Ajker Patrika

ক্রিকেটীয় চেতনায় রাজনীতির থাবা

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১: ২০
ট্রফি ছাড়াই উদ্যাপন করেছে ভারত। ছবি: বিসিসিআই
ট্রফি ছাড়াই উদ্যাপন করেছে ভারত। ছবি: বিসিসিআই

অনেক কারণেই এবারের এশিয়া কাপটা অনেক দিনই মনে থাকবে মানুষের। টুর্নামেন্টের ৪১ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ফাইনাল খেলেছে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত-পাকিস্তান। প্রথমবারের মতো পাকিস্তানকে তিনবার হারিয়ে শিরোপা জিতেছে ভারত। ক্রিকেটীয় এসব কারণের মধ্যে অক্রিকেটীয় একটা কারণও আছে। মহাদেশীয় এই টুর্নামেন্টে এবারই যে প্রথম ক্রিকেটীয় চেতনা ভূলুণ্ঠিত! মাত্রই শেষ হওয়া টুর্নামেন্টে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যা খেলোয়াড়ি চেতনার সঙ্গে একদমই যায় না।

রোববার রাতে রোমাঞ্চ ছড়িয়ে শেষ ওভারে শেষ হয় ফাইনাল। কিন্তু ম্যাচের নাটকীয়তা ছাড়িয়ে যায় খেলা শেষের নাটক। জয়ের পর ভারতের দুই অপরাজিত ব্যাটার রিংকু সিংহ ও তিলক ভার্মা হাত মেলাননি পাকিস্তানি খেলোয়াড়দের সঙ্গে। গ্রুপ পর্ব ও সুপার ফোরে দুই দলের লড়াইয়েও দুই দলের খেলোয়াড়দের হ্যান্ডশেক না হওয়ায় দর্শকদের কাছে সেটা নতুন কিছু মনে হয়নি। তবে নতুন কিছু দেখা গেল এর পরই। পুরস্কারের জন্য মঞ্চ তৈরি। চ্যাম্পিয়ন দলের হাতে ট্রফি তুলে দেওয়ার জন্য মঞ্চেও উঠে এসেছেন এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের (এসিসি) সভাপতি, পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের (পিসিবি) চেয়ারম্যান মহসিন নাকভি।

কিন্তু ট্রফি নিতে এলেন না ভারতীয় অধিনায়ক সূর্যকুমার যাদব কিংবা দলের অন্য কেউ। এর আগেই ভারতীয় দলের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, নাকভির হাত থেকে তারা ট্রফি নেবে না। কারণ, নাকভি এসিসির সভাপতি হলেও তিনি পাকিস্তানের মন্ত্রী (স্বরাষ্ট্র)। ভারত চেয়েছিল, নাকভি না, এমিরেটস ক্রিকেট বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান খালিদ আর জারোনি তাদের হাতে ট্রফি তুলে দেবেন। কিন্তু এসিসি সভাপতি সেটি মানেননি। এই দেনদরবারে প্রায় সোয়া এক ঘণ্টা পর শুরু হয় পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। স্টেডিয়ামে উপস্থিত ভারতীয় সমর্থকদের ‘ভারত মাতা কি জয়’ ধ্বনির মধ্যেই মঞ্চে উঠে আসেন নাকভি। ততক্ষণে জানাজানি হয়ে গেছে, এসিসি সভাপতির হাত থেকে ট্রফি নেবে না ভারত। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুলের হাত থেকে পাকিস্তান অধিনায়ক সালমান আলী আগা রানার্সআপের ডামি চেক নিলেও মঞ্চ ছাড়ার আগেই দৃষ্টিকটুভাবে ছুড়ে ফেলে দিলেন। এরপর ভারতীয় দল মঞ্চে এসে পুরস্কার গ্রহণ না করলে মাঠ ছেড়ে যান নাকভিসহ এসিসির কর্মকর্তারা। তাতে ট্রফি ছাড়াই উদ্‌যাপন শুরু করেন ভারতীয় ক্রিকেটাররা। ট্রফি থাকলে যেভাবে উদ্‌যাপন করতেন, ট্রফি ছাড়াই সেরকম ভঙ্গিতে উদ্‌যাপন করলেন সূর্যকুমার যাদব, তিলক ভার্মারা। বহুজাতিক কোনো ক্রিকেট টুর্নামেন্টে শিরোপ জয়ের পর ট্রফি ছাড়াই চ্যাম্পিয়ন দলের উদ্‌যাপন ক্রিকেটের ইতিহাসে সম্ভবত এটাই প্রথম।

পরে সংবাদ সম্মেলনে এসে পাকিস্তান অধিনায়ক সালমান আলী আগা বললেন, ‘আমাদের সঙ্গে তারা (ভারত দল) যা করেছে, তাতে শুধু আমাদের অসম্মানই করেনি, অসম্মান করেছে পুরো ক্রিকেট বিশ্বকেই।’

ফাইনালের আগে পাকিস্তান অধিনায়ক সালমান আলী আগার সঙ্গে ট্রফি নিয়ে ছবি তুলতেও রাজি হননি ভারতীয় অধিনায়ক সূর্যকুমার যাদব। এর জবাবে টসের সময় পাকিস্তান অধিনায়ক ভারতীয় সঞ্চালক রবি শাস্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। তারও আগে সুপার ফোরের ম্যাচে ফিফটির পর সাহিবজাদা ফারহানের ‘একে ৪৭ সেলিব্রেশন’ কিংবা ভারত-পাকিস্তানের ডগফাইটে ভারতের রাফায়েল হারানোর কথা মনে করিয়ে দিয়ে হারিস রউফের ‘প্লেন ক্র্যাশ সেলিব্রেশন’ নতুন করে উসকে দিয়েছিল বিতর্ককে। ফাইনালে রউফকে আউট করে বিমানধসের ভঙ্গি করে জবাব দেন যশপ্রীত বুমরা।

মাঠের এসব ঘটনা যে দুই দেশের রাজনৈতিক বৈরিতার ফসল, বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ম্যাচ শেষে নিজের এক্স হ্যান্ডলে এক পোস্ট দিয়ে যা আরও পরিষ্কার করে দিয়েছেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ওই পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘মাঠের ক্রিকেটেও অপারেশন সিঁদুর। সেই একই ফল। এবারও জিতল ভারত।’

নরেন্দ্র মোদির এই পোস্টের জবাবে, মহসিন নাকভি তাঁর এক্স হ্যান্ডলে লিখেছেন, ‘যদি যুদ্ধ হয় তোমাদের গর্বের মানদণ্ড, তবে ইতিহাসে পাকিস্তানের হাতে তোমাদের লজ্জাজনক পরাজয়ই লেখা আছে। কোনো ক্রিকেট ম্যাচই সেই সত্যকে মুছে ফেলতে পারে না। খেলায় যুদ্ধ টেনে আনা শুধুই হতাশার প্রকাশ, যা খেলাধুলার চেতনাকেই কলঙ্কিত করে।’

মোদি ও নাকভির এই কথার যুদ্ধ স্রেফ রাজনৈতিক বৈরিতার ফসল। দুই দেশের রাজনীতিতে বৈরিতা থাকতেই পারে। কিন্তু সেটি খেলার চেতনাকে বিনাশ করবে, এটা কারও কাম্য হতে পারে না। দিনকয়েক আগেই ভারতের সাবেক ক্রিকেটার মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন বলেছিলেন, ‘হাত মেলানোর মধ্যে কোনো ভুল আছে বলে মনে হয় না আমার। যখন আপনি ম্যাচ খেলছেন, তখন সবকিছুই করা উচিত, হাত মেলানোও তার একটি অংশ।’ হাত মেলাতেই হবে—ক্রিকেটে এমন কোনো আইন না থাকলেও খেলাধুলায় এটি অলিখিত একটা রীতিই হয়ে গেছে। সেই রীতির চূড়ান্ত বরখেলাপ হলো এশিয়া কাপের ফাইনাল শেষে!

ম্যাচ শেষের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে দুবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে উপস্থিত বাংলাদেশের সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছিলেন বিসিবি সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল। আকারে-ইঙ্গিতে তিনিও যা বোঝালেন তার মর্মার্থ এই—এত বড় টুর্নামেন্টে যা ঘটল, তাতে প্লেয়িং কন্ডিশনে খেলোয়াড়ি চেতনা বা গেম স্পিরিটের আর গুরুত্ব থাকবে বলে মনে হয় না!

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত