Ajker Patrika

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান এখন অনেক উঁচুতে

ড. কামালউদ্দীন আহমদ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান এখন অনেক উঁচুতে

আগামীকাল ২০ অক্টোবর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৬ বছরের এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক অর্জন আছে। হয়তো সেই অর্জন অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নাও হতে পারে। রাজধানীতে পুরান ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থানের কারণে এর আকর্ষণ অন্য রকমের। যখন জগন্নাথ কলেজ ছিল, তখনো অন্যরকমের আবেদন ছিল। বাংলাদেশে ও দেশের বাইরে অনেক পেশাজীবী এই প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করেছেন। অনেক রাজনীতিবিদ এখানেই লেখাপড়া করেছেন। আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতিও এখানে বসে আইন বিষয়ে পরীক্ষা দিয়েছেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তনে তিনি তাঁর স্মৃতিচারণে সে কথা বলেছেন। এ রকম অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব এই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতিধারণ করছেন।

‘জগাবাবুর পাঠশালা’ বা যে নামেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় অভিহিত হোক না কেন, এর একটি অহংকারের ভিত্তি আছে। তবে যে প্রক্রিয়ায় জগন্নাথ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়েছে, তা ছিল অনেকটাই ত্রুটিপূর্ণ। সাধারণত একটি নতুন পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হলে তার একটি অবকাঠামোগত পরিকল্পনা থাকে। এর কোনোটাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছিল না। কলেজ আমলের কতগুলো ছাত্রাবাস ছিল, যার অনেকগুলোই বেহাত হয়ে গিয়েছিল। এগুলো ঠিকমতো পরিচালিত হতো কি-না, জানা নেই। মাঝেমধ্যে এলাকাবাসীর সঙ্গে ছাত্রদের কলহ বিবাদ হতো। হল পরিচালনার ব্যাপারে যেভাবে প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়, তার অনেকটাই ছিল না। স্বাধীনতার পর কয়েক বছর হলগুলো মোটামুটি সচল ছিল। হলগুলো কীভাবে পরিচালিত হতো, কিংবা এর প্রশাসনিক কার্যক্রম কতটা কলেজ কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে ছিল, তা জানা নেই। এভাবে এগুলো একে একে হাতছাড়া হতে থাকে। এরশাদের আমল থেকেই এই প্রক্রিয়া শুরু। প্রভাবশালীদের দখলে চলে যেতে থাকে একেকটি হল। 

মাঝেমধ্যে পত্রপত্রিকায় এসব হলের ভেতরে সংগঠিত বিভিন্ন ঘটনার সত্য/মিথ্যা বিবরণ প্রকাশিত হতো। আর হলগুলোর অবস্থান ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। দীর্ঘ অনেক বছর এই কলেজ, আর তথাকথিত হলগুলোও নিয়ন্ত্রিত হতো মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তির দ্বারা। এক সময় কলেজের একাডেমিক কার্যক্রম নিয়েও নানা রকম প্রশ্ন উঠতে থাকে। তারপরও জগন্নাথ তার স্বকীয় মহিমায় এগিয়ে গিয়েছে। ফলে ২০০৫ সালে এটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এর অবকাঠামো কলেজ আমলের মতোই রয়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পরিকল্পিত কিছুই এখানে নেই। শুধু অবস্থান রাজধানীতে বলে এর একটি গুরুত্ব আছে। স্বাভাবিক কারণেই এখানকার ছাত্র-ছাত্রীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমতুল্য অনেক সুবিধা আশা করেন। আবার অনেকে সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়েও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যান।

এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭/৪ ধারা নামে একটি ধারা ছিল। ধারাটি ছিল পাঁচ বছর পর বিশ্ববিদ্যালয় তার নিজস্ব আয়ে চলবে। এই ধারার মধ্যে আর কী কী শর্ত সন্নিবেশিত ছিল, তা আমার এই মুহূর্তে জানা নেই। একই ধারার বলে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। এর বিরুদ্ধে এই জগন্নাথের ছাত্র-ছাত্রীরা ২০১১ সালে এক জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলেন। একপর্যায়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এগিয়ে এলেন এই সমস্যা সমাধানে। আমরা একদল সিনিয়র শিক্ষক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মেজবাহ উদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে সহযোগিতা করি এবং এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করি। তিনি প্রথম প্রতিক্রিয়ায় বললেন, এটা তো বিশ্ববিদ্যালয় করাই ঠিক হয়নি। আসলে তিনি অবকাঠামোগত অপ্রতুলতার কথা ভেবেই কথাটি বলেছিলেন। সে জন্যই ২৭/৪ ধারা বাতিলের ঘোষণা দেন এবং বিল আকারে এটি সংসদে উত্থাপন করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন এবং বাতিল করেন।

সেই থেকেই আসলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু। নিজস্ব আয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চালু হওয়া মানে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায় টিউশন ফি পরিশোধ করা। সে জন্যই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রথম দেখাতেই আমাদের বলেছিলেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এত বেতন কীভাবে দেবে। 

১৬ বছরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জন অনেক। সবচেয়ে ঈর্ষণীয় হলো এর শিক্ষকমণ্ডলী। বিদেশ থেকে উচ্চ ডিগ্রি নিয়ে অনেক শিক্ষক এখানে পড়াচ্ছেন ও গবেষণা করেছেন। দেশের বিভিন্ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠানে গবেষণা করেছেন। এসব অভিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলীর সান্নিধ্যে শিক্ষার্থীরাও স্ব স্ব ক্ষেত্রে অনেক অবদান রাখছে। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান এখন অনেক উঁচুতে।

দেশব্যাপী বিভিন্ন সৃষ্টিশীল কাজে এখানকার শিক্ষার্থীদের ভূমিকা প্রশংসাযোগ্য। অবকাঠামোগত উন্নয়নের লক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ইচ্ছায় কেরানীগঞ্জে ২০০ একর জায়গায় নতুন ক্যাম্পাস নির্মাণের প্রাথমিক কাজ এগিয়ে চলছে। শিগগিরই মাস্টারপ্ল্যান প্রণীত হবে। দ্রুতই সীমানা দেয়ালের কাজ শুরু হবে বলে আশা করা যায়। সীমাবদ্ধতা অনেক আছে। তারপরও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার আশাহত নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বঙ্গবন্ধুর আদর্শে শেখ হাসিনার হাত ধরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্যই অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে; অগণিত শিক্ষার্থীর স্বপ্ন পূরণে পুরোনো ঢাকার ঐতিহ্য রক্ষার্থে অর্থবহ ভূমিকা পালন করবে। 

অধ্যাপক ড. কামালউদ্দীন আহমদ: কোষাধ্যক্ষ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

সাক্ষাৎকার

সংকটটা ঐকমত্য কমিশন ও সরকারের তৈরি করা

সাইফুল হক।

সাইফুল হক বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক। গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন ‘ছাত্র ঐক্য ফোরাম’-এর কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। জুলাই সনদ নিয়ে তৈরি হওয়া রাজনৈতিক সংকট, বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ গতিপথ কোন দিকে যাবে—এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা

মাসুদ রানা
আপডেট : ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ০৭: ৫০

বিএনপি, গণতন্ত্র মঞ্চসহ অন্য দলগুলো জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছিল। কিন্তু স্বাক্ষর করার পর বিএনপিসহ আপনারা সনদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিরোধিতা করছেন কেন?

অনেকগুলো বিষয়ে একমত হয়েছি, আবার কতগুলো জায়গায় আমরা ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা আপত্তি দিয়েছি। আমরা ‘নোট অব ডিসেন্ট’সহ সাতটি অঙ্গীকারনামাতেও স্বাক্ষর করেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, নোট অব ডিসেন্টের অংশটা ঐকমত্য কমিশনের মূল সনদে নেই। এটা তো বড় ধরনের একটা অসততা। আমরা শুধু নোট অব ডিসেন্টের ওপর আমাদের সিদ্ধান্তগুলো দিয়েছি। কিন্তু বিএনপিসহ অন্যান্য দলের সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের সমঝোতা হয়েছিল, নোট অব ডিসেন্টের অংশগুলো মূল দলিলে থাকতে হবে। কীভাবে নোট অব ডিসেন্টের বিষয়গুলো মীমাংসা করা হবে, তার পদ্ধতি নিয়েও সেখানে নোট ছিল। নোট অব ডিসেন্ট ছিল জুলাই সনদের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

জুলাই সমঝোতা সনদ (সংবিধান সংশোধন) করার জন্য একটা আদেশ জারি করার পরামর্শ দিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। আমাদের যুক্তি ছিল, বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে বর্তমান সরকার সংবিধানের ১০৬ ধারার একটা রেফারেন্সের আলোকে শপথ নিয়েছে। সেই ধারার আলোকে সংবিধান নিয়ে সরকার কোনো আদেশ দিতে পারে না। কারণ, তারা নিজেরাই বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে ১৪ মাস ধরে দেশ চালাচ্ছে। এ ছাড়া সরকার, নির্বাচন কমিশন, নির্বাহী বিভাগ, বিচারব্যবস্থাসহ গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থা চলছে শত সমালোচনার পরেও এই সংবিধানের অধীনেই। তাহলে যে সংবিধানের অধীনে শপথ নিয়েছেন, সেই সংবিধানের আদেশ দিয়ে কোনো কিছু সংশোধন করার কোনো ম্যান্ডেট ও ক্ষমতা আপনাদের নেই। তাদের যুক্তি হলো, এটা তো একটা গণ-অভ্যুত্থানের সরকার। গণ-অভ্যুত্থানের সরকার অনেক কিছুই করতে পারে।

আমরা বলেছি, এ যুক্তি হলো খোঁড়া যুক্তি। আপনারা গণ-অভ্যুত্থানের সরকার, কিন্তু সংবিধান তো বাতিল বা স্থগিত করা হয়নি। সংবিধানের সংশোধনী করতে পারে শুধু নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সংসদ। সে জায়গা থেকে আমরা বলেছি, সবকিছু সংসদে গিয়ে রেকটিফাই হতে হবে, সংশোধনীগুলো বিল আকারে উত্থাপিত হবে এবং সবকিছু নিয়ে আলাপ-আলোচনার পর আইনে পরিণত হবে। এটাই হলো সাংবিধানিক প্রক্রিয়া। এর বাইরে তো যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটা করা মানেই হলো, আপনারা যে সংবিধানের অধীনে শপথ নিয়েছেন, সেটাকে অস্বীকার করা এবং প্রকারান্তরে সেই সংবিধানকে বিলুপ্ত করা।

আমার যুক্তি হলো, আপনারা যদি এটাকে অনুমোদন করেন, ভবিষ্যতে কোনো পটপরিবর্তনের সময় সংবিধান পরিবর্তনের জন্য এই ঘটনাটা উদাহরণ হিসেবে কাজ করবে। তখন আর নির্বাচন, সংসদের কোনো প্রয়োজন পড়বে না। যেকোনো সরকার চাইলেই সংবিধান সংশোধন করতে পারবে। এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতে কর্তৃত্ববাদী শাসন ফিরে আসতে পারে। এগুলো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এই দুটি হলো মেজর পয়েন্ট।

এরপর গণভোটের ব্যাপারে জামায়াতসহ কয়েকটি দল ছাড়া সবাই আমরা বলেছি, আগামী জাতীয় নির্বাচনের দিনই গণভোট একসঙ্গে করার। কারণ, সরকারের পক্ষে দুটি জাতীয় নির্বাচন করার সক্ষমতা নেই। এটার জন্য বিশাল অর্থের ব্যাপার আছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সক্রিয় করার ব্যাপার আছে। বাস্তবে সে কারণে এটা সম্ভব নয়।

তাহলে ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদ এভাবে কেন চূড়ান্ত করল? এখানে কোনো ষড়যন্ত্র আছে বলে মনে করেন?

সরকারকে দিয়ে যদি তারা আদেশ জারি করতে পারে, প্রকারান্তরে বর্তমান সংবিধান ‘নাই’ হয়ে যায়। যেটা তারা শুরুতে বলেছিল, এটা মুজিববাদী সংবিধান, এটাকে ফেলে দিতে হবে। প্রকারান্তরে এখন তারা বলছে, এই সংবিধানের আর কোনো দরকার নেই। নতুন সংবিধান তৈরি করতে হবে। তারপর আমরা একটা বিপ্লবী সরকার গঠন করব। যেটা তারা ১৪ মাস আগে করার চেষ্টা করেছিল (যদিও সে সময় সেটা করতে পারেনি)।

এটার উদ্দেশ্যটা হলো রাজনৈতিক কৌশল। যদিও এটার মধ্যে কোনো আন্তরিক উদ্যোগ আছে বলে আমি মনে করি না। আর একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, ২৭০ দিনের মধ্যে সংশোধনীগুলো করতে হবে। মানে ৯ মাসের মধ্যে। কিন্তু কথা হলো, এটা দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার না। ৯ মাস কোনো ব্যাপার হতে পারে না। এটা দুই-এক মাসের ব্যাপার মাত্র বা সংসদের একটা অধিবেশনে এটা করা সম্ভব। পরে আবার ভয়াবহ একটা কথা বলা হয়েছে, ২৭০ দিনের মধ্যে সেটা করা সম্ভব না হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এটা সংবিধানে যুক্ত হয়ে যাবে। পৃথিবীর কোনো দেশে কি এভাবে সংবিধান সংশোধন হয়েছে বা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর করার উদাহরণ আছে?

এটা সামরিক ফরমানের মতো করে চাপিয়ে দেওয়ার ব্যাপার যেন। এ জন্য আমরা বলেছি, কোনো একটা দুরভিসন্ধি আছে বলে অনুমান করা যায়। এটা কি পরিস্থিতিকে জটিল করার জন্য, জামায়াত ও এনসিপিকে বাড়তি কোনো সুবিধা দেওয়ার জন্য অথবা অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না—এ জন্যই তো জটিলতা তৈরি করা হয়েছে।

এখন সমাধানের পথ কী?

এখন সরকার যেটা বলেছে, সেটা আরও ভয়াবহ। সরকার যেভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর কোর্টে বল তুলে দিয়েছে, আমি মনে করি, সেটা খুব অন্যায় কাজ করেছে। আসলে এই সংকটটা ঐকমত্য কমিশন ও সরকারের তৈরি করা। কারণ, তারা দলগুলোর অবস্থান জানে। এখন সমাধানের পথ এবং দাঁড়ানোর জায়গা কোথায়? দাঁড়ানোর জায়গাটা ছিল, দলগুলো যেখানে ঐকমত্য পোষণ করেছে সেটাই তো ঐকমত্যের জায়গা হওয়ার কথা। যেসব প্রশ্নে ঐকমত্য হয়নি, সেসব তো কোনোভাবেই সবার সিদ্ধান্ত হিসেবে চাপানো উচিত হয়নি। সমস্যা আসলে তৈরি হয়েছে এখানেই। পরোক্ষভাবে সরকারই এই সংকট জিইয়ে রাখছে কি না, সেই শঙ্কাটা দেখা দিয়েছে। এখন আবার সরকার নিজেরাই সমাধান না করে দলগুলোর ওপর তা চাপিয়ে দিয়েছে। তবে সরকারের যদি সদিচ্ছা থাকে, তাহলে বাকিটা আলোচনা করে সমাধান করা সম্ভব। সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়েও কিন্তু প্রশ্ন আছে। সমস্যাটা তো এখানেই।

আগামী দিনের নির্বাচন বা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় জুলাই সনদ বিতর্কটি কোনো প্রভাব ফেলবে বলে আপনি মনে করেন?

জুলাই সনদ আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দলিল। যেটা রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারের মধ্যে থাকবে। এই সনদের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যেসব অংশীজন স্বাক্ষর করেছে, পরবর্তী সংসদে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আলোচনা হবে, বিল আকারে উত্থাপিত হবে এবং তা আইন হবে। পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে কাজ করবে।

এখন চাপিয়ে দেওয়ার বিষয়গুলো কীভাবে সমাধান হবে?

এটা নির্ভর করছে সরকারের ওপর। সরকার চাপাতে চাইলে সংকটের সমাধান হবে না। তখন বহুমাত্রিক জটিলতা তৈরি হতে পারে। এমনকি নির্বাচনও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যেতে পারে। সরকার যদি সংবিধানের কোনো আদেশ দেয়, তাহলে যে কেউ হাইকোর্টে যেতে পারবে। সরকার কোনো বেআইনি কাজ করতে পারে না। প্রচলিত সংবিধান থাকার পরেও কোনো অর্ডার দিয়ে সংবিধান সংশোধন করতে পারে না। যদি সংবিধান বাতিল বা স্থগিত করা হয়, তখন কী হবে? তখন তো আরেক ধরনের সংকট তৈরি হবে। ফলে সরকার বিতর্কিত পথে হাঁটলেই সংকট, বিভাজন বাড়তে থাকবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে হিংসাশ্রয়ী জায়গাটাও তৈরি হবে।

জুলাই সনদে স্বাক্ষরের পরে যে সমালোচনা শোনা যাচ্ছে, তা কি শুধু কৌশলগত, নাকি দলগুলোর মূল আদর্শগত বিরোধের বহিঃপ্রকাশ?

এখানে তো নিশ্চিতভাবে দলগুলোর মূল আদর্শগত বিরোধের বহিঃপ্রকাশ আছে। দলগুলোর চিন্তার একটা ছাপ আছে। বিএনপি উচ্চকক্ষে পিআর চাইছে না। এটা তো তাদের রাজনীতির বিষয়। বিএনপি চাইছে নিম্নকক্ষে আসনের অনুপাতে পিআর। আর আমরা চেয়েছি ভোটের অনুপাতে পিআর। বিএনপি ও জামায়াত দুই দলই সরকার গঠনের সম্ভাবনা দেখছে। তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো দলের জন্য কোনটা সুবিধা হবে। বিএনপি ভাবছে, আমরা সরকার গঠন করলে কোনটাতে আটকে যেতে পারি; আবার জামায়াত ভাবছে, আমরা যদি বিরোধী দল হই, তাহলে কোনটাতে আমাদের সুবিধা হবে। এগুলো হলো রাজনৈতিক বিবেচনা। আর একটা তো কৌশলগত বিবেচনা আছে।

জুলাই সনদ-বিতর্ক নিষ্পত্তি না হলে, বাংলাদেশের রাজনীতি কোন দিকে অগ্রসর হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

সেটা না হলে রাজনীতিতে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, অস্থিতিশীলতা বাড়বে, সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দূরত্ব তৈরি হবে, অবিশ্বাস ও সন্দেহ বাড়বে। এমনকি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও পারস্পরিক দোষারোপ করার প্রবণতা বাড়বে।

তখন একটা সুস্থ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার চেয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতা বাড়বে। কোথাও কোথাও সহিংসতা তৈরি হওয়ার ঝুঁকি বাড়বে। এটা যদি বাড়ে, অভ্যুত্থানের অংশীজনদের মধ্যে যদি বিতর্ক, মতভেদ এবং রাজপথ দখলের প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়, তখন তৃতীয় পক্ষ সুযোগ নিতে পারে। সেটা মার্শাল ল হবে, নাকি তৃতীয় পক্ষ সুযোগ নেবে, না অন্য কিছু হবে—গভীর একটা দুর্যোগ এবং একটা অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা আছে। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনও ভন্ডুল হয়ে যেতে পারে।

এ সরকার ক্ষমতায় থাকতে পারবে কি না, সে প্রশ্ন করা যায়। তখন গ্লোবাল প্লেয়াররা, যাদের বাংলাদেশকে নিয়ে বহুমাত্রিক পরিকল্পনা আছে, তারা এ ধরনের সরকারকে প্রলম্বিত করতে চাইবে কি না, সে আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। দেশে একটা সামাজিক নৈরাজ্য দ্রুত রাজনৈতিক নৈরাজ্যে রূপ নিতে পারে। একটা নিম্ন পর্যায়ের গৃহযুদ্ধের জমিন তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা যায়।

সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

আজকের পত্রিকাকেও ধন্যবাদ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

নারী ক্রিকেট দল!

সম্পাদকীয়
নারী ক্রিকেট দল!

বাংলাদেশ জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক জাহানারা আলম যেন প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দিলেন! সেখান থেকে একে একে বেরিয়ে আসছে দুর্গন্ধযুক্ত ঘটনা। যাঁরা নারীক্রিকেটারদের সুরক্ষা দেবেন বলে প্রতিশ্রুত, তাঁদেরই কেউ কেউ ক্রিকেটারদের জন্য হয়ে উঠেছেন বিভীষিকা। এ রকম একটি অভিযোগ ওঠার পর সত্যিই জাতীয় নারী দলের সংগঠক, নেতাদের নীতিবোধ, সততা, স্বচ্ছতা—সবই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়।

ব্যাপারটা এমন নয় যে, এবারই প্রথম নারী দলের সদস্যরা যৌন নিপীড়নের অভিযোগ করেছেন। ভয়াবহ তথ্য হলো, অভিযোগ করার পরও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। যে কেউ বুঝতে পারবেন, একটি দলে নিয়মানুবর্তিতা, নির্দেশ মেনে চলা খুব গুরুত্বপূর্ণ। নিয়ম অনুযায়ী না চললে খেলাধুলায় ভালো ফল আসে না। কিন্তু ভালো পারফরম্যান্সের জন্য মানসিকভাবে যে মুক্ত পরিবেশ গড়ে তুলতে হয়, শঙ্কাহীন মানসিকতা গড়ে তুলতে হয়, তার অভাব হলে সরাসরিভাবেই মাঠে তার প্রভাব পড়ে। এ কথা তো সত্য, নিকট অতীত থেকে এখন পর্যন্ত ক্রিকেটে আমাদের যে সাফল্যগুলো এসেছে, তার বেশির ভাগই এনেছেন আমাদের নারী ক্রিকেটাররা। কিন্তু তাদের ওপর যদি দলের অভিভাবকেরাই যৌন হয়রানির মতো অপরাধ করে থাকেন, তবে সেটা খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। অভিভাবকেরাই যদি নারী ক্রিকেটারদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করেন, তাহলে তাঁরা নিরাপদ থাকবেন কী করে? এই মানসিক চাপ খেলার মাঠেও সঞ্চারিত হতে বাধ্য।

বিষয়টি খুব জটিল। মূল দলে থাকা না-থাকার বিষয়টিও তো নির্ভর করে নির্বাচক, ফিজিওসহ অনেকের ওপর। তাঁরা পারফরম্যান্স দেখে মূল দলে রাখবেন খেলোয়াড়দের, সেটাই নিয়ম। কিন্তু যদি কোনো ‘অজ্ঞাত কারণে’ (পড়ুন যৌনতার প্রলোভন দেখানোর মাধ্যমে) কোনো খেলোয়াড় সেরা একাদশে না আসতে পারেন, তাহলে ঘটনাটি যাচাই করে দেখবে কে? এ ধরনের অন্যায় আচরণের প্রত্যক্ষ সাক্ষী থাকে না। টেলিফোন রেকর্ড বা সে রকম কিছু হয়তো থাকতে পারে, কিন্তু শরীর স্পর্শ করা, পিরিয়ড শেষ হলে দেখা করতে বলা—এগুলো নিশ্চয়ই সাক্ষী রেখে করা হয় না। দলে সুযোগ পাওয়ার মুলা ঝুলিয়েও ফায়দা হাসিল করার কথা ভাবতে পারেন অপরাধী। দলে যাঁরা সুযোগ পাচ্ছেন, তাঁরাও বিষয়টি নিয়ে নীরব থাকতে পারেন। এখন যাঁরা মূল দলে আছেন, মাঠে নামার জন্য প্রস্তুত—তদন্ত হলে তাঁরা কী বলবেন? দলের সংগঠকদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস কি থাকবে তাঁদের?

যে অভিযোগগুলো উঠেছে, সেগুলো খুবই ভয়াবহ। বিষয়গুলো খতিয়ে দেখার জন্য বিসিবি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটিতে যাঁরা আছেন, তাঁদের ওপর নির্ভর করছে স্বচ্ছ তদন্ত হবে কি না। তবে বিসিবির বাইরে একটি স্বাধীন তদন্ত কমিটি হওয়া উচিত ছিল। কেননা, এই কমিটিতে বিসিবির সংশ্লিষ্টতা থাকায় তদন্তকাজে পক্ষপাত হতে পারে। এটা মাথায় রাখা দরকার। সব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে আমাদের নারী ক্রিকেটাররা নিরাপদ ক্যারিয়ার গড়ে তুলে সাফল্য অর্জন করুক—এটাই আমাদের কামনা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

প্রাচীন, পবিত্র ও স্মারক বৃক্ষগুলো রক্ষা পাক

মৃত্যুঞ্জয় রায় 
আপডেট : ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ০৭: ২২
পারিল-বলধারার প্রাচীন পাকুড়গাছ যেখানে পৌষসংক্রান্তির মেলা বসে, নিশকাইন্দা দেওয়ের পূজা হয়। ছবি: লেখক
পারিল-বলধারার প্রাচীন পাকুড়গাছ যেখানে পৌষসংক্রান্তির মেলা বসে, নিশকাইন্দা দেওয়ের পূজা হয়। ছবি: লেখক

নিসর্গবিদ, কৃষিবিজ্ঞানী ও আলোকচিত্রী ড. নওয়াজেশ আহমদের ‘মহাবনস্পতির পদাবলী’ বইটা যখনই সুযোগ পাই, তখনই দুই-চার পাতা পড়ি। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল মে, ১৯৯৩ সালে। সে বইয়ের ‘মহাদ্রুম সমাচার’ নিবন্ধে তিনি পারিল-বলধারার একটি পবিত্র বটবৃক্ষ সম্পর্কে লিখেছেন: ‘ভর এসেছে, গগন ঋষির উপর বটতলায়। সারা গায়ে ছাই মেখে আধপোড়া গজার মাছ খেয়ে গগন নেচে নেচে দৌড়িয়েছে কয়েক মাইল ঢাকের তালে তালে। মোটা কাছি দিয়ে বেঁধে বিশজন জোয়ান পুরুষও গগনকে ধরে রাখতে পারেনি। এমনি শক্তিধর নিশকাইন্দা দেওয়ের ভর!’

অনেক দিন থেকেই ইচ্ছা ছিল পারিল-বলধারার সেই প্রাচীন বটগাছটা দেখার। অবশেষে এ মাসেই সে সুযোগ এল। ড. নওয়াজেশের ভাইপো নাসিম আহমেদ নাদভী ও আজাদ ভাইয়ের সঙ্গে সেখানে গিয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। বিরাট এলাকাজুড়ে ডালপালা ছড়িয়ে সে গাছটা অনেকটা জায়গা ছেয়ে ফেলেছে। গোড়াটা পাকা করে বাঁধানো। তার তলায় শুয়ে আছে নিশকাইন্দা দেওয়ের মাটির ক্ষয়িষ্ণু অবয়ব, বিশাল দেহ, প্রায় ৪০ ফুট লম্বা আর ৩০ ফুট চওড়া। কে এই নিশকাইন্দা দেও তা কেউ বলতে পারে না। কারও কারও ধারণা, ওটা শিবের এক ভয়ংকর রূপ। প্রতিবছর পৌষসংক্রান্তির দিন সে গাছের তলায় বিরাট মেলা বসে, নিশকাইন্দা দেওয়ের পূজা হয়। ঢাক বাজে, উলুধ্বনি ও শঙ্খধ্বনিতে সে বটতলাটা উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। ভক্তরা মাটির ঘোড়া গাছের তলায় রেখে মানত করে। বড় বড় জটায়, থামের মতো গুঁড়িতে সিঁদুর-তেল দিয়ে দেবতার প্রতীক আঁকে। সে গাছটা স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে হয়ে উঠেছে এক পবিত্র বৃক্ষ। স্থানীয় বাসিন্দাদের ধারণা, গাছটার বয়স প্রায় ৩০০ বছর। গ্রামবাসীর ধারণা, বলধারার সে গাছটাই গ্রামকে ঝড়ঝাপটা ও বিপদ-আপদ থেকে শত শত বছর ধরে রক্ষা করে চলেছে। তাই ওর প্রতি তাদের এ মান্যতা। কিন্তু যে গাছকে তারা বটবৃক্ষ বলে, নামটা যার কারণে হয়েছে বলধারার বটতলা, আসলে সেটি বটগাছ না, অশ্বত্থ না। ড. নওয়াজেশ আহমদেরও সন্দেহ ছিল ওটা নিয়ে, ভেবেছিলেন পাকুড়গাছ। সে যাই হোক, গাছটি যে অনেক প্রাচীন ও পবিত্র, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

এরূপ আরও দুটি প্রাচীন গাছের দেখা পেলাম এ মাসেই। নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার হিরনাল গ্রামে সে গাছ দুটি রয়েছে। এর একটি বটগাছ, অন্যটি খিরনিগাছ। পাশাপাশি দুটি গাছের অবস্থান। বটগাছটা প্রায় তিন বিঘা জমিজুড়ে ডালপালা ছড়িয়ে জায়গাটা অন্ধকার করে ফেলেছে। অনেক খুঁজেও সে বটগাছের মূল গাছ বা গোড়া কোনটি, তা দেখতে পেলাম না। অসংখ্য ঝুরি নামিয়ে মোটা মোটা থামের মতো করে তা দিয়ে ঠেক দিয়ে রেখেছে ভারী ডালপালাগুলোকে। সে বটতলাতেও স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা পূজা করে, মানত করে। কুলাদি মৌজায় অবস্থিত সে গাছটি হিরনাল বটগাছ নামে পরিচিত। অনেকের ধারণা, বটগাছটির বয়স হবে প্রায় ৪০০ বছর। এর কাছেই রয়েছে এর চেয়েও বয়সী আরেকটি গাছ, সেখানকার অনেকেরই ধারণা সে গাছটির বয়স হবে কমপক্ষে ৫০০ বছর। সেটি বট না, খিরনিগাছ। পাশে হজরত শাহ আল হাদী (র.)-এর মাজার। সে বিশাল গাছটির গোড়াটা বৃত্তাকার বেদি করে বাঁধানো। সে গ্রামে ওই খিরনিগাছটিও পেয়েছে পবিত্র বৃক্ষের মর্যাদা, কেউ তার একটা পাতাও ছেঁড়ে না। মানত করে তা পূরণ হলে কেউ কেউ খিরনিতলায় এসে শিরনি দিয়ে যায়। এভাবেই যুগের পর যুগ ধরে মানুষের প্রগাঢ় বিশ্বাস ও ভয় গাছগুলোকে টিকিয়ে রেখেছে। গাছগুলোও গ্রামের মানুষকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে আগলে রাখছে।

রংপুরের পীরগাছা উপজেলার ইটাকুমারী জমিদারবাড়িতেও আছে প্রায় আড়াই শ বছর বয়সী একটি কাঠগোলাপগাছ। বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার ব্রাহ্মণবাড়িয়া গ্রামে আছে প্রায় ২০০ বছর বয়সী একটি শিমুলগাছ। ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার গ্রামে আছে ২২০ বছর বয়সী একটি সূর্যপুরী আমগাছ। গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার হিরণ্যকান্দিতে আছে একটি শতবর্ষী আমগাছ। বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার কাটাখালী গ্রামের কাছে আছে একটি প্রাচীন গাবগাছ। ধারণা করা হয়, এশিয়ার বৃহত্তম ও সবচেয়ে বেশি বয়সী একটি গাবগাছ আছে মাগুরা জেলার সদর উপজেলার রাঘবদাইড় ইউনিয়নের পাটকেলবাড়িয়া গ্রামে। এ দুটি গাবগাছেরই বয়স হবে কয়েক শ বছর। চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার শুড়রা গ্রামে আছে প্রায় ৫০০ বছর বয়সী একটি তেঁতুলগাছ, যা তেভাগা আন্দোলন ও সাঁওতাল বিদ্রোহের নীরব সাক্ষী হয়ে বেঁচে আছে। এসব সুসংবাদের পাশাপাশি দুঃসংবাদও শুনতে পাই। রাজশাহীর তানোরের অমৃতপুর গ্রামের সেই শতবর্ষী তেঁতুলগাছটা কেন কাটা পড়ল?

ঢাকা শহরেও কিছু শতবর্ষী বৃক্ষ আছে। এগুলোর মধ্যে হেয়ার রোডের পাদাউক, রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার সীমানাপ্রাচীরের কোলে ব্ল্যাকবিন গাছ, ফুলার রোডে উদয়ন স্কুলের সামনে থাকা তেঁতুলগাছ ও রোডের মুখে থাকা বিশাল আকৃতির রেইনট্রিগাছ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শামসুন্নাহার হল ও টিএসসির সামনে আছে শতবর্ষী বুদ্ধ নারকেলগাছ, কার্জন হলের সামনে আছে শতবর্ষী নাগলিঙ্গম ও মেহগনিগাছ, একটু দূরেই আছে কনকচূড়া ও গ্লিরিসিডিয়াগাছ। রমনা পার্কের মধ্যে আছে বিশাল আকৃতির দুটি ছাতিমগাছ। এ ছাড়া সেখানে আছে শতবর্ষী মহুয়া ও কুসুমগাছ। লেদার টেকনোলজি কলেজ চত্বরে আছে একটি প্রাচীন খিরনিগাছ। এ রকম শত শত প্রাচীন বৃক্ষ পাওয়া যাবে সারা দেশে।

অতীতে প্রায় গ্রামেই একটা বিশাল বটগাছ থাকত। সে বটগাছগুলো বিভিন্ন দেবতার থান (স্থানের বিকৃত শব্দ) হিসেবে পরিচিতি পেত। সেসব থানে প্রতিবছর বিশেষ কোনো দিনে বিশেষ দেব-দেবীর পূজা হতো, এখনো কোথাও কোথাও তা হয়। বটতলায় মেলা ও হাটবাজার বসত। নদীর ধারে খেয়াঘাটের পাড়ে বট আর অশ্বত্থগাছ লাগানো হতো, যাতে খেয়ার যাত্রীরা সেখানে জিরিয়ে অপেক্ষা করতে পারে। এমনকি অনেক স্কুলের বিশাল মাঠের কোণে থাকত বিশাল বিশাল বৃক্ষ, যার তলায় শিশুরা খেলত। আজ সেসব অনেকের কাছেই অতীতের স্মৃতি। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীপল্লিতে গিয়েও দেখেছি, সেসব গ্রামে অন্তত একটি প্রাচীন বৃক্ষ রয়েছে। মারমা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা কোনো স্থানে তাদের নতুন বসতি স্থাপনের আগে প্রথমে সে জায়গায় একটি তেঁতুলগাছ লাগিয়ে রেখে আসে। কয়েক বছর পর সেখানে গিয়ে যদি দেখতে পায় যে গাছটি খুব বেড়েছে, তাহলে সে জায়গায় তারা নতুন বসতি স্থাপন করে। সে তেঁতুলগাছই যেন ওদের রক্ষক ও প্রহরী হয়ে দাঁড়ায়।

কেন একটি প্রাচীন বৃক্ষ কোনো এলাকার মানুষের জন্য রক্ষক হবে না? একটি বর্ষীয়ান আমগাছ গড়ে দিনে ১০০ গ্যালন পানি তার পাতার মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলে ছেড়ে সে এলাকাকে শীতল করে দেয়। এটা অনুভব করা যায় ঢাকা শহরেই, মতিঝিল থেকে ফিরে হঠাৎ করে বুয়েট ক্যাম্পাসে ঢুকলে, আহা কী প্রশান্তি আর শীতলতা সেখানে! তাই যেকোনোভাবে হোক এ দেশের প্রাচীন ও পবিত্র গাছগুলো যত দিন নিজেরা বাঁচতে চায়, তত দিন তাদের বাঁচতে দিতে হবে। আশার কথা যে সরকার ইতিমধ্যে দেশের প্রাচীন বৃক্ষগুলোকে জাতীয় ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে। বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২-এর ধারা ২৩ (১) অনুযায়ী স্মারক বৃক্ষ, পবিত্র বৃক্ষ ও প্রাচীন বৃক্ষগুলোকে রক্ষার ঘোষণা দিয়েছে। আবেদন জানিয়েছে সেগুলো সংরক্ষণের স্বার্থে ৫০ বছরের বেশি বয়স্ক গাছগুলোকে চিহ্নিত করে তালিকা তৈরি করতে। এ বিষয়ে আমাদের আশপাশে এরূপ যেসব বৃক্ষ রয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করে তার তথ্য আমাদেরই সরকারকে তথা বন অধিদপ্তরকে জানাতে হবে। স্থানীয়ভাবে নিজেরা সচেতন হয়ে সেগুলো রক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারের পক্ষে কখনো প্রতিটি গাছের পাশে পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা করা সম্ভব না, বিষয়টা হাস্যকরও বটে। আর গবেষকদের দায়িত্ব হবে, তালিকা তৈরির পর সেসব গাছের সঠিক বয়স নিরূপণপূর্বক ডেটাবেইস তৈরি করা, এসব গাছের ইতিহাস উদ্ধার করা।

মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলা ফুল বেঁচে থাক

রাজিউল হাসান
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

‘এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি/নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’—শিশুর জন্য পৃথিবীর জঞ্জাল সরাতে চেয়েছিলেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। মাঝেমধ্যেই আমরা নানা আয়োজনে, নানা কারণে তাঁর ‘ছাড়পত্র’ কবিতার এই পঙ্‌ক্তিগুলো আওড়াই। দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা দিই, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আমরা বিশ্বটাকে আরও বাসযোগ্য করব। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি কতটা রাখতে পারছি? জঞ্জাল তো সরছেই না, বরং এই আধুনিক যুগেও পৃথিবীর বুকে শ্বাস ফেলতে না ফেলতেই কিছু নবজাতকের ঠাঁই হয় আবর্জনার স্তূপে, অকারণে-নিঃশব্দে ঝরে যায় তাদের প্রাণ।

পৃথিবীটা সুন্দর। জীবন আরও সুন্দর। কিন্তু এত এত সুন্দরের মাঝে সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা সম্ভবত ডাস্টবিনে নবজাতকের ঠাঁই হওয়া। আবর্জনার স্তূপ কেন কিছু নবজাতকের ঠিকানা হচ্ছে, তার কারণ অনুসন্ধান এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। প্রতিটা প্রাণই গুরুত্বপূর্ণ। সেই প্রেক্ষাপট থেকে জীবন বাঁচানোর দিকে মনোযোগ আকর্ষণই এ লেখার উদ্দেশ্য। কারও জীবনে সেই নবজাতক সন্তান অনাকাঙ্ক্ষিত বলেই নিজের কিংবা সঙ্গীর নাড়ি ছেঁড়া ধনকে এভাবে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। সভ্য জগতে এমনটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।

মানবাধিকার সংগঠন সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের তথ্যের বরাত দিয়ে দৈনিক দেশ রূপান্তর পত্রিকায় গত ১০ জানুয়ারি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ২০২৪ সালে সারা দেশে মোট ৯৪টি নবজাতক উদ্ধার হয়েছে। তার মধ্যে ৬৪টিই মৃত।

১২ এপ্রিল ‘বিশ্ব পথশিশু দিবস’ সামনে রেখে গত ১০ এপ্রিল জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে ‘ডা. মুজিব নিউবর্ন ফাউন্ডেশন’। এই সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, নবজাতকসহ বিভিন্ন বয়সী শিশুদের নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠনগুলোর পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরে প্রায় ১০ হাজার পথশিশু ও নবজাতকের সন্ধান মিলেছে। তাদের মধ্যে ৮০০ ছিল নবজাতক। ২০২৪ সালে উদ্ধার হওয়া নবজাতকদের ৬৮ শতাংশই উদ্ধার হয়েছে মৃত অবস্থায়। অথচ পৃথিবীর নতুন এই অতিথিদের জীবন এভাবে চোখ মেলার আগেই শেষ হওয়ার কথা ছিল না। তাদের থাকার কথা ছিল মায়ের কোলে, পরিবারের আলো হয়ে। কিন্তু তা না হয়ে তাদের ঠিকানা হয়েছে আবর্জনার স্তূপে।

অথচ এর বিপরীত চিত্রও রয়েছে আমাদের সমাজে। একটা সন্তানের জন্য অনেক দম্পতির জীবন অপূর্ণ থেকে যাচ্ছে। ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলা সেই নবজাতকের সঙ্গে যদি কোনোভাবে ওই সব দম্পতির যোগসূত্র ঘটিয়ে দেওয়া যায়, তাহলেই কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। একটু সচেতন আর উদ্যোগী হলে এই যোগসূত্র ঘটানো সম্ভব, ঠেকানো সম্ভব নতুন প্রাণগুলোর ঝরে পড়া।

একটি শিশু যখন জন্ম নেয়, তার প্রতি যেমন মা-বাবার দায়িত্ব থাকে, একইভাবে দায়িত্ব থাকে রাষ্ট্রেরও। উন্নত বিশ্বে শিশুর দায়দায়িত্ব পালনে মা-বাবা ব্যর্থ হলে রাষ্ট্র রীতিমতো হস্তক্ষেপ করে বসে। বলিউডে এ নিয়ে একটি ছবিও আছে—‘মিসেস চ্যাটার্জি ভার্সেস নরওয়ে’। ছবিটিতে যদিও কোল থেকে সন্তান কেড়ে নেওয়ার পর একজন মায়ের আকুতি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু সেখানে বড় একটি বার্তাও আছে। নরওয়ে, ফিনল্যান্ডসহ উন্নত রাষ্ট্রগুলো মনে করে, আজকের শিশু আগামী দিনের সম্পদ। কাজেই তার সুরক্ষা, তাকে বড় করে তোলার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। মা-বাবা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সে দায়িত্ব পালন করবেন। তাঁরা যদি কোনোভাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন, তাহলে রাষ্ট্র নিজেই সে দায়িত্ব নিয়ে নেবে।

এমন ব্যবস্থার কারণেই উন্নত বিশ্বে ডাস্টবিন কখনো কোনো নবজাতকের ঠিকানা হয় না। এমন ঘটনা কেবল ঘটে আমাদের দেশের মতো উন্নত হওয়ার চেষ্টায় থাকা দেশগুলোয়। কারণ, এখানে এখনো আজকের শিশুকে আগামীর সম্পদ বলে মনে করা হয় না।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে, এমন মর্মান্তিক ঘটনা ঠেকানোর উপায় কী? আমাদের দেশে অবশ্য একটি সমাধান আছে। সেটা হলো সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতাধীন ‘ছোটমনি নিবাস’। সারা দেশে ছয়টি বিভাগে পিতৃ-মাতৃ পরিচয়হীন ০-৭ বছর বয়সী উদ্ধারকৃত শিশুদের এখানে লালনপালন করা হয়। কিন্তু ডাস্টবিনে পড়ে থাকা শিশুকে উদ্ধার করে সেই নিবাস পর্যন্ত নিয়ে যেতে হয়। এর পাশাপাশি যদি হাসপাতালগুলোয় ‘নবজাতক ব্যাংক’ থাকত, তাহলে হয়তো ডাস্টবিনে নবজাতকের ঠাঁইই হতো না। তারপরও যদি কোনো নবজাতককে ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলা হয়, তার জীবন অন্তত সেই আবর্জনার স্তূপেই শেষ হতো না। এই ব্যবস্থা এমনভাবে করা যেতে পারে যেখানে কেউ চাইলে তাঁর ‘অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তানকে’ ডাস্টবিনে ছুড়ে না ফেলে নবজাতক ব্যাংকে রেখে যাবেন। সেখানে তাঁর পরিচয় গোপন থাকবে। আগ্রহী দম্পতিরা হাসপাতালে যোগাযোগ করে সেই ব্যাংক থেকে সন্তান দত্তক নিতে পারবেন। এতে সন্তানহীন দম্পতিরা যেমন মা-বাবা হওয়ার স্বাদ পাবেন, একইভাবে মা-বাবাহীন নবজাতকগুলোও পরিবার খুঁজে পাবে।

কেউ কেউ হয়তো বলতে পারেন, দেশজুড়ে থাকা সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের এতিমখানা, সমাজসেবা অধিদপ্তরের ‘ছোটমনি নিবাস’ থেকেই তো দত্তক নেওয়া যায়। হাসপাতালে আবার ‘নবজাতক ব্যাংক’ খোলার ঝক্কি নিতে হবে কেন? ওপরে যে তথ্যগুলো আমি উল্লেখ করেছি, তাতেই এই প্রশ্নের জবাব রয়েছে। একটি তথ্য আবার উল্লেখ করছি—২০২৪ সালে উদ্ধার হওয়া নবজাতকদের ৬৮ শতাংশই উদ্ধার হয়েছে মৃত অবস্থায়।

একটি শিশুর জন্মের পর তার কিছু সেবার প্রয়োজন হয়। সেই সেবাটা না পেলে তার জীবন ঝুঁকিতে পড়ে যায়। কাজেই একটি নবজাতককে ডাস্টবিন থেকে উদ্ধার করে ‘ছোটমনি নিবাস’ কিংবা এতিমখানায় নেওয়ার চেয়ে চিকিৎসকের কাছে নেওয়া জরুরি। হাসপাতালে যদি ‘নবজাতক ব্যাংক’ থাকে, তাহলে ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলা শিশুগুলোর জন্য সেই সেবা পাওয়া সহজ হবে। ফলে শিশুদের জীবন ঝুঁকিতে পড়বে না, অকালে ঝরবে না তাদের প্রাণ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত