Ajker Patrika

আমাদের শিশুরা কী করবে?

রুমা মোদক
আমাদের শিশুরা কী করবে?

বাংলাদেশে সব অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে পাবজি, ফ্রি-ফায়ারসহ ক্ষতিকর অনলাইন গেমস আগামী তিন মাস বন্ধ থাকার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ ছাড়া টিকটক, লাইকি, বিগো লাইভসহ অনলাইন লাইভ স্ট্রিমিং অ্যাপগুলো কেন বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।

২০২১ সালের ২৪ জুন দেশীয় সব অনলাইন প্ল্যাটফর্মে টিকটক, বিগো লাইভ, লাইকি, পাবজি, ফ্রি-ফায়ারের মতো গেমসগুলো বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করা হয়। ওই রিট আবেদনের শুনানিতেই ১৬ আগস্ট এই নির্দেশ দেওয়া হলো। সিদ্ধান্তটি অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং সত্যিকার অর্থে একটি সোশ্যাল ডিলেইমা থেকে আমাদের আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করার জন্য এর বিকল্প নেই।

এই গেমগুলো ভয়াবহ নেশার মতো। করোনাকালে নিজের সন্তানসহ আত্মীয়স্বজন প্রায় সবার বাচ্চাদের দেখেছি এই গেমে ডুবে আছে। অন্তত গৃহবন্দী লকডাউনে এই গেম থাকার কারণে অনেক বাচ্চাই বন্দিজীবনের অসহায়ত্ব, দমবন্ধতার জন্য অভিভাবককে খুব ভোগায়নি। খারাপ দিক অসংখ্য। লক্ষ করেছি, গেমগুলো খেলার সময় বাচ্চারা দুটো কথা উচ্চারণ করে, ‘এনিমি, এনিমি’, ‘মার, মার’। বাচ্চারা ডুবে থাকে, কখনোই তলিয়ে দেখিনি এরা কীভাবে এনিমি ধরে আর মারে। এই নিষ্পাপ শিশুদের মুখে শব্দগুলো শোনা মোটেই প্রীতিকর নয়।

আমরা তো শিশুদের মধ্যে সব সুকুমারবৃত্তির উন্মেষ ঘটিয়ে তাদের দূরে রাখতে চাই পৃথিবীর যাবতীয় অন্ধকার-অসুস্থতা থেকে। অথচ খেলার নামে ওরা ঢুকে যাচ্ছে এক কাল্পনিক প্রতিহিংসার জগতে। কিন্তু আমাদের শিশুরা করবে কী? আট-দশ বছর আগের কথা মনে পড়ছে। ডিজনি চ্যানেলে ‘ডোরেমন’ নামে একটা শিশুতোষ সিরিয়াল হতো। জাপানি সিরিয়াল, হিন্দিতে ডাবিং করা। বাচ্চাদের খাইয়ে দেওয়ার ফাঁকে মাঝে মাঝে আমারও সুযোগ হতো সিরিয়ালটি দেখার। বৈজ্ঞানিক কল্পনার জগৎ খুলে দেওয়ার মনকাড়া গল্প। শিশুরা গভীর মনোযোগ আর আগ্রহে সিরিয়ালটা দেখত। একদিন দেখলাম জাতীয় সংসদে এর কী কী যেন খারাপ প্রভাব নিয়ে মাননীয় সাংসদেরা আলোচনা করলেন, পরদিন থেকে চ্যানেলটি বন্ধ।

আমার মেয়ে পদ্যর সেই থেকে কয়েক দিন কী কান্না! পছন্দের কিছু হারিয়ে গেলে বাচ্চারা কাঁদবে স্বাভাবিক, কিন্তু আমি তখন আবিষ্কার করেছিলাম অভিভাবক হিসেবে আমার অসহায়ত্ব। আমার কথাটা সেখানেই। একের পর এক দখলদারদের হাতে যাচ্ছে আমাদের খেলার মাঠ। সাঁতার কাটার পুকুরগুলো হয় ময়লা-ডোবা, নয়তো একেবারেই হারিয়ে গেছে।

মহামারির কারণে ওদের স্কুল বন্ধ। শহরে শহরে সামাজিক পরিবেশ কিশোর গ্যাংয়ের দখলে, বাচ্চাদের একমুহূর্ত নিশ্চিন্তে বাইরে ছাড়ার উপায় নেই। একটা ভালো শিশুতোষ বাংলা চ্যানেল নেই। সবেধন নীলমণি ‘দুরন্ত টিভি’ এই মফস্বলে কেব্‌ল অপারেটররা ক্ষণে দেন, ক্ষণে বন্ধ করে রাখেন।

আমাদের শিশুরা করবেটা কী? সুকুমারবৃত্তির বিকাশ তো দূর অস্ত, এদের সময়টা কাটবে কী করে, কেউ ভেবে দেখেছেন? শিশুদের বিনোদনহীন করে ফেলছেন যাঁরা, তাঁরা কি একটি মুহূর্ত একটু ভেবে দেখবেন, আমাদের শিশুরা কতটা অসহায়? আপনাদের বাতাবি লেবু দিয়ে ফুটবল খেলা আর উদ্দাম পুকুরে সাঁতার কাটার রূপকথা শুনে বড় হচ্ছে এরা। এদের যাপনে কোনো গল্প তৈরি তো হচ্ছেই না, বরং সারা দিন ‘ভাল্লাগে না’ নামের এক ডিপ্রেশন তাদের ভেতরে ভেতরে এক হতাশার প্রজন্ম করে গড়ে তুলছে।

আচ্ছা, আমাদের মধ্যে এমন সাহসী কেউ কি আছেন, যিনি প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী, ক্ষমতাবান দখলদারদের বিরুদ্ধে একটা মামলা ঠুকে দিতে পারেন? আর সেই সূত্রে মহামান্য আদালত ফিরিয়ে দিতে পারেন আমাদের শিশুদের খেলার মাঠ, উদ্দাম জলাশয় আর আনন্দময় শৈশব? আছেন কি কেউ, আমাদের অভিভাবকদের বলতে পারেন নিজেদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার মতো মেশিন আপনাদের সন্তান নয়? 

লেখক: সাহিত্যিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত