Ajker Patrika

ট্রাম্প একটি ধন্যবাদ পেতেই পারেন

এম আর রহমান
আপডেট : ১৪ মে ২০২৫, ০৭: ২৬
ট্রাম্প কি ভারত-পাকিস্তানের মতো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধেও বিরতি আনতে পারবেন? ছবি: এএফপি
ট্রাম্প কি ভারত-পাকিস্তানের মতো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধেও বিরতি আনতে পারবেন? ছবি: এএফপি

গত এপ্রিল মাসে ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর হামলার ঘটনায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। উভয় দেশই পাল্টাপাল্টি হামলা চালায়। যদিও এই হামলার শুরুটা ভারতের দিক থেকে হয়েছিল। পরমাণু অস্ত্রধর দুই দেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে, বাণিজ্য ও যাতায়াত বন্ধ করে দেয়—সর্বাত্মক যুদ্ধ যেন অনিবার্য হয়ে ওঠে। ঠিক সেই মুহূর্তে আবির্ভাব ঘটে এক অপ্রত্যাশিত চরিত্রের—মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

অনেকে ট্রাম্পকে চেনেন তাঁর বেপরোয়া বক্তব্য ও অপ্রথাগত নেতৃত্বের জন্য, কিন্তু আন্তর্জাতিক কূটনীতির ক্ষেত্রে তাঁর অতীত রেকর্ড কিছুটা ভিন্ন। উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সংলাপ, আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের উদ্যোগ, এমনকি চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে সাময়িক বিরতি—সবই তাঁর উদ্যোগের ফসল। এবার ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষেও তিনি নিজেকে উপস্থাপন করলেন এক দক্ষ ‘ডিলমেকার’ হিসেবে।

ট্রাম্প সরাসরি ফোনে কথা বলেন ভারত ও পাকিস্তানের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে এবং উভয় পক্ষকে সতর্ক করেন—যুদ্ধ শুরু হলে তা শুধু দুই দেশ নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য বিপর্যয়কর হবে। তাঁর এই সক্রিয় উদ্যোগের ফলে দেশ দুটি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয় এবং সীমান্ত থেকে সেনা সরানোর প্রক্রিয়া শুরু করে। কীভাবে তিনি রাজি করিয়েছিলেন, সেটা নিজের মুখেই ট্রাম্প বলেছেন। তা-ও হোয়াইট হাউসে সবার সামনে। ‘ভারত ও পাকিস্তানের সরকারপ্রধানদের আমি বলেছিলাম, আমরা তোমাদের সঙ্গে অনেক বাণিজ্য করব। চলো এটা বন্ধ করি। যদি তোমরা এটা বন্ধ করো, তাহলে আমরা বাণিজ্য করব। যদি তোমরা এটা বন্ধ না করো, তাহলে আমরা আর কোনো বাণিজ্য করব না।’ অর্থাৎ যুদ্ধ বন্ধে কোন অস্ত্র প্রয়োগ করতে হবে, তা ট্রাম্প ভালোই জানেন, এটা এখন প্রমাণিত।

এই ঘটনাকে কেউ কেউ ট্রাম্পের রাজনৈতিক কৌশল বললেও বাস্তবতা হলো—এতে হাজার হাজার মানুষের সম্ভাব্য প্রাণহানি এড়ানো গেছে। ট্রাম্পের হস্তক্ষেপ নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু কার্যকর ছিল নিঃসন্দেহে। শান্তি ফিরিয়ে আনার এই উদ্যোগ বিশ্বকে আবার মনে করিয়ে দেয়, কখনো কখনো অপ্রথাগত কূটনীতি প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে বেশি ফলদায়ক হতে পারে।

ট্রাম্প প্রশাসনের কিছু কূটনীতিক ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা এই আলোচনার সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করেন। ওয়াশিংটনের মাধ্যমে ব্যাকচ্যানেল যোগাযোগ গড়ে ওঠে, যাতে অল্প সময়ের মধ্যেই যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয় নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদ। এই যুদ্ধবিরতির পেছনে অনেকেই রাজনৈতিক ব্যাখ্যা খোঁজেন। কেউ বলেন, ট্রাম্প নিজের জন্য ‘শান্তি রক্ষক’-এর ভাবমূর্তি তৈরি করতে চাইছেন। অন্যদিকে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এই হস্তক্ষেপ দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের হারাতে বসা প্রভাব ফিরিয়ে আনার একটি চেষ্টামাত্র। তবে এর চেয়ে বড় বিষয় হলো—যুদ্ধ রোধ হয়েছে, হাজারো প্রাণহানি এড়ানো গেছে।

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ থামিয়ে ট্রাম্প কেবল একজন নেতার দক্ষতা দেখাননি, বরং আরও একবার প্রমাণ করলেন ‘ডিলমেকিং’ কেবল ব্যবসায় নয়, যুদ্ধ বন্ধেও প্রয়োগযোগ্য।

চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধের অবসান

ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে ২০১৮ সালে শুরু হয় চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ। একসময় এই বাণিজ্যযুদ্ধ বিশ্বের অর্থনীতিকে চরম অস্থিরতায় ফেলে দিয়েছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্প চীন থেকে আমদানি করা প্রায় ৩৫০ বিলিয়ন ডলারের পণ্যের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করেন, যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প ও চাকরি রক্ষার নামে। চীনও পাল্টা জবাব দেয় মার্কিন কৃষিপণ্য ও প্রযুক্তিপণ্যে শুল্ক বসিয়ে। এতে উভয় দেশের ভোক্তা ও উৎপাদকদের পাশাপাশি বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সম্প্রতি চীনসহ বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রের আমদানি পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করেন ট্রাম্প। সবচেয়ে বেশি শুল্ক আরোপ করা হয় চীনের ওপর। জবাবে চীনও যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপ বিশ্ববাজারে উত্তেজনা ও অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা তৈরি করে।

তবে গত সোমবার যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ৯০ দিনের জন্য পারস্পরিক বাণিজ্য শুল্ক বিপুল হারে কমানোর ঘোষণা দিয়েছে। এতে বাণিজ্যযুদ্ধের তীব্রতা হ্রাস পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দুই দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে সপ্তাহজুড়ে আলোচনায় সেই শুল্ক অনেকাংশে কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই আলোচনা হয়েছেও বেশ গোপনে। জাতিসংঘে নিযুক্ত সুইস রাষ্ট্রদূতের জেনেভার ভিলায় দুই পক্ষ বৈঠকে বসে।

আলোচনার পর মার্কিন ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট ও বাণিজ্য প্রতিনিধি জেমিসন গ্রিয়ার সাংবাদিকদের বলেন, উভয় পক্ষই ৯০ দিনের জন্য পারস্পরিক শুল্ক ১১৫ শতাংশ সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করতে সম্মত হয়েছে। বিবৃতি অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র চীনের পণ্যে আরোপিত ১৪৫ শতাংশ শুল্ক কমিয়ে ৩০ শতাংশে নিয়ে আসবে এবং চীনও যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর ১২৫ শতাংশ শুল্ক কমিয়ে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনবে। এই পদক্ষেপটি যুক্তরাষ্ট্রে মুদ্রাস্ফীতির চাপ হ্রাস করতে সহায়ক হবে বলে অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন। একই সঙ্গে, চীনা বাজারেও আমেরিকান কৃষিপণ্য এবং সেবা খাতের প্রবেশাধিকার বাড়বে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্ত হয়তো নির্বাচনী কৌশলের অংশ, কিন্তু অর্থনৈতিক দিক থেকে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিবাচক। এই সিদ্ধান্ত কেবল দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করেই থেমে থাকছে না, বরং বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যপ্রবাহে স্বস্তি এনে দিচ্ছে। বাংলাদেশসহ বহু উন্নয়নশীল দেশ, যারা চীনা কাঁচামাল আমদানি করে রপ্তানি পণ্য তৈরি করে, তাদের জন্যও এটি স্বস্তির বার্তা। যদিও দক্ষিণ চীন সাগর, তাইওয়ান ও প্রযুক্তিগত আধিপত্য নিয়ে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা রয়ে গেছে। কিন্তু এই বাণিজ্যিক সমঝোতা প্রমাণ করে যে অর্থনৈতিক যৌক্তিকতা অনেক সময় রাজনৈতিক মতানৈক্যের চেয়েও শক্তিশালী হয়।

ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় হতে পারে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধবিরতি

ইউক্রেন যুদ্ধ তিন বছর পার করে চারে পা রেখেছে। এই যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি ও ইউরোপীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ এবং তাঁর ‘পুতিনকে বোঝার ক্ষমতা’ এখন একটি সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতির আশ্বাস দিচ্ছে। বিভিন্ন মহল বলছে, ট্রাম্প প্রশাসনের প্রস্তাবিত ‘নতুন নিরাপত্তা গ্যারান্টি’ প্যাকেজ ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে একটি সীমিত সমঝোতার ভিত্তি তৈরি করতে পারে।

ট্রাম্পের কূটনৈতিক কৌশল অনেক সময় প্রচলিত ধারা থেকে সরে গিয়ে ‘চুক্তিনির্ভর’ পদ্ধতিতে এগিয়ে যায়। এটি কখনো ঝুঁকিপূর্ণ, কখনো কার্যকর। তবে বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে যেখানে শান্তির পথ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, সেখানে এমন এক চরিত্রের প্রয়োজন হতে পারে, যিনি প্রচলিত নিয়ম ভেঙে নতুন সমাধানের পথ দেখাতে পারেন। ট্রাম্পের এই সাফল্যগাথা তাই কেবল তাঁর নয়, বরং বিশ্ব কূটনীতির একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনাও হতে পারে। সব মিলিয়ে ট্রাম্প একটি ধন্যবাদ পেতেই পারেন।

এম আর রহমান

সাংবাদিক ও কলাম লেখক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‘মেয়েরা যেন আমার মরা মুখ না দেখে’, চিরকুট লিখে ঠিকাদারের ‘আত্মহত্যা’

ফরিদপুরে পালিয়ে যাওয়া আ.লীগ নেতা গ্রেপ্তার, থানার ওসিকে বদলি

আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করায় ভারতের উদ্বেগ

কাতারের রাজপরিবারের দেওয়া বিলাসবহুল বিমান না নেওয়াটা বোকামি: ট্রাম্প

সৌদি আরবের সঙ্গে ১৪২ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রির চুক্তি করে নিজের রেকর্ড ভাঙল যুক্তরাষ্ট্র

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত