Ajker Patrika

কয়েক ছত্র

পূর্ব ও পশ্চিম-১

মযহারুল ইসলাম বাবলা 
মযহারুল ইসলাম বাবলা। ছবি: সংগৃহীত
মযহারুল ইসলাম বাবলা। ছবি: সংগৃহীত

পশ্চিম বাংলার স্থানীয় বাঙালিরা পূর্ববঙ্গীয়দের সম্পর্কে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য মনোভাব পোষণ করতেন। তার নজির আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় জেনেছি। বহু আগে থেকে কলকাতাসহ ভারত ভ্রমণের ফলে কিছু ব্যক্তির সঙ্গে আলাপে তাঁদের মনোভাব জেনেছি। করোনার আগে শান্তিপুর লোকাল ট্রেনে ফুলিয়া থেকে শিয়ালদহ ফেরার পথে শান্তিপুরের স্থানীয় এক ব্যক্তি চিৎকার করে অন্যদের শুনিয়ে বলছিলেন, ‘কুকুরকে আশ্রয় দিলেও বাঙালদের আশ্রয় দিতে নেই।’ তিনি কেন অমন কথা বলছেন, জানতে চাইলে বলেছিলেন অনেক কথা। তাঁর কথার সারসংক্ষেপ ছিল, তাঁর পিতার শান্তিপুরে তিন বিঘা সম্পত্তি ছিল। সাতচল্লিশের দেশভাগে পূর্ব বাংলা প্রত্যাগত মানুষেরা তাঁর পিতার হাত-পা ধরে দুই কাঠা, তিন কাঠা করে আড়াই বিঘা জায়গা কিনে নেয়। এতে তাঁদের পাঁচ কাঠার ওপর বসতভিটায় বসবাস করতে হচ্ছে। আর পৈতৃক জায়গায় বসবাস করা বাঙালদের দাপটে তাঁদের চুপসে থাকতে হয়। একজনের সঙ্গে বিবাদ হলে বাঁদরের ন্যায় সবাই একত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাঙালদের দাপটে তাঁদের কোণঠাসা দশা। এসব কারণেই তিনি পূর্ববঙ্গীয়দের সম্পর্কে অমন কথাগুলো বলেছিলেন।

১৯৮৬ সালে কলকাতায় স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। আশি বছর বয়সী ক্ষিতিশচন্দ্র ধর। তিনি পূর্ববঙ্গীয়দের সম্পর্কে বিদ্বেষমূলক এমন সব কথা বলেছিলেন যে তাতে বিষণ্ন হয়েছিলাম। তাঁর কথাগুলো ছিল এরূপ: পশ্চিম বাংলাই নানাভাবে পূর্ব বাংলাকে সমৃদ্ধ করেছে। পূর্ব বাংলার মানুষদের শিক্ষা ও জীবিকার জন্য কলকাতামুখী হতে হয়েছে। পূর্ব বাংলা আগাগোড়া পশ্চিম বাংলার ওপর নির্ভরশীল ছিল। পূর্ব বাংলা সভ্য মানুষের বসবাসযোগ্য ছিল না। খাল-বিল, নদ-নদী, জলাশয়, কাদামাটিতে লেপ্টে থাকা পূর্ববঙ্গ অখণ্ড বাংলার এক পশ্চাৎপদ জনপদ। সভ্যতাবঞ্চিত অজগাঁবিশেষ। পূর্ব বাংলার মানুষদের সভ্য বলেও তিনি গণ্য করেন না। সাতচল্লিশের দেশভাগে পূর্ববঙ্গীয় উদ্বাস্তুদের কারণে তাঁদের মরণদশা হয়েছিল। বাঙালদের চাপের ওই কুফল তাঁরা আজ অবধি ভোগ করছেন। দুই বাংলার সংস্কৃতিগত পার্থক্য জাজ্বল্যমান, পশ্চিম অগ্রে, পূর্ব পশ্চাতে।

পূর্ব বাংলা ও পূর্ববঙ্গীয়দের সম্পর্কে তাঁর ধারণা অত্যন্ত নিম্নস্তরের। পশ্চিম বাংলার মানুষকে পূর্ব বাংলায় যাওয়ার কোনো প্রয়োজন পড়েনি। পূর্ব বাংলার বাঙালদের বিষয়ে তাঁদের কোনো আগ্রহও ছিল না। শিক্ষা, সংস্কৃতিতে পিছিয়ে থাকা পূর্ব বাংলা তাঁদের কাছে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের প্রতীক। ভাষা ও সংস্কৃতিগত কারণে পূর্ববঙ্গীয়দের তাঁরা বাঙালির স্থলে ‘বাঙাল’ বলতেন। অবশ্য সাতচল্লিশের দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গীয়রাও তাঁদের ‘ঘটি’ বলে উপহাস করা শুরু করে। দুই বাংলার মানুষের মধ্যে কোনো সামাজিক সম্পর্ক নেই বললেই চলে। ব্যক্তিগত পছন্দে ছেলেমেয়ের বিয়ে সম্পাদনে দুই পক্ষের অভিভাবকেরা বাধ্য হলেও পারিবারিকভাবে পরস্পরের সন্তানদের বিয়ে অতীতেও দেয়নি, আজও দিতে আগ্রহী নয়। এ বিষয়ে ক্ষিতিশ বাবুকে প্রশ্ন করলে তিনি জবাব দিয়েছিলেন—সংস্কৃতিগত ব্যবধানের জন্যই দুই বাংলার নারী-পুরুষের মধ্যকার সামাজিক আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার উপায় নেই। দুই বাংলার মানুষের মাঝে প্রত্যক্ষ বিরোধ-বিবাদ নেই সত্য। মনস্তাত্ত্বিকভাবে বৈপরীত্য কিন্তু উভয়ের মাঝে বিরাজ করে আসছে। যার নজির দেখা যায় ইস্ট বেঙ্গল ও মোহনবাগান ফুটবল দলের খেলাকে কেন্দ্র করে ঘটি ও বাঙালদের পরস্পরের বিরোধে।

পূর্ববঙ্গীয়দের সম্পর্কে ক্রমাগত নেতিবাচক কথায় তাঁকে আমি বলেছিলাম, ‘আজকের পশ্চিম বাংলার খ্যাতিমান লেখক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক, অভিনয়শিল্পী, রাজনীতিক, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী সবার ব্যাকগ্রাউন্ড কিন্তু পূর্ববঙ্গীয়। তিনি দমার পাত্র নন। জোর দিয়ে বলেছিলেন, ‘তারা এখানে আসার ফলেই ঋদ্ধ হতে পেরেছে। আমাদের সংস্পর্শে না এলে কুলি, কামার, মজুর, চাষাই থাকত।’ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছিলেন, ‘কিসের মুক্তিযুদ্ধ! বলো ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধ, যুদ্ধে পাকিস্তানিদের পরাজিত করে ভারতই বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে তোমাদের উপহার দিয়েছে।’

‘আমরা বাংলাভাষী রাষ্ট্রের নাগরিক। একজন বাঙালি হিসেবে আপনার তো গর্ব করা উচিত।’ এই কথায় তিনি বলেছিলেন, ‘দেখ, আমি প্রথমে ভারতীয়। তারপর অন্যকিছু।’ আরও বলেছিলেন, ‘পূর্ববঙ্গীয়রা শুদ্ধ বাংলাও জানে না। যতটুকু শিখেছে সেটা আমাদের কাছ থেকেই। তোমাদের যতটুকু অগ্রগতি হয়েছে, সেটা আমাদের জন্যেই। টালিগঞ্জের এক বাঙাল অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেকে বাঙাল বলে গর্ব করে। এত বছরেও বাংলায় কথা পর্যন্ত বলতে পারল না। বাঙাল ভাষায়ই কথা বলে। এমনকি সিনেমাতে পর্যন্ত বাঙাল ভাষায় সংলাপ বলে আসছে।’

আমি তাঁকে মনে করিয়ে দিই খ্যাতিমান গায়ক, সুরকার শচীন দেববর্মন বাঙাল ভাষায় জীবনভর

কথা বলেছেন। এতে তো তাঁর সৃজনশীলতায় কোনো বিরূপ প্রভাব পড়েনি। তিনি আমাকে থামিয়ে বলেন, ‘ভুল বকছ কেন? শচীনকর্তা বাঙাল বা বাঙালি

নন। তিনি ত্রিপুরার রাজাদের বংশধর এবং জাতিতে বোরো বা ত্রিপুরী। বাল্যকাল থেকে কুমিল্লায় থাকার ফলে বাঙালদের সংশ্রবে বাঙাল ভাষায় অভ্যস্ত হয়েছেন। ত্রিপুরায় থাকলে ককবরক কিংবা

বোরো ভাষাই জানতেন।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সমাবেশে দলীয় স্লোগান ও জাতীয় সংগীত পরিবেশনে বাধা দেওয়া প্রসঙ্গে এনসিপির বিবৃতি

তোরা যারা রাজাকার, সময় থাকতে বাংলা ছাড়: বাকের মজুমদার

কঠোর হচ্ছে যুক্তরাজ্যের অভিবাসন নীতি, স্থায়ী বসবাসের আবেদনে অপেক্ষা ১০ বছর

চাকরিতে কোটা: সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য আসছে সমান সুযোগ

রাজপথের চাপে কোনো বিচার করা সম্ভব নয়: চিফ প্রসিকিউটর

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত