Ajker Patrika

জুলাই ছিল জনতার, এখন তার মুখপাত্র কে

আনোয়ারুল হক
আনোয়ারুল হক
আনোয়ারুল হক

এক বছর আগে এই জুলাই মাসেই দেশের সরকারি-বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, ইংরেজি মাধ্যম, পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাখে লাখে তরুণ-তরুণী রাজপথে নেমে এসেছিল। তারা এসেছিল অবিচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে, স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে এক মানবিক, গণতান্ত্রিক সমাজের স্বপ্ন নিয়ে।

বাল্যকালে আমরা পড়েছি—একটি কবিতায় খাঁচার পাখি আর বনের পাখির আলাপ। একদিকে খাঁচার শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা, অন্যদিকে বনের মুক্ত আকাশ। ২০২৪ সালের জুলাইয়ের আন্দোলনে যে তারুণ্য রাজপথে নেমেছিল, তারা ছিল সেই বনের পাখির মতো। তাদের লক্ষ্য ছিল নীল আকাশ, বাধাহীন স্বাধীনতা।

সেই তারুণ্যের মুখ উমামা ফাতেমা—যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতটি ছাত্রী হলসহ গোটা শহরের ছাত্রীদের রাজপথে নামাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন—আজ কেন আবার নিজেকে ‘বনের পাখি’ বলে ঘোষণা করছেন? কারণ, অভ্যুত্থানের পরে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে, তার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে তৈরি হচ্ছে এক পরিপাটি সোনার খাঁচা। যেখানে বসে থাকতে হয় নীরবে, প্রশ্নহীন। কিন্তু উমামা তেমন তরুণী নন। তিনি জানেন—আকাশ না দেখলে পাখি বাঁচে না।

আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের পাঁচ দশক পরও চাকরি ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক মুক্তিযোদ্ধা কোটার রাজনৈতিক ব্যবহারের বিরুদ্ধে। এর আগেও কোটা সংস্কারের দাবি উঠেছিল। কিন্তু সাড়া না দিয়ে তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অভিমানের সুরে বলেছিলেন—‘সব কোটাই বাতিল করলাম।’ এটি ছিল একধরনের স্বৈরাচারী ভাষ্য, যা সমস্যা সমাধান না করে জিইয়ে রেখেছিল।

এরপর ২০২৪ সালে, নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্বাচন আয়োজন করে, আবার ক্ষমতা নিশ্চিত করেন শেখ হাসিনা। তারপর আদালতে দ্রুত রায় দিয়ে কোটা বাতিলকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। সেখান থেকেই আন্দোলনের নতুন ঢেউ শুরু হয়।

প্রথম দিকে স্লোগানে ছিল, ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’ এবং ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই, শেখ হাসিনার বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’-এর মতো স্লোগান। আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলেন ছাত্রলীগঘনিষ্ঠ সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহ। তাঁদের অতীত ঘাঁটলে দেখা যায়—তাঁরা সরাসরি না হলেও আওয়ামী ধারার ভাবনায় ছিলেন। তাই এই ভাষা তাঁদের ছিল স্বাভাবিক।

কিন্তু যখন আদালতের রায়ের পর সরকার আন্দোলন দমন শুরু করল—লাঠিসোঁটা হাতে ছাত্রলীগকে নামানো হলো, ছাত্রছাত্রীদের ওপর হামলা হলো, রক্ত ঝরল—তখন সেই আন্দোলন আর কেবল একটি দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব রইল না। সেটা হয়ে উঠল জাতীয় প্রতিরোধ।

রংপুরে আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা, গুলিবিদ্ধ ‘পানিওয়ালা’ মুগ্ধ, রিকশার পাদানিতে গুলিবিদ্ধ গোলাম নাফিজ, শিশুর গায়ে-বুকে গুলির আঘাত—এই সব ছবি গোটা দেশের বিবেককে নাড়া দেয়। তরুণেরা তখন আর থামেনি। সরকার বিদায় নিতে বাধ্য হয়।

কিন্তু যাওয়ার আগে সরকার রেখে যায় বিভাজন, রক্তের দাগ আর আদর্শিক শূন্যতা।

১৫ বছর ধরে যে সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেছে, তারা শেষ পর্যন্ত সেই চেতনার ওপরই চুনকালি মেখে গেল। এমনকি নিজের পিতার স্মৃতিও ধুলায় মিশে গেল।

এই শূন্যতায় যাঁরা ‘অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রের বিকল্প’ হতে পারতেন, তাঁদের ব্যর্থতা এক নতুন সংকটের জন্ম দিয়েছে। আন্দোলনের ফাঁকে-ভাঁজে লুকিয়ে থাকা ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠী এবং বিভ্রান্তিকর স্লোগানধারীরা আজ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। যারা গণরুমের কোণে কোণে উগ্র মতাদর্শ নিয়ে লুকিয়ে ছিল, তারা আজ প্রকাশ্যে ধর্ম, ঘৃণা ও নারী বিদ্বেষের মুখোশ পরে মাঠে নেমেছে। এমনকি আন্দোলনের একাংশও এই দিকেই ঢলে পড়েছে।

এরই মধ্যে একটি নতুন রাজনৈতিক শক্তি এনসিপি—আন্দোলনের ‘কোটা’টি নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিতে চাইছে।

কোটাবিরোধী আন্দোলন করেও এখন তারা সর্বত্র কোটা দাবি করছে—মন্ত্রিসভা, সচিবালয়, সংসদ, ব্যবসা, টেন্ডার, মামলা—সব জায়গায়। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হলো, শহীদ ও আহতদের মধ্যে যাঁদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই, সাধারণ পরিবার থেকে এসেছেন—তাঁদের কেউ খোঁজ নেয় না। বরং একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে, যারা শহীদ তালিকা ও আর্থিক সুবিধাকে কেন্দ্র করে রাজনীতি করছে।

উমামা স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, এই অভ্যুত্থানকে এখন বাজারদরে কেনাবেচা করার চেষ্টা হচ্ছে। তিনি জানেন, আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি ছিল ছাত্রলীগ বাদে দেশের প্রায় সব ছাত্রসংগঠন এবং তার চেয়েও বড় কথা—সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা, শিক্ষকেরা, শ্রমজীবী মানুষ ও রাজপথের জনতা। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ব্যানার ছাড়াই, ছাত্রনেতাদের অনুরোধে মাঠে এসেছিল। এটা ছিল একটা অভিন্ন জনতার অভ্যুত্থান। জুলাই কারও একার নয়। তাই ‘জুলাই সনদ’ চাইলে সব অংশীজনকে নিয়ে করতে হবে।

এনসিপি এখন তাদের ছাত্রসংগঠনকে দুই ভাগে ভাগ করেছে—একদিকে ‘গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ’, যা মূলত এনসিপির ছাত্র শাখা; অন্যদিকে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’, যেখানে তারা তাদের বাইরে থাকা ছাত্রদের ধরে রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু এটি আর আগের মতো গণ-আন্দোলন নেই। এটি এখন কিছু এনসিপি সমর্থক আর কিছু মতাদর্শিক গ্রুপের সীমিত বলয়ে আবদ্ধ। এই খাঁচা ভাঙতেই উমামা বলেছেন, ‘আমি শিকল পরব না।’

কিন্তু প্রশ্ন হলো, এখন সেই অভ্যুত্থানের মুখপাত্র কে? তারা, যারা জোর করে ইতিহাসকে লিখতে চায়, নাকি তারা, যারা তা গড়ে তুলেছিল? এই প্রশ্নের উত্তরেই লুকিয়ে আছে আগামীর পথ। জনতার অভ্যুত্থান, তাদের হাতেই ফিরে আসবে। কেননা, জুলাই ছিল জনতার।

লেখক: সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

তোমাদের যে কিছু করিনি, তা-ই ভাগ্য—ডাকাতির সময় দুই কিশোরীকে সাবেক সেনা কর্মকর্তা

বিকেলে চাঁদাবাজি নিয়ে লাইভ, রাতে সাংবাদিককে কুপিয়ে হত্যা

সাধুর বেশে এসে সাবেক স্ত্রীকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা

স্টার্টআপ থেকে স্মার্ট সিটি: যেভাবে দক্ষিণ কোরিয়ার বিনিয়োগ টানছে বাংলাদেশ

বরিশাল-১: স্বপন-কুদ্দুসের দ্বন্দ্বে নির্বাচনের আগে দলে অস্থিরতা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত