অন্তর্বর্তী সরকারের সালতামামি
অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে যে রাজনৈতিক দলের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, সেই এনসিপির একশ্রেণির নেতা-কর্মী চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, মব কালচারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। এতে সরকার ও এনসিপি বা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ইমেজ দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। তাদের ঐক্যও নষ্ট হয়ে গেছে। এই অবস্থা আরও কিছুদিন চলতে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
ড. এম এম আকাশ
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে। গত বছর জুলাই-আগস্টে দেশে গড়ে ওঠা ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটে। তখন সাধারণ মানুষের মনে একধরনের ইতিবাচক প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছিল। তারা আশা করেছিল, অতীতের ব্যর্থতা সংশোধন করে দেশ নতুনভাবে যাত্রা শুরু করবে। কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উন্নয়ন অর্জিত হবে ন্যায্যতার ভিত্তিতে, যার ফল ভোগ করতে পারবে দেশের প্রত্যেক নাগরিক।
ছাত্র-জনতার এই আন্দোলন ছিল বিস্ময়কর। অতীতের যেকোনো সরকারবিরোধী আন্দোলনের চেয়ে গত বছরের আন্দোলন ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এই আন্দোলনে দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের সমর্থন থাকলেও মাঠে সক্রিয় ছিলেন শিক্ষার্থীরা, যাদের দৃশ্যত কোনো রাজনৈতিক পরিচিতি ও অভিলাষ ছিল না। সাধারণ মানুষ মনে করেছিল, আন্দোলনের মাধ্যমে যে নতুন সরকারের সূচনা হয়েছে, তা দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন সাধন করবে। অনেকেই এটাকে সাধারণ কোনো গণ-অভ্যুত্থান না বলে ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’, এমনকি ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ বলে আখ্যায়িত করেন।
অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ও অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই এই প্রত্যাশা সংশোধন করেছেন। তাঁরা এখন বুঝতে পেরেছেন ১৯৬৯ ও ১৯৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানের তুলনায় ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান ছিল কম বিস্তৃত, কম গভীর এবং নেতৃত্বও ছিল মতাদর্শগতভাবে বিভক্ত এবং স্বতঃস্ফূর্ত। এখন সাধারণ অভিমত হচ্ছে, জুলাই-আগস্টের আন্দোলন ছিল ‘মেটিকুলাসলি ডিজাইন্ড গণ-অভ্যুত্থান’। কারা এই ডিজাইন করেছিলেন, তা-ও এখন প্রকাশ পাচ্ছে। এই আন্দোলনের নেতিবাচক লক্ষ্যটি ছিল, ‘এক দফা এক দাবি, হাসিনা তুই কবে যাবি’। কিন্তু হাসিনা চলে যাওয়ার পর তাদের ঐক্য আর থাকল না! ফলে সরকারকে যাঁরা ক্ষমতায় বসিয়েছেন, তাঁরাই সরকারকে নানা পরস্পরবিরোধী চাপ দিচ্ছেন। এই বাস্তব সীমাবদ্ধতার পটভূমিতে আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের বিগত এক বছরের সাফল্য-ব্যর্থতা দুইভাবে মূল্যায়ন করতে পারি।
এর মধ্যে একটি পদ্ধতি হচ্ছে জনমনে সৃষ্ট উচ্চাশা এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের গৃহীত কর্মপরিকল্পনার মূল্যায়ন। কেউ কেউ মনে করেন, একটি অনির্বাচিত সরকারের জন্য এক বছর মেয়াদকালও খুব স্বল্প সময় নয়। এর মধ্যেই সরকারের অনেক কিছু করার ছিল, যা তারা করতে পারেনি। সমালোচকদের অভিমত হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার গণপ্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। কেউ যদি আমাকে প্রশ্ন করেন, বিগত এক বছরে দেশের রাজনীতি, শাসনকাঠামো বা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কি বড় কোনো পরিবর্তন হয়েছে? শাসকদের শ্রেণি চরিত্রের কি কোনো পরিবর্তন হয়েছে? শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মূল উপজীব্য ছিল বৈষম্য নিরসন করা, সে ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়েছে কি? সামষ্টিক অর্থনৈতিক সংকট কি দূর হয়েছে, এমনকি গণতন্ত্র কি প্রকৃতই আরও এগিয়েছে?
আমার উত্তর, এসব ক্ষেত্রে তেমন কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হয়নি। শ্রেণিশোষণ, সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন অত্যন্ত কঠিন কাজ। এটা মূলত রাজনৈতিক কাজ। জনগণকে সচেতন, সংগঠিত ও উদ্বুদ্ধ করে সেটা করতে হবে। এ জন্য নতুন রাজনৈতিক গণ-ক্ষমতাকাঠামো তৈরি করতে হতো। কিন্তু বিগত এক বছরে সে ধরনের কোনো উদ্যোগ আমরা প্রত্যক্ষ করিনি। জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার মতো কোনো রাজনৈতিক সরকার এটি নয়।
সরকারের মধ্যে এনসিপিকে এ রকম একটি শক্তিতে পরিণত করতে যাঁরা চেয়েছিলেন, তাঁরা পদত্যাগ করে মাঠের রাজনীতিতে নেমেছেন। কেউ যদি প্রত্যাশা করে থাকেন যে, অন্তর্বর্তী সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এ ধরনের পরিবর্তন সাধন করবেন, তাহলে সেটা ভুল হবে। কারণ, এটা অতিপ্রত্যাশা, কাজেই তা পূরণ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। আর যাঁরা একে বিপ্লবে পরিণত করতে চেয়েছিলেন, তাঁরাও ব্যর্থ হয়েছেন। যেদিন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি মেনে নিয়ে সাংবিধানিক পদ্ধতির অধীনেই অন্তর্বর্তী সরকার তৈরি হয়েছে, সেদিনই বোঝা গেছে এটি কোনো বিপ্লবী সরকার নয়।
সীমিত প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি
বাস্তবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সীমিত প্রত্যাশাগুলো ছিল—আন্দোলন করতে গিয়ে যাঁরা নিহত হলেন, আন্দোলন দমনকালে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার যেসব সদস্য নিহত হলেন, তাঁদের সবার পূর্ণাঙ্গ এবং গ্রহণযোগ্য একটি তালিকা প্রণয়ন করা। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের কারণ এবং কে হত্যাকারী, তা নির্ণীত হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমরা সেই তালিকা ও বিবরণ এখনো পাইনি এবং ভবিষ্যতে তালিকা পেলেও বিবরণ পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এটা ছিল মানুষের ন্যূনতম একটি প্রত্যাশা। এই প্রত্যাশা পূরণ হওয়া উচিত ছিল। অন্যথায় ভবিষ্যতে সব ধরনের আন্দোলনে নিহত ও আহতদের নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। আমি একে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের একটি বড় ব্যর্থতা বলেই মনে করি।
দ্বিতীয় প্রত্যাশা ছিল, অতীতে অর্থনৈতিক এবং শাসনক্ষমতা পরিচালনাকালে যাঁরা অপরাধী হিসেবে প্রমাণিত হয়েছেন, বিশেষত সরকার কর্তৃক গঠিত শ্বেতপত্রে যাঁদের ব্যাপারে ইঙ্গিতে বলার চেষ্টা করা হয়েছে, তাঁদের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট শাস্তিমূলক দৃষ্টান্ত স্থাপন। যদিও শ্বেতপত্রে অপরাধীদের নাম উল্লেখ করা হয়নি, কিন্তু প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ইঙ্গিত সেখানে যথেষ্ট পরিমাণে ছিল। এদের ব্যাপারে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে না। যাঁরা বিগত সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে ঋণের নামে অর্থ লোপাট করেছেন বা অন্যান্য আর্থিক ও সামাজিক অপরাধ করেছেন, তাঁদের তালিকা কেন প্রকাশিত হলো না? অপরাধীদের মুখোশ উন্মোচন করা প্রয়োজন ছিল। একই সঙ্গে দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাৎকৃত অর্থ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করার কোনো উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে না। অর্থাৎ, আমি বলতে চাইছি, সাড়ে ১৫ বছর সময়ে যাঁরা আর্থিক, রাজনৈতিক ও বিভিন্ন ধরনের সামাজিক অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যাঁরা সরাসরি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়দের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন ছিল। হয়তো বলা হবে, অপরাধীদের অনেকেই এখন জেলে বন্দী আছেন। কিন্তু জেলে বন্দী থাকলেও তাঁদের বিচারকাজ চলছে মন্থর গতিতে। হয়তো ভবিষ্যতে একসময় তাঁরা খালাস পেয়ে যাবেন। আবারও নতুন করে অপরাধকর্ম শুরু করবেন। বিভিন্ন সেক্টরে যাঁরা বড় বড় অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হবেন, তাঁদের জন্য প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বিগত সরকারের আমলে যাঁরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে মারাত্মক অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে, তাঁদের সবাইকে কি গ্রেপ্তার করা হয়েছে? অর্থাৎ, সব অভিযুক্তের বিচারপ্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করে নিরপরাধীদের খালাস এবং অপরাধীদের শাস্তির নিশ্চয়তা বিধান এখনো সম্ভব হয়নি। সম্ভবত পক্ষপাতহীন, চাপহীন স্বচ্ছ বিচারের ক্ষমতা বর্তমান সরকার এবং প্রশাসনের নেই।
আরেকটি প্রত্যাশা ছিল, পাচারকৃত অর্থ উদ্ধার করা যাবে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ থেকে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার সমতুল্য ২৮ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। পাচারকৃত এই অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য কী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে, তা-ও আমরা জানতে পারছি না। আর্থিক এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে অপরাধীদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করা হলো তো নাই-ই, উপরন্তু কার অপরাধ কতটা, তা-ও জানা গেল না। ফলে বিচারের মাধ্যমে তাঁদের অন্তত কিছু শাস্তিদানের বিষয়টিও অনিশ্চিত রয়ে গেল।
হত্যার অভিযোগ এবং অর্থনৈতিক অপরাধের অভিযোগ এক জিনিস নয়। সেখানেও তালগোল পাকিয়ে ফেলা হয়েছে। কে অসৎ ব্যবসায়ী, কে অসৎ আমলা, কে অসৎ রাজনীতিবিদ, কে দুর্নীতি করেছে, কে সহায়তা করেছে, কে লাভবান হয়েছে—এগুলো তদন্ত করে প্রতিষ্ঠা না করে হরেদরে অভিযোগ করে অসংখ্য দুর্বল মামলা করা এই সরকারের আরেকটি ব্যর্থতা। এ জন্য ভবিষ্যতে রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এলে তারা যে বিচার চাইবে বা করবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আর করলেও তারা পক্ষপাতমূলক বিচার করতে পারে। এ ধরনের অসম্পূর্ণ ঝুলন্ত বিচার মানুষ অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে প্রত্যাশা করেনি। ফলে তারা হতাশ হয়েছে।
তাই সাধারণ মানুষ চাইছে অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এমন রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত করুক, যারা এই অসমাপ্ত কাজগুলো দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে। না হলে জনগণকে আরেকটি অপেক্ষাকৃত সচেতন গণ-অভ্যুত্থান গড়ে তুলতে হবে।
অর্থনৈতিক সাফল্য বা ব্যর্থতাসমূহ
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য দুটি চ্যালেঞ্জ ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি হচ্ছে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি স্বল্পতম সময়ের মধ্যে কমিয়ে এনে সাধারণ মানুষের জন্য স্বস্তি নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়টি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাড়ানো। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের স্থবিরতা কাটানো এবং প্রবৃদ্ধি যতটুকু পারা যায়, তা ধরে রাখাও ছিল বড় চ্যালেঞ্জ।
সর্বশেষ খবর হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। তবে প্রত্যাশিত মাত্রায় নয়। আর সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও খাদ্যপণ্য, বিশেষ করে চালের দাম এখনো সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে রয়েছে। মূল্যস্ফীতি যেভাবে কমেছে, তাতে ধনী লোকদের জন্য কিছুটা সুবিধা হলেও দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য অসুবিধা বেড়েছে। কাজেই মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমার কারণে সাধারণ মানুষের তেমন কোনো উপকার হয়নি। একই সঙ্গে যাঁরা কর্মরত আছেন, তাঁদের মজুরি বৃদ্ধির সঙ্গে মূল্যস্ফীতির সমন্বয় ঘটেনি। মূল্যস্ফীতি যেভাবে বেড়েছে, শ্রমিক-কর্মচারীর মজুরি/বেতন সেভাবে বাড়েনি। ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। যাঁরা স্বনিয়োজিত পেশায় নিযুক্ত ছিলেন, অর্থনীতিতে মন্দাবস্থার কারণে তাঁদের বিক্রি ও আয় কমেছে। অর্থাৎ, সামষ্টিক দারিদ্র্য বেড়েছে, বেকারত্বের হার বেড়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধিও অর্ধেকে নেমে এসেছে। অর্থাৎ, অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা বজায় রাখার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ হয়েছে।
বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার অনেকটা বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। অর্থ উপদেষ্টা বলেছিলেন, আমরা আইএমএফের নির্দেশনার ভিত্তিতে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করব না। যদি মার্কিন ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা টাকার বিনিময় হার অস্বাভাবিকভাবে হ্রাস-বৃদ্ধি শুরু হয়, তাহলে আমরা বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করব। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার অনেকটা বাজারভিত্তিক করার পর প্রতি মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ১২২-১২৩ টাকায় স্থির হয়েছিল। মাঝে ১২৫ টাকায় ওঠার পর আবারও মার্কিন ডলারের বিনিময় হার কমেছে। আগে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ১১০ টাকায় স্থির করে রেখেছিল। তার অর্থ হচ্ছে, মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে আমাদের আমদানি ব্যয় বেড়েছে, যা মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিচ্ছে।
অন্যদিকে এখন বাজারে জোগান বৃদ্ধিজনিত কারণে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে মার্কিন ডলার কিনে তার দাম আবার ঠিক রাখার চেষ্টা করছে। আগে অস্বাভাবিক বৃদ্ধির বিরুদ্ধে, হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে বললেও এখন আইএমএফ কিন্তু কিছু বলছে না। তাই আমার প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ ব্যাংক মার্কিন ডলারের ভিত্তিমূল্য কীভাবে নির্ধারণ করবে? প্রতি মার্কিন ডলারের দাম কত টাকার নিচে নামলে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে মার্কিন ডলার কিনে নেবে এবং কত টাকার ওপরে উঠলে রিজার্ভ থেকে মার্কিন ডলার বাজারে ছাড়বে, তা কীভাবে ঠিক করা হবে? এগুলো এখনো স্পষ্ট করে বলা হয়নি।
সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্কারোপ করেছে। কোনো কোনো দেশ এই শুল্কহার আলোচনার মাধ্যমে যৌক্তিকভাবে কমিয়ে আনতে সক্ষম হলেও বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে তেমন কোনো সাফল্য প্রদর্শন করতে পারেনি। যেমন—ভিয়েতনামের রপ্তানি পণ্যের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রাথমিক পর্যায়ে ৪৬ শতাংশ বাড়তি শুল্কারোপ করলে দেশটি আলোচনার মাধ্যমে বাড়তি শুল্কহারের পরিমাণ ২০ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। ভবিষ্যতে ভিয়েতনামকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান ১৫ শতাংশসহ মোট ৩৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে। আর বাংলাদেশের ওপর আরোপিত বাড়তি শুল্কহারও কমিয়ে ২০ শতাংশে নির্ধারণ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান ১৫ শতাংশসহ মোট ৩৫ শতাংশ শুল্ক প্রদান করতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে ভিয়েতনাম হচ্ছে বাংলাদেশি তৈরি পোশাকসামগ্রী রপ্তানির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। বাংলাদেশ বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে দ্বিতীয় শীর্ষস্থানে রয়েছে। ভিয়েতনাম তৃতীয় স্থানে রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে ভিয়েতনামের তৈরি পোশাক রপ্তানি গ্যাপ খুবই সামান্য।
রাজনীতিতে পক্ষপাতিত্ব
অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে যে রাজনৈতিক দলের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, সেই এনসিপির একশ্রেণির নেতা-কর্মী চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, মব কালচারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। এতে সরকার ও এনসিপি বা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ইমেজ দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। তাদের ঐক্যও নষ্ট হয়ে গেছে। এই অবস্থা আরও কিছুদিন চলতে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের স্বাতন্ত্র্য ও নিরপেক্ষতা দৃঢ়ভাবে রক্ষা করা উচিত। এ দেশে কিংস পার্টি স্ট্র্যাটেজি অতীতে গণতন্ত্র আনতে পারেনি। জিয়া ও এরশাদ আমলে তা প্রমাণিত হয়েছে।
তাই আশু করণীয় হবে নিজের নিরপেক্ষ অবস্থান ও ন্যূনতম সংস্কার নিশ্চিত করে স্বল্প সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। জনগণের তখন সুযোগ থাকবে পুরোনো স্বৈরাচারকে ফেরত না এনে আরও গণতান্ত্রিক কোনো সরকারকে বেছে নেওয়ার। সেই পথ ও সুযোগ আপাতত ঠিকমতো করে দিতে পারলে সরকারকে ফুল মার্ক দিতে হয়তো জনগণের কোনো আপত্তি থাকবে না।
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
অনুলিখন: এম এ খালেক
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে। গত বছর জুলাই-আগস্টে দেশে গড়ে ওঠা ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটে। তখন সাধারণ মানুষের মনে একধরনের ইতিবাচক প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছিল। তারা আশা করেছিল, অতীতের ব্যর্থতা সংশোধন করে দেশ নতুনভাবে যাত্রা শুরু করবে। কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উন্নয়ন অর্জিত হবে ন্যায্যতার ভিত্তিতে, যার ফল ভোগ করতে পারবে দেশের প্রত্যেক নাগরিক।
ছাত্র-জনতার এই আন্দোলন ছিল বিস্ময়কর। অতীতের যেকোনো সরকারবিরোধী আন্দোলনের চেয়ে গত বছরের আন্দোলন ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এই আন্দোলনে দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের সমর্থন থাকলেও মাঠে সক্রিয় ছিলেন শিক্ষার্থীরা, যাদের দৃশ্যত কোনো রাজনৈতিক পরিচিতি ও অভিলাষ ছিল না। সাধারণ মানুষ মনে করেছিল, আন্দোলনের মাধ্যমে যে নতুন সরকারের সূচনা হয়েছে, তা দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন সাধন করবে। অনেকেই এটাকে সাধারণ কোনো গণ-অভ্যুত্থান না বলে ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’, এমনকি ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ বলে আখ্যায়িত করেন।
অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ও অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই এই প্রত্যাশা সংশোধন করেছেন। তাঁরা এখন বুঝতে পেরেছেন ১৯৬৯ ও ১৯৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানের তুলনায় ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান ছিল কম বিস্তৃত, কম গভীর এবং নেতৃত্বও ছিল মতাদর্শগতভাবে বিভক্ত এবং স্বতঃস্ফূর্ত। এখন সাধারণ অভিমত হচ্ছে, জুলাই-আগস্টের আন্দোলন ছিল ‘মেটিকুলাসলি ডিজাইন্ড গণ-অভ্যুত্থান’। কারা এই ডিজাইন করেছিলেন, তা-ও এখন প্রকাশ পাচ্ছে। এই আন্দোলনের নেতিবাচক লক্ষ্যটি ছিল, ‘এক দফা এক দাবি, হাসিনা তুই কবে যাবি’। কিন্তু হাসিনা চলে যাওয়ার পর তাদের ঐক্য আর থাকল না! ফলে সরকারকে যাঁরা ক্ষমতায় বসিয়েছেন, তাঁরাই সরকারকে নানা পরস্পরবিরোধী চাপ দিচ্ছেন। এই বাস্তব সীমাবদ্ধতার পটভূমিতে আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের বিগত এক বছরের সাফল্য-ব্যর্থতা দুইভাবে মূল্যায়ন করতে পারি।
এর মধ্যে একটি পদ্ধতি হচ্ছে জনমনে সৃষ্ট উচ্চাশা এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের গৃহীত কর্মপরিকল্পনার মূল্যায়ন। কেউ কেউ মনে করেন, একটি অনির্বাচিত সরকারের জন্য এক বছর মেয়াদকালও খুব স্বল্প সময় নয়। এর মধ্যেই সরকারের অনেক কিছু করার ছিল, যা তারা করতে পারেনি। সমালোচকদের অভিমত হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার গণপ্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। কেউ যদি আমাকে প্রশ্ন করেন, বিগত এক বছরে দেশের রাজনীতি, শাসনকাঠামো বা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কি বড় কোনো পরিবর্তন হয়েছে? শাসকদের শ্রেণি চরিত্রের কি কোনো পরিবর্তন হয়েছে? শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মূল উপজীব্য ছিল বৈষম্য নিরসন করা, সে ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়েছে কি? সামষ্টিক অর্থনৈতিক সংকট কি দূর হয়েছে, এমনকি গণতন্ত্র কি প্রকৃতই আরও এগিয়েছে?
আমার উত্তর, এসব ক্ষেত্রে তেমন কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হয়নি। শ্রেণিশোষণ, সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন অত্যন্ত কঠিন কাজ। এটা মূলত রাজনৈতিক কাজ। জনগণকে সচেতন, সংগঠিত ও উদ্বুদ্ধ করে সেটা করতে হবে। এ জন্য নতুন রাজনৈতিক গণ-ক্ষমতাকাঠামো তৈরি করতে হতো। কিন্তু বিগত এক বছরে সে ধরনের কোনো উদ্যোগ আমরা প্রত্যক্ষ করিনি। জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার মতো কোনো রাজনৈতিক সরকার এটি নয়।
সরকারের মধ্যে এনসিপিকে এ রকম একটি শক্তিতে পরিণত করতে যাঁরা চেয়েছিলেন, তাঁরা পদত্যাগ করে মাঠের রাজনীতিতে নেমেছেন। কেউ যদি প্রত্যাশা করে থাকেন যে, অন্তর্বর্তী সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এ ধরনের পরিবর্তন সাধন করবেন, তাহলে সেটা ভুল হবে। কারণ, এটা অতিপ্রত্যাশা, কাজেই তা পূরণ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। আর যাঁরা একে বিপ্লবে পরিণত করতে চেয়েছিলেন, তাঁরাও ব্যর্থ হয়েছেন। যেদিন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি মেনে নিয়ে সাংবিধানিক পদ্ধতির অধীনেই অন্তর্বর্তী সরকার তৈরি হয়েছে, সেদিনই বোঝা গেছে এটি কোনো বিপ্লবী সরকার নয়।
সীমিত প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি
বাস্তবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সীমিত প্রত্যাশাগুলো ছিল—আন্দোলন করতে গিয়ে যাঁরা নিহত হলেন, আন্দোলন দমনকালে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার যেসব সদস্য নিহত হলেন, তাঁদের সবার পূর্ণাঙ্গ এবং গ্রহণযোগ্য একটি তালিকা প্রণয়ন করা। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের কারণ এবং কে হত্যাকারী, তা নির্ণীত হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমরা সেই তালিকা ও বিবরণ এখনো পাইনি এবং ভবিষ্যতে তালিকা পেলেও বিবরণ পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এটা ছিল মানুষের ন্যূনতম একটি প্রত্যাশা। এই প্রত্যাশা পূরণ হওয়া উচিত ছিল। অন্যথায় ভবিষ্যতে সব ধরনের আন্দোলনে নিহত ও আহতদের নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। আমি একে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের একটি বড় ব্যর্থতা বলেই মনে করি।
দ্বিতীয় প্রত্যাশা ছিল, অতীতে অর্থনৈতিক এবং শাসনক্ষমতা পরিচালনাকালে যাঁরা অপরাধী হিসেবে প্রমাণিত হয়েছেন, বিশেষত সরকার কর্তৃক গঠিত শ্বেতপত্রে যাঁদের ব্যাপারে ইঙ্গিতে বলার চেষ্টা করা হয়েছে, তাঁদের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট শাস্তিমূলক দৃষ্টান্ত স্থাপন। যদিও শ্বেতপত্রে অপরাধীদের নাম উল্লেখ করা হয়নি, কিন্তু প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ইঙ্গিত সেখানে যথেষ্ট পরিমাণে ছিল। এদের ব্যাপারে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে না। যাঁরা বিগত সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে ঋণের নামে অর্থ লোপাট করেছেন বা অন্যান্য আর্থিক ও সামাজিক অপরাধ করেছেন, তাঁদের তালিকা কেন প্রকাশিত হলো না? অপরাধীদের মুখোশ উন্মোচন করা প্রয়োজন ছিল। একই সঙ্গে দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাৎকৃত অর্থ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করার কোনো উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে না। অর্থাৎ, আমি বলতে চাইছি, সাড়ে ১৫ বছর সময়ে যাঁরা আর্থিক, রাজনৈতিক ও বিভিন্ন ধরনের সামাজিক অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যাঁরা সরাসরি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়দের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন ছিল। হয়তো বলা হবে, অপরাধীদের অনেকেই এখন জেলে বন্দী আছেন। কিন্তু জেলে বন্দী থাকলেও তাঁদের বিচারকাজ চলছে মন্থর গতিতে। হয়তো ভবিষ্যতে একসময় তাঁরা খালাস পেয়ে যাবেন। আবারও নতুন করে অপরাধকর্ম শুরু করবেন। বিভিন্ন সেক্টরে যাঁরা বড় বড় অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হবেন, তাঁদের জন্য প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বিগত সরকারের আমলে যাঁরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে মারাত্মক অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে, তাঁদের সবাইকে কি গ্রেপ্তার করা হয়েছে? অর্থাৎ, সব অভিযুক্তের বিচারপ্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করে নিরপরাধীদের খালাস এবং অপরাধীদের শাস্তির নিশ্চয়তা বিধান এখনো সম্ভব হয়নি। সম্ভবত পক্ষপাতহীন, চাপহীন স্বচ্ছ বিচারের ক্ষমতা বর্তমান সরকার এবং প্রশাসনের নেই।
আরেকটি প্রত্যাশা ছিল, পাচারকৃত অর্থ উদ্ধার করা যাবে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ থেকে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার সমতুল্য ২৮ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। পাচারকৃত এই অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য কী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে, তা-ও আমরা জানতে পারছি না। আর্থিক এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে অপরাধীদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করা হলো তো নাই-ই, উপরন্তু কার অপরাধ কতটা, তা-ও জানা গেল না। ফলে বিচারের মাধ্যমে তাঁদের অন্তত কিছু শাস্তিদানের বিষয়টিও অনিশ্চিত রয়ে গেল।
হত্যার অভিযোগ এবং অর্থনৈতিক অপরাধের অভিযোগ এক জিনিস নয়। সেখানেও তালগোল পাকিয়ে ফেলা হয়েছে। কে অসৎ ব্যবসায়ী, কে অসৎ আমলা, কে অসৎ রাজনীতিবিদ, কে দুর্নীতি করেছে, কে সহায়তা করেছে, কে লাভবান হয়েছে—এগুলো তদন্ত করে প্রতিষ্ঠা না করে হরেদরে অভিযোগ করে অসংখ্য দুর্বল মামলা করা এই সরকারের আরেকটি ব্যর্থতা। এ জন্য ভবিষ্যতে রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এলে তারা যে বিচার চাইবে বা করবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আর করলেও তারা পক্ষপাতমূলক বিচার করতে পারে। এ ধরনের অসম্পূর্ণ ঝুলন্ত বিচার মানুষ অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে প্রত্যাশা করেনি। ফলে তারা হতাশ হয়েছে।
তাই সাধারণ মানুষ চাইছে অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এমন রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত করুক, যারা এই অসমাপ্ত কাজগুলো দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে। না হলে জনগণকে আরেকটি অপেক্ষাকৃত সচেতন গণ-অভ্যুত্থান গড়ে তুলতে হবে।
অর্থনৈতিক সাফল্য বা ব্যর্থতাসমূহ
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য দুটি চ্যালেঞ্জ ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি হচ্ছে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি স্বল্পতম সময়ের মধ্যে কমিয়ে এনে সাধারণ মানুষের জন্য স্বস্তি নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়টি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাড়ানো। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের স্থবিরতা কাটানো এবং প্রবৃদ্ধি যতটুকু পারা যায়, তা ধরে রাখাও ছিল বড় চ্যালেঞ্জ।
সর্বশেষ খবর হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। তবে প্রত্যাশিত মাত্রায় নয়। আর সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও খাদ্যপণ্য, বিশেষ করে চালের দাম এখনো সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে রয়েছে। মূল্যস্ফীতি যেভাবে কমেছে, তাতে ধনী লোকদের জন্য কিছুটা সুবিধা হলেও দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য অসুবিধা বেড়েছে। কাজেই মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমার কারণে সাধারণ মানুষের তেমন কোনো উপকার হয়নি। একই সঙ্গে যাঁরা কর্মরত আছেন, তাঁদের মজুরি বৃদ্ধির সঙ্গে মূল্যস্ফীতির সমন্বয় ঘটেনি। মূল্যস্ফীতি যেভাবে বেড়েছে, শ্রমিক-কর্মচারীর মজুরি/বেতন সেভাবে বাড়েনি। ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। যাঁরা স্বনিয়োজিত পেশায় নিযুক্ত ছিলেন, অর্থনীতিতে মন্দাবস্থার কারণে তাঁদের বিক্রি ও আয় কমেছে। অর্থাৎ, সামষ্টিক দারিদ্র্য বেড়েছে, বেকারত্বের হার বেড়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধিও অর্ধেকে নেমে এসেছে। অর্থাৎ, অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা বজায় রাখার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ হয়েছে।
বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার অনেকটা বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। অর্থ উপদেষ্টা বলেছিলেন, আমরা আইএমএফের নির্দেশনার ভিত্তিতে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করব না। যদি মার্কিন ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা টাকার বিনিময় হার অস্বাভাবিকভাবে হ্রাস-বৃদ্ধি শুরু হয়, তাহলে আমরা বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করব। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার অনেকটা বাজারভিত্তিক করার পর প্রতি মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ১২২-১২৩ টাকায় স্থির হয়েছিল। মাঝে ১২৫ টাকায় ওঠার পর আবারও মার্কিন ডলারের বিনিময় হার কমেছে। আগে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ১১০ টাকায় স্থির করে রেখেছিল। তার অর্থ হচ্ছে, মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে আমাদের আমদানি ব্যয় বেড়েছে, যা মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিচ্ছে।
অন্যদিকে এখন বাজারে জোগান বৃদ্ধিজনিত কারণে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে মার্কিন ডলার কিনে তার দাম আবার ঠিক রাখার চেষ্টা করছে। আগে অস্বাভাবিক বৃদ্ধির বিরুদ্ধে, হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে বললেও এখন আইএমএফ কিন্তু কিছু বলছে না। তাই আমার প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ ব্যাংক মার্কিন ডলারের ভিত্তিমূল্য কীভাবে নির্ধারণ করবে? প্রতি মার্কিন ডলারের দাম কত টাকার নিচে নামলে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে মার্কিন ডলার কিনে নেবে এবং কত টাকার ওপরে উঠলে রিজার্ভ থেকে মার্কিন ডলার বাজারে ছাড়বে, তা কীভাবে ঠিক করা হবে? এগুলো এখনো স্পষ্ট করে বলা হয়নি।
সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্কারোপ করেছে। কোনো কোনো দেশ এই শুল্কহার আলোচনার মাধ্যমে যৌক্তিকভাবে কমিয়ে আনতে সক্ষম হলেও বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে তেমন কোনো সাফল্য প্রদর্শন করতে পারেনি। যেমন—ভিয়েতনামের রপ্তানি পণ্যের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রাথমিক পর্যায়ে ৪৬ শতাংশ বাড়তি শুল্কারোপ করলে দেশটি আলোচনার মাধ্যমে বাড়তি শুল্কহারের পরিমাণ ২০ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। ভবিষ্যতে ভিয়েতনামকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান ১৫ শতাংশসহ মোট ৩৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে। আর বাংলাদেশের ওপর আরোপিত বাড়তি শুল্কহারও কমিয়ে ২০ শতাংশে নির্ধারণ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান ১৫ শতাংশসহ মোট ৩৫ শতাংশ শুল্ক প্রদান করতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে ভিয়েতনাম হচ্ছে বাংলাদেশি তৈরি পোশাকসামগ্রী রপ্তানির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। বাংলাদেশ বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে দ্বিতীয় শীর্ষস্থানে রয়েছে। ভিয়েতনাম তৃতীয় স্থানে রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে ভিয়েতনামের তৈরি পোশাক রপ্তানি গ্যাপ খুবই সামান্য।
রাজনীতিতে পক্ষপাতিত্ব
অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে যে রাজনৈতিক দলের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, সেই এনসিপির একশ্রেণির নেতা-কর্মী চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, মব কালচারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। এতে সরকার ও এনসিপি বা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ইমেজ দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। তাদের ঐক্যও নষ্ট হয়ে গেছে। এই অবস্থা আরও কিছুদিন চলতে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের স্বাতন্ত্র্য ও নিরপেক্ষতা দৃঢ়ভাবে রক্ষা করা উচিত। এ দেশে কিংস পার্টি স্ট্র্যাটেজি অতীতে গণতন্ত্র আনতে পারেনি। জিয়া ও এরশাদ আমলে তা প্রমাণিত হয়েছে।
তাই আশু করণীয় হবে নিজের নিরপেক্ষ অবস্থান ও ন্যূনতম সংস্কার নিশ্চিত করে স্বল্প সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। জনগণের তখন সুযোগ থাকবে পুরোনো স্বৈরাচারকে ফেরত না এনে আরও গণতান্ত্রিক কোনো সরকারকে বেছে নেওয়ার। সেই পথ ও সুযোগ আপাতত ঠিকমতো করে দিতে পারলে সরকারকে ফুল মার্ক দিতে হয়তো জনগণের কোনো আপত্তি থাকবে না।
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
অনুলিখন: এম এ খালেক
বর্ষাকাল এলেই যেন ঢাকায় জলাবদ্ধতা ভর করে বসে। জলাবদ্ধতা যখন এই শহরের ঘাড়ে চেপে বসে, তখন এই নগরের মানুষকে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়। আজ এই শহরের এত সমস্যার মুখোমুখি হতে হতো না যদি তারা অপরিকল্পিত নগরায়ণের দিকে না ঝুঁকত, যদি নদী কিংবা খালের স্থান দখল না করে কোনো স্থাপনা করার পরিকল্পনা করত।
৩ ঘণ্টা আগেটাঙ্গাইলের সখীপুর-কচুয়া-আড়াইপাড়া সড়কের যে করুণ অবস্থা, তা আসলে আমাদের সড়ক যোগাযোগব্যবস্থার অব্যবস্থাপনার এক করুণ প্রতিচ্ছবি। সাত কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক—যেখানে প্রতিদিন স্কুলশিক্ষার্থী, রোগী, কৃষিপণ্যবাহী ট্রাক ও হাজারো সাধারণ মানুষ চলাচল করে।
৩ ঘণ্টা আগেজুলাই অভ্যুত্থানের এক বছর হয়ে গেল। ওই অভ্যুত্থানের সময় দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি ছিল। মূলত তারা ফ্যাসিবাদী সরকারব্যবস্থার পতন ঘটিয়ে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিল। মূলত বাংলাদেশের মূল সমস্যা সেটাই যে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে একটি
১ দিন আগেঢুলিভিটা থেকে ধামরাই উপজেলার একটি গ্রামের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। যাব সীতি গ্রামের আলাদিন পার্কে। হঠাৎ নাকে একটা উৎকট গন্ধ এসে লাগল। যতই এগোচ্ছি গন্ধটা তত বেশি উগ্র হয়ে উঠছে। নাক দিয়ে ঢুকছে দুর্গন্ধযুক্ত বাতাস, পেটের ভেতরটা যেন ঘুলঘুল করে উঠছে। কারণটা কী? একটু এগিয়ে যেতেই ব্যাপারটা খোলাসা হয়ে গেল। রাস্তার
১ দিন আগে