Ajker Patrika

সাশ্রয়ী মূল্যের ‘জলজ মুরগি’

ড. মো. শরীফুল ইসলাম
আপডেট : ১৬ নভেম্বর ২০২৫, ১২: ৫৪
তেলাপিয়া মাছে পারদের মাত্রা অনেক কম থাকায় এটি নিরাপদ খাদ্য হিসেবেও বিবেচিত। ছবি: লেখকের সৌজন্যে
তেলাপিয়া মাছে পারদের মাত্রা অনেক কম থাকায় এটি নিরাপদ খাদ্য হিসেবেও বিবেচিত। ছবি: লেখকের সৌজন্যে

একটা সময় মাছ মানেই ছিল রুই, কাতলা বা ইলিশ। কিন্তু এখন দেশের গ্রামীণ পুকুর থেকে শুরু করে শহরের হাটবাজার পর্যন্ত এক নতুন তারকার উত্থান—তেলাপিয়া। দ্রুত বৃদ্ধি, সহজ চাষপদ্ধতি এবং সাশ্রয়ী মূল্যের কারণে তেলাপিয়াকে বিশ্বের অনেক দেশেই বলা হয় ‘জলজ মুরগি’, কেউ বলে ‘গ্রামের রুপালি সম্পদ’—যে যেভাবেই ডাকুন না কেন, এই মাছ এখন বাংলাদেশের নীল অর্থনীতি ও খাদ্যনিরাপত্তার এক গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ।

তেলাপিয়া চাষ আজ আর কেবল মাছ চাষ নয়—এ যেন গ্রামীণ অর্থনীতির এক নতুন গল্প। একসময়ের অকাজের পুকুর এখন চাষির জন্য হয়ে উঠেছে টাকার ব্যাংক। মাত্র চার থেকে পাঁচ মাসে ফসল তোলা যায়, খরচ কম, ঝুঁকি সামান্য—ফলাফল, বছরে দুই থেকে তিনবার আয়! ময়মনসিংহ, যশোর, খুলনা, কুমিল্লা কিংবা বরিশালের হাজারো পরিবার এখন তেলাপিয়ার চাষের ওপর নির্ভরশীল। এক মাছের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে চাষি, ফিড মিল, হ্যাচারি, বাজার আর রেস্টুরেন্টে—গড়ে তুলেছে হাজারো কর্মসংস্থানের সুযোগ।

বিশ্বে তেলাপিয়ার রাজত্ব

তেলাপিয়া এখন বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় মাছ। পৃথিবীর ১৫০টির বেশি দেশে এই মাছের চাষ হচ্ছে। ২০২৩ সালে বিশ্বজুড়ে তেলাপিয়া উৎপাদন ছিল প্রায় ৬ দশমিক ৭ মিলিয়ন টন। আর বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাস, ২০২৫ সালের মধ্যে তা ছাড়াবে ৭ মিলিয়ন টন! চীন, ইন্দোনেশিয়া, মিসর ও ফিলিপাইন এখন তেলাপিয়ার গ্লোবাল পাওয়ারহাউস। বিশ্বের মোট উৎপাদনের প্রায় ৬৭ শতাংশই আসে এশিয়া থেকে, যেখানে বাংলাদেশও দ্রুত উঠে আসছে নতুন শক্তি হিসেবে। তেলাপিয়া এখন শুধু একটি খাবার নয়—এটি বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা, কর্মসংস্থান ও গ্রামীণ অর্থনীতির নতুন প্রতীক।

বাংলাদেশ ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই), মৎস্য অধিদপ্তর এবং সরকারি-বেসরকারি নানাবিধ উদ্যোগে এখন দেশ বিশ্বের শীর্ষ তেলাপিয়া উৎপাদকদের কাতারে। ২০১০-১১ অর্থবছরে যেখানে উৎপাদন ছিল মাত্র ৯৭ হাজার ৯০৯ টন, ২০২১-২২ সালে তা লাফিয়ে বেড়ে দাঁড়ায় ৩.২৯ লাখ টনে। ২০২৩-২৪ সালে দেশের মোট মাছ উৎপাদন ছিল প্রায় ৫০.১৮ লাখ টন। এর মধ্যে তেলাপিয়ার উৎপাদন প্রায় ৪ লাখ টন। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম তেলাপিয়া উৎপাদক দেশ, আর এশিয়ায় আমাদের অবস্থান তৃতীয়।

তেলাপিয়ার পুষ্টিগুণ

তেলাপিয়ার নরম মাংস, মৃদু স্বাদ এবং উচ্চ প্রোটিন উপাদান একে জনপ্রিয় করে তুলেছে। ভাজা, ঝোল বা গ্রিল—যেভাবেই রান্না করা হোক, এটি খেতে সহজ ও সুস্বাদু। তেলাপিয়ার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর উচ্চ প্রোটিন ও নিম্ন চর্বি। প্রতি ১০০ গ্রাম রান্না করা তেলাপিয়ায় থাকে প্রায় ২০-২১ গ্রাম প্রোটিন, যা শরীরের কোষ গঠন ও ক্ষয়পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একই পরিমাণ মাছ থেকে মাত্র ১.৭ থেকে ২ গ্রাম চর্বি পাওয়া যায়, ফলে এটি হৃদ্‌রোগীদের জন্যও নিরাপদ। তেলাপিয়ায় রয়েছে ভিটামিন বি-১২, নিয়াসিন (বি-৩), সেলেনিয়াম, পটাশিয়াম ও ফসফরাস—যেগুলো শরীরের শক্তি উৎপাদন, রক্তকণিকা গঠন, স্নায়ু ও হাড়ের সুস্থতা বজায় রাখতে অপরিহার্য। বিশেষ করে সেলেনিয়াম দেহে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে, যা কোষকে ক্ষয় থেকে রক্ষা করে এবং রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়। তেলাপিয়া মাছের মধ্যে রয়েছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, যা মস্তিষ্কের বিকাশ, স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি এবং হৃৎপিণ্ডের সুস্থতায় সাহায্য করে। যদিও তেলাপিয়ায় সামুদ্রিক মাছের তুলনায় ওমেগা-৩ কম, তবু এর পরিমাণ শরীরের জন্য যথেষ্ট উপকারী মাত্রায় রয়েছে। তেলাপিয়া সহজপাচ্য ও স্বাদে মৃদু হওয়ায় এটি শিশু, বৃদ্ধ এবং গর্ভবতী মায়েদের জন্য আদর্শ মাছ। এতে পারদের মাত্রা (মারকিউরি লেভেল) অনেক কম থাকায় এটি নিরাপদ খাদ্য হিসেবেও বিবেচিত। দিনে একবার খাবারে তেলাপিয়া রাখলে শরীর পায় প্রোটিন, ভিটামিন ও খনিজের চমৎকার ভারসাম্য।

নীল নদ থেকে ময়মনসিংহ-কুমিল্লায়

মাছের জগতে তেলাপিয়া আজ এক পরিচিত নাম। কিন্তু এই মাছের গল্প শুরু হয় হাজার বছরের পুরোনো সভ্যতা প্রাচীন মিসরের নীল নদে। প্রাচীনকালে মিসরীয়রা তেলাপিয়াকে শুধু আহার হিসেবে দেখেনি, এটি তাদের জন্য ছিল উর্বরতা ও সমৃদ্ধির প্রতীক। নীল নদে জন্মানো নাইল তেলাপিয়া (Oreochromis niloticus) দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, কারণ এটি সহজে বংশ বিস্তার করে, দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। নীল নদে জন্ম হলেও তেলাপিয়া ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে সাব-সাহারা আফ্রিকার নদী, হ্রদ ও জলাভূমিতে। এটি এমন এক মাছ যা কম অক্সিজেনযুক্ত পানি, পরিবর্তনশীল তাপমাত্রা ও সামান্য লবণাক্ত পানি সহ্য করতে পারে। ফলে ছোট ও মাঝারি মাপের চাষের জন্য এটি আদর্শ হয়ে ওঠে। বিশ শতকে আফ্রিকান দেশগুলো পুকুরে তেলাপিয়ার সফল চাষ শুরু করে, যা পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাপী এক বিপ্লবের সূচনা করে।

বিশ শতকের মধ্যভাগে তেলাপিয়া পৌঁছায় এশিয়ায়। থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, চীনসহ বিভিন্ন দেশে তেলাপিয়া বাণিজ্যিক চাষে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৭০-এর দশকে এটি গবেষণার উদ্দেশে বাংলাদেশে আনা হয়। তবে আসল পরিবর্তন আসে ২০০০ সালের পর, যখন ‘জেনেটিক্যালি ইমপ্রুভড ফার্মড তেলাপিয়া’ (জিআইএফটি) জাত দেশে ছড়িয়ে পড়ে। জিআইএফটি হচ্ছে জেনেটিক্যালি উন্নত তেলাপিয়ার জাত, যা দ্রুত বাড়ে, টিকে থাকে, আর দেয় তিন গুণ উৎপাদন।

তবে এই সাফল্যের গল্পেও আছে সতর্কতার ছায়া। মানহীন পোনা, পানিদূষণ, বাজারে মূল্যপতন আর জলবায়ুর প্রভাব—সব মিলিয়ে চাষিদের সামনে রয়েছে নতুন চ্যালেঞ্জ। সময় এসেছে উন্নত ব্যবস্থাপনা, টেকসই চাষপদ্ধতি এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের। আমাদের উচিত উন্নত চাষপ্রকরণ, মান নিয়ন্ত্রণ, বাজার সংগঠন ও রপ্তানিতে মনোযোগ দিয়ে তেলাপিয়া চাষকে আরও গতিশীল ও টেকসই করা। কারণ, এই মাছ শুধুই পুকুরের মাছ নয়—এটি আমাদের ভবিষ্যতের খাদ্য ও জীবিকা পরিকল্পনার এক অংশ।

লেখক: ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

হাদির ইনকিলাব কালচারাল সেন্টার বন্ধ ঘোষণা

সুদানে সন্ত্রাসী হামলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৬ শান্তিরক্ষী নিহত, যুদ্ধ চলমান: আইএসপিআর

আচরণবিধি লঙ্ঘন করায় বিএনপির প্রার্থীকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা

উত্তরায় জুলাই রেভেলসের দুই সদস্যকে কুপিয়ে জখম

নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র চলছে: তিন দলের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা

এলাকার খবর
Loading...