Ajker Patrika

টাকা দিয়ে কেনা কাচের প্রাসাদ

মামুনুর রশীদ
টাকা দিয়ে কেনা কাচের প্রাসাদ

আমার এক বন্ধুর স্ত্রী অকস্মাৎ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। স্ত্রীটি জাপানের, তাঁর নাম কাজুকো। আমার বন্ধু জাপানে লেখাপড়া করতে যান এবং সেখানেই তাঁদের পরিচয়, বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক তৈরি হয়। পরিচয়ের কারণ, আমাদের দেশে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ত্রাণ কার্যক্রমে তরুণী কাজুকো অংশ নিয়েছিলেন এবং পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধের সময় জাপানের জনগণ ব্যাপকভাবে এগিয়ে আসে। আমার বন্ধুর সঙ্গে কাজুকোও ঝাঁপিয়ে পড়েন। তারপর ১৯৭৩ সালে তাঁরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং চিরদিনের জন্যই বাংলাদেশে চলে আসেন। পরবর্তীকালে সন্তানাদি নিয়ে এ দেশের সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়ে পড়েন। তাঁর অকস্মাৎ মৃত্যুতে আমরা শোক ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ি। কারণ, এ ধরনের মানুষ খুবই বিরল। যাঁরা সুখে-দুঃখে সব সময় তাঁদের সুন্দর হাসিটি দিয়ে অন্যদের প্রভাবিত করতে পারেন।

কাজুকোর মৃত্যুর কয়েক দিন পর তাঁর পরিবার একটি প্রার্থনাসভার আয়োজন করে। তাঁর পুত্র হুন একটি স্মরণ পাঠ করেন। সংক্ষিপ্ত সেই স্মৃতিচারণায় যে বিষয়টি এখনো মনে পড়ে, তা হলো তাঁর মা কী কী শিখিয়েছিলেন। প্রথম কথাই ছিল, ভ্যালু অব মানি—টাকার মূল্য কী? দ্বিতীয়টি সম্ভবত ভ্যালু অব টাইম। টাকার মূল্য বোঝাতে গিয়ে অর্থনীতির জটিল প্রক্রিয়া তিনি নিশ্চয় শেখাননি। একজন শিশুকে কতটা বলা যায়, তা মা জানতেন। তাই বিষয়টি সীমাবদ্ধ ছিল ছোট্ট কতগুলো কথা দিয়ে। অর্থের প্রয়োজন আছে। তোমার টিফিনের জন্যও অর্থ লাগে। মানুষের ক্ষুধা মেটাবার জন্য অর্থের প্রয়োজন হয়। বিনোদনের জন্যও টাকার দরকার। কিন্তু কত দরকার? এই দরকারটি মেটাবার জন্য তোমার প্রস্তুতির প্রয়োজন। প্রয়োজনকে আবার তত সংকুচিত হতে বলেননি, কৃপণও হতে বলেননি। কিন্তু অর্থ যেন অনর্থ ডেকে না আনে।

আমরা দেখেছি, কাজুকো পরিবার সাধারণ জীবন-যাপন করতেন। একেবারেই বিলাসবহুল নয়। কিন্তু খাবারদাবার, বাড়িতে নিমন্ত্রণ, উপহার—এসব বিষয়ে তেমন কোনো কার্পণ্য ছিল না। ছেলেমেয়েরা বড় হয়েও একইভাবে জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হয়েছেন। সময়ের ব্যাপারে জাপানিরা ভীষণ সচেতন। ব্রিটিশরা যথাসময়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু জাপানিদের যথাসময় মানে এক ঘণ্টা আগে। ১০টার সভা মানে ৯টায় গিয়ে পৌঁছানোই জাপানিদের নিয়ম। এইভাবে সময়ের শৃঙ্খলা রাখতে রাখতে একজন মানুষের জীবন-যাপনে অনেক সুনিয়ম চলে আসে। টাকার মূল্য, সময়ের মূল্য—এসব বুঝতে বুঝতে একজন চরিত্রবান মানুষ হয়ে পড়ে। জাপানের স্কুলগুলোতেও এই শিক্ষা হয়তো নিয়মিত দিয়ে থাকে। জাপানে এইসব নিয়মানুবর্তিতা অকস্মাৎ আসেনি। তাদেরও একসময় সামন্তবাদী আচরণ ছিল, যুদ্ধবিগ্রহ ছিল। একসময় তারা মহাযুদ্ধেও জড়িয়ে পড়েছিল।

১৯৪৫ সালে হিরোশিমা-নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণের পরে তাদের নতুন করে বোধোদয় ঘটে। এই শুভবুদ্ধির আগমনে তাদের ভবিষ্যৎ পাল্টে যায় এবং জাপান পৃথিবীর সুসভ্য, সুশৃঙ্খল এবং শিল্পবিপ্লবের দেশ হয়ে দাঁড়ায়।

আমাদের দেশেও একটা মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আমরাও স্বাধীনতা পেয়েছি। স্বাধীনতার পরেও আমাদের বিপর্যয় থেমে থাকেনি। হঠাৎ করে একটা সময়ে সমাজে টাকা একটা বড় বিষয় হিসেবে দাঁড়ায়। টাকার মূল্যটা সমগ্র মানবিক মূল্যবোধের প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। শিক্ষা, সুনিয়ম, শৃঙ্খলা, সুশিক্ষা—সবকিছুর ঊর্ধ্বে টাকা। টাকা, বস্তায় বস্তায় টাকা, গাড়িবোঝাই টাকা, ঘরের বিছানার নিচে, বাথরুমে—সর্বত্র টাকা। তারপর আবার টাকা উড়তে থাকে। উড়ে উড়ে চলে যায় বিদেশে। দেশের মানুষের প্রবাসে রক্ত হিম করা উপার্জনের টাকা দেশে ফিরে আসে নানা পথে। আবার অন্য পথে চলে যায় অন্য দেশে। টাকার এই প্রবল আধিপত্যে মানুষ বিশৃঙ্খল হতে শেখে। সবকিছুই কিনতে চায় টাকা দিয়ে। প্রেম-ভালোবাসা-প্রভুত্ব-নেতৃত্ব—সব। শেষেরটাই সবচেয়ে মারাত্মক। নেতৃত্ব।

গণতন্ত্রের জন্য তীব্র লড়াই করা মানুষেরা একদিন দেখল, টাকা দিয়ে কিছু মানুষ নেতৃত্ব কিনে ফেলছে। তারপর ভোট কিনছে। একটা সময় ভোট কেনা লাগছে না। ভোটের বাক্সটাই টাকায় ভরে গেছে। ব্যালট পেপার উধাও। এই টাকার ম্যাজিকে আটকে পড়ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। শিক্ষকদের আদর্শকে টেনে ধরছে টাকা। বিদ্যালয়ের লেখাপড়াটার স্থান পরিবর্তন হয় গেল। একটা নতুন জায়গা, যার নাম কোচিং সেন্টার। শিশুশ্রেণি থেকে একেবারেই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত কোচিং। শিক্ষকদের সঞ্চিত বিদ্যা আর শিক্ষার্থীর গলাধঃকরণ, মুখস্থ বিদ্যায় চলছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষায় কোনো মনোযোগ নেই ছাত্রের। কারণ, তার সামনেও টাকা। অশ্রম উপার্জনের পথ। চাঁদাবাজি অথবা পেশিশক্তির ব্যবহার। অপরিণত বয়সে বিশাল অর্থ ও ভোগের ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় মাঝেমধ্যে উৎপাত ঘটে। কিন্তু মিটে যায় ওই টাকার জোরেই।

টাকা একসময় একটি অভিজাত শ্রেণি তৈরি করেছিল। যে অভিজাতেরা নিজেদের প্রয়োজনেই একটা নতমুখী সমাজ তৈরি করেছিল। সেই অভিজাত শ্রেণিও এখানে তৈরি হয়নি। টাকার মালিকদের একধরনের জৌলুশ ছিল। সেই জৌলুশও নেই। এর প্রভাব গিয়ে পড়েছে শিল্পে-মিডিয়ায়-বিনোদনে। যেখানে বিনোদন মানেই ভায়োলেন্স অথবা যৌনতা। অবৈধ অর্থ উপার্জনের পর মসজিদ, মাদ্রাসা নির্মাণ করে তাকে হালাল করার প্রক্রিয়াও প্রবল। রমজান মাসের ব্যবসায় প্রচুর অর্থ কামিয়ে, সেই অবৈধ অর্থের হজ উদ্‌যাপনের হিড়িকও আছে এখানে।

কাজুকো যেমন টাকার মূল্যে সাধারণ জীবন-যাপনের চিন্তা করতেন, যে জীবন-যাপন আমরা শিক্ষক, চাকরিজীবী এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে একসময় দেখেছি, তা কোথায় যেন উবে গেল। বিনিময়ে যাঁরা এই জীবন-যাপন করছেন, তাঁদের গ্লানিভরা, পরাজয়ের কাহিনি আমাদের প্রতিদিনের হাহাকার। কিন্তু এ কথাও তো সত্যি, টাকা দিয়ে কেনা ভালোবাসা, আনুগত্য, নেতৃত্ব—এসব যে ঠুনকো কাচের প্রাসাদ, তা আর কত কাল দেখব?

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

তোরা যারা রাজাকার, সময় থাকতে বাংলা ছাড়: ফেসবুকে বাকের মজুমদার

সমাবেশে দলীয় স্লোগান ও জাতীয় সংগীত পরিবেশনে বাধা দেওয়া প্রসঙ্গে এনসিপির বিবৃতি

যুদ্ধ বলিউডের সিনেমা নয়: ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান

কঠোর হচ্ছে যুক্তরাজ্যের অভিবাসন নীতি, স্থায়ী বসবাসের আবেদনে অপেক্ষা ১০ বছর

যুক্তরাষ্ট্র-চীন সমঝোতায় এক দিনে ১০০ ডলার কমল সোনার দাম

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত