Ajker Patrika

নেদারল্যান্ডসে স্মার্ট ফলবাগান

শাইখ সিরাজ
নেদারল্যান্ডসে ডেলফির ফলবাগানে রেনের সঙ্গে কথা বলছেন লেখক।  ছবি: হৃদয়ে মাটি ও মানুষ
নেদারল্যান্ডসে ডেলফির ফলবাগানে রেনের সঙ্গে কথা বলছেন লেখক। ছবি: হৃদয়ে মাটি ও মানুষ

পৃথিবীতে আধুনিক কৃষিশিল্পের বিকাশে বদ্বীপ রাষ্ট্র নেদারল্যান্ডস যে অনন্য ভূমিকা রেখেছে, তা নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর। শুধু কৃষিপণ্য উৎপাদন নয়, কৃষি গবেষণা, প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং কৃষিজ্ঞানকে অর্থনৈতিক সম্পদে রূপান্তরে দেশটি আজ বৈশ্বিক দৃষ্টান্ত। ফলে ধীরে ধীরে নেদারল্যান্ডস হয়ে উঠেছে আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তির সূতিকাগার। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব যখন ক্রমেই প্রকট হচ্ছে, তখন টেকসই কৃষি ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তির ব্যবহার যে অপরিহার্য—সেই সত্যটিই বাস্তবভাবে প্রমাণ করছে তারা।

প্রিয় পাঠক, এর আগে আমি নেদারল্যান্ডসের কৃষিপ্রযুক্তি ও গবেষণার নানা দিক আপনাদের সামনে তুলে ধরেছি—ওয়ার্ল্ড হর্টি সেন্টার, ফ্লোটিং ফার্ম, রয়্যাল আইকোলকাম্প কিংবা ভাগেনিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগার। এবার বলব প্রযুক্তিনির্ভর ফলবাগান ব্যবস্থাপনার এক অনন্য অভিজ্ঞতার কথা।

নেদারল্যান্ডসে কৃষি ঘিরে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। তার মধ্যে অন্যতম ‘ডেলফি’। ফলবাগান ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি করেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এবং ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) ব্যবহার করে ফল উৎপাদনে এনেছে নতুন ধারা। শুধু প্রযুক্তি সরবরাহ নয়, ফলবাগান গড়ে তুলতেও তারা দিচ্ছে কারিগরি সহায়তা।

বছর তিন আগে এপ্রিল মাসে আমি গিয়েছিলাম নেদারল্যান্ডসের জিল্যান্ড অঞ্চলে—যা ফলবাগানের জন্য বিখ্যাত। সেখানে পরিচয় হলো দীর্ঘদেহী তরুণ রেনে বলের সঙ্গে। তিনি ডেলফির ফল উৎপাদন বিভাগের প্রধান। আমাদের নিয়ে গেলেন ২০ হেক্টর আয়তনের একটি ফলবাগানে, যেখানে ছিল পিয়ার ও আপেল চাষ।

রেনে জানালেন, তিনি মূলত ডেলফির কনসালটেন্ট। বাগানটি তিনি পরিচালনা করেন তাঁর চাচাকে নিয়ে। পুরো এলাকায় ফলচাষিদের প্রযুক্তি শেখানোই তাঁর মূল কাজ। সহজ করে বললে, তাঁরা প্রযুক্তিজ্ঞান বিক্রি করছেন।

আমরা যে সময়টিতে গিয়েছিলাম তখন ছিল ফুল আসার মৌসুম। সাড়ে তিন হেক্টর জমিতে পিয়ার, আট হেক্টরে আপেল এবং বাকি জায়গায় অন্যান্য ফল। গাছে গাছে ফুল আর নতুন ফলের আভাস। রেনে একটি ডাল দেখিয়ে বললেন, প্রতি ডালে সাধারণত তিনটি ফল আসে। এর মধ্যে একটি স্বাভাবিকভাবে শক্তিশালী হয়। বাকি দুটি সরিয়ে ফেলতে হয়, যাতে ভালো মানের ফল পাওয়া যায়।

এক একটি গাছে ৬০০ থেকে ৭০০ ফল এলেও তাঁরা রাখেন মাত্র ১০০টি। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, এতে প্রতিটি ফলের আকার হয় ৬০-৭৫ মিলিমিটার, যা সুপারশপে সবচেয়ে বেশি চাহিদার। যদি ১৫০টি রাখা হয় তবে ফল ছোট হয়ে যায়, দামও কমে যায়।

রেনে জানালেন, বাগানে ১০ শতাংশ গাছ থাকে ‘পলিনেশন ট্রি’, যা মৌমাছি ও বাতাসের মাধ্যমে পরাগায়নে সহায়তা করে। বাগানের সেচ ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ স্মার্ট প্রযুক্তিনির্ভর। রেনে মোবাইল ফোনে দেখালেন কীভাবে তিনি দূর থেকেই সেচ চালু বা বন্ধ করতে পারেন। ড্রিপ ইরিগেশনের পাইপ মাটি থেকে উঁচুতে বসানো, যাতে মেশিন দিয়ে সহজে আগাছা পরিষ্কার করা যায়।

প্রতি হেক্টরে আছে ৩ হাজার গাছ। প্রতিটি গাছের বয়স ২৫-৩০ বছর হলেও উচ্চতা ৭ ফুটের বেশি নয়। কারণ, প্রতিবছর ফলন শেষে গাছগুলোকে ভালোভাবে প্রুনিং করা হয়। রেনে একটি পিয়ার গাছ দেখালেন—২৫ বছরের পুরোনো হলেও এর একটি ডাল মাত্র দুই বছরের। নতুন ডালে ফল হয় বেশি বলিষ্ঠ, পুরোনো ডালে হয় দুর্বল।

রেনের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি হেক্টরে ৫০-৫৫ হাজার কেজি ফল পাওয়া যায়। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মৌসুমের সময় ঠিকঠাক না থাকায় তাঁদেরও হিমশিম খেতে হয়। বসন্ত যেন আগেভাগেই চলে আসে। প্রযুক্তি ছাড়া এই সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।

আপেল বাগানে লক্ষ করলাম সেন্সর বসানো আছে, যা প্রতি মুহূর্তে মাটির আর্দ্রতা মাপছে। প্রয়োজন হলে অ্যালার্ম দেয়। এটাই আসলে স্মার্ট ফলবাগান।

কিন্তু চমকপ্রদ বিষয় ছিল ‘অ্যান্টি হেইল প্রোটেকশন মেশিন’। নেদারল্যান্ডসে বছরে গড়ে ১০ বার শিলাবৃষ্টি হয়। ফলের মারাত্মক ক্ষতি হয়। এই মেশিন শিলাকে আকাশেই ভেঙে পানি করে ফেলে। ৫০ হেক্টর জমি রক্ষা করতে পারে একটি মেশিন। তাই ৯ জন কৃষক মিলে যৌথভাবে কিনেছেন ৯টি মেশিন।

এলস্টার জাতের আপেল আগস্ট-সেপ্টেম্বরে সংগ্রহ করা হয়। মৌমাছির বাক্সও দেখলাম, যা চাষিরা মৌসুমে নিয়ে আসেন। এতে পরাগায়ন হয়, পাশাপাশি মধু সংগ্রহ করেন তাঁরা।

রেনে আমাদের নিয়ে গেলেন স্টোরেজ রুমে। সেখানে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সারা বছর ফল সংরক্ষণ করা হয়। মৌসুমে ফল বেশি থাকায় দাম কমে যায়, তাই তাঁরা ফল জমিয়ে রেখে মৌসুম শেষে বাজারে ছাড়েন, যখন দাম বেশি থাকে। এতে লাভও বাড়ে। ভাগেনিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা থেকেও তাঁরা সহযোগিতা নিচ্ছেন, যাতে ফলের শেলফ লাইফ বাড়ানো যায়।

এ বিশাল বাগানজুড়ে শ্রমিকের সংখ্যা চোখে পড়ল খুবই কম। সবকিছুই প্রযুক্তিনির্ভর। সেচ, সার, সংরক্ষণ, এমনকি শিলাবৃষ্টি প্রতিরোধ—সবই মেশিন নিয়ন্ত্রিত। ফলে নিশ্চিত হচ্ছে গুণগত মানের ফল উৎপাদন।

উন্নত বিশ্ব এভাবেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করছে। কৃষি উৎপাদনে ব্যবহার করছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রযুক্তি। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে পৌঁছাতে চাইলে শতভাগ গুড অ্যাগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিস মেনে চলা জরুরি, যা প্রযুক্তি ছাড়া সম্ভব নয়। টেকসই কৃষি অর্থনীতির ভবিষ্যৎ গড়তে আমাদেরও এসব অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন।

নেদারল্যান্ডসের স্মার্ট ফলবাগান ব্যবস্থাপনা আমাদের মতো কৃষি-সম্ভাবনাময় দেশের জন্য একটি বড় অনুপ্রেরণা। যদিও জলবায়ু, মাটি এবং ফসলের বৈচিত্র্যে নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে বাংলাদেশের মিল নেই, তবে প্রযুক্তি ব্যবহারের মডেল থেকে আমরা অনেক কিছু গ্রহণ করতে পারি।

নেদারল্যান্ডসে প্রতিটি গাছে সীমিত ফল রেখে মান ও বাজার চাহিদাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। আমাদের দেশে প্রায়ই গাছ যত ফল দেয় সব রেখে দেওয়া হয়। এতে ফল হয় ছোট, স্বাদ ও গুণগত মান কমে যায়। ফল পাতলা করার এই কৌশল আম, লিচু, পেয়ারা, কুল বা ড্রাগন ফলের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা যেতে পারে। এতে কম ফল হলেও দাম বেশি পাওয়া সম্ভব হবে।

আমাদের দেশে এখনো সেচব্যবস্থার বড় অংশই প্রচলিত ধারা—অতিরিক্ত পানি ব্যবহার। নেদারল্যান্ডসের মতো ড্রিপ ইরিগেশন ও মাটির আর্দ্রতা সেন্সর ব্যবহার করলে পানির সাশ্রয় হবে, পাশাপাশি সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণ পানি দেওয়া সম্ভব হবে। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে এবং বরেন্দ্র অঞ্চল কিংবা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ততা সমস্যার জায়গায় এটি হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ সমাধান।

বাংলাদেশে মৌসুমে প্রচুর ফল উৎপাদিত হলেও সংরক্ষণ সুবিধা না থাকায় কৃষক ন্যায্য দাম পান না। নেদারল্যান্ডসে ফল প্রিজার্ভ করে সারা বছর বাজার নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আমাদের দেশেও শীতাতপনিয়ন্ত্রিত আধুনিক কোল্ডস্টোরেজ স্থাপন জরুরি। বিশেষ করে আম, লিচু, মাল্টা কিংবা ড্রাগন ফলের শেলফ লাইফ বাড়াতে হলে এমন প্রযুক্তি প্রয়োজন।

নেদারল্যান্ডসে শিলাবৃষ্টির ক্ষতি ঠেকাতে যে অ্যান্টি হেইল প্রোটেকশন মেশিন ব্যবহার হয়, তা আমাদের দেশে সরাসরি সম্ভব না হলেও যৌথ বিনিয়োগে কিছু প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন উচ্চমূল্যের শেডনেট, আধুনিক গ্রিনহাউস, ঝড়-বন্যাপ্রতিরোধী অবকাঠামো। এতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতি অনেকটাই কমানো সম্ভব হবে।

বাংলাদেশে মধু চাষ রয়েছে, তবে ফলবাগানভিত্তিক মধু চাষ তেমন জনপ্রিয় নয়। নেদারল্যান্ডসের মতো যদি ফল মৌসুমে মৌমাছির বাক্স ভাড়া দেওয়া যায়, তাহলে ফলের পরাগায়ন বাড়বে, ফলনও নিশ্চিত হবে। একই সঙ্গে কৃষকেরা অতিরিক্ত আয়ের উৎস হিসেবেও মধু বিক্রি করতে পারবেন।

নেদারল্যান্ডসের ফল চাষের অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য নতুন চিন্তার দিগন্ত উন্মোচন করে। তারা দেখিয়েছে, প্রযুক্তি ব্যবহার করলে সীমিত জমিতেও বিপুল ফলন ও মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন সম্ভব। বাংলাদেশে যদি প্রযুক্তিভিত্তিক ফল চাষের দিকে আমরা গুরুত্ব দিই, তাহলে শুধু দেশীয় বাজার নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও আমাদের ফলের অবস্থান তৈরি করা সম্ভব হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

তৌকীর-বিপাশা বিদেশে স্থায়ী হয়েছেন যে কারণে

ফিলিস্তিনকে আজই রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেবে আরও ৬ দেশ, বিরোধিতা ইসরায়েল–যুক্তরাষ্ট্রের

আশ্বিনে ৯ ঘণ্টায় ১০৫ মিলিমিটার বৃষ্টি কি স্বাভাবিক, যা বলছে আবহাওয়া অধিদপ্তর

ধর্ষণের শিকার শিশুর স্বজনকে মারতে উদ্যত হওয়া সেই চিকিৎসক বরখাস্ত

বাজারের খোলা ভোজ্যতেলের ৫১ শতাংশ নমুনায় ভিটামিন ‘এ’ পায়নি বিএসটিআই

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত