Ajker Patrika

হারানো সময়

সম্পাদকীয়
হারানো সময়

আড়াই টাকা! বাহ্! আড়াই টাকার গরমিল একজন মানুষের জীবনটাকেই গোঁজামিলে ভরে দিল। বছরের পর বছর এই আড়াই টাকার অপমান নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হলো একজন মানুষকে। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট তাঁর বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগ খারিজ করে দেওয়ায় এখন তিনি চাকরি ফিরে পাবেন, পাবেন ১৯৮২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত পাওনা টাকাও।

আইনের চোখে তিনি অপরাধী নন আর। এখন হয়তো এত বছরের জমা টাকা পেলে তাঁর জীবন বদলে যেতে পারে। কিন্তু তাতে কি হারানো সময়টা আর ফিরে পাবেন তিনি? ‘সবার উপরে’ ছায়াছবিতে ছবি বিশ্বাসের বলা কথাটা মনে আছে কি কারও? বিনা অপরাধে জীবনের বড় একটা সময় জেল খাটার পর যখন তিনি মুক্তি পেলেন, তখন বলেছিলেন, ‘দাও ফিরিয়ে আমার জীবনের বারোটি বছর।’ মোহাম্মদ আলী যখন ষাটের দশকের দ্বিতীয় ভাগে ভিয়েতনাম যুদ্ধে যেতে অস্বীকৃতি জানান, তখন তাঁকে জেলখানায় যেতে হলো। সে সময় তিনি মুষ্টিযুদ্ধ জগতে সবচেয়ে উজ্জ্বল তারকা হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছেন। সাড়ে তিনটি বছর হারিয়ে গেল তাঁর জীবন থেকে। মুক্তি পাওয়ার পর বাংলা পত্রিকায় শিরোনাম হয়েছিল, ‘দাও ফিরিয়ে আমার জীবনের সাড়ে তিনটি বছর’। ওই সিনেমার সংলাপ থেকেই জীবন, সিনেমা আর খেলাধুলা যেন মিলেমিশে এক হয়ে গেল।

সময় এক অদ্ভুত জিনিস। চাইলেও আর ফিরে পাওয়া যায় না। নাজিম হিকমতের ‘আমি জেলে যাবার পর’ কবিতাটি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনবদ্য অনুবাদে একসময় কবিতাপ্রেমীদের মুখে মুখে ঘুরত। এখনো অনেকের প্রিয় কবিতা এটি। প্রথম কয়েক পঙ্তিতেই ১০ বছর সময়কে দুদিক থেকে দেখানোর যে চমৎকারিত্ব উপহার দিয়েছিলেন তিনি, তাতে বিশাল-ক্ষুদ্র সম্পর্কের ধারণাটাই বদলে গিয়েছিল। কারও জন্য যা অণুকালমাত্র, কারও জন্য তা গোটা জীবন!

এত কথা বলতে হলো মো. ওবায়দুল আলম আকনের কথা মনে করে। ৩৯ বছর পর তিনি চাকরি ফিরে পেয়েছেন। আড়াই টাকা অনিয়মের মামলার অভিশাপ আর তাঁর মাথার ওপরে নেই। কুষ্টিয়ার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পাট সম্প্রসারণ সহকারী ছিলেন তিনি। পাঁচ প্যাকেট পাটের বীজ বিক্রিতে তিনি নাকি আড়াই টাকা বেশি নিয়েছিলেন—এই অভিযোগ করেছিলেন এক ব্যক্তি। তাতে তাঁর জেল-জরিমানা হয়, চাকরিও খোয়ান তিনি। এরপর চাকরি ফিরে পেতে ধরনা দিয়েছেন বারবার। কিন্তু বরফ গলেনি। বরং তাঁর করা  রিটের বিপক্ষে লড়েছে তাঁর অফিস। অবশেষে গত ২৮ জুন জয় হলো ওবায়দুল আলম আকনের। ফিরে পেলেন চাকরি। এই দীর্ঘ সময়ে তাঁর পাওনাও মিটিয়ে দিতে বলেছেন মহামান্য আদালত।

এতে হয়তো আমরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারি; কিন্তু সত্যিই তো, একজন মানুষের জীবন থেকে কেড়ে নেওয়া সময়টা তো আর ফিরিয়ে দিতে পারা যাবে না। আর অপমানটা? সবার চোখে একজন অপরাধী হয়ে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। সেই অপমানের বদলা কি নিতে পারবেন তিনি? সবকিছুর বদলা হয় না। স্বস্তি হয়তো হয়; কিন্তু ফিরে আসে না হারানো সময়। তাই স্বস্তির মধ্যেও একটা মন খচখচ থেকেই যায়, সেই খচখচানি মন থেকে সরে না একেবারেই।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত