Ajker Patrika

করোনার টিকা কি বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত

ফয়সাল হাসান
আপডেট : ১৯ অক্টোবর ২০২১, ১৫: ৪১
করোনার টিকা কি বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত

গত বছর বিশ্বের সামনে নতুন আতঙ্ক হয়ে আসে করোনাভাইরাস। পরবর্তী সময়ে যা মহামারি আকার ধারণ করে এবং এর প্রভাব এখনো দৃশ্যমান। এখন পর্যন্ত করোনার টিকাই এই মহামারি নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বড় অস্ত্র। এসব টিকা কতটা নিরাপদ, এর কার্যকারিতাই বা কতটুকু—এ ধরনের নানা প্রশ্ন আগেই উঠেছে। তবে সংক্রমণ রোধে বিভিন্ন দেশ ক্ষেত্রবিশেষে তাদের নাগরিকদের জন্য টিকা নেওয়া বাধ্যতামূলক করায় এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে নতুন করে। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, জীবন বাঁচাতে এ ধরনের পদক্ষেপ জরুরি হলেও অনেক ক্ষেত্রে তা সরাসরি সাংঘর্ষিক হতে পারে মানবাধিকারের সঙ্গে। 

করোনার নতুন নতুন ধরন, বিশেষ করে ডেলটা ধরন এখনো তাণ্ডব চালালেও বিভিন্ন অঞ্চলে মানুষের মাঝে টিকা নেওয়ার আগ্রহ আবারও কমতে শুরু করেছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় তাই টিকা নেওয়া বাধ্যতামূলক করছে অনেক দেশ। তবে সরকারি এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে এর বিরুদ্ধে দেশে দেশে বিক্ষোভও করছেন অনেকে। 

ক্রমাগত সংক্রমণের মধ্যে ‘কোভিড-জিরো’, অর্থাৎ রোগীর সংখ্যা শূন্যে নামার পর বিধিনিষেধ শিথিল করার কৌশল থেকে সম্প্রতি সরে এসেছে নিউজিল্যান্ড। এর পরপরই গত সপ্তাহে সেখানকার চিকিৎসক ও শিক্ষকদের জন্য ‘নো ভ্যাকসিন, নো জব’ নীতি চালু করেছে দেশটি। একই সময়ে নিউজিল্যান্ডের প্রতিবেশী ফিজি বলছে, নভেম্বরের মধ্যে করোনা টিকার পূর্ণ ডোজ না নিলে সেখানকার সরকারি ও বেসরকারি খাতের সব কর্মীকে চাকরি হারাতে হবে। 

যুক্তরাষ্ট্র তাদের সব বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার পরিকল্পনা করলেও সম্প্রতি করোনার সংক্রমণ ফের বাড়তে শুরু করায় সেই পরিকল্পনা বাদ দিতে হয়েছে। তবে গত সেপ্টেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দেশটির সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য টিকা নেওয়া বাধ্যতামূলক করার ঘোষণা দেন। একই সঙ্গে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আহ্বান জানান তাদের কর্মীদের টিকা গ্রহণ নিশ্চিত করতে অথবা প্রতি সপ্তাহে করোনা পরীক্ষা করাতে। 

তবে টিকানীতি নিয়ে সবচেয়ে কঠোর অবস্থান নিতে দেখা গেছে সৌদি আরব ও ইতালিকে। উপসাগরীয় দেশগুলোতে সব সরকারি-বেসরকারি খাতের কর্মচারীদের কর্মক্ষেত্রে শারীরিকভাবে উপস্থিত থাকার জন্য টিকা নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ ছাড়া কোনো সরকারি ভবন ও বিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে হলে এবং গণপরিবহন ব্যবহার ও অঞ্চলের বাইরে ভ্রমণ করতে চাইলে করোনা টিকার পূর্ণ ডোজ গ্রহণের প্রমাণ দেখাতে হবে বলেও জানানো হয়েছে। 

আর ইতালিতে সম্প্রতি একটি নীতি কার্যকর করে বলা হয়েছে, সেখানে সব খাতের কর্মীদের কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার জন্য টিকা নেওয়ার প্রমাণ অথবা করোনার নেগেটিভ সনদ দেখাতে হবে। প্রমাণ বা তথাকথিত ‘গ্রিন পাস’ না থাকলে কর্মীদের চাকরি হারাতে হতে পারে অথবা তাঁদের বেতন বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে বলেও সতর্ক করা হয়েছে। ট্রেন, বাস ও উড়োজাহাজে ভ্রমণের পাশাপাশি স্থানীয় দর্শনীয় স্থান বা রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করতে হলেও প্রয়োজন হবে এই গ্রিন পাসের।

এদিকে বাধ্যতামূলক টিকাদানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন শহরে রাস্তায় নেমে এসেছেন অনেকে। চলতি মাসের শুরুর দিকে নিউইয়র্কে ‘আমরা ল্যাবের ইঁদুর নই’, ‘স্বাধীনতা মরে গেছে’ ইত্যাদি লেখা সংবলিত বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড হাতে বিক্ষোভ শুরু হয়। এ ছাড়া ‘স্বৈরাচারকে না বলুন’, ‘স্বাধীনতা চাই’, ‘গ্রিন পাস না’সহ বিভিন্ন স্লোগানে গত সপ্তাহে বিক্ষোভ হয় রোমে। 

‘শতভাগ মানবাধিকার ইস্যু’
লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবাধিকার আইনের অধ্যাপক কানস্টানসিন দেতসিয়েরো সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, মানবাধিকার ও বাধ্যতামূলক টিকা দেওয়ার মধ্যে খুব স্পষ্ট একটি সংযোগ রয়েছে। এটি শতভাগ মানবাধিকার ইস্যু, যা গোপনীয়তা ও শারীরিক অখণ্ডতার অধিকার সম্পর্কিত। মানবাধিকার আমাদের দেহ এবং দেহের কর্তা হওয়ার ক্ষমতা রক্ষা করে।’ 

তবে এই অধিকার ‘শর্তহীন’ নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারে, যদি তাঁরা এই ধরনের হস্তক্ষেপকে প্রয়োজনীয় এবং অন্য গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য অর্জনের জন্য যুক্তিযুক্ত হিসেবে প্রমাণ করতে পারে।’ 

বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে করোনা টিকা নেওয়া বাধ্যতামূলক করায় মানবাধিকার প্রশ্নটি বেশ জোরে শোরে উচ্চারিত হচ্ছে এখনবাধ্যতামূলক টিকার বিষয়টিকে ‘নির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠীর জন্য কিংবা একজন ব্যক্তির স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসনের ওপর যুক্তিযুক্ত অনুপ্রবেশ’ বলে আখ্যা দিয়েছেন আইনজীবীরা। কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, করোনাভাইরাস মারাত্মক এবং প্রাণঘাতী। এ পর্যন্ত ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ৫০ কোটি মানুষ এবং মৃতের সংখ্যা ৪৯ লাখ ছাড়িয়েছে। এ ছাড়া সংক্রমণ রোধে লকডাউনসহ নেওয়া নানা পদক্ষেপ জীবন ও জীবিকাকে বিপর্যস্ত করেছে, বিশ্বজুড়ে সংঘাত বেড়েছে এবং দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করছেন লাখ লাখ মানুষ। 

করোনার টিকা নিরাপদ ও কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে এবং এর কোনো বিকল্পও এখন নেই উল্লেখ করে মার্কিন সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়নের দুই কর্মকর্তা ডেভিড কোল ও ড্যানিয়েল ম্যাক বলেছেন, ‘নাগরিক স্বাধীনতার সঙ্গে আপস করা দূরে থাক, টিকা প্রকৃতপক্ষে নাগরিক স্বাধীনতাকে আরও ত্বরান্বিত করবে। কারণ, এই টিকাই আমাদের রক্ষা করবে।’ 

তবে টিকা নেওয়ার বাধ্যবাধকতায় সমর্থন জানায়নি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। সংস্থাটি বলছে, বাধ্যতামূলক না করে সরকারগুলোর উচিত এসংক্রান্ত জনসচেতনতামূলক তথ্য প্রচারের পাশাপাশি সবার জন্য টিকা আরও সহজলভ্য করে তোলা। 

ইন্দোনেশিয়ার মহামারি বিশেষজ্ঞ এবং মহামারি পুনরুদ্ধারে ডব্লিউএইচওর পরামর্শক হিসেবে কাজ করা ডা. ডিকি বুডিম্যানের মতে, ‘সংকটের এই সময়ে টিকা বাধ্যতামূলক করা হিতে বিপরীত হবে। মানুষের মধ্যে যখন অবিশ্বাস বা ভুল বোঝাবুঝি থাকে, তখন এই ধরনের পরিকল্পনা (টিকা বাধ্যতামূলক করা) কেবল তাদের মতামতকে শক্তিশালী করবে।’ 

জোর বা জবরদস্তি নয়
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, টিকা নেওয়া বাধ্যতামূলক করা যদি ন্যায়সংগতও হয়, তবু নীতিটি অবশ্যই স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে এবং ক্ষেত্রবিশেষে ছাড় দিতে হবে, যেমন অ্যালার্জির ক্ষেত্রে। এ নিয়ে জোর বা জবরদস্তি কোনো সমাধান দেবে না। 

গত সেপ্টেম্বরে চীনের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে জনগণকে জোরপূর্বক টিকা দেওয়ার অভিযোগ আনে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। সংস্থাটির মতে, ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী সরকারগুলো তাদের নাগরিকদের টিকা দিতে পারবে। তবে তা শারীরিক শক্তি প্রয়োগ বা অযৌক্তিক জবরদস্তির মাধ্যমে নয়।’ এ ছাড়া টিকা নেওয়ার বাধ্যবাধকতা কেবল উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা মানুষের ক্ষেত্রে দেওয়া উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞেরা। 

এ বিষয়ে নিউইয়র্কের সিটি ইউনিভার্সিটির বারুচ কলেজের আইনের অধ্যাপক ডেবি কামিনার বলেন, ‘এমন দেশগুলোতে টিকা বাধ্যতামূলক করা উচিত, যেখানে হাসপাতাল, নার্সিং হোম এবং স্কুলের মতো জায়গা থেকে করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি রয়েছে।’ 

তবে টিকা নেওয়া বাধ্যতামূলক করার নীতি কাজে আসছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমি এখানে জোর করে টিকা দেওয়ার কথা বলছি না। কিন্তু আপনি যদি স্বাস্থ্যসেবা কর্মী কিংবা শিক্ষক হন, অন্যের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে হলেও আপনাকে টিকা নিতে হবে। জোরাজুরির বিষয় নয়, এটি সমাজকে নিরাপদ রাখার বিষয়।’ 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সমাবেশে দলীয় স্লোগান ও জাতীয় সংগীত পরিবেশনে বাধা দেওয়া প্রসঙ্গে এনসিপির বিবৃতি

তোরা যারা রাজাকার, সময় থাকতে বাংলা ছাড়: ফেসবুকে বাকের মজুমদার

কঠোর হচ্ছে যুক্তরাজ্যের অভিবাসন নীতি, স্থায়ী বসবাসের আবেদনে অপেক্ষা ১০ বছর

যুদ্ধ বলিউডের সিনেমা নয়: ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান

রাজপথের চাপে কোনো বিচার করা সম্ভব নয়: চিফ প্রসিকিউটর

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত