সৈয়দা সাদিয়া শাহরীন
আমরা এই প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ চোখে দেখিনি। দেখিনি বাংলাদেশের বিজয়। তাই বলে কি মুক্তিযুদ্ধকে জানব না? বিজয়কে জানব না? বিস্তর বই-পুস্তক ঘাঁটাঘাঁটির পরও কেমন যেন করতে থাকে মন।
বাবার কাছে জানতে চাই, মায়ের কাছে জানতে চাই–কেমন ছিল তোমাদের যুদ্ধ? কেমন ছিল বিজয়ের উল্লাস? মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সাহায্য করতেন আমাদের কিশোর বাবা। কখনো সংবাদ, কখনো বুলেট পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করেছেন। একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে আত্মীয়ের বাড়ি থেকে নিজের বাড়ি পালিয়ে ফিরতে ভোর হয়ে গিয়েছিল মায়ের। ঢাকা থেকে গা ঢাকা দিয়ে গাঁয়ের বাড়িতে পালিয়ে আশ্রয় নিতে হয় নানাবাড়ির সবাইকে। এমন গল্প শুনে শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায়। আর গর্বে চিকচিক করে চোখ।
বড়দের কাছে শুনেছি ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে নাকি বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এ নিয়েও একদিন জানতে চাইলাম এক বর্ষীয়ানের কাছে। সঠিক উচ্চতা আর কম ওজনের কারণে মুক্তিবাহিনীতে নাম লেখাতে পারেননি তিনি। সেই আক্ষেপ নেই। কেননা, রণক্ষেত্রে না থাকলেও যুদ্ধ করে গেছেন প্রতিনিয়ত ৯ মাস। বাড়ি পঞ্চগড় থেকে পশ্চিমবঙ্গের বালুরঘাটে সপরিবারে চলে যান এপ্রিল মাসেই। পাকিস্তানি বাহিনী তাঁদের এলাকা দখল করলে তখন আর নিজের বাড়িতে থাকতে পারেনি তাঁর পরিবার। কলেজপড়ুয়া সেই তরুণ যখন নভেম্বরের শেষের দিকে শুনলেন ধীরে ধীরে শত্রুমুক্ত হচ্ছে প্রিয় বাংলাদেশ, তখন কোনো কিছুর পরোয়া না করে ফিরে এলেন নিজ এলাকায়। রেডিও তখন সবার হাতে ছিল না। হয় অবস্থাসম্পন্ন কারও বাড়িতে, না হয় হাট-বাজারের কোনো দোকানে রেডিও শুনতে ব্যাকুল বাঙালিরা জমায়েত হতো। বন্ধুর বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া তরুণ লেপের নিচে শুয়ে রেডিও শুনতেন। সঠিক চ্যানেল আনতে কত যে টিউনিং করতে হয়েছে! এমনই এক সকালে, ডিসেম্বরের ৬ তারিখ বেতারবার্তায় শুনলেন ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। আহা কী আনন্দ! বাজারে রেডিও শুনতে জড়ো হওয়া মানুষের উল্লাসের কথা মনে করে সেখানেই যেন ফিরে গেলেন তিনি। স্মৃতি হাতড়ে আমাকে বললেন, ‘আমরা সাধারণ মানুষ চাইছিলাম যেন ভারত একটা কিছু করে। তবেই জিততে পারব আমরা। সবার এই বিশ্বাসটা ছিল। কারণ, ভারত যেভাবে শরণার্থীদের আশ্রয় দিচ্ছিল, গেরিলা বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল, তাতেই বোঝা গিয়েছিল ভারত আরেকটু সাহায্য করলেই আমরা স্বাধীনতা পাব।’ এর আগে ভারত ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তানিদের সঙ্গে যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়। ভারতের স্বীকৃতি বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি বাহিনীকে তাড়ানোর গতি ত্বরান্বিত করে।
জানতে চাইলাম আরেক গেরিলা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বর্ষীয়ানের কাছে—কেমন ছিল সেদিনের অনুভূতি? যখন জানা হলো বাংলাদেশ স্বীকৃতি পেয়েছে ভারতের কাছ থেকে? আবছা স্মৃতির গভীরে গিয়ে জানালেন রেডিওতে শুনেছেন সেই খবর। মেঘালয়ের কোনো এক পাহাড়ে প্রশিক্ষণ শেষে যুদ্ধযাত্রার অপেক্ষায় থাকতেই জানতে পেরেছিলেন ৬ ডিসেম্বরের আগে, দু-এক দিনের মধ্যে স্বীকৃতি দেওয়া হবে বাংলাদেশকে। ভারতের স্বীকৃতি পাওয়া মানে তো বিজয়ের দরজায় কড়া নাড়ার মতো অবস্থা। বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব অর্জনের প্রাক্কাল।
ফিরে যাই আবার প্রথম বর্ষীয়ানের কাছে। তাঁর এক আত্মীয় ছিলেন সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রের কম্পাউন্ডার। যতীন কম্পাউন্ডার নামেই এলাকার সবাই চিনতেন। পাকিস্তানি বাহিনীরা তাঁকে নাম জিজ্ঞেস করলে তিনি সরল মনেই উত্তর দেন, ‘যতীন কম্পাউন্ডার’। পাকিস্তানি সেনা হুংকার দিয়ে বলল, ‘ক্যায়া? তুম মুক্তি কা কমান্ডার হো?’ বলেই বুলেটের আঘাতে ঝাঁঝরা করে দিল যতীন কম্পাউন্ডারের বুক। যতীন কম্পাউন্ডারের মতো এ রকম হাজার হাজার বাঙালির ত্যাগের বিনিময়ে ধীরে ধীরে স্বাধীন হয়েছে আমাদের দেশ। সেসব গল্প আমরা শুনেই যাই, নিজেকে কল্পনা করে নিই একাত্তরের দিনপঞ্জিকায়। কখনো ৭ কিংবা ২৫ মার্চে, কখনো ১৭ এপ্রিলে, কখনো ৬ ডিসেম্বরে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর ভারত যেভাবে আমাদের যোদ্ধাদের সঙ্গে থেকে ১৬ ডিসেম্বর এনে দিতে সাহায্য করেছে, তা প্রকৃত বন্ধুর কাজ বটে।
সৈয়দা সাদিয়া শাহরীন
সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
আমরা এই প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ চোখে দেখিনি। দেখিনি বাংলাদেশের বিজয়। তাই বলে কি মুক্তিযুদ্ধকে জানব না? বিজয়কে জানব না? বিস্তর বই-পুস্তক ঘাঁটাঘাঁটির পরও কেমন যেন করতে থাকে মন।
বাবার কাছে জানতে চাই, মায়ের কাছে জানতে চাই–কেমন ছিল তোমাদের যুদ্ধ? কেমন ছিল বিজয়ের উল্লাস? মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সাহায্য করতেন আমাদের কিশোর বাবা। কখনো সংবাদ, কখনো বুলেট পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করেছেন। একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে আত্মীয়ের বাড়ি থেকে নিজের বাড়ি পালিয়ে ফিরতে ভোর হয়ে গিয়েছিল মায়ের। ঢাকা থেকে গা ঢাকা দিয়ে গাঁয়ের বাড়িতে পালিয়ে আশ্রয় নিতে হয় নানাবাড়ির সবাইকে। এমন গল্প শুনে শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায়। আর গর্বে চিকচিক করে চোখ।
বড়দের কাছে শুনেছি ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে নাকি বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এ নিয়েও একদিন জানতে চাইলাম এক বর্ষীয়ানের কাছে। সঠিক উচ্চতা আর কম ওজনের কারণে মুক্তিবাহিনীতে নাম লেখাতে পারেননি তিনি। সেই আক্ষেপ নেই। কেননা, রণক্ষেত্রে না থাকলেও যুদ্ধ করে গেছেন প্রতিনিয়ত ৯ মাস। বাড়ি পঞ্চগড় থেকে পশ্চিমবঙ্গের বালুরঘাটে সপরিবারে চলে যান এপ্রিল মাসেই। পাকিস্তানি বাহিনী তাঁদের এলাকা দখল করলে তখন আর নিজের বাড়িতে থাকতে পারেনি তাঁর পরিবার। কলেজপড়ুয়া সেই তরুণ যখন নভেম্বরের শেষের দিকে শুনলেন ধীরে ধীরে শত্রুমুক্ত হচ্ছে প্রিয় বাংলাদেশ, তখন কোনো কিছুর পরোয়া না করে ফিরে এলেন নিজ এলাকায়। রেডিও তখন সবার হাতে ছিল না। হয় অবস্থাসম্পন্ন কারও বাড়িতে, না হয় হাট-বাজারের কোনো দোকানে রেডিও শুনতে ব্যাকুল বাঙালিরা জমায়েত হতো। বন্ধুর বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া তরুণ লেপের নিচে শুয়ে রেডিও শুনতেন। সঠিক চ্যানেল আনতে কত যে টিউনিং করতে হয়েছে! এমনই এক সকালে, ডিসেম্বরের ৬ তারিখ বেতারবার্তায় শুনলেন ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। আহা কী আনন্দ! বাজারে রেডিও শুনতে জড়ো হওয়া মানুষের উল্লাসের কথা মনে করে সেখানেই যেন ফিরে গেলেন তিনি। স্মৃতি হাতড়ে আমাকে বললেন, ‘আমরা সাধারণ মানুষ চাইছিলাম যেন ভারত একটা কিছু করে। তবেই জিততে পারব আমরা। সবার এই বিশ্বাসটা ছিল। কারণ, ভারত যেভাবে শরণার্থীদের আশ্রয় দিচ্ছিল, গেরিলা বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল, তাতেই বোঝা গিয়েছিল ভারত আরেকটু সাহায্য করলেই আমরা স্বাধীনতা পাব।’ এর আগে ভারত ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তানিদের সঙ্গে যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়। ভারতের স্বীকৃতি বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি বাহিনীকে তাড়ানোর গতি ত্বরান্বিত করে।
জানতে চাইলাম আরেক গেরিলা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বর্ষীয়ানের কাছে—কেমন ছিল সেদিনের অনুভূতি? যখন জানা হলো বাংলাদেশ স্বীকৃতি পেয়েছে ভারতের কাছ থেকে? আবছা স্মৃতির গভীরে গিয়ে জানালেন রেডিওতে শুনেছেন সেই খবর। মেঘালয়ের কোনো এক পাহাড়ে প্রশিক্ষণ শেষে যুদ্ধযাত্রার অপেক্ষায় থাকতেই জানতে পেরেছিলেন ৬ ডিসেম্বরের আগে, দু-এক দিনের মধ্যে স্বীকৃতি দেওয়া হবে বাংলাদেশকে। ভারতের স্বীকৃতি পাওয়া মানে তো বিজয়ের দরজায় কড়া নাড়ার মতো অবস্থা। বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব অর্জনের প্রাক্কাল।
ফিরে যাই আবার প্রথম বর্ষীয়ানের কাছে। তাঁর এক আত্মীয় ছিলেন সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রের কম্পাউন্ডার। যতীন কম্পাউন্ডার নামেই এলাকার সবাই চিনতেন। পাকিস্তানি বাহিনীরা তাঁকে নাম জিজ্ঞেস করলে তিনি সরল মনেই উত্তর দেন, ‘যতীন কম্পাউন্ডার’। পাকিস্তানি সেনা হুংকার দিয়ে বলল, ‘ক্যায়া? তুম মুক্তি কা কমান্ডার হো?’ বলেই বুলেটের আঘাতে ঝাঁঝরা করে দিল যতীন কম্পাউন্ডারের বুক। যতীন কম্পাউন্ডারের মতো এ রকম হাজার হাজার বাঙালির ত্যাগের বিনিময়ে ধীরে ধীরে স্বাধীন হয়েছে আমাদের দেশ। সেসব গল্প আমরা শুনেই যাই, নিজেকে কল্পনা করে নিই একাত্তরের দিনপঞ্জিকায়। কখনো ৭ কিংবা ২৫ মার্চে, কখনো ১৭ এপ্রিলে, কখনো ৬ ডিসেম্বরে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর ভারত যেভাবে আমাদের যোদ্ধাদের সঙ্গে থেকে ১৬ ডিসেম্বর এনে দিতে সাহায্য করেছে, তা প্রকৃত বন্ধুর কাজ বটে।
সৈয়দা সাদিয়া শাহরীন
সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
রাজনীতির মাঠে অশালীন শব্দ ব্যবহার করলে আর মিথ্যা কথা বললে জনপ্রিয়তা বাড়ে—এ রকম বক্তব্যসহ সহকর্মী জাহাঙ্গীর আলমের লেখা একটি উপসম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছে বৃহস্পতিবারের আজকের পত্রিকায়। ব্যাপারটা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক।
১১ ঘণ্টা আগেসম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটা ভাইরাল নিউজ চোখে পড়ল। একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন ক্লিনার বকশিশ চেয়ে না পেয়ে অসুস্থ শিশুর মুখ থেকে অক্সিজেনের মাস্ক খুলে ফেলেন। এতে সেই শিশুর একপর্যায়ে করুণ মৃত্যু হয়। এমন অভিযোগ শিশুর মায়ের।
১১ ঘণ্টা আগেবাগছাস নেতা এসে স্কুলের ফেল করা শিক্ষার্থীদের বেধড়ক পিটিয়ে যাচ্ছেন—এটাকে কি রূপকথার গল্প বলে মনে হচ্ছে? মনে হচ্ছে কারও অলীক কল্পনা? চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে হারাটি উচ্চবিদ্যালয়ের অস্থায়ী (অ্যাডহক) কমিটির আহ্বায়ক হন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ আহম্মদ।
১২ ঘণ্টা আগেদেশের দু’টি সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ—ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের অভাবনীয় উত্থান সাম্প্রতিক ছাত্রসংসদ নির্বাচনে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। যে সংগঠনটি অতীতে রাজনৈতিক সহিংসতা, সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কারণে নিষিদ্ধ ছিল, তারাই কীভাবে এত সংখ্যক পদে জয়ী হলো—এই প্রশ্ন শিক্ষিত সমাজকে
১৮ ঘণ্টা আগে