Ajker Patrika

গণসংবর্ধনায় ভাষণ: সবাই মিলে গড়ব দেশ

  • যেকোনো মূল্যে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে
  • মহানবী (সা.)-এর ন্যায়পরায়ণতার আলোকে রাষ্ট্র চালানোর প্রতিশ্রুতি
  • তরুণ প্রজন্মই আগামী দিনে দেশকে নেতৃত্ব দেবে
  • পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সবার সহযোগিতা কামনা
  • মা খালেদা জিয়ার জন্য দোয়া প্রার্থনা
‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
দীর্ঘ ১৭ বছর পর দেশে ফিরলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তাঁকে স্বাগত জানাতে এসেছেন দলের লাখো নেতা-কর্মী-সমর্থক। গতকাল রাজধানীর পূর্বাচলে ৩০০ ফুটে গণসংবর্ধনাস্থলে। ছবি: আজকের পত্রিকা
দীর্ঘ ১৭ বছর পর দেশে ফিরলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তাঁকে স্বাগত জানাতে এসেছেন দলের লাখো নেতা-কর্মী-সমর্থক। গতকাল রাজধানীর পূর্বাচলে ৩০০ ফুটে গণসংবর্ধনাস্থলে। ছবি: আজকের পত্রিকা

দীর্ঘ প্রতীক্ষা, ক্ষণে ক্ষণে অনিশ্চয়তা। অবশেষে সেই অপেক্ষার অবসান। ১৭ বছর পর দেশের মাটিতে পা রাখলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। নেতা-কর্মীদের জনসমুদ্রে তিনি ঘোষণা দিলেন, দেশ গড়তে হবে। স্বপ্নের বাংলাদেশ। সবাই মিলে গড়তে হবে, সবার জন্য নিরাপদ দেশ।

প্রত্যয়ী কণ্ঠে তারেক রহমান জানান, দেশের উন্নয়নের জন্য, মানুষের জন্য তাঁর একটি পরিকল্পনা আছে। সে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সবার সহযোগিতা চেয়ে তিনি বলেছেন, ‘আপনারা যদি আমাদের পাশে থাকেন, আপনারা যদি আমাদেরকে সহযোগিতা করেন, আমরা এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হব।’

এক-এগারোর প্রেক্ষাপটে ২০০৭ সালে কারাগারে যেতে হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানকে। কারামুক্ত হওয়ার পর ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যের লন্ডনে চলে যান তিনি। এরপর প্রায় দেড় যুগ কেটে গেছে নির্বাসনে। মাতৃভূমি থেকে ৮ হাজার কিলোমিটার দূরে থাকলেও রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিলেন তিনি। মা খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর থেকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দলের দায়িত্ব নেন তিনি। দুর্দিনে ঐক্যবদ্ধ রাখেন দলকে।

প্রেক্ষাপট বদলে যায় ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে তারেক রহমানের দেশে ফেরার প্রতীক্ষা শুরু হয়। অবশেষে সেদিন এলো গতকাল বৃহস্পতিবার।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে বেলা ১১টা ৪৩ মিনিটে ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে নামেন তারেক রহমান। তাঁর সঙ্গে এসেছেন স্ত্রী জুবাইদা রহমান ও মেয়ে জাইমা রহমান। বিমানবন্দর থেকেই জুবাইদা ও জাইমা চলে যান গুলশানের বাসা ফিরোজায়। বিমানবন্দর থেকে গাড়িবহর নিয়ে রাজধানীর পূর্বাচলের ৩০০ ফুট সড়কে সংবর্ধনা মঞ্চের দিকে যাত্রা শুরু করেন

তারেক রহমান। যেখানে তাঁকে সংবর্ধনা দিতে সমাবেশের আয়োজন করা হয়।

স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরের আশপাশের সড়ক ও পূর্বাচলে সমবেত হয়েছিলেন লাখ লাখ নেতা-কর্মী। লাল-সবুজে আবৃত বাসে করে উচ্ছ্বসিত নেতা-কর্মীদের অভিনন্দনের জবাব দিতে দিতে সংবর্ধনাস্থলে যান তারেক রহমান। এতে ৭ কিলোমিটার দূরত্বের ওই পথ যেতে তিন ঘণ্টার বেশি সময় লেগে যায়।

সংবর্ধনা মঞ্চে বক্তৃতার শুরুতেই ‘প্রিয় বাংলাদেশ’ সম্বোধন করে তারেক রহমান বলেন, ‘একাত্তর সালে এ দেশের মানুষ যেমন স্বাধীনতা অর্জন করেছিলেন, ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতাসহ সর্বস্তরের মানুষ এই দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করেছিলেন। আজ বাংলাদেশের মানুষ কথা বলার অধিকার ফিরে পেতে চান। তাঁরা তাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পেতে চান। বাংলাদেশের মানুষ চান, তাঁরা তাঁদের যোগ্যতা অনুযায়ী ন্যায্য অধিকার পাবেন।’

বিএনপির নেতা আরও বলেন, ‘আজ আমাদের সময় এসেছে, সবাই মিলে দেশ গড়ার। এ দেশে যেমন পাহাড়ের মানুষ আছেন, এ দেশে একইভাবে সমতলেরও মানুষ আছেন; এই দেশে মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, হিন্দুসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বসবাস করেন।’

সবার জন্য নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ার ইচ্ছার কথা প্রকাশ করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘যে বাংলাদেশে একজন নারী, একজন পুরুষ, একজন শিশু, যেহোক না কেন, ঘর থেকে বের হয়ে নিরাপদে ইনশা আল্লাহ ঘরে আবার ফিরে আসতে পারেন।’

শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখায় গুরুত্ব দিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘আসুন, আমরা যে ধর্মের মানুষ হই, আমরা যে শ্রেণির মানুষ হই, যে রাজনৈতিক দলেরই সদস্য হই, অথবা একজন নির্দলীয় ব্যক্তি হই, আমাদেরকে নিশ্চিত করতে হবে, যেকোনো মূল্যে আমাদের এ দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা ধরে রাখতে হবে; যেকোনো মূল্যে যেকোনো বিশৃঙ্খলাকে পরিত্যাগ করতে হবে; যেকোনো মূল্যে আমাদেরকে নিশ্চিত করতে হবে, যাতে মানুষ নিরাপদ থাকতে পারেন। শিশু হোক, নারী হোক, পুরুষ হোক, যেকোনো বয়স, যেকোনো শ্রেণি, যেকোনো পেশা, যেকোনো ধর্মের মানুষ যেন নিরাপদ থাকেন, এ হোক আমাদের চাওয়া।’

এ রকম একটি বাংলাদেশ গঠনের জন্য একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধে শহীদেরা নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন বলে মন্তব্য করেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, বিগত ১৫ বছরে স্বৈরাচারের হাতে শত শত, হাজারো মানুষ গুম-খুনের শিকার হয়েছেন। শুধু রাজনৈতিক দলের সদস্য নয়, নিরীহ মানুষও প্রতিবাদ করতে গিয়ে অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, জীবন দিয়েছেন।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘২০২৪ সাল, মাত্র সেদিনের ঘটনা। আমরা দেখেছি আমাদের তরুণ প্রজন্মের সদস্যরা কীভাবে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে দেশের এই স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার জন্য।’

আততায়ীর গুলিতে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান বিন হাদির নিহতের কথা স্মরণ করে তারেক রহমান বলেন, ‘কয়েক দিন আগে এই বাংলাদেশের চব্বিশের আন্দোলনের এক সাহসী প্রজন্মের এক সাহসী সদস্য ওসমান হাদিকে হত্যা করা হয়েছে। ওসমান হাদি শহীদ হয়েছেন।’

বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে শহীদদের সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করে তারেক রহমান বলেন, ‘আজ চব্বিশের আন্দোলনে যাঁরা শহীদ হয়েছেন ওসমান হাদিসহ, একাত্তরে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, বিগত স্বৈরাচারের সময় বিভিন্নভাবে খুন-গুমের শিকার হয়েছেন, এ মানুষগুলোর রক্তের ঋণ যদি শোধ করতে হয়, আসুন আমরা আমাদের সেই প্রত্যাশিত বাংলাদেশ গড়ে তুলব। যেখানে আমরা সবাই মিলে কাজ করব; যেখানে আমরা সবাই মিলে আমাদের প্রত্যাশিত বাংলাদেশকে গড়ে তুলব।’

যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদবিরোধী নেতা মার্টিন লুথার কিংয়ের বক্তব্যের সঙ্গে মিলিয়ে তারেক রহমান বলেন, ‘আই হ্যাভ এ প্ল্যান ফর দ্য পিপল অব মাই কান্ট্রি’। সমবেত নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে তারেক রহমান বলেন, ‘প্রিয় ভাই-বোনেরা, মার্টিন লুথার কিং... নামটি শুনেছেন না আপনারা? নাম শুনেছেন তো আপনারা? মার্টিন লুথার কিং, তাঁর একটি বিখ্যাত ডায়ালগ আছে, আই হ্যাভ এ ড্রিম। আজ এই বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে আপনাদের সবার সামনে আমি বলতে চাই, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের একজন সদস্য হিসেবে আপনাদের সামনে আমি বলতে চাই, আই হ্যাভ এ প্ল্যান ফর দ্য পিপল অব মাই কান্ট্রি, ফর মাই কান্ট্রি।’

পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সবার সহযোগিতা চেয়ে তারেক রহমান বলেন, ‘প্রিয় ভাই-বোনেরা, এই জনসমুদ্রে যত মানুষ উপস্থিত আছেন, এই বাংলাদেশে গণতন্ত্রের শক্তি যত মানুষ উপস্থিত আছেন, প্রত্যেকটি মানুষের সহযোগিতা আমার লাগবে। প্রত্যেকটি, প্রত্যেকটি মানুষের সহযোগিতা আমাদের লাগবে।’

কোনো দেশের নাম উচ্চারণ না করে তারেক রহমান বলেন, ‘বিভিন্ন আধিপত্যবাদ শক্তির গুপ্তচরেরা বিভিন্নভাবে ষড়যন্ত্রে এখনো লিপ্ত রয়েছে। আমাদেরকে ধৈর্যশীল হতে হবে, আমাদের ধৈর্য ধারণ করতে হবে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের যে সদস্যরা আছেন, আপনারাই আগামী দিন দেশকে নেতৃত্ব দেবেন, দেশকে গড়ে তুলবেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই দায়িত্ব তরুণ প্রজন্মের সদস্যদের আজ গ্রহণ করতে হবে, যেন এ দেশকে আমরা সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে পারি; শক্ত ভিত্তির ওপরে, গণতান্ত্রিক ভিত্তি, শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপরে যেন এ দেশকে আমরা গড়ে তুলতে পারি।’

মঞ্চে এবং মঞ্চের বাইরে থাকা জাতীয় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে জনগণের প্রত্যাশিত বাংলাদেশ গড়তে চাওয়ার কথা তুলে ধরেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, ‘যেকোনো মূল্যে আমাদের এ দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে, যেকোনো উসকানির মুখে আমাদের ধীর, শান্ত থাকতে হবে।’

তারেক রহমান বলেন, ‘আসুন, আমরা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে হাত তুলে প্রার্থনা করি, হে রাব্বুল আলামিন, হে একমাত্র মালিক, হে একমাত্র পরওয়ারদিগার, হে একমাত্র রহমত দানকারী, হে একমাত্র সাহায্যকারী, আজ আপনি যদি আমাদেরকে রহমত দেন, তাহলে আমরা এ দেশের মানুষ কঠোর পরিশ্রম করার মাধ্যমে আমাদের প্রত্যাশিত বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে পারব।’

মহানবীর (সা.) আদর্শে ন্যায়পরায়ণতার আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘আসুন, আজ আমরা সবাই মিলে প্রতিজ্ঞা করি, ইনশা আল্লাহ আগামী দিনে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আসবেন, আমরা সবাই নবী করিম (সা.)-এর যে ন্যায়পরায়ণতা, সেই ন্যায়পরায়ণতার আলোকে আমরা দেশ পরিচালনার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।’

এ সময় মায়ের সুস্থতার জন্য দোয়া চেয়ে তারেক রহমান বলেন, ‘আপনারা জানেন, এখান থেকে আমি আমার মা দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার কাছে যাব। এই একটি মানুষ, যে মানুষটি এ দেশের মাটি, এ দেশের মানুষকে নিজের জীবনের থেকেও বেশি ভালোবেসেছেন। তাঁর সঙ্গে কী হয়েছে, আপনারা প্রত্যেকটি মানুষ সে সম্পর্কে অবগত আছেন। সন্তান হিসেবে আপনাদের কাছে আমি চাইব, আজ আল্লাহর দরবারে আপনারা দোয়া করবেন, যেন আল্লাহ উনাকে তৌফিক দেন, উনি যেন সুস্থ হতে পারেন।’

বক্তৃতার শেষ প্রান্তে নেতা-কর্মীদের সঙ্গে তিনি স্লোগান ধরেন, ‘আসুন প্রিয় ভাই-বোনেরা, সবাই মিলে আজ আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই, সবাই মিলে করব কাজ, গড়ব মোদের বাংলাদেশ।’

সাড়ে ১৬ মিনিটের বক্তৃতার পরও যেন শেষ হলো না তারেক রহমানের কথা। নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে হাত নেড়ে বিদায় নিতে নিতে আবার ফিরে আসেন মাইকের কাছে। নিজের পরিকল্পনার কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘মনে রাখবেন, উই হ্যাভ এ প্ল্যান। উই হ্যাভ এ প্ল্যান ফর দ্য পিপল অ্যান্ড ফর দ্য কান্ট্রি। ইনশা আল্লাহ আমরা সে প্ল্যান বাস্তবায়ন করব।’

সংবর্ধনা মঞ্চে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমদ, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, হাফিজ উদ্দিন আহমদ (বীর বিক্রম), এ জেড এম জাহিদ হোসেন ও দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী উপস্থিত ছিলেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...