বাংলাদেশিরা অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে।’
গত ৩০ সেপ্টেম্বর নির্বাচন কমিশন বিহারের চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করে। এতে প্রায় ৮ কোটি ভোটারের মধ্যে প্রায় ৬ শতাংশের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। মুসলিম অধ্যুষিত কিষানগঞ্জ—যেখানে প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ মুসলিম—দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৭ শতাংশ নাম কাটা গেছে। পুরো সীমাঞ্চল অঞ্চলে বাদ পড়েছে গড়ে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ ভোটার। অন্যদিকে বিহারের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও বিজেপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রতিষ্ঠাতা লালু প্রসাদ যাদবের নিজ জেলা গোপালগঞ্জে সবচেয়ে বেশি ভোটার বাদ পড়েছে।
রোববার ও সোমবার টানা দুদিনের সংবাদ সম্মেলনে ভারতের প্রধান নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমারকে বারবার জিজ্ঞেস করা হয়—এসআইআর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কতজন ‘বিদেশি ভোটার’ শনাক্ত হয়ে তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন? তিনি বলেন, ‘নাম বাদ দেওয়ার প্রধান কারণগুলো হলো—অনেকেই মারা গেছেন, কেউ ভারতের নাগরিক নন, কারও নাম একাধিকবার উঠেছে, আবার অনেকে বিহার ছেড়ে চলে গেছেন।’ পরে নির্বাচন কমিশন জানায়, যদি কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তি মনে করেন কোনো বৈধ ভোটারের নাম বাদ গেছে, তাহলে অভিযোগ বা দাবি দাখিল করা যাবে।
কিষানগঞ্জের শেরশাহবাদি মুসলিম আকবরের নাম চূড়ান্ত তালিকায় রয়েছে। তিনি বলেন, এসআইআর প্রক্রিয়া নিয়ে তিনি ভয় পাননি। কারণ, তাঁর প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র আছে। তিনি বলেন, ‘আল্লাহর রহমতে আমাদের সব প্রমাণপত্র আছে। যাদের টার্গেট করা হয়, তারাই বরং সব সময় শক্ত প্রমাণপত্র গুছিয়ে রাখে।’
স্থানীয় শিক্ষাবিদ পুষ্পেন্দ্রর মতে, বিজেপি শেরশাহবাদি মুসলমানদের বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী বলে আখ্যা দিয়ে শুধু সীমাঞ্চল নয়, সারা বিহারে নির্বাচনী সুবিধা নিতে চাইছে। তিনি বলেন, ‘সীমাঞ্চলে মুসলমান বেশি থাকায় সেখানে বিজেপির তেমন লাভ হবে না। তারা জানে, শেরশাহবাদি মুসলিমদের দোষারোপ করে আসলে সীমাঞ্চলের বাইরের হিন্দু ভোটারদের প্রভাবিত করা সম্ভব। এর মাধ্যমে রাজ্যের অন্যান্য জায়গায় বেশি আসন জিততে চাইছে বিজেপি।’
উদ্বেগ আর অনিশ্চয়তার রাজ্য বিহার
শেরশাহবাদি মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিজেপির প্রচারণার সামাজিক প্রভাবও স্পষ্ট হচ্ছে। কিষানগঞ্জ মুসলমানদের পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে হিন্দু শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমেই কমে যাচ্ছে। কিষানগঞ্জ এক দশক ধরে বেসরকারি স্কুল চালাচ্ছেন তাফহিম রহমান। তিনি বলেন, ‘আজকাল প্রায় কোনো হিন্দু পরিবার তাদের সন্তানকে মুসলিম-পরিচালিত স্কুলে পাঠায় না।’
তাফহিম রহমান জানান, স্কুলটি যখন তিনি শুরু করেছিলেন, শিক্ষার্থীদের প্রায় ১৬ শতাংশ ছিল হিন্দু। এখন তা নেমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২ শতাংশে। তিনি আরও বলেন, ‘এমনকি অনেক সচ্ছল মুসলিম পরিবারও তাদের সন্তানকে এসব স্কুলে পাঠানো থেকে বিরত থাকছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে এই নীরব বিচ্ছিন্নতা আসলে ভয়ংকর এক পরিবর্তনের ইঙ্গিত। এটা দেখাচ্ছে, নির্বাচনী রাজনীতি কীভাবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে স্বাভাবিক করে তুলছে।’
একই চিত্র দেখা যাচ্ছে স্বাস্থ্য খাতেও। কিষানগঞ্জের শেরশাহবাদি মুসলিম আজাদ আলম একটি বেসরকারি হাসপাতালের মালিক। তিনি বলেন, ‘হিন্দু রোগীরা মুসলিম-পরিচালিত হাসপাতাল, বিশেষ করে শেরশাহবাদিদের হাসপাতাল যেতে সংকোচ বোধ করেন। এমনকি চিকিৎসকদের সহায়তার দরকার হলে মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনগুলোও মুসলিম চিকিৎসকদের পাশে খুব কমই দাঁড়ায়।’
তবে সীমাঞ্চল অঞ্চলে আল–জাজিরার সঙ্গে কথা বলা অনেক হিন্দুই বলেছেন, তারা ধর্মভিত্তিক বিভাজনে বিশ্বাস করেন না। ৪৯ বছরের ধোপা অজয় কুমার চৌধুরী বলেন, ‘কিষানগঞ্জ যদি কোনো হিন্দু মনে করে যে মুসলিম ডাক্তার বা মুসলিম-পরিচালিত স্কুলে যাওয়া উচিত নয়, সেটা ভুল।’
তাঁর ভাষায়, ‘কিষানগঞ্জ মুসলিম-অধ্যুষিত জেলা; মুসলমান ছাড়া হিন্দু ব্যবসা টিকতে পারবে না। আমার ৯০ শতাংশ ক্রেতাই মুসলমান। আর আমি যদি চিকিৎসকের কাছে যাই, আগে দেখি তিনি ভালো ডাক্তার কিনা, তার ধর্ম নয়।’
কিন্তু কাটিহারের ৬২ বছর বয়সী আইনজীবী অমরিন্দর বাঘি—যিনি দীর্ঘদিন ধরে বিজেপির সঙ্গে যুক্ত—ভিন্ন মত পোষণ করেন। তিনি বলেন, ‘অবৈধ মুসলিমরা দেশে ঢুকেছে, সরকারকে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে।’ বাঘি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, কেউ যদি অবৈধভাবে কোনো দেশে প্রবেশ করে, সেটা সরকারের পূর্ণ দায়িত্ব। যেমন কেউ যদি আমার ঘরে ঢোকে, এর মানে হয় আমি দুর্বল এবং পরাস্ত, নয়তো আমি শক্তিশালী কিন্তু ঘুমিয়ে আছি।’
এমন মেরুকৃত পরিবেশ মুসলিম সম্প্রদায়কে হতাশ করছে বলে মনে করেন বেঙ্গালুরুর আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক আদিল হোসেন। তিনি বলেন, ‘সীমাঞ্চলের মূল সমস্যা উন্নয়ন। কিন্তু পরিকল্পিতভাবে এটাকে নিরাপত্তা ইস্যু বানানো হচ্ছে, অবৈধ অনুপ্রবেশের ভূত দেখিয়ে। এতে মানুষ উদ্বেগ আর অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ছে। নাগরিক হিসেবে নিজেদের সম্ভাবনা বাস্তবায়নের পথে এটা সবচেয়ে বড় অন্তরায়।’
আজাদ আলম চিন্তিত বিজেপির মুসলিমবিরোধী প্রচারণা নিয়ে। কাঁপা কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘প্রতিবার রাজনীতিকেরা শেরশাহবাদি মুসলমানদের নিয়ে মন্তব্য করলে আমাদের ব্যাখ্যা দিতে হয় যে, আমরা অনুপ্রবেশকারী নই। আমাদের মধ্যে ভয় ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।’ মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, ‘শেরশাহবাদি মুসলমান হিসেবে ওই সব মন্তব্য মাথায় ঘুরপাক খায়। যেন কোনো অসুখ... যেন এক অদৃশ্য ভূত।’
অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান
এক দশকেরও বেশি আগে, যখন মুখতার আলম কিষানগঞ্জের সরকারি স্কুলে পড়তেন, তখন তাঁর বন্ধুদের বেশির ভাগই ছিল হিন্দু। কিষানগঞ্জ ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় বিহার রাজ্যের একমাত্র মুসলিম-অধ্যুষিত জেলা। মুখতারের বিশেষ ঘনিষ্ঠ ছিল এক হিন্দু বন্ধু। দুজনে একসঙ্গে পড়াশোনা করতেন, স্কুলের প্রজেক্ট করতেন। মুখতার তাঁর বন্ধুর খেয়াল রাখতেন। একসঙ্গে খাওয়ার সময় তিনি মাংস খেতেন না, কারণ তাঁর বন্ধু ছিলেন নিরামিষাশী।
কিন্তু দুই বছর আগে ঘটে যাওয়া এক ঘটনার পর সেই বন্ধুত্বে ফাটল ধরে। এখনো সেই সম্পর্ক জোড়া লাগেনি। ঘটনাটা ঘটে জিতনরাম মাঞ্জির এক বক্তব্যকে ঘিরে। তিনি বিহারের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) জোটসঙ্গী। কিষানগঞ্জ এক সমাবেশে মাঞ্জি মুসলিম শেরশাহবাদি সম্প্রদায়কে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ বলে অভিহিত করেন। বাংলাদেশ ভারতের পূর্ব সীমান্তের প্রতিবেশী, যেখানে ৯১ শতাংশের বেশি মানুষ মুসলিম এবং প্রধান ভাষা বাংলা।
শেরশাহবাদি নামটি এসেছে ঐতিহাসিক শেরশাহবাদ অঞ্চল থেকে। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের কিছু এলাকা অন্তর্ভুক্ত। আর ‘শেরশাহবাদ’ শব্দটির উৎপত্তি বলা হয় আফগান শাসক শেরশাহ সূরির নাম থেকে। তিনি শক্তিশালী মুঘলদের পরাজিত করে ষোড়শ শতকে অল্প সময়ের জন্য বিহার ও বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশসহ) শাসন করেছিলেন।
বিহারে হিন্দি ও উর্দু বেশ প্রচলিত। কিন্তু শেরশাহবাদি মুসলিমরা কথা বলেন বাংলার এক বিশেষ উপভাষায়, যেখানে উর্দু ও হিন্দির অনেক শব্দ মিশে আছে। তাঁদের অনেকে ‘বাদিয়া’ বা ‘ভাটিয়া’ নামেও পরিচিত। ভাটিয়া শব্দটি এসেছে স্থানীয় উপভাষার ‘ভাটো’ থেকে—যার অর্থ, নদীর স্রোতের বিপরীতে যাওয়া। ইতিহাস বলে, শেরশাহবাদিরা পশ্চিমবঙ্গের মালদা থেকে মুর্শিদাবাদ হয়ে গঙ্গার উজান বেয়ে এসে শেষ পর্যন্ত বিহারের সীমাঞ্চলে বসতি গড়েন। সীমাঞ্চলকে বলা হয় ভারতের সবচেয়ে দরিদ্র এলাকা।
মুখতার আলম বলেন, মাঞ্জির বক্তব্যের পর ‘আমরা হুমকির মুখে পড়েছি।’ মুখতার শেরশাহবাদি মুসলিম এবং ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক। চুপ না থেকে তিনি ফেসবুকে প্রতিবাদ করেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে তাঁর পোস্টের নিচে হিন্দিতে এক মন্তব্য ভেসে ওঠে—‘তোরা বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী।’ আর সেই মন্তব্যটি করেছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। তিনি বলেন, ‘ওই মন্তব্য পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার শরীর কেঁপে ওঠে।’
মুখতার সীমাঞ্চল এলাকায় একটি প্রাথমিক স্কুল চালান। সেই স্কুলের খড়ের ছাউনির তলায় বসে আল–জাজিরাকে বলেন, ‘সেই মন্তব্য আমাদের সম্পর্ক ভেঙে দেয়। আমাদের মধ্যকার বিশ্বাস–আস্থা হারিয়ে যায়। ভ্রাতৃত্ব, বন্ধুত্ব—সব শেষ হয়ে যায়।’
বিহার রাজ্য সরকারের প্রকাশিত ২০২৩ সালের জাতিভিত্তিক শুমারির তথ্য বলছে, বিহারে শেরশাহবাদি মুসলিমের সংখ্যা ১৩ লাখ। এঁদের বেশির ভাগ থাকেন—কিষানগঞ্জ ও কাটিহার জেলায়।
ভারতের তৃতীয় জনবহুল রাজ্য বিহার এখন গুরুত্বপূর্ণ বিধানসভা নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে। নির্বাচনের ফল জাতীয় রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে। আর এই প্রেক্ষাপটেই কিষানগঞ্জ ও কাটিহারকে কেন্দ্র করে বিজেপি জোরালো প্রচারণা চালাচ্ছে। কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলটির অভিযোগ, এখানে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা’ বসবাস করছে।
শেরশাহাবাদি মুসলিমরাই টার্গেট কেন
গত ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসে নরেন্দ্র মোদি দিল্লির লালকেল্লা থেকে দেশের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ঘোষণা করেন, অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করার জন্য একটি ‘উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন জনসংখ্যা মিশন’ গঠন করা হবে। তিনি বলেন, ‘কোনো দেশই নিজেকে অনুপ্রবেশকারীদের হাতে তুলে দেয় না। বিশ্বের কোনো দেশ তা করে না—তাহলে ভারত কীভাবে তা মেনে নেবে?’
তবে তিনি স্পষ্ট করে বলেননি যে, এই অনুপ্রবেশকারীরা কারা। তাঁর দাবি, এই মিশনের মাধ্যমে দেশকে ঘিরে থাকা ‘গুরুতর সংকট’ নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সমাধান করা হবে। এখনো সরকার বিস্তারিত কিছু জানায়নি।
ভারতের হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো প্রায়ই ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ শব্দ ব্যবহার করে বাংলাভাষী মুসলিমদের নিশানা করে। এদের প্রধানত বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে টার্গেট করা হয়। আসামে বিজেপি ২০১৬ সাল থেকে ক্ষমতায়। সেখানকার সরকার বহুদিন ধরে বাংলাভাষী মুসলিমদের ‘বহিরাগত’ বলে প্রচারণা চালাচ্ছে। অভিযোগ করা হচ্ছে, তারা নাকি রাজ্যের জনসংখ্যার ভারসাম্য পাল্টে দিতে চাইছে।
আসামের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মুসলিম। ভারতের অন্য কোনো রাজ্যে মুসলিমের হার এত বেশি নয়। শুধু কেন্দ্রশাসিত জম্মু-কাশ্মীর ও আরব সাগরের লাক্ষাদ্বীপে এর চেয়ে বেশি মুসলিম বাস করেন। বিহারের মুসলিম জনসংখ্যা ১ কোটি ৭০ লাখ, যা রাজ্যের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৭ শতাংশ (২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী)। এই মুসলিমদের প্রায় ২৮ দশমিক ৩ শতাংশ বসবাস করেন সীমাঞ্চল এলাকায়। এখানে কিষানগঞ্জ, কাটিহার, আরারিয়া ও পূর্ণিয়া জেলা রয়েছে। কিষানগঞ্জ, কাটিহার ও পূর্ণিয়া পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত। আর সীমাঞ্চল থেকে বাংলাদেশের সীমান্ত কয়েক কিলোমিটার দূরে।
আগামী ৬ ও ১১ নভেম্বর দুই দফায় বিহারে বিধানসভা নির্বাচন হবে। ফল ঘোষণা করা হবে ১৪ নভেম্বর। বিজেপি কখনোই বিহারে এককভাবে সরকার গঠন করতে পারেনি। গত ২০ বছরের বেশির ভাগ সময়ই আঞ্চলিক দলের সঙ্গে জোট বেঁধে ক্ষমতায় ছিল। সমালোচকদের অভিযোগ, এবার বিজেপি ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ ইস্যু সামনে এনে সীমাঞ্চলের ভোটারদের ধর্ম ও ভাষার ভিত্তিতে বিভক্ত করার চেষ্টা করছে।
গত দুই বছরে স্থানীয় মুসলিমদের আশঙ্কা আরও বেড়েছে। কারণ, এখন স্বয়ং মোদি এই প্রচারণার নেতৃত্ব দিচ্ছেন। গত বছর ভারতের জাতীয় নির্বাচনের আগে পূর্ণিয়ায় এক সমাবেশে মোদি বলেছিলেন, ‘ভোটব্যাংকের রাজনীতি করা লোকেরা পূর্ণিয়া ও সীমাঞ্চলকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের ঘাঁটিতে পরিণত করেছে। এতে এই অঞ্চলের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে।’
এ বছর বিহারের বিভিন্ন জেলার নির্বাচনী জনসভায়ও তিনি একই সুরে কথা বলেছেন। সাম্প্রতিক এক সমাবেশে মোদি বলেন, ‘আজ সীমাঞ্চলসহ পূর্ব ভারতের বহু জায়গায় অনুপ্রবেশকারীদের কারণে ভয়াবহ জনসংখ্যাগত সংকট তৈরি হয়েছে।’ তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, ‘প্রতিটি অনুপ্রবেশকারীকে দেশ থেকে তাড়ানো হবে।’ ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে এ অভিযান ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে।
‘দানব/অসুর এসেছে বাংলাদেশ থেকে’
ভারতের বিজেপি শাসিত কয়েকটি রাজ্যে সম্প্রতি কথিত ‘অবৈধ বাংলাদেশি’দের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছে প্রশাসন। আসাম, গুজরাট, মহারাষ্ট্র ও রাজধানী দিল্লি থেকে শত শত বাংলাভাষী মানুষকে বিতাড়িত করা হয়েছে। অথচ তাঁদের অনেকের কাছেই ভারতীয় নাগরিকত্বের বৈধ কাগজপত্র ছিল। সমালোচকেরা বলছেন, এই অভিযানের মূল লক্ষ্য মুসলিমদের টার্গেট করা।
চলতি মাসের শুরুর দিকে বিজেপির আসাম শাখা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে তৈরি ভিডিও প্রকাশ করে। ‘আসাম উইদআউট বিজেপি’—শিরোনামের ৩০ সেকেন্ডের ভিডিওটিতে দাবি করা হয়, রাজ্যে মুসলিম জনসংখ্যা দ্রুত ৯০ শতাংশে পৌঁছে যাবে এবং তারা চা বাগান, বিমানবন্দর, স্টেডিয়ামের মতো সব জনসমাগমস্থল দখল করে নেবে। ভিডিওতে দেখানো হয়, মুসলিমরা কাঁটাতারের বেড়া ভেঙে অবৈধভাবে প্রবেশ করবে এবং গরুর মাংস খাওয়া বৈধ করবে। উল্লেখ্য, ভারতের বেশির ভাগ রাজ্যে গরুর মাংস বিক্রি বা খাওয়া নিষিদ্ধ, আর উচ্চবর্ণের অনেক হিন্দুই নিরামিষাশী।
তবে সীমাঞ্চলের মুসলিমদের কাছে বাংলাদেশি ‘অনুপ্রবেশকারীর’ এই বুলি নতুন নয়। সীমাঞ্চলে মুসলিম জনসংখ্যা অনেক বেশি এবং ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ কাছেই হওয়ায় এই অভিযোগকে ঘিরে রাজনীতি হয়। সীমাঞ্চলের বাসিন্দাদের অভিযোগ, বিজেপি বহু বছর ধরে এ অঞ্চলকে ‘হিন্দুত্ববাদের ল্যাবরেটরি’ বানানোর চেষ্টা করছে। এই শব্দটি বেশি ব্যবহার হয় গুজরাটকে বোঝাতে, যেখানে নরেন্দ্র মোদি ২০০১ সালের ডিসেম্বরে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর মাত্র দুই মাসের মাথায় ভয়াবহ দাঙ্গায় প্রায় ২ হাজার মুসলিম নিহত হয়েছিলেন।
সীমাঞ্চলের এক বাসিন্দা মুখতার আলম বলেন, ‘যখনই কোনো হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতাকে এখানে দেখি, আমরা আতঙ্কে থাকি তিনি আমাদের নিয়ে কী মন্তব্য করবেন এবং তার প্রভাব কী হবে।’ গত মাসে কেন্দ্রীয় বস্ত্রমন্ত্রী ও বিহারের বিজেপি নেতা গিরিরাজ সিং পূর্ণিয়ায় এক সমাবেশে বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে অনেক দানব এসেছে, আমাদের সেই দানবদের মারতে হবে।’
এর আগেও গত বছরের অক্টোবরে গিরিরাজ সিং সীমাঞ্চল ও পার্শ্ববর্তী ভাগলপুর জেলায় একটি ‘হিন্দু প্রাইড মার্চ’ আয়োজন করেছিলেন। ওই এলাকায়ও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মুসলিম বাস করেন। সমাবেশে তিনি বারবার বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের কথা বলেন। পাশাপাশি রোহিঙ্গা শরণার্থী ও ‘লাভ জিহাদ’–এর মতো ইস্যু তোলেন। ‘লাভ জিহাদ’—হলো হিন্দু ডানপন্থী গোষ্ঠীর প্রচারিত একটি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, যেখানে বলা হয়—মুসলিম পুরুষেরা হিন্দু নারীদের প্রেম বা বিয়েতে প্রলুব্ধ করে ধর্মান্তরিত করছে।
গত বছরের কিষানগঞ্জের সমাবেশে তিনি সমর্থকদের উদ্দেশে বলেন, ‘এই বাদিয়া (শেরশাহবাদি), অনুপ্রবেশকারী আর মুসলিমরা যদি আমাদের একবার থাপ্পড় মারে, আমরা একসঙ্গে হয়ে তাদের হাজারবার থাপ্পড় মারব।’ তাঁর এই মন্তব্যে ভিড় উল্লাসে ফেটে পড়ে।
আল–জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিজেপির বিধায়ক হরিভূষণ ঠাকুর বলেন, তাঁর দলের সীমাঞ্চলের শেরশাহবাদি মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রচারণা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নয়। তিনি দাবি করেন, ‘এটা কোনো ভোট বা মেরুকরণের বিষয় নয়। সীমাঞ্চলে মুসলিম জনসংখ্যা বাড়ছে অনুপ্রবেশের কারণে। তাই ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। যদি অনুপ্রবেশ বন্ধ না হয়, ২০–২৫ বছরের মধ্যে সীমাঞ্চল বাংলাদেশে পরিণত হবে।’
মুম্বাইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেসের সাবেক অধ্যাপক পুষ্পেন্দ্র মনে করেন, বিজেপির এই মেরুকরণের কৌশল সীমাঞ্চলে তেমন কার্যকর হবে না। তিনি বলেন, ‘বিজেপি ঝাড়খণ্ডের ২০২৪ সালের বিধানসভা নির্বাচনের সময়ও বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীর ইস্যু তুলেছিল। কিন্তু কাজ হয়নি, কারণ অভিযোগের কোনো ভিত্তি ছিল না। একই ঘটনা বিহারেও ঘটবে। কারণ সীমাঞ্চলে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ আদৌ নেই। আর কীভাবে হবে? সীমাঞ্চলের সঙ্গে তো বাংলাদেশের সীমান্তই নেই।’
দশক পুরোনো প্রচারণা
ভারতের বিহারের সীমাঞ্চলে বাংলাভাষী মুসলমানদের ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ বলে অভিযুক্ত করার প্রচার নতুন কিছু নয়। কয়েক দশক আগে আসাম থেকে শুরু হয়েছিল এ প্রচার। সত্তরের দশকের শেষ দিকে আসামের এক ছাত্র সংগঠন রাস্তায় নেমে বাংলাভাষী মুসলমানদের বহিষ্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। এর ফলেই হাজারো মুসলমান হয় দেশ থেকে বিতাড়িত, নয়তো ‘সন্দেহভাজন নাগরিক’ ঘোষিত হয়। এতে তাঁদের আইনি অবস্থান অনিশ্চিত হয়ে পড়ে এবং নিপীড়নের ঝুঁকিতে পড়ে যান তাঁরা।
আসাম থেকে শুরু হওয়া এ আন্দোলন দ্রুত বিহারেও ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে বিষয়টি প্রথম সামনে আনে অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এবিভিপি)। এটি চরম ডানপন্থী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) ছাত্র সংগঠন। ১৯২৫ সালে জন্ম নেওয়া আরএসএস শুরুর দিকে ইউরোপের ফ্যাসিস্ট দলগুলো থেকেও অনুপ্রেরণা নিয়েছিল। বিজেপির আদর্শিক পথপ্রদর্শক সংগঠনটি ভারতের সংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষতাকে বদলে জাতিগত হিন্দু রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছে। সারা ভারতে তাদের হাজারো শাখা আছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপির শীর্ষ নেতারাও এই সংগঠনের আজীবন সদস্য।
আশির দশকের শুরুতে এবিভিপি দাবি করে, সীমাঞ্চলে ২০ হাজার বাংলাদেশি আছে, যারা স্থানীয় ভোটার তালিকায় নাম তুলেছে। এরপর আসামের মতো ভোটার তালিকা যাচাইয়ের দাবি তোলে তারা। ১৯৮৩ সালে ভারতের নির্বাচন কমিশন এবিভিপির দাবি মেনে নেয়। প্রায় ৬ হাজার মুসলমানকে নাগরিকত্ব প্রমাণের নোটিশ পাঠায় কমিশন। তাঁদের সবাই শেরশাহবাদি সম্প্রদায়ের সদস্য।
সেই সময় তরুণ মুসলিম অধিকারকর্মী জাহাঙ্গীর আলম ছিলেন এবিভিপির এ প্রচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের অন্যতম সংগঠক। এখন তিনি সত্তরোর্ধ্ব প্রবীণ। তিনি বলেন, ‘তাদের জমির কাগজপত্র দেখাতে বলা হয়েছিল। আমরা ক্যাম্প বসিয়ে কাগজ সংগ্রহ করি। পরে একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে রাজ্যের রাজধানী পাটনায় যাই।’ তিনি জানান, শেষ পর্যন্ত কাউকেই নাগরিকত্ব থেকে বাদ দেওয়া যায়নি। তাঁর ভাষায়, ‘পুরো ঘটনাই এবিভিপির সাজানো নাটক ছিল।’
কিন্তু সেই পুরোনো প্রচারণা ফের জোরদার হয়েছে সীমাঞ্চলে। একাধিক বিজেপি নেতা আসাম মডেলের মতো সীমাঞ্চলেও জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) চালুর দাবি তুলছেন। এনআরসি হলো—ভারতের সব নাগরিকের একটি তালিকা, যার মূল লক্ষ্য হলো অবৈধ অভিবাসী শনাক্ত করা।
সর্বপ্রথম ২০১৯ সালে আসামে এনআরসি তালিকা প্রকাশ করা হয়। এতে প্রায় ২০ লাখ মানুষকে নাগরিক তালিকার বাইরে রেখে দেওয়া হয়। তাঁদের ‘অন্য দেশের নাগরিক’ বলে চিহ্নিত করা হয়। মোদি সরকার বারবার জানিয়েছে, সারা দেশেই এনআরসি চালু করা হবে।
২০২৩ সালে পার্লামেন্টে দেওয়া বক্তৃতায় বিজেপি এমপি নিশিকান্ত দুবে বলেন, ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীর কারণে কাটিহার, কিষানগঞ্জ, আরারিয়া, পূর্ণিয়া ও ভাগলপুরের জনসংখ্যার চিত্রই বদলে গেছে। আমি সরকারের কাছে অনুরোধ করছি, এনআরসি কার্যকর করে সব বাংলাদেশিকে তাড়িয়ে দিতে হবে।’
কাটিহারের শেরশাহবাদি অধ্যুষিত জাংলা তাল গ্রামের বাসিন্দা আকবর ইমাম বলেন, তাঁদের গ্রামে হিন্দুদের মধ্যে আগেই আলোচনা চলছে, মুসলমানদের যদি বাংলাদেশি আখ্যা দিয়ে তাড়ানো হয়, তাহলে কারা কোন মুসলমানের বাড়িঘর দখল করবে। ৪৬ বছরের এ কৃষক বলেন, ‘আসামে যখন এনআরসি চালু হলো, তখন থেকেই হিন্দুদের মধ্যে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল—কোন মুসলমানের বাড়ি কে নেবে। আমাদের সবকিছুর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তবে নাগরিকত্ব প্রমাণে পুরোনো জমির কাগজ জোগাড় করা কঠিন হবে।’
স্বাভাবিক করা হচ্ছে সাম্প্রদায়িক বিভাজন
ভারতের নির্বাচন কমিশন সম্প্রতি বিহারে ভোটার তালিকা সংশোধনের নামে এক বিতর্কিত পদক্ষেপ নিয়েছে। এই উদ্যোগ বিজেপিকে নতুন করে সীমাঞ্চলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করার সুযোগ দিয়েছে। স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন বা এসআইআর নামের এই প্রক্রিয়ায় প্রায় ৮ কোটি ভোটারের তালিকা সংশোধন করা হয়।
নাগরিকদের ভোটার তালিকায় নাম তুলতে খুব কম সময়ের মধ্যে একগাদা কাগজপত্র দিতে বলা হয়। সমালোচকেরা বলছেন, এটি ছিল সরকার সমর্থিত এক কৌশল, যাতে মুসলমান ও অন্যান্য দুর্বল গোষ্ঠীকে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যায়। বিজেপি মরিয়া হয়ে এই রাজ্য জিততে চায়।
এসআইআর প্রক্রিয়ার সময় বিহারের উপমুখ্যমন্ত্রী চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘কেবল প্রথম সাত দিনে কিষানগঞ্জ আবাসিক সনদের আবেদন বেড়ে গেছে ১০ গুণ। এর মানে বাংলাদেশিরা অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে।’
গত ৩০ সেপ্টেম্বর নির্বাচন কমিশন বিহারের চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করে। এতে প্রায় ৮ কোটি ভোটারের মধ্যে প্রায় ৬ শতাংশের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। মুসলিম অধ্যুষিত কিষানগঞ্জ—যেখানে প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ মুসলিম—দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৭ শতাংশ নাম কাটা গেছে। পুরো সীমাঞ্চল অঞ্চলে বাদ পড়েছে গড়ে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ ভোটার। অন্যদিকে বিহারের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও বিজেপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রতিষ্ঠাতা লালু প্রসাদ যাদবের নিজ জেলা গোপালগঞ্জে সবচেয়ে বেশি ভোটার বাদ পড়েছে।
রোববার ও সোমবার টানা দুদিনের সংবাদ সম্মেলনে ভারতের প্রধান নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমারকে বারবার জিজ্ঞেস করা হয়—এসআইআর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কতজন ‘বিদেশি ভোটার’ শনাক্ত হয়ে তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন? তিনি বলেন, ‘নাম বাদ দেওয়ার প্রধান কারণগুলো হলো—অনেকেই মারা গেছেন, কেউ ভারতের নাগরিক নন, কারও নাম একাধিকবার উঠেছে, আবার অনেকে বিহার ছেড়ে চলে গেছেন।’ পরে নির্বাচন কমিশন জানায়, যদি কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তি মনে করেন কোনো বৈধ ভোটারের নাম বাদ গেছে, তাহলে অভিযোগ বা দাবি দাখিল করা যাবে।
কিষানগঞ্জের শেরশাহবাদি মুসলিম আকবরের নাম চূড়ান্ত তালিকায় রয়েছে। তিনি বলেন, এসআইআর প্রক্রিয়া নিয়ে তিনি ভয় পাননি। কারণ, তাঁর প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র আছে। তিনি বলেন, ‘আল্লাহর রহমতে আমাদের সব প্রমাণপত্র আছে। যাদের টার্গেট করা হয়, তারাই বরং সব সময় শক্ত প্রমাণপত্র গুছিয়ে রাখে।’
স্থানীয় শিক্ষাবিদ পুষ্পেন্দ্রর মতে, বিজেপি শেরশাহবাদি মুসলমানদের বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী বলে আখ্যা দিয়ে শুধু সীমাঞ্চল নয়, সারা বিহারে নির্বাচনী সুবিধা নিতে চাইছে। তিনি বলেন, ‘সীমাঞ্চলে মুসলমান বেশি থাকায় সেখানে বিজেপির তেমন লাভ হবে না। তারা জানে, শেরশাহবাদি মুসলিমদের দোষারোপ করে আসলে সীমাঞ্চলের বাইরের হিন্দু ভোটারদের প্রভাবিত করা সম্ভব। এর মাধ্যমে রাজ্যের অন্যান্য জায়গায় বেশি আসন জিততে চাইছে বিজেপি।’
উদ্বেগ আর অনিশ্চয়তার রাজ্য বিহার
শেরশাহবাদি মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিজেপির প্রচারণার সামাজিক প্রভাবও স্পষ্ট হচ্ছে। কিষানগঞ্জ মুসলমানদের পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে হিন্দু শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমেই কমে যাচ্ছে। কিষানগঞ্জ এক দশক ধরে বেসরকারি স্কুল চালাচ্ছেন তাফহিম রহমান। তিনি বলেন, ‘আজকাল প্রায় কোনো হিন্দু পরিবার তাদের সন্তানকে মুসলিম-পরিচালিত স্কুলে পাঠায় না।’
তাফহিম রহমান জানান, স্কুলটি যখন তিনি শুরু করেছিলেন, শিক্ষার্থীদের প্রায় ১৬ শতাংশ ছিল হিন্দু। এখন তা নেমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২ শতাংশে। তিনি আরও বলেন, ‘এমনকি অনেক সচ্ছল মুসলিম পরিবারও তাদের সন্তানকে এসব স্কুলে পাঠানো থেকে বিরত থাকছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে এই নীরব বিচ্ছিন্নতা আসলে ভয়ংকর এক পরিবর্তনের ইঙ্গিত। এটা দেখাচ্ছে, নির্বাচনী রাজনীতি কীভাবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে স্বাভাবিক করে তুলছে।’
একই চিত্র দেখা যাচ্ছে স্বাস্থ্য খাতেও। কিষানগঞ্জের শেরশাহবাদি মুসলিম আজাদ আলম একটি বেসরকারি হাসপাতালের মালিক। তিনি বলেন, ‘হিন্দু রোগীরা মুসলিম-পরিচালিত হাসপাতাল, বিশেষ করে শেরশাহবাদিদের হাসপাতাল যেতে সংকোচ বোধ করেন। এমনকি চিকিৎসকদের সহায়তার দরকার হলে মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনগুলোও মুসলিম চিকিৎসকদের পাশে খুব কমই দাঁড়ায়।’
তবে সীমাঞ্চল অঞ্চলে আল–জাজিরার সঙ্গে কথা বলা অনেক হিন্দুই বলেছেন, তারা ধর্মভিত্তিক বিভাজনে বিশ্বাস করেন না। ৪৯ বছরের ধোপা অজয় কুমার চৌধুরী বলেন, ‘কিষানগঞ্জ যদি কোনো হিন্দু মনে করে যে মুসলিম ডাক্তার বা মুসলিম-পরিচালিত স্কুলে যাওয়া উচিত নয়, সেটা ভুল।’
তাঁর ভাষায়, ‘কিষানগঞ্জ মুসলিম-অধ্যুষিত জেলা; মুসলমান ছাড়া হিন্দু ব্যবসা টিকতে পারবে না। আমার ৯০ শতাংশ ক্রেতাই মুসলমান। আর আমি যদি চিকিৎসকের কাছে যাই, আগে দেখি তিনি ভালো ডাক্তার কিনা, তার ধর্ম নয়।’
কিন্তু কাটিহারের ৬২ বছর বয়সী আইনজীবী অমরিন্দর বাঘি—যিনি দীর্ঘদিন ধরে বিজেপির সঙ্গে যুক্ত—ভিন্ন মত পোষণ করেন। তিনি বলেন, ‘অবৈধ মুসলিমরা দেশে ঢুকেছে, সরকারকে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে।’ বাঘি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, কেউ যদি অবৈধভাবে কোনো দেশে প্রবেশ করে, সেটা সরকারের পূর্ণ দায়িত্ব। যেমন কেউ যদি আমার ঘরে ঢোকে, এর মানে হয় আমি দুর্বল এবং পরাস্ত, নয়তো আমি শক্তিশালী কিন্তু ঘুমিয়ে আছি।’
এমন মেরুকৃত পরিবেশ মুসলিম সম্প্রদায়কে হতাশ করছে বলে মনে করেন বেঙ্গালুরুর আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক আদিল হোসেন। তিনি বলেন, ‘সীমাঞ্চলের মূল সমস্যা উন্নয়ন। কিন্তু পরিকল্পিতভাবে এটাকে নিরাপত্তা ইস্যু বানানো হচ্ছে, অবৈধ অনুপ্রবেশের ভূত দেখিয়ে। এতে মানুষ উদ্বেগ আর অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ছে। নাগরিক হিসেবে নিজেদের সম্ভাবনা বাস্তবায়নের পথে এটা সবচেয়ে বড় অন্তরায়।’
আজাদ আলম চিন্তিত বিজেপির মুসলিমবিরোধী প্রচারণা নিয়ে। কাঁপা কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘প্রতিবার রাজনীতিকেরা শেরশাহবাদি মুসলমানদের নিয়ে মন্তব্য করলে আমাদের ব্যাখ্যা দিতে হয় যে, আমরা অনুপ্রবেশকারী নই। আমাদের মধ্যে ভয় ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।’ মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, ‘শেরশাহবাদি মুসলমান হিসেবে ওই সব মন্তব্য মাথায় ঘুরপাক খায়। যেন কোনো অসুখ... যেন এক অদৃশ্য ভূত।’
অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান
দুই বছর আগে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের সশস্ত্র বাহিনী ইসরায়েলে আকস্মিক হামলা চালায়। এতে প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হয় এবং ২৫০ জনকে জিম্মি করা হয়। জবাবে ইসরায়েল গাজায় ব্যাপক বিমান হামলা ও স্থল অভিযান চালিয়ে আসছে।
১ দিন আগেরুশ প্রচারণা যেসব দাবি ছড়াচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে বাস্তবে তার উল্টো ছবি দেখা যাচ্ছে রণক্ষেত্রে। ইউক্রেন এখন পর্যন্ত লড়াইয়ে এগিয়ে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও এবার স্বীকার করেছেন, ইউক্রেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় ‘লড়াই চালিয়ে যেতে এবং জয়লাভ করতে সক্ষম।’
১ দিন আগেযুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হঠাৎ করেই এইচ-১বি ভিসার ফি ১ লাখ ডলার নির্ধারণের ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁর এই সিদ্ধান্তের পর চীনের দেখাদেখি দিল্লির নীতিনির্ধারকেরাও দক্ষ ভারতীয়দের দেশে ফেরাতে উদ্যোগী হয়েছেন। ট্রাম্পের ভিসা নীতিতে কাড়াকাড়ি আরোপের পর অনেক চীনা শীর্ষস্থানীয় মার্কিন বিজ্ঞানী নিজ
১ দিন আগেনোবেল কমিটিতে পাঠানো এক চিঠিতে তাঁরা লিখেছেন, ‘গত এক বছরে বিশ্বের শান্তির জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মতো অবদান আর কেউ রাখেননি। অনেকে শান্তি নিয়ে সুন্দরভাবে কথা বলেছেন, কিন্তু তিনিই তা বাস্তবে অর্জন করেছেন।’
২ দিন আগে