Ajker Patrika

ফরেন পলিসির নিবন্ধ /খনিজের লোভে মিয়ানমারে কৌশলগত ভুলের পথে ট্রাম্প

ডেরেক গ্রসম্যান
আপডেট : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১: ০৭
মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং চিঠি লিখে প্রশংসা করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের। 	ছবি: এএফপি
মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং চিঠি লিখে প্রশংসা করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের। ছবি: এএফপি

মিয়ানমারের বিরল খনিজে নজর দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বলতে গেলে তিনি মরিয়া হয়ে উঠেছেন। সম্প্রতি মিয়ানমারে মার্কিন দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স সুসান স্টিভেনসন দেশটির কাচিন রাজ্যের রাজধানী মিচিনা সফর করেন। সফরের বিষয়ে পরে মুখপাত্র বলেন, এই সফরের মাধ্যমে তিনি স্থানীয় সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা আরও ভালোভাবে বুঝতে চান। চীন সীমান্তে অবস্থিত এই রাজ্য জেড পাথর ও বিরল খনিজের ভান্ডার। চীনা প্রভাববলয়ের মধ্যে অবস্থিত মিয়ানমারের খনিজে ট্রাম্পের এই আসক্তি যুক্তরাষ্ট্রের ভুল কৌশলগত পদক্ষেপের আশু পরিস্থিতি তৈরি করেছে।

মিয়ানমারে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম বিরল খনিজের মজুত রয়েছে। টানা কয়েক বছর ধরে গৃহযুদ্ধ চলছে। জান্তা সরকার অধিকাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ কার্যত হারিয়েছে। এই পরিস্থিতির মধ্যে ট্রাম্প প্রশাসন মিয়ানমারের বিরল মৃত্তিকা খনিজে প্রবেশাধিকারের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছে। এ লক্ষ্যে মিয়ানমারের কাচিন রাজ্যের জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠী কাচিন ইনডিপেনডেন্স আর্মিকে (কেআইএ) সহায়তা দেওয়া থেকে শুরু করে জান্তা সরকারের কার্যত প্রধান জ্যেষ্ঠ জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের সঙ্গে সরাসরি শান্তি আলোচনার চেষ্টাও চালিয়ে যাওয়ার মতো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে গোপনে।

অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা বিবেচনায় এসব বিকল্প যে খারাপ, তা হয়তো নয়। বরং মিয়ানমারে চার বছরের বেশি সময় ধরে চলা গৃহযুদ্ধ শেষ করতে উভয়ই হয়তো প্রয়োজনীয়। আগে জো বাইডেনের প্রশাসন মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনলেও ট্রাম্প প্রশাসন প্রাথমিক পদক্ষেপগুলোর মাধ্যমে দেখিয়েছে যে, তারা এই রেজিমের প্রতি অবস্থান নরম করতে ইচ্ছুক।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই নরম অবস্থান যদি মিয়ানমারে শান্তি আলোচনার সূচনা করতে পারে, তাহলে মিয়ানমারের খনিজ সম্পদে মার্কিন প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যও সেই প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবে না। এ ছাড়া আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলা যেতে পারে, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার উদ্বেগগুলোকে কম গুরুত্ব দেওয়ার যে অবস্থান মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট নিয়েছে, তাতে ওয়াশিংটনকে সন্দেহ করার আরও সুযোগ তৈরি হয়েছে।

গত জুলাইয়ে ট্রাম্প প্রশাসন মিয়ানমারের জান্তা সরকারের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ব্যবসায়ী ও সেনাসংশ্লিষ্ট কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো—মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং ট্রাম্পকে চিঠি লেখার পরপরই মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয় এসব নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে। ওই চিঠিতে তিনি ট্রাম্পের প্রশংসা করে লেখেন, সরকারি অর্থায়নে যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমে মিয়ানমারের জান্তা ও তাদের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করা হচ্ছিল, এর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ায় ট্রাম্পের ‘শক্তিশালী নেতৃত্বই’ প্রকাশ পেয়েছে।

হোয়াইট হাউসের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা অবশ্য অতি প্রশংসাসূচক ওই চিঠি আর ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের মধ্যে কোনো যোগসূত্র নেই বলে দাবি করেছেন। তবে প্রশাসন এখনো ব্যাখ্যা দেয়নি, কেন এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে।

এখানে এমন একটি ইঙ্গিত মিলছে যে, জান্তা সরকার হয়তো ভাবছে ওয়াশিংটন-নেপিডো সম্পর্ক নতুন করে সাজানোর ‘সবচেয়ে বড় সুযোগ’ এটি। আর আশা করছে, ওয়াশিংটনের তথাকথিত সমর্থন পেয়ে তারা বিরোধীদের চূড়ান্তভাবে দমন করে যুদ্ধে জয়ী হবে। এমন একটি আত্মবিশ্বাস থেকে নেপিডো এখন নিজেদের শুধরে নেওয়ার ভান করছে, যাতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একটি ইতিবাচক বার্তা দেওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ, জান্তা সরকার আগামী ডিসেম্বর বা আগামী বছরের জানুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করবে। যদিও চলমান যুদ্ধে স্বাধীন, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন আয়োজন মোটেই সম্ভব নয়।

গত ৩১ জুলাই জান্তা বাহিনী ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ক্ষমতা দখলের পর প্রথমবারের মতো জাতীয় জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেয়। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তারা আবার সেটি বহাল করে। একই সঙ্গে বিদ্রোহী গোষ্ঠী-নিয়ন্ত্রিত বহু অশান্ত শহরে সামরিক আইন জারি করে। নেপিডো একইভাবে প্রতারণামূলকভাবে বেসামরিক নেতৃত্বের কাছে সরকারের দায়িত্ব হস্তান্তরের নির্দেশ দেয়। তবে বাস্তবে ক্ষমতা কেবল সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের কাছ থেকে দেশের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের হাতে যায়। আর সেই ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট আবার মিন অং হ্লাইং নিজেই!

সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, ওয়াশিংটনভিত্তিক লবি প্রতিষ্ঠান ডিসিআই গ্রুপকে ভাড়া করেছে জান্তা সরকার। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠনেই এই উদ্যোগ। চুক্তি অনুযায়ী বছরে প্রায় ৩০ লাখ ডলার দেবে জান্তা। যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন এজেন্টস রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্টে (এফএআরএ) দাখিল করা নথিতে প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, তারা ‘জনসংযোগ সেবা প্রদান করবে... যেখানে মূলত বাণিজ্য, প্রাকৃতিক সম্পদ ও মানবিক সহায়তা ইস্যুতে কাজ করা হবে।’ এর ভিত্তিতেই দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক পুনর্গঠনের চেষ্টা চলবে।

কিন্তু যদি সত্যিই ভবিষ্যতে বিরল খনিজে প্রবেশাধিকার পাওয়ার বিনিময়ে ট্রাম্প প্রশাসন সরাসরি মিয়ানমারের সেনাশাসকের সঙ্গে যোগাযোগ এবং সমর্থন দেওয়ার কথা ভেবে থাকে, তাহলে সেটি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ ও মূল্যবোধের জন্য লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি বয়ে আনবে।

এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র যে দীর্ঘদিন গণতন্ত্রের পক্ষের ভাবমূর্তি তৈরি করেছে, তা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। উদাহরণস্বরূপ, ট্রাম্প যখন মিয়ানমারের জান্তা সরকারসংশ্লিষ্ট কিছু ব্যক্তির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন, তখন মিয়ানমারের মানবাধিকারসংক্রান্ত জাতিসংঘের বিশেষ কর্মকর্তা টম অ্যান্ড্রুজ এই সিদ্ধান্তে বিস্ময় প্রকাশ করেন। অ্যান্ড্রুজের যুক্তি, এই পদক্ষেপ ‘হন্তারক জান্তা রেজিমকে অস্ত্র সরবরাহে বাধা দেওয়ার মাধ্যমে (সাধারণ মানুষের) জীবন বাঁচানোর আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টাকে ব্যাপকভাবে ব্যাহত করার সমতুল্য।’ তবে, ট্রাম্পের এভাবে কর্তৃত্ববাদ ও গণতন্ত্রের মধ্যকার লড়াইয়ে স্বৈরশাসকের পাশে দাঁড়ানোর ঘটনা এটিই প্রথম এবং সম্ভবত শেষও নয়!

যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো ধরনের সহায়তা মিয়ানমারের জান্তা শাসককে চাপে রাখতে ২০২১ সালে আসিয়ান জোট যে পাঁচ দফা উত্থাপন করেছিল, সেটিকে সরাসরি বাধাগ্রস্ত করবে। ওই সম্মেলনে বলা হয়, মিয়ানমারে সংকট সমাধানে ‘সব পক্ষের মধ্যে গঠনমূলক সংলাপ’ প্রয়োজন। যদিও আসিয়ানের এই ঐকমত্য কার্যত খুব একটা ফলপ্রসূ নয়। এর পরও যদি ট্রাম্প প্রশাসন এটি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে আসিয়ান কঠোর নিন্দা জানাবে, ফলে যুক্তরাষ্ট্র-আসিয়ান সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি হবে।

আর আসিয়ানের সমর্থন ও মিয়ানমারের সব পক্ষের সঙ্গে সংলাপ ছাড়া কেবল জান্তার সঙ্গে সমন্বয় করে বিরল মৃত্তিকা খনিজে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার চিন্তা মোটেও বাস্তবসম্মত নয়। মিয়ানমারের জান্তা যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় চীন ও রাশিয়ার প্রতি বেশি আস্থাশীল। কারণ, এরাই অস্ত্র, কূটনৈতিক সহায়তা এবং আর্থিক সাহায্য দিয়ে জান্তা সরকারকে টিকিয়ে রেখেছে। ফলে, এই বিবেচনায় চীন-রাশিয়ার স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে নেপিডো ওয়াশিংটনের স্বার্থকে প্রাধান্য দেবে, এমন সম্ভাবনা কম।

এ ছাড়া, বিরল মৃত্তিকা নিষ্কাশন বা উত্তোলন নিয়েও বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিশেষ করে খনিজসমৃদ্ধ উত্তর কাচিন রাজ্য কাচিন ইনডিপেনডেন্ট আর্মির রাজনৈতিক সরকারের হাতে। এই সরকার জান্তাবিরোধী। সাম্প্রতিক সময়ে অঞ্চলটিতে খনিজ উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। জান্তার এই অঞ্চলে তো তেমন নিয়ন্ত্রণ নেই-ই, বরং সাম্প্রতিক সময়ে তারা বিদ্রোহীদের হাতে কিছু এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে।

জান্তা সরকার কাচিনের এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণে না থাকলেও চীন এই বিতর্কিত অঞ্চল থেকে বিরল মৃত্তিকা রপ্তানিতে সুবিধা পাচ্ছে। সুতরাং, ওয়াশিংটন যদি মিয়ানমারের বিরল মৃত্তিকা সম্পদের পূর্ণ সুবিধা নিতে চায়, তাহলে তাকে হয় কাচিন ইনডিপেনডেন্স অর্গানাইজেশনের সঙ্গে চীনের চেয়ে ভালো কোনো চুক্তি করতে হবে, নয়তো জান্তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ হাসিলের মাধ্যমে খনিসমৃদ্ধ এলাকাগুলোতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তবে দ্বিতীয় অপশন নতুন জটিল পরিস্থিতি তৈরি করবে, এটি ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। সেই সঙ্গে এমন পদক্ষেপ মার্কিন মূল্যবোধ ও স্বার্থের ক্ষতির কারণ হতে পারে।

অবশ্য, নিশ্চিতভাবেই ট্রাম্প প্রশাসন এখনো এমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, যা স্পষ্টভাবে দেখায় যে তারা জান্তার পক্ষ নিয়েছে, বরং কিছু ক্ষেত্রে তারা বিপরীত কাজ করেছে। যেমন—জান্তা সরকারের ওপর ৪০ শতাংশ শুল্ক বজায় রেখেছে। খুব শিগগির এই হার কমানোর কোনো ইঙ্গিত নেই। তবে সম্প্রতি ট্রাম্প প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা উদ্বেগের বিষয়। ওয়াশিংটনকে এই বিরল খনিজের জটিল পথে আরও এগোনোর চেষ্টা এড়ানো উচিত। কারণ, এর ফলাফল অত্যন্ত মারাত্মক কৌশলগত ভুল হতে পারে।

অনুবাদ: আব্দুর রহমান, সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত