Ajker Patrika

ফারহানার এক টুকরো ‘শৈশব’

মন্টি বৈষ্ণব, ঢাকা
আপডেট : ০১ মার্চ ২০২৩, ১২: ২৭
ফারহানার এক টুকরো ‘শৈশব’

মোহাম্মদপুরের জাকির হোসেন রোডের একটি ভবনে চোখ আটকে যায়। ভবনটির প্রধান প্রবেশপথে ‘শৈশব’ লেখা সবুজ ঘাসের কার্পেট। শিশুদের শৈশবহীন একটি শহরে এ যেন মরূদ্যান! এ সবুজ ঘাসের উৎস জানার আগ্রহ থেকে কথা হয় ‘শৈশব’ নামের প্রতিষ্ঠানটির সিইও ফারহানা মান্নানের সঙ্গে। শিশুদের নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কাজ করেন তিনি। শৈশব মূলত দুই থেকে আট বছর বয়সের শিশু এবং তাদের অভিভাবকদের জন্য ‘প্লে অ্যান্ড লার্নিং সেন্টার’। 

শুরুর গল্প
আইসিটি শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন ফারহানা। শিক্ষকতা করতে করতে তিনি উপলব্ধি করেন, বইয়ের কনটেন্ট পড়ানো বা শেখানোর জন্য কিছু নতুন পরিকল্পনা দরকার।

একটি বইয়ে অসংখ্য কনটেন্ট থাকে। তা পড়ানোর জন্য নতুন পরিকল্পনা প্রয়োজন। ফারহানা মনে করেন, সব শিক্ষক নতুন নতুন উদ্ভাবনী ধারণা দিয়ে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে অভ্যস্ত নন। তাই নতুন ধারণা পাওয়ার আশায় প্রকৌশলবিদ্যায় পড়াশোনা করেও বিএড ও এমএড শেষ করেন তিনি। পাশাপাশি ‘আর্লি চাইল্ডহুড’ বিষয়ে এমএসসি শেষ করেন।

অনুপ্রেরণায় সন্তানেরা
চিনি আর মধুর মা হিসেবে পরিচিতি আছে ফারহানা মান্নানের। সন্তানদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মেশেন বলে ‘অনলাইন ও অফলাইন’-এ ফারহানার বিশেষ পরিচিতি আছে। তিনি নিজের সন্তানদের শেখান, ‘আমিও মানুষ, তোমরাও মানুষ। যেহেতু আমি আকারে একটু বড়, তাই তোমাদের তুলনায় আমার কিছু বিষয়ে অভিজ্ঞতা বেশি। তোমরা আমার অভিজ্ঞতা নেবে।’ মধু আর চিনির সঙ্গে খেলতে খেলতে ফারহানা একদিন সিদ্ধান্ত নেন, শিশুদের নিয়ে খেলার বিষয়টি হবে তাঁর প্যাশনের জায়গা। তিনি মনে করেন, দেশে শিক্ষাক্ষেত্রের পরিধি অনেক বড়।এখানে নিত্যনতুন পরিকল্পনা নিয়ে একসঙ্গে কাজ করা যাবে না। কোনো একটি নির্দিষ্ট কাজকে ফোকাস করতে হবে। এই ভাবনা থেকে সিদ্ধান্ত নেন, শিশুদের শৈশব নিয়ে কাজ করবেন। শুরু হয় ‘শৈশব’ প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা। এ প্রসঙ্গে ফারহানা বলেন, ‘আমার ভালোবাসার জায়গা “শৈশব”।  দুই সন্তানের সঙ্গে খেলতে খেলতে অনুপ্রাণিত হয়ে শৈশবের কাজ শুরু করি। এটি আসলে শিশুদের স্কুল নয়। এটি শিশুদের বাড়ি। শিশুরা এখানে আসবে, গাইডের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে খেলবে, নতুন নতুন জিনিস শিখবে। এই প্রতিষ্ঠানের বয়স প্রায় সাড়ে তিন বছর। তবে এখানকার প্লে অ্যান্ড লার্নিং সেন্টারের বয়স মাত্র পাঁচ মাস।’

শিশুদের সঙ্গে খেলছেন ফারহানা মান্নানকেমন ছিল পড়ুয়া ‘মধু’
ফারহানা মান্নানের ছোট মেয়ে মধু। গত বছর সে ডেঙ্গুতে মারা যায়। হারিয়ে যাওয়া সন্তান সম্পর্কে ফারহানা বলেন, ‘খুব হাসিখুশি শিশু ছিল মধু। সে বই পড়তে পছন্দ করত। খুব ভালো রিভিউ করত। আড়াই থেকে তিন বছর বয়স থেকে এ কাজ করত মধু। যখন তার বয়স পাঁচ বছর হলো, তখন তার চিন্তার জায়গায় অনেক পরিবর্তন ঘটে। তখন সে তার নিজস্ব চিন্তাভাবনার বিষয়গুলো যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে বলত। আমার বাসায় ওয়াশরুমের একটা ঝুড়িতে বই থাকত। সে ওয়াশরুমে গিয়ে বই পড়ত। পুরো বই পড়া শেষ হলে বলত, “মা, বই বদলিয়ে দাও।” সে ছবি দেখে বই পড়ত। পরে ছবি না দেখে হুবহু চরিত্রগুলো এঁকে ফেলতে পারত। আমার বাথরুমে এখনো বই আছে। আমার আরেক সন্তান চিনি আবার খুব বেশি বই পড়ে না, এটা বুঝতে পারি। শৈশব সেন্টারে একটা বইয়ের কর্নার আছে। মধু ছাড়া এই কর্নারে গিয়ে এখন পর্যন্ত কেউ আগ্রহ করে নিজের খেলনা রেখে বই পড়েনি।’

যেখানে শিশুরা ভিন্ন জগতের বাসিন্দা
শৈশবে শিশু ও তাদের অভিভাবকেরা বন্ধুর মতো নিজেদের মধ্যে খেলাধুলা করে। সেখানে একটি কক্ষ বাইরের জগতের মতো করে সাজানো। সেখানে শিশুরা অনুভব করতে পারে, সে একটা ঘাসভর্তি মাঠে বসে আছে। এটা আর্কিটেকচারের জায়গা থেকে বড় পরিবর্তন। এখানকার কিছু কিছু কক্ষে কৃত্রিম ঘাস রেখে চারপাশটা সবুজ করে সাজানো হয়েছে। এখানে আছে হরেক রকমের গাছ। একটি কক্ষের কর্নারে আছে দোলনা। দোলনার পাশে রাখা হয়েছে কিছু বই। এ ছাড়া শিশুদের জন্য রয়েছে স্টিম রুম। সেখানে বিজ্ঞান, টেকনোলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং, শিল্প ও গণিত—এই পাঁচ বিষয়ে ধারণা দেওয়া হয়। এই পাঁচটি শব্দের আদ্যাক্ষর নিয়েই স্টিম। স্টিম প্রক্রিয়ার পাঠদান বাংলাদেশের প্রথম প্রতিষ্ঠান ‘শৈশব’। এ ছাড়া এখানে শিশুরা সংগীত, নাটক, পাপেটের সঙ্গে দারুণ সময় কাটাতে পারে।

অভিভাবকসহ  চলছে শিশুদের খেলা  স্বপ্নের স্রষ্টা আর ভবিষ্যতের স্বপ্ন
প্রকৌশলী এম এম মান্নান আর মিলি আক্তারের সন্তান ফারহানা মান্নান। তাঁর স্বামী বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী। ফারহানার মা-বাবা সংস্কৃতিমান ও মুক্তচিন্তার মানুষ। এম এম মান্নান যেকোনো বিষয়ে পারিবারিকভাবে আলাপ-আলোচনা করতে পছন্দ করতেন। তিনি বিভিন্ন কাজে সন্তানদের মতামত নিতেন। ফারহানা মান্নানও যেকোনো বিষয়ে পারিবারিকভাবে আলাপ-আলোচনা করেন। শৈশবে যে শিশুরা আসে, তাদেরও তিনি বাবার কাছে শেখা জ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা করেন। ফারহানা মান্নান মনে করেন, তাঁর পুরো যাত্রাটি হবে গবেষণার। সেই গবেষণার ফল থেকে শিখতে চান প্রতিনিয়ত। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...