Ajker Patrika
সাক্ষাৎকার

তারুণ্যের ধর্মচ্যুত তরুণ আমাদের কাম্য নয়

মোজাম্মেল হোসেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে পড়াশোনা করা মোজাম্মেল হোসেন, ঘনিষ্ঠ মহলে যিনি মঞ্জু নামেই বেশি পরিচিত, ছাত্রাবস্থায় ১৯৬৯ সালে সাপ্তাহিক ‘যুগবাণী’ ও ১৯৭০ সালে সাপ্তাহিক ‘একতা’য় প্রতিবেদক হিসেবে পেশাজীবন শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘মুক্তিযুদ্ধ’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ছিলেন। দৈনিক ‘ভোরের কাগজ’ ও ‘প্রথম আলো’র বার্তা বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। দৈনিক ‘সমকাল’সহ একাধিক পত্রিকায় সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন। সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোজাম্মেল হোসেনের সঙ্গে সমসাময়িক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার বিভুরঞ্জন সরকার

আপডেট : ২৯ জুন ২০২৫, ১৩: ৫২

আপনি দীর্ঘকাল ধরে দেশের রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করছেন। আজকের অবস্থানে দাঁড়িয়ে আপনি দেশের রাজনীতিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

রাজনৈতিকভাবে দেশ একটি ঘোরতর জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সাংবিধানিক ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি দেশে থাকলেও, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ভালো হলেও নিয়মনীতি অগ্রাহ্য করে, নির্বাচনে নগ্ন কারচুপি করে আওয়ামী লীগ দীর্ঘ সময় একচ্ছত্রভাবে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করে অনেক সংকট তৈরি করেছিল। প্রাতিষ্ঠানিক ভাঙন, রাষ্ট্রযন্ত্র দলীয়করণ, খোলাখুলি ব্যাপক দুর্নীতি, রাজনৈতিক দলের দুর্বৃত্তায়ন, সমান সুযোগের অভাবে নাগরিকদের মধ্যে বঞ্চনাবোধ—এগুলোই হচ্ছে সংকটের রূপ। ছাত্র-তরুণেরা ভীষণ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং গত বছর জুলাই-আগস্টে ত্বরিত ফুঁসে ওঠা রাজপথের রক্তাক্ত আন্দোলনে সরকারের পতন ঘটে যায়। কিন্তু এর পরই জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী নিয়মশৃঙ্খলা এনে একটি ভালো নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসনের পথে যাত্রা সম্পর্কে শঙ্কা তৈরি হতে থাকে, কেননা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শের বিরুদ্ধের শক্তিগুলো, বিশেষত ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাধান্য প্রকাশ পায় এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-ঐতিহ্য, স্মারক আক্রান্ত হতে থাকে। গণতন্ত্রকে সফল করার জন্য, সাম্প্রতিক সময়ের মতো কোনো স্বৈরতান্ত্রিক শাসন যাতে আর না ফিরে আসে, সে জন্য অভিজ্ঞতা থেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকাঠামোয় কিছু সংস্কার দরকার, তা সবাই মানে। কিন্তু সে অছিলায় সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তনসহ রাষ্ট্রের চরিত্র বদলে ফেলার একটি লক্ষণীয় চেষ্টা একধরনের নতুন দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করছে। এটা জটিলতা। এই পটভূমিতে দেশে অসহিষ্ণুতা, হিংস্রতা, প্রতিহিংসাপরায়ণতা যা দেখা যাচ্ছে, তা উদ্বেগের কারণ। এসবের নিরসন ঘটিয়ে সমাজে শান্তি আনা, জাতীয় ঐক্য-সংহতি দৃঢ় করা বড় চ্যালেঞ্জ।

আওয়ামী লীগ তো এখন কার্যত দৃশ্যপট থেকে অপসারিত। বিএনপি কি শূন্যস্থান পূরণ করতে বা বিকল্প শক্তি হয়ে উঠতে পারবে? জাতীয় পার্টি?

এই প্রশ্নে আমি কিছুটা কঠোর হব। বিএনপি ও জাতীয় পার্টি জনগণের প্রয়োজনে জনগণের মধ্য থেকে উঠে আসা দল নয়। সামরিক শাসকদের সৃষ্ট দল, যা তাঁরা ক্ষমতায় বসে বানিয়েছেন এবং পরিকৌশলী নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের মাধ্যমে জিতিয়ে এনেছেন। তবে সময়ের সঙ্গে রাজনীতি করে বিএনপি পোড় খেয়েছে, জনগণের কাতারে এসেছে। একাধিকবার দেশ পরিচালনা করেছে। প্রতিষ্ঠাতা সামরিক নেতা জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরে ভোটে জিতেই ক্ষমতায় এসেছে। ২০০৬ সাল থেকে ১৯ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকেও দলটি বড় আকারেই রয়েছে। কখনো কখনো ভুল সিদ্ধান্ত ও ভুল কৌশল এবং সাংগঠনিক দুর্বলতার জন্য আশানুরূপ ফল পায়নি। ২০১৪ থেকে আমি একাধিকবার বলেছি, বিএনপির উচিত ছিল আওয়ামী লীগ সৃষ্ট প্রতিকূলতার মধ্যেও সরকারের পতন ঘটাতে না চেয়ে, বয়কট না করে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ভোট শুদ্ধ করার জন্য লড়াই করা। তাতে সার্বিকভাবেও দেশের রাজনীতির উপকার হতো। ছাত্রদের আন্দোলনসহ আরও নানা কারণে হাসিনা সরকারের পতন ঘটায় এখন রাজনীতির মাঠ বিএনপির জন্যই অনুকূলে। তবে নিকট অতীতে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের অংশীদার বিএনপিও। এখনো চাঁদাবাজি, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রভৃতি পরিহারসহ দলের পরিশীলন ছাড়া বিএনপি জনগণের স্বার্থে ভূমিকা পালন করতে পারবে না। দলে তুলনামূলকভাবে চিন্তাশীল নেতৃত্বের দরকার ও তুলনামূলক বিশুদ্ধ রাজনীতির পথে হাঁটতে হবে দলটিকে।

জাতীয় পার্টি, এর প্রতিষ্ঠাতা সামরিক নেতা এরশাদের সময়ই কেবল ক্ষমতায় ছিল। পরে মূলত একটি ‘প্রক্সি পার্টি’তে রূপান্তরিত হয়। ক্ষমতার রাজনীতিতে এরা কখনো সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় না। বরং একটি ‘বিকল্প নয়, বিকল্পের অংশীদার’ হিসেবেই তারা বেশি কাজ করে। বর্তমান রাজনীতিতে জাতীয় পার্টির ভূমিকা সীমিতই থাকবে।

সব সময়ই তো বলা হয় তরুণেরাই পরিবর্তন আনে। তরুণেরাই ভরসা। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পরে রাজনীতিতে তরুণদের ভূমিকা কেমন দেখছেন?

নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি তো তরুণদের দল। এনসিপি জন্ম নেওয়ার আগেই জুলাই আবহে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে আমি বলেছিলাম, তরুণদের একটি রাজনৈতিক দলকে আমরা স্বাগত জানাতে পারি। এঁরা বয়সে তরুণ ও মানসিকতায় আধুনিক হবেন। নীতি, কর্মসূচি, জ্ঞান ও ব্যবস্থাপনাকে গুরুত্ব দেবেন; স্লোগান, বুলি কপচানো ও নেতা বন্দনায় নয়। যুক্তি দিয়ে কথা বলবেন সাধারণ স্বরগ্রামে, অহেতুক গলার রগ ফুলিয়ে বক্তৃতা করবেন না। গণতন্ত্রের রীতিনীতি মেনে চলবেন এবং পার্লামেন্টে বিরোধী দলের আসনে বসে রাজনীতি করাকে মর্যাদাপূর্ণ ভাববেন।

এমন তরুণদের দল আমরা পাচ্ছি কি না বা এনসিপি তেমন দল হচ্ছে কি না, তা পাঠকেরা প্রতিদিনই তাদের দেখে যাচাই করতে পারেন। গলা ফুলিয়ে, হিংসা ছড়িয়ে বক্তৃতা করা, অজ্ঞাত উৎসের হিসাববহির্ভূত অর্থ ব্যয়, চাঁদাবাজির অভিযোগ ওঠা, গাড়ির বহর নিয়ে শক্তির মহড়া ইত্যাদি না হলে বুঝব রাজনীতিতে পরিবর্তন আসছে।

আমাদের তরুণেরা রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। ‘আই হেইট পলিটিকস’ শোনা যেত। কারণ, বছরের পর বছর তারা আদর্শহীন, সুবিধাবাদী, সংঘাতপূর্ণ, দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি দেখেছে। অন্যদিকে সামাজিক মাধ্যমে তারা দুনিয়া দেখে, সেখানে তাদের রাজনৈতিক উপস্থিতি পাওয়া যায়, তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে, প্রশ্ন তোলে। তরুণেরা এখন ‘নিউ পলিটিকস’ চায়, যেখানে নেতৃত্ব হবে বিশ্বাসযোগ্য, চিন্তাশীল এবং বাস্তবমুখী। কিন্তু আমি বিস্মিত যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা, জাতীয় নাগরিক পার্টিতে সমবেত তরুণেরা শিক্ষিত, প্রতিভাবান, স্মার্ট কিন্তু কেউ কেউ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়, এমনকি ধর্মভিত্তিক রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত ও জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে তাদের নৈকট্য দেখা যায়। তখন ভাবি, তরুণ মানেই তো ভালো, অগ্রসর চিন্তার মানুষ, প্রগতিশীল ও ন্যায়যোদ্ধা নয়। এগুলো হচ্ছে তারুণ্যের ধর্ম। কিন্তু সব তরুণের মধ্যে তারুণ্য নেই। চোর-গুন্ডা-বদমাশ ও সন্ত্রাসীরা কি বয়সে তরুণ নয়? নজরুল যাদের আহ্বান করেন ‘চল চল চল...অরুণপ্রাতের তরুণদল’ বলে এবং রবীন্দ্রনাথ যাদের বলেন ‘ওরে আমার সবুজ, ওরে আমার কাঁচা, আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা’। তারা শুধু বয়সে তরুণ নয়, ধর্মে-মর্মে তরুণ। তাই তরুণ ও তারুণ্যে পার্থক্য আছে। তারুণ্যের ধর্মচ্যুত তরুণ আমাদের কাম্য নয়। তাই আমাদের দেশ ও সমাজের ব্যাপক সাধারণ তরুণদের মধ্যে এনসিপির আবেদন কতটুকু হবে, তা ওই দলের ভূমিকা ও কাজের ওপর নির্ভর করবে।

আপনি কি মনে করেন বাংলাদেশে আশু গণতান্ত্রিক উত্তরণ সম্ভব?

নিশ্চয়ই সম্ভব, কারণ জনগণ দৃঢ়ভাবে এটা চায়। তবে কয়েকটি কঠিন চ্যালেঞ্জও আছে। মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চলকে ঘিরে আমেরিকার মতো পরাশক্তির কোনো একটি ভূ-রাজনৈতিক পরিকল্পনা আছে বলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জল্পনা আছে, যদিও সংগত কারণে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। এখানে কোনো অস্থিতিশীলতা ঘটলে আমাদের নির্বাচন ব্যাহত হতে পারে। আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধের মধ্যে আমাদের নির্বাচন হওয়ার কথা। তবে এখনো এটা নিশ্চিত নয়।

মনে রাখতে হবে, গণতন্ত্র একটি সংস্কৃতি, শুধু নিয়ম নয়। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কারের একটি ব্যাপক পরিকল্পনা প্রয়োজন, যে বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য লাগবে। প্রথম ধাপেই আমাদের নির্বাচনকে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। বিগত সরকারের বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজের বিচার অবশ্যই হতে হবে। তবে সরকার ও প্রশাসনের দায়ী ব্যক্তিবর্গ ছাড়া বর্তমানে সরকারের আদেশে কার্যক্রম নিষিদ্ধ রাখা আওয়ামী লীগের বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী-সমর্থককে সংগঠিত হওয়ার ও মতপ্রকাশের সাংবিধানিক অধিকার দিয়ে গণতন্ত্রের যাত্রাকে অংশগ্রহণমূলক করা ভালো। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনও এই অধিকারগুলোর কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।

এবার দু-একটি আন্তর্জাতিক বিষয়। চলমান বিশ্ব পরিস্থিতি, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা জোটের ভূমিকাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

পশ্চিমা জোট বলতে যদি আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা স্পষ্টত ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোকে বোঝাই, তাহলে এই দেশগুলো হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী দেশ। সারা দুনিয়ায় আধিপত্য তাদের কাম্য। আমরা তাত্ত্বিকভাবে বলি যে সাম্রাজ্যবাদের খাদ্য হচ্ছে যুদ্ধ। যুদ্ধ ছাড়া তারা বাঁচতে পারে না। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেও সারাক্ষণ কোথাও না কোথাও যুদ্ধ লেগেই আছে। চার বছর ধরে রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ চলার মধ্যেই এই মাসে ইরানে ইসরায়েল ও আমেরিকা আক্রমণ চালিয়ে একটি আঞ্চলিক যুদ্ধ ঘটাল। ইসরায়েল প্রায় দুই বছর ধরে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় অকল্পনীয় নিষ্ঠুরতায় অব্যাহত গণহত্যা চালাচ্ছে। প্রায় ৬০ হাজার মানুষকে হত্যা করার পর এখন তাদের দুর্ভিক্ষে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিচ্ছে। এইসব ঘটনায় এখন জাতিসংঘ কার্যত নিষ্ক্রিয় বা সভায় বসলেও কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে না। ফিলিস্তিন ও ইরানে যা দেখা গেল, আমেরিকা ও ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে চলেছে। সর্বশেষ এই সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চাপে প্রতিটি ন্যাটো দেশ অস্ত্র খাতে ব্যয় ৫ শতাংশ বাড়াতে সম্মত হয়েছে। এককথায় বৃহৎ শক্তিগুলোর স্বার্থে বিশ্বকে যুদ্ধে তাতিয়ে রাখাই হচ্ছে বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ পুরোটাই স্নায়ুযুদ্ধের কাল হলেও সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ব্লক ও পশ্চিমা ব্লকের শক্তির ভারসাম্য ছোট দেশগুলোকে একটা ভরসায় রেখেছিল। সে সময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জেতার পেছনে সোভিয়েতের ভূমিকা একটি বড় উপাদান ছিল। সোভিয়েতের আহ্বানে তখন বিশ্বে পূর্ণাঙ্গ পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের আলোচনা হয়েছিল। এখন বড় শক্তিগুলো নিরস্ত্রীকরণ নয়, পারমাণবিক অস্ত্রের একচেটিয়া অধিকার হাতে রাখতে চায়।

পরাশক্তিব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পরে আমেরিকা ভেবেছিল বিশ্ব এককেন্দ্রিক হবে। কিন্তু তা হলো না। বরং আমেরিকা একটু দুর্বল হওয়ার পাশাপাশি চীন, রাশিয়া, ভারত, ইরান প্রভৃতি শক্তিধর রাষ্ট্র আছে। দুই মহাশক্তির পরিবর্তে পৃথিবী শক্তিকেন্দ্রিক। এ রকম

অবস্থায় বাংলাদেশের মতো ছোট দেশের জন্য সুযোগ এবং চ্যালেঞ্জ দুটোই আছে। সুযোগ এই কারণে যে, একপেশে অবস্থানের পরিবর্তে কৌশলী পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করে আমরা স্বার্থসংশ্লিষ্ট সুবিধা আদায় করতে পারি। চ্যালেঞ্জ এই কারণে যে, বড়দের দ্বন্দ্বে আমরা পড়ে যেতে পারি একপেশে সিদ্ধান্তে। ভারসাম্য রক্ষা করে চলাই আমাদের স্বার্থানুকূল।

আপনার দৃষ্টিতে ইরান-ইসরায়েলের যুদ্ধের মূলে কী? এটি ধর্মীয়, রাজনৈতিক, না কৌশলগত সংঘাত? আমেরিকা কেন জড়াল?

খুব ভালো প্রশ্ন। কিন্তু উত্তরটা এককথায় দেওয়া যায় না। এই সংঘাত ধর্মীয়ও বটে, কৌশলগতও বটে এবং আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তার নিয়েও বটে।

দুটি রাষ্ট্রই ধর্মভিত্তিক। ইহুদি রাষ্ট্রটির শাসকদের মধ্যে জায়নবাদীরা আছে। জায়নবাদ হচ্ছে ইহুদি-শ্রেষ্ঠত্বের দাবিতে ফ্যাসিবাদী ভাবধারা। তবে সব ইহুদি জায়নবাদী নয়। তাদের মধ্যে উদার আধুনিক মানুষ অনেক আছে। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু যুদ্ধে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করতে সব সময় ধর্মগ্রন্থ ‘তোরাহ’ ব্যবহার করেন। যেমন ১২ জুন ইরান আক্রমণের নাম ‘জাগ্রত সিংহ অপারেশন’ ওল্ড টেস্টামেন্টভিত্তিক কাহিনি থেকে। তিনি আক্রমণের আগে জেরুজালেমে ওয়েস্ট ওয়ালে গিয়ে প্রার্থনা করেন। ওদিকে জাব্বাজোব্বা পরা আয়াতুল্লাহ শাসকেরা ইরানকে মধ্যপ্রাচ্যে শিয়াপন্থী অভিভাবক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এরা এমন ধর্মান্ধ যে ২০২২ সালে মাহশা আমিনি নামে এক তরুণীর হিজাব সরে গিয়ে চুল বেরিয়ে পড়ায় নীতি-পুলিশ তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বন্দী অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হলে প্রতিবাদকারী শতাধিক কিশোরী-তরুণীকে মিছিলে গুলি করে মারা হয়। যুদ্ধে ধর্মীয় উপাদান ব্যবহার করা হলেও এটি মূলত ক্ষমতা ও আঞ্চলিক আধিপত্যের লড়াই। ইসরায়েল হচ্ছে একটি আঞ্চলিক পরাশক্তি, যাকে পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়ে থাকে। ইরান বড় আকারে পারমাণবিক গবেষণা করে, কিন্তু পারমাণবিক বোমা বানাতে চায়, তা স্বীকার না করে শান্তিপূর্ণ উন্নয়নের কাজে ব্যবহারের কথা বলে। আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থাকে পরিদর্শনের অনুমতি দেয়। আলোচনায়ও বসেছে। এর আগের মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একতরফা আলোচনা ভেঙে দিয়েছিলেন। ইসরায়েল এবার ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা ফেলে, কয়েকজন সেনাপতি ও পরমাণুবিজ্ঞানীকে গুপ্তহত্যা করে। ইরান কার্যকরভাবে ইসরায়েলে পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করতে পারলে ইসরায়েলের ইজ্জত বাঁচাতে যুক্তরাষ্ট্র শঠতাপূর্ণভাবে বি-টু যুদ্ধবিমান দিয়ে ইরানে বড় হামলা করে। তার পরই ট্রাম্প যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেন। তিন রাষ্ট্রের দুই পক্ষের ১২ দিনের যুদ্ধ। সন্দেহ করা হয় যে ২০০৩ সালে জনবিধ্বংসী অস্ত্র আছে বলে মিথ্যা অজুহাতে ইরাক আক্রমণ করে সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাত ও ফাঁসি দেওয়ার মতো ঘটনা ইরানে ঘটানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র ফন্দি আঁটতে পারে।

এবার কে জিতল?

(হেসে) তিন পক্ষই। যুদ্ধ শেষ হওয়ার দিন ২৪ জুনেই আন্তর্জাতিক মিডিয়া জানায়, যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, তারা ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র বানানো অনেক পিছিয়ে দিতে পেরেছে। ইসরায়েল বলেছে, তারা ইরানকে দুর্বল করে দিয়েছে। অবশ্য ইসরায়েলের আরেকটি লক্ষ্য খামেনি সরকারের পতন ঘটেনি—সে সম্পর্কে নীরব। আর ইরান বলেছে, তারা উপযুক্ত জবাব দিয়েছে। সর্বশেষ ২৬ জুন টিভিতে সম্প্রচারিত ভিডিও বার্তায় আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি কাতারে মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতকে ‘সজোরে চপেটাঘাত’ উল্লেখ করে বলেন, ‘ইসরায়েল ধসে পড়েছে।’

বলাই যায়, ইসরায়েলি ‘সিংহ’ গর্জন মোতাবেক শিকার ধরতে পারেনি। ইউরোপে কিছুটা কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতায় পড়েছে। তবে নেতানিয়াহুর ক্ষমতার আয়ু কিছু বাড়তে পারে। ইরান ধারণার চেয়ে বেশি সক্ষমতা দেখিয়েছে এবং খামেনির সরকার পড়ে যাওয়ার বিপরীতে জনমতের দিক থেকে কিছুটা সংহত হয়েছে। বিশ্বের মুসলমানদের সমর্থন পেয়েছে। তারা বাংলাদেশকে ধন্যবাদও জানিয়েছে। আর আমেরিকা কিছুটা দুর্বল ইরানকে আলোচনার টেবিলে বসাবে। তিন পক্ষই বড় যুদ্ধ চায়নি, সেখানেও জিতেছে।

এই ১২ দিনের উপসংহারহীন অসমাপ্ত যুদ্ধের আরেকটি দিক হলো চীন ও রাশিয়ার কৌশলগত উত্থান। চীন চায় মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন আধিপত্যে ফাটল ধরুক। তারা ইরানকে কিছুটা উসকানি বা কৌশলগত সহায়তা দিয়েছে বলে ধারণা। রাশিয়াও মধ্যপ্রাচ্যে বন্ধুত্ব বাড়াতে সক্রিয়।

ইরানে বড় আক্রমণ দেখে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আশঙ্কার কথা বলা হচ্ছিল।

তেমন আশঙ্কা দূরবর্তী বলেই মনে হয়। তবে স্থানিক যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি হতে পারে বা বলতে পারেন ‘প্রক্সিতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ’ সম্ভব। দুটি বৈশ্বিক মেরু তৈরি হয়েছে: একদিকে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল-ন্যাটো ব্লক, অন্যদিকে চীন-রাশিয়া-ইরান-হিজবুল্লাহ-হামাস।

এই দুই মেরুর মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষ না হলেও তারা পরোক্ষে যুদ্ধ করছে ইউক্রেন, সিরিয়া, ইয়েমেন, গাজা প্রভৃতি যুদ্ধক্ষেত্রে। এখন তো যুদ্ধ শুধু অস্ত্রের না, তথ্যেরও। মিডিয়া, সামাজিক মাধ্যম, কূটনৈতিক মঞ্চ—সবই যুদ্ধে জড়িয়ে। থেমে নেই।

বাংলাদেশের অবস্থান কী হওয়া উচিত? আমাদের কি নিরপেক্ষ থাকা উচিত, নাকি অবস্থান নিতে হবে?

দৃঢ় অবস্থান, আমরা যুদ্ধ চাই না। সাংবিধানিকভাবে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়। তবে অবশ্যই ন্যায়-অন্যায় ও মানবাধিকারের প্রশ্নে গাজা যুদ্ধে ও ইরান আক্রমণে ইসরায়েলের তীব্র নিন্দা করেছি আমরা। ইসরায়েলকে আমরা রাষ্ট্র হিসেবে এখনো স্বীকৃতি দিইনি। আমাদের জনগণের একটি মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ আছে।

তবে রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। ইরানের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য ও জ্বালানি সহযোগিতা আছে। আমরা আন্তর্জাতিক শান্তির পক্ষে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে অবশ্যই আপসহীন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত