Ajker Patrika

শ্রদ্ধাঞ্জলি

রনো ভাইয়ের স্মরণে

কল্লোল বণিক
হায়দার আকবর খান রনো  (৩১ আগস্ট ১৯৪২-১১ মে ২০২৪)
হায়দার আকবর খান রনো (৩১ আগস্ট ১৯৪২-১১ মে ২০২৪)

রনো ভাইকে আমরা শেষ বিদায় জানালাম আজ এক বছর হলো। সেই ষাটের দশক থেকে হায়দার আকবর খান রনো গণতান্ত্রিক সংগ্রামে, স্বাধীনতার সংগ্রামে, মানবমুক্তির সংগ্রামে অক্লান্তভাবে ভূমিকা রেখে গেছেন, কখনো রাজপথে আবার কখনো লেখনীর মাধ্যমে। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার তিনি কারা নির্যাতনও ভোগ করেছেন। বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও মৃত্যুর কয়েক দিন আগপর্যন্ত তিনি সক্রিয় ছিলেন শোষিত মানুষের পক্ষে মতাদর্শিক সংগ্রামকে এগিয়ে নেওয়ার কাজে। রনো ভাইয়ের সঙ্গে মুখোমুখি বসার সুযোগ একবার আমার হয়েছিল।

ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণার মতো তেমন বড় কিছু আমার ভাণ্ডে নেই। তবু আজকের দিনে তাঁকে স্মরণ করার তাগিদ এবং তাঁর সঙ্গে স্মৃতি ফেরি করার আকুতি নিজের মধ্যে বোধ করি। আমি যখন ছাত্র আন্দোলনের কর্মী, রনো ভাই তখন ‘ওয়ার্কার্স পার্টি’ থেকে বের হয়ে ‘ওয়ার্কার্স পার্টি পুনর্গঠিত’ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম দাঁড় করিয়েছেন। সেই বয়সে নতুন করে শুরু করার যে উদ্যোগ রনো ভাই নিয়েছিলেন, সেটা তখন আমাদের মতো তরুণদের খুব উজ্জীবিত করেছিল। সেই সময় কমরেড লেনিনের জন্মবার্ষিকীতে আমি এবং আরও কয়েকজন সহযোদ্ধা ঠিক করলাম লেনিনকে স্মরণ করার জন্য আমরা রনো ভাইয়ের কাছে যেতে পারি। লেনিনকে স্মরণ করার সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম রনো ভাই-ই হতে পারেন—এ রকমই একটা ধারণা আমাদের মধ্যে তখন তৈরি হয়েছিল।

সেই সময় রনো ভাইয়ের কাছের মানুষ অনিন্দ্য আরিফ আমাদের রনো ভাইয়ের শরণাপন্ন হতে সাহায্য করলেন। ‘ওয়ার্কার্স পার্টি পুনর্গঠিত’ দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তখন ধানমন্ডির একটি অ্যাপার্টমেন্টে একসঙ্গেই থাকেন। রনো ভাইয়ের কাছে গিয়ে সরাসরি বললাম—আজ লেনিনের জন্ম দিবস, আপনার কাছে এসেছি লেনিনকে জানতে। রনো ভাই তেমন একটা প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। কিছুক্ষণ পর খুবই কোমল স্বরে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য? তখন আমি তরুণ, সেই সময় চিন্তাজগতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ দখল করে ছিল—যে করেই হোক, দেশে একটা শ্রমিক-কৃষকের নেতৃত্বে বিপ্লব করতে হবে, যদিও বিপ্লবের অ আ ক খ কিছুই বুঝতাম না। রনো ভাইকে উত্তর দিলাম—হ্যাঁ, সদস্য। কিন্তু ওরা যদি বিপ্লব করতে না চায়, তবে ওদের সঙ্গে থাকব না। যারা করবে, তাদের সঙ্গেই যাব। রনো ভাই কিছু বললেন না। কিছুক্ষণ কোনো কথা নেই। খানিকক্ষণ পায়চারি করে একটা সিগারেট ধরিয়ে সোফার ওপর বসলেন। রনো ভাই এবার বলতে শুরু করলেন।

ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির কয়েকজন নেতা গোপনে একবার মস্কো গিয়েছিলেন ভারতে বিপ্লবের রূপরেখা তৈরি করার জন্য। সময়টা ১৯৫০ সালের দিকে হবে। উদ্দেশ্য ছিল সোভিয়েত পার্টির নেতা স্তালিনের সঙ্গে বসে তাঁরা ভারতে বিপ্লবের রূপরেখা দাঁড় করাবেন। রনো ভাই বললেন যে খুব সম্ভবত যোশী, ডাঙ্গে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিদের মধ্যে ছিলেন এবং কোনো একটা প্রকাশনায় এ বিষয়ে পরবর্তীকালে তারা প্রকাশ করেছিল।

ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির, অর্থাৎ সিপিআইয়ের নেতারা মস্কোয় পৌঁছানোর পর সোভিয়েত পার্টির ভলান্টিয়াররা তাদের নিয়ে বেশ কয়েক দিন বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান ঘুরে বেড়ালেন। এভাবে বেশ কিছুদিন কেটে গেল। আট-দশ দিন পার হয়ে যাওয়ার পর সিপিআইয়ের নেতারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি শুরু করলেন যে আমরা বিপ্লবের রূপরেখা নির্ধারণ করতে এসেছি, অথচ তার তো কোনো উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছি না, ঘুরতে ঘুরতেই দিন কেটে যাচ্ছে। এ রকম সময় একদিন তাঁদের নিয়ে যাওয়া হলো মাটির নিচে একটি ঘরে। ওই ঘরে আসবাব বলতে ছিল একটি লম্বা টেবিল আর চারপাশে ছড়ানো-ছিটানো চেয়ার। কিছুক্ষণ পর একজন লম্বা-চওড়া লোক এসে হ্যান্ডশেক করার জন্য তাঁদের উদ্দেশে হাত বাড়িয়ে দিলেন। সিপিআইয়ের নেতারা ওই পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছিলেন যে প্রথম দর্শনেই লম্বা-চওড়া লোকটিকে দেখে মনে হয়েছিল অনেকটা স্তালিনের মতো দেখতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁরা নিশ্চিত হলেন এইতো স্তালিন। এই ছিল তাঁদের স্তালিনের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা।

তারপর কমরেড স্তালিনের সঙ্গে শুরু হলো আলাপ-আলোচনা। আলোচনা চলতে লাগল বেশ কয়েক দিন ধরে। স্তালিন গভীর মনোযোগ দিয়ে তাঁদের কথা শুনতেন এবং বিভিন্ন সময়ে পরামর্শ দিতেন। এই আলোচনার একপর্যায়ে স্তালিন সিপিআইয়ের নেতাদের কাছে পার্টির রণনীতি ও রণকৌশল চাইলেন। কিন্তু উপস্থিত ভারতীয় নেতারা তাঁদের পার্টির রণনীতি ও রণকৌশল সম্পর্কে নিজেরাই সঠিকভাবে ওয়াকিবহাল ছিলেন না। তখন স্তালিন বললেন, ‘আপনারা যেহেতু তৃতীয় আন্তর্জাতিকে উপস্থিত ছিলেন, তাই আপনাদের রণনীতি ও রণকৌশল নিশ্চয়ই আমাদের কাছে আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে।’ সেখান থেকে ডকুমেন্টস সংগ্রহ করে আলোচনা ও পর্যালোচনা চলতে লাগল। সিপিআইয়ের নেতারা বলেছিলেন যে সেই আলোচনা-পর্যালোচনা চলতে চলতে, অর্থাৎ বিপ্লবের রূপরেখা তৈরি করতে করতে আমাদের সঙ্গে কমরেড স্তালিনের এমন সম্পর্ক হয়েছিল যে যদি কোনো বিষয়ে আমাদের কমরেড স্তালিনের কোনো মতামত বা চিন্তা সঠিক নয় বলে মনে হতো, তখন আমরা তাঁর মুখের ওপর বলতে পারতাম—কমরেড, আপনি ভুল করছেন। সিপিআই নেতারা সেই স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেন যে তাঁরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলেন, ঠিক যখন বৈঠক শেষ পর্যায়ে। তাঁরা তখন কমরেড স্তালিনের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠকের মাধ্যমে বিপ্লবের একটা রূপরেখা তৈরি করেছেন। এবার বিদায় নেওয়ার পালা। স্তালিন তখন তাঁদের বললেন, ‘আপনারা যদি ভারতে গিয়ে দেখেন যে ভারতের সমাজব্যবস্থার যে বিশ্লেষণ আমরা দাঁড় করালাম, তার সঙ্গে ভারতের বিদ্যমান বাস্তবতার মিল হচ্ছে না, তাহলে এত দিন ধরে আমরা যেই রূপরেখা দাঁড় করালাম, তা ছিঁড়ে ফেলে দেবেন।’ রনো ভাই এই ছিঁড়ে ফেলা বিষয়টির মর্ম সেদিন উপলব্ধি করতে শিখিয়েছিলেন। আজও সেটাই পথ চলার জ্বালানি হিসেবে শক্তির জোগান দিয়ে যাচ্ছে। হায়দার আকবর খান রনোর সঙ্গে বসে তাঁর জবানিতে এমন ইতিহাসের পাঠ শোনা, যা ঠিক বই-পুস্তকে পড়া হয়নি, সেটা আমার সেই জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

সিপিআইয়ের নেতাদের বিপ্লবের রূপরেখা তৈরির গল্প শেষ হতেই সেদিন আমরা রনো ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলাম। রনো ভাইয়ের বাসা থেকে ফেরার সময় মনে হচ্ছিল যে, লেনিনের জন্মদিন উদ্‌যাপনের সিদ্ধান্তটি আমাদের যথার্থই ছিল। যদিও লেনিনের কোনো গল্প শোনা হলো না, তাতে কি, স্তালিনই তো ছিলেন লেনিনের যোগ্য উত্তরসূরি, যিনি সোভিয়েত রাশিয়াকে নিয়ে গিয়েছিলেন উন্নতির শিখরে, যাঁর নেতৃত্বে তখন বিশ্ব ফ্যাসিজমের অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়েছিল। রনো ভাইয়ের সঙ্গে আমার আর মুখোমুখি বসার সুযোগ হয়নি। তবে বিগত আগস্ট অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে তাঁর অনুপস্থিতি খুবই উপলব্ধি করেছি। কারণ, অনেককেই বলতে শুনেছি, অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি শ্রেণি দৃষ্টিকোণের আলোকে বিশ্লেষণ করে করণীয় নির্ধারণে রনো ভাই দিতে পারতেন গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা।

লেখক: কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ ক্ষেতমজুর সমিতি

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পুরোনো রাউটার ফেলে না দিয়ে যে কাজে ব্যবহার করতে পারেন

পাকিস্তানের সামরিক ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতার সামনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে ভারত: ব্রিটিশ বিশ্লেষক

কী লিখেছিলেন মাহফুজ আলম, ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে ডিলিট করলেন কেন

প্রশাসনিক আদেশে জামায়াত নিষিদ্ধ ভুল, আ.লীগের কার্যক্রম বন্ধ সঠিক: বিএনপি

প্রথম ভাষণে গাজা প্রসঙ্গে যা বললেন পোপ লিও চতুর্দশ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত