সাহিদা পারভীন শিখা
‘জুলাই আন্দোলনের সময় যাঁরা রাজপথে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই নারীরা আজ ঘরে বসে আছেন। তাঁরা মুখ লুকিয়ে ফেলেছেন। এটা আমাদের জন্য ভালো বার্তা নয়।’—মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদের এই বক্তব্য শুধু হতাশার প্রকাশ নয়, বরং এক ব্যর্থ সময়ের স্বীকারোক্তি। নারী যখন রাষ্ট্রবিরোধী নয়, বরং রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হয়ে ওঠেন, তখন সমাজের নানা মুখোশ খসে পড়ে—এটাই যেন আমরা আবারও প্রত্যক্ষ করলাম জুলাই আন্দোলনের পরে। এই একটি বাক্যেই যেন বাংলাদেশের নারীর সামাজিক অবস্থান, রাজনৈতিক পরিণতি এবং সাংস্কৃতিক প্রতিক্রিয়ার এক জটিল চিত্র উঠে এসেছে।
২০২৪ সালের ১৪ জুলাই মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের হল থেকে বেরিয়ে আসা, রাজপথে মশাল নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়া এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে প্রতিবাদ জানানো—সবকিছুই একটি নতুন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অভিঘাত তৈরি করেছিল। আন্দোলনটি ছিল নারী নেতৃত্বাধীন, কিন্তু তা নারীকেন্দ্রিক ছিল না; বরং সেটি ছিল সামগ্রিক জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন, যেখানে নারীরা এগিয়ে এসেছিলেন সাহসিকতার প্রথম সারিতে।
তবে এখন এক বছরের মাথায় দেখা যাচ্ছে, সেই নারীদের অনেকে আর সামনে নেই। তাঁদের কেউ কেউ আত্মগোপনে, কেউ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, কেউবা পরিবার-সমাজের চাপের কাছে পরাজিত। শারমীন মুরশিদ জানিয়েছেন, অনেক নারী জানিয়েছেন তাঁরা আর সামনে আসতে চান না। কাউন্সেলিংয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ১০০ নারীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাঁদের খুঁজে বের করার জন্য। কিন্তু এ উদ্যোগ এত দেরিতে কেন? এই প্রশ্ন করা যেতেই পারে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে নারীরা বারবার সাহস দেখিয়েছেন, কিন্তু বারবারই তাঁদের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ তার বড় দৃষ্টান্ত। হাজার হাজার নারী তখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সাহস দেখিয়েছিলেন, যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, কিন্তু যুদ্ধ শেষে তাঁরা পাননি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা। বরং অনেকেই পেয়েছেন সমাজের অবজ্ঞা, সন্দেহ, নিঃসঙ্গতা। সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা না নিয়ে আমরা বারবার একই ভুল করে চলেছি।
জুলাই আন্দোলনের নারী অংশগ্রহণকারীদের মুখ লুকিয়ে ফেলাটা নিছক মানসিক ক্লান্তি বা ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নয় বরং এটি একটি রূঢ় ও বৈষম্যমূলক সামাজিক প্রতিক্রিয়ার প্রতিফলন। আন্দোলনের সময় তাঁদের কণ্ঠস্বর যাদের পক্ষে যায়নি, তারা আন্দোলন ব্যর্থ করার জন্য নারী নেতৃত্বকে ব্যক্তিগত আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। অপপ্রচার, সাইবার বুলিং, চরিত্রহননের ষড়যন্ত্র, ফেক পোস্ট এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা—এসব ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সচেতনভাবে, পরিকল্পিতভাবে।
এই প্রেক্ষাপটে নারীর মানসিক স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা এবং রাজনৈতিক প্রণোদনার প্রসঙ্গ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কাউন্সেলিং কেবল চিকিৎসা নয়—এটি একধরনের সামাজিক স্বীকৃতি। কাউকে যদি বলা হয়, ‘তোমার কষ্ট
আমরা বুঝি’, তবেই সেই ব্যক্তি আবার উঠে দাঁড়াতে পারেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বাংলাদেশে এখনো কাউন্সেলিংকে দুর্বলতা হিসেবে দেখা হয়। যাঁরা সামনের সারিতে ছিলেন, তাঁরা যখন হঠাৎ করে নিঃসঙ্গ হয়ে যান, তখন তাঁরা কেবল মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হন না—তাঁদের মধ্যে একধরনের আত্মদ্বন্দ্বও তৈরি হয়: ‘আমি কি ভুল করেছিলাম?’
এই দ্বন্দ্ব অনেক বেশি তীব্র হয়, যখন পরিবার, সমাজ, এমনকি সহযোদ্ধারাও দূরে সরে যায়। ফলে একজন নারী শুধু নিঃসঙ্গ নন, অপরাধবোধে ভুগতে থাকেন। তিনি ভাবেন, যদি সামনে না আসতাম, তাহলে হয়তো আজ আমাকে এসব সহ্য করতে হতো না। অথচ প্রশ্ন হওয়া উচিত ছিল, কেন একটি সমাজ নারী নেতৃত্বকে সম্মান জানাতে ব্যর্থ হলো?
শারমীন মুরশিদ এই প্রশ্নটি তুলেছেন অত্যন্ত আবেগপূর্ণ ও বাস্তবভিত্তিক ভঙ্গিতে। তিনি বলেন, ‘কিছুদিন আগেও যে নারীরা রাজপথে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করল, এখন তারা কেন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে?’ তিনি ১৯৭১ সালের উদাহরণ টেনে এনেছেন—মুক্তিযুদ্ধের পরও অনেক নারী মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু এবার যেন তা না হয়, সেই চেষ্টার কথা তিনি উল্লেখ করেন। এটিই হয়তো আমাদের সামনে থাকা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। নারীর সাহসিকতাকে স্মৃতিতে সীমাবদ্ধ না রেখে তাঁকে জীবন্ত ইতিহাসে রূপান্তরিত করা দরকার।
এমন ইতিহাস কেবল স্মৃতিস্তম্ভ বা ডকুমেন্টারির মধ্য দিয়ে রক্ষা করা যাবে না। সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী জানান, ৬৪ জেলায় জুলাই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ শুরু হচ্ছে। এটি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে প্রশ্ন হলো, যাঁরা এই ইতিহাস গড়েছেন, তাঁদের জীবনের প্রতিটি ক্ষণ আজ কেমন কাটছে? তাঁরা কি সমাজে গ্রহণযোগ্য? তাঁরা কি কর্মজীবনে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন না? তাঁদের আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীরা তাঁদের নিয়ে গর্ব করেন, না লুকিয়ে রাখেন? প্রশ্নগুলো অস্বস্তিকর, কিন্তু এড়ানো যাবে না।
এখানে আরও একটি প্রাসঙ্গিক বিষয় হচ্ছে, নারী নেতৃত্বকে কে কীভাবে দেখে? একদিকে রাষ্ট্র তাঁদের স্মরণ করছে, উৎসব করছে, স্মৃতিচিহ্ন নির্মাণ করছে, অন্যদিকে তাঁদের অনেককে সামাজিক বয়কট, অপমান, ট্রলের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। নারীরা যখন কেবল ‘ভিকটিম’ হন, তখন তাঁদের নিয়ে সহানুভূতি কাজ করে। কিন্তু যখন তাঁরা রাজনৈতিক ভাষ্য তৈরি করেন, নেতৃত্ব দেন, অবস্থান নেন—তখন তাঁদের প্রতি সহানুভূতি নয়, বরং প্রতিহিংসা, ঈর্ষা এবং বিদ্বেষ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
সাইবার বুলিং এখানে এক নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। একসময় নারীর মানসিক নিপীড়ন ঘটত সামাজিক আকারে—অন্যদের চোখে,
কথায়। এখন তা ঘটছে ডিজিটালি—অপরিচিত আইডি থেকে, ফেক ভিডিও বানিয়ে, সম্পাদিত ছবি ছড়িয়ে বা তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে
কুৎসা রটিয়ে। এই ধরনের সহিংসতা নারীর শরীরকে স্পর্শ না করেও তাঁর আত্মাকে জর্জরিত করে তোলে।
সরকার এখন একটি ২৪ ঘণ্টা সচল সাইবার নজরদারি ইউনিট গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। এটি ভালো উদ্যোগ। তবে আইন বাস্তবায়ন না হলে এবং দ্রুত বিচার না হলে এই ঘোষণা কেবল ফাইলের মধ্যেই থেকে যাবে। যারা বুলিং করে, তাদের শনাক্ত করা, প্রকাশ্যে আনা এবং বিচারের আওতায় আনা অত্যন্ত জরুরি। অন্যথায় সাহসী নারীদের বারবার মুখ লুকিয়ে ফেলার এই প্রবণতা আমাদের একটি বিপজ্জনক সামাজিক গহ্বরে ঠেলে দেবে।
তাই সময় এসেছে, শুধু নারীদের খুঁজে বের করাই নয়—তাঁদের জীবনের গল্প রাষ্ট্রীয়ভাবে সংরক্ষণের। তাঁদের প্রতিটি কণ্ঠ, প্রতিটি ক্ষত, প্রতিটি সংগ্রাম পরবর্তী প্রজন্মের জন্য শিক্ষা হতে পারে, যদি আমরা এখনই তাঁদের ইতিহাস না লিখি। তাঁদের নাম না জানলে ভবিষ্যতের ইতিহাসও ভুলে যাবে, কাদের নেতৃত্বে একটি সময় পরিবর্তন এসেছিল।
একটি কথা মনে রাখা জরুরি, নারীরা কেবল মুখ দেখিয়ে ইতিহাস রচনা করেন না, তাঁরা মুখ ফিরিয়ে নিলে ইতিহাস থমকে যায়। জুলাই আন্দোলনের মেয়েরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন, এটি নিছক ব্যক্তিগত দুর্বলতা নয়, বরং রাষ্ট্র ও সমাজের ব্যর্থতার প্রতিফলন। তাঁদের মুখ আবার ফিরিয়ে আনতে না পারলে ভবিষ্যতে কোনো নারী হয়তো আর এগিয়ে আসার সাহস পাবেন না।
আমরা যদি সত্যিই ইতিহাসকে সম্মান করি, তাহলে এখনই তাঁদের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাঁদের কষ্ট বুঝতে হবে। তাঁদের কণ্ঠকে আবার সাহস দিতে হবে। তাহলেই আমরা বলতে পারব, জুলাই আন্দোলনের নারীরা হারিয়ে যাননি, তাঁরা আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরে এসেছেন এবং এই সমাজ তাঁদের মুখ চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
লেখক:– সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় নারী শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র
‘জুলাই আন্দোলনের সময় যাঁরা রাজপথে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই নারীরা আজ ঘরে বসে আছেন। তাঁরা মুখ লুকিয়ে ফেলেছেন। এটা আমাদের জন্য ভালো বার্তা নয়।’—মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদের এই বক্তব্য শুধু হতাশার প্রকাশ নয়, বরং এক ব্যর্থ সময়ের স্বীকারোক্তি। নারী যখন রাষ্ট্রবিরোধী নয়, বরং রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হয়ে ওঠেন, তখন সমাজের নানা মুখোশ খসে পড়ে—এটাই যেন আমরা আবারও প্রত্যক্ষ করলাম জুলাই আন্দোলনের পরে। এই একটি বাক্যেই যেন বাংলাদেশের নারীর সামাজিক অবস্থান, রাজনৈতিক পরিণতি এবং সাংস্কৃতিক প্রতিক্রিয়ার এক জটিল চিত্র উঠে এসেছে।
২০২৪ সালের ১৪ জুলাই মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের হল থেকে বেরিয়ে আসা, রাজপথে মশাল নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়া এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে প্রতিবাদ জানানো—সবকিছুই একটি নতুন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অভিঘাত তৈরি করেছিল। আন্দোলনটি ছিল নারী নেতৃত্বাধীন, কিন্তু তা নারীকেন্দ্রিক ছিল না; বরং সেটি ছিল সামগ্রিক জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন, যেখানে নারীরা এগিয়ে এসেছিলেন সাহসিকতার প্রথম সারিতে।
তবে এখন এক বছরের মাথায় দেখা যাচ্ছে, সেই নারীদের অনেকে আর সামনে নেই। তাঁদের কেউ কেউ আত্মগোপনে, কেউ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, কেউবা পরিবার-সমাজের চাপের কাছে পরাজিত। শারমীন মুরশিদ জানিয়েছেন, অনেক নারী জানিয়েছেন তাঁরা আর সামনে আসতে চান না। কাউন্সেলিংয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ১০০ নারীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাঁদের খুঁজে বের করার জন্য। কিন্তু এ উদ্যোগ এত দেরিতে কেন? এই প্রশ্ন করা যেতেই পারে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে নারীরা বারবার সাহস দেখিয়েছেন, কিন্তু বারবারই তাঁদের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ তার বড় দৃষ্টান্ত। হাজার হাজার নারী তখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সাহস দেখিয়েছিলেন, যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, কিন্তু যুদ্ধ শেষে তাঁরা পাননি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা। বরং অনেকেই পেয়েছেন সমাজের অবজ্ঞা, সন্দেহ, নিঃসঙ্গতা। সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা না নিয়ে আমরা বারবার একই ভুল করে চলেছি।
জুলাই আন্দোলনের নারী অংশগ্রহণকারীদের মুখ লুকিয়ে ফেলাটা নিছক মানসিক ক্লান্তি বা ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নয় বরং এটি একটি রূঢ় ও বৈষম্যমূলক সামাজিক প্রতিক্রিয়ার প্রতিফলন। আন্দোলনের সময় তাঁদের কণ্ঠস্বর যাদের পক্ষে যায়নি, তারা আন্দোলন ব্যর্থ করার জন্য নারী নেতৃত্বকে ব্যক্তিগত আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। অপপ্রচার, সাইবার বুলিং, চরিত্রহননের ষড়যন্ত্র, ফেক পোস্ট এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা—এসব ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সচেতনভাবে, পরিকল্পিতভাবে।
এই প্রেক্ষাপটে নারীর মানসিক স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা এবং রাজনৈতিক প্রণোদনার প্রসঙ্গ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কাউন্সেলিং কেবল চিকিৎসা নয়—এটি একধরনের সামাজিক স্বীকৃতি। কাউকে যদি বলা হয়, ‘তোমার কষ্ট
আমরা বুঝি’, তবেই সেই ব্যক্তি আবার উঠে দাঁড়াতে পারেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বাংলাদেশে এখনো কাউন্সেলিংকে দুর্বলতা হিসেবে দেখা হয়। যাঁরা সামনের সারিতে ছিলেন, তাঁরা যখন হঠাৎ করে নিঃসঙ্গ হয়ে যান, তখন তাঁরা কেবল মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হন না—তাঁদের মধ্যে একধরনের আত্মদ্বন্দ্বও তৈরি হয়: ‘আমি কি ভুল করেছিলাম?’
এই দ্বন্দ্ব অনেক বেশি তীব্র হয়, যখন পরিবার, সমাজ, এমনকি সহযোদ্ধারাও দূরে সরে যায়। ফলে একজন নারী শুধু নিঃসঙ্গ নন, অপরাধবোধে ভুগতে থাকেন। তিনি ভাবেন, যদি সামনে না আসতাম, তাহলে হয়তো আজ আমাকে এসব সহ্য করতে হতো না। অথচ প্রশ্ন হওয়া উচিত ছিল, কেন একটি সমাজ নারী নেতৃত্বকে সম্মান জানাতে ব্যর্থ হলো?
শারমীন মুরশিদ এই প্রশ্নটি তুলেছেন অত্যন্ত আবেগপূর্ণ ও বাস্তবভিত্তিক ভঙ্গিতে। তিনি বলেন, ‘কিছুদিন আগেও যে নারীরা রাজপথে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করল, এখন তারা কেন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে?’ তিনি ১৯৭১ সালের উদাহরণ টেনে এনেছেন—মুক্তিযুদ্ধের পরও অনেক নারী মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু এবার যেন তা না হয়, সেই চেষ্টার কথা তিনি উল্লেখ করেন। এটিই হয়তো আমাদের সামনে থাকা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। নারীর সাহসিকতাকে স্মৃতিতে সীমাবদ্ধ না রেখে তাঁকে জীবন্ত ইতিহাসে রূপান্তরিত করা দরকার।
এমন ইতিহাস কেবল স্মৃতিস্তম্ভ বা ডকুমেন্টারির মধ্য দিয়ে রক্ষা করা যাবে না। সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী জানান, ৬৪ জেলায় জুলাই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ শুরু হচ্ছে। এটি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে প্রশ্ন হলো, যাঁরা এই ইতিহাস গড়েছেন, তাঁদের জীবনের প্রতিটি ক্ষণ আজ কেমন কাটছে? তাঁরা কি সমাজে গ্রহণযোগ্য? তাঁরা কি কর্মজীবনে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন না? তাঁদের আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীরা তাঁদের নিয়ে গর্ব করেন, না লুকিয়ে রাখেন? প্রশ্নগুলো অস্বস্তিকর, কিন্তু এড়ানো যাবে না।
এখানে আরও একটি প্রাসঙ্গিক বিষয় হচ্ছে, নারী নেতৃত্বকে কে কীভাবে দেখে? একদিকে রাষ্ট্র তাঁদের স্মরণ করছে, উৎসব করছে, স্মৃতিচিহ্ন নির্মাণ করছে, অন্যদিকে তাঁদের অনেককে সামাজিক বয়কট, অপমান, ট্রলের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। নারীরা যখন কেবল ‘ভিকটিম’ হন, তখন তাঁদের নিয়ে সহানুভূতি কাজ করে। কিন্তু যখন তাঁরা রাজনৈতিক ভাষ্য তৈরি করেন, নেতৃত্ব দেন, অবস্থান নেন—তখন তাঁদের প্রতি সহানুভূতি নয়, বরং প্রতিহিংসা, ঈর্ষা এবং বিদ্বেষ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
সাইবার বুলিং এখানে এক নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। একসময় নারীর মানসিক নিপীড়ন ঘটত সামাজিক আকারে—অন্যদের চোখে,
কথায়। এখন তা ঘটছে ডিজিটালি—অপরিচিত আইডি থেকে, ফেক ভিডিও বানিয়ে, সম্পাদিত ছবি ছড়িয়ে বা তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে
কুৎসা রটিয়ে। এই ধরনের সহিংসতা নারীর শরীরকে স্পর্শ না করেও তাঁর আত্মাকে জর্জরিত করে তোলে।
সরকার এখন একটি ২৪ ঘণ্টা সচল সাইবার নজরদারি ইউনিট গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। এটি ভালো উদ্যোগ। তবে আইন বাস্তবায়ন না হলে এবং দ্রুত বিচার না হলে এই ঘোষণা কেবল ফাইলের মধ্যেই থেকে যাবে। যারা বুলিং করে, তাদের শনাক্ত করা, প্রকাশ্যে আনা এবং বিচারের আওতায় আনা অত্যন্ত জরুরি। অন্যথায় সাহসী নারীদের বারবার মুখ লুকিয়ে ফেলার এই প্রবণতা আমাদের একটি বিপজ্জনক সামাজিক গহ্বরে ঠেলে দেবে।
তাই সময় এসেছে, শুধু নারীদের খুঁজে বের করাই নয়—তাঁদের জীবনের গল্প রাষ্ট্রীয়ভাবে সংরক্ষণের। তাঁদের প্রতিটি কণ্ঠ, প্রতিটি ক্ষত, প্রতিটি সংগ্রাম পরবর্তী প্রজন্মের জন্য শিক্ষা হতে পারে, যদি আমরা এখনই তাঁদের ইতিহাস না লিখি। তাঁদের নাম না জানলে ভবিষ্যতের ইতিহাসও ভুলে যাবে, কাদের নেতৃত্বে একটি সময় পরিবর্তন এসেছিল।
একটি কথা মনে রাখা জরুরি, নারীরা কেবল মুখ দেখিয়ে ইতিহাস রচনা করেন না, তাঁরা মুখ ফিরিয়ে নিলে ইতিহাস থমকে যায়। জুলাই আন্দোলনের মেয়েরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন, এটি নিছক ব্যক্তিগত দুর্বলতা নয়, বরং রাষ্ট্র ও সমাজের ব্যর্থতার প্রতিফলন। তাঁদের মুখ আবার ফিরিয়ে আনতে না পারলে ভবিষ্যতে কোনো নারী হয়তো আর এগিয়ে আসার সাহস পাবেন না।
আমরা যদি সত্যিই ইতিহাসকে সম্মান করি, তাহলে এখনই তাঁদের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাঁদের কষ্ট বুঝতে হবে। তাঁদের কণ্ঠকে আবার সাহস দিতে হবে। তাহলেই আমরা বলতে পারব, জুলাই আন্দোলনের নারীরা হারিয়ে যাননি, তাঁরা আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরে এসেছেন এবং এই সমাজ তাঁদের মুখ চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
লেখক:– সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় নারী শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে। গত বছর জুলাই-আগস্টে দেশে গড়ে ওঠা ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটে। তখন সাধারণ মানুষের মনে একধরনের ইতিবাচক প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছিল।
২১ ঘণ্টা আগেবর্ষাকাল এলেই যেন ঢাকায় জলাবদ্ধতা ভর করে বসে। জলাবদ্ধতা যখন এই শহরের ঘাড়ে চেপে বসে, তখন এই নগরের মানুষকে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়। আজ এই শহরের এত সমস্যার মুখোমুখি হতে হতো না যদি তারা অপরিকল্পিত নগরায়ণের দিকে না ঝুঁকত, যদি নদী কিংবা খালের স্থান দখল না করে কোনো স্থাপনা করার পরিকল্পনা করত।
২১ ঘণ্টা আগেটাঙ্গাইলের সখীপুর-কচুয়া-আড়াইপাড়া সড়কের যে করুণ অবস্থা, তা আসলে আমাদের সড়ক যোগাযোগব্যবস্থার অব্যবস্থাপনার এক করুণ প্রতিচ্ছবি। সাত কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক—যেখানে প্রতিদিন স্কুলশিক্ষার্থী, রোগী, কৃষিপণ্যবাহী ট্রাক ও হাজারো সাধারণ মানুষ চলাচল করে।
২১ ঘণ্টা আগেজুলাই অভ্যুত্থানের এক বছর হয়ে গেল। ওই অভ্যুত্থানের সময় দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি ছিল। মূলত তারা ফ্যাসিবাদী সরকারব্যবস্থার পতন ঘটিয়ে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিল। মূলত বাংলাদেশের মূল সমস্যা সেটাই যে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে একটি
২ দিন আগে