Ajker Patrika

যুদ্ধের নামে পুঁজি: ভারত-পাকিস্তান সংঘাত

হাবীব ইমন
যুদ্ধের নামে পুঁজি: ভারত-পাকিস্তান সংঘাত

সাম্রাজ্যবাদ একসময় যেভাবে বন্দুকের জোরে উপনিবেশ কায়েম করত, আজ সেই একই রণনীতি চলছে অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও প্রযুক্তিগত আধিপত্যের দাপটে। এই জটিল ও নির্মম বাস্তবতায় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের অবস্থান কোন দিকে—এই প্রশ্ন কেবল কূটনৈতিক নয়, একান্তভাবে রাজনৈতিক, মানবিকও বটে। এই লেখা সেই প্রশ্নের দিকেই চোখ ফেরাতে চায়।

আমরা দাঁড়িয়ে আছি এক সংঘাতের মাঝখানে—যে সংঘাত আমাদের তৈরি নয়, যার বীজ অন্যের হাতে বোনা, কিন্তু ফল আমাদের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ভারতের প্রতি অন্ধ আনুগত্য আর পাকিস্তানের প্রতি ধর্মীয় আবেগ—এ দুই মেরুর মাঝে পড়ে আছে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ, আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন।

কাশ্মীরের পেহেলগামে ২৬ জন নিহত। ভারত অভিযোগ করে পাকিস্তানের দিকে। পাকিস্তান অস্বীকার করে। পাল্টা হামলা, বিমান ধ্বংস, সীমান্তে উত্তেজনা, নিহতের সংখ্যা ৪৩। কাশ্মীরের আকাশে ধোঁয়ার রেখা যখন ক্রমে অন্ধকার করে তোলে, তখন একই সময়ে গাজার আকাশে ইসরায়েলের আগ্রাসনে শত শত ফিলিস্তিনি নিহত। দুটি ভিন্ন মানচিত্র, দুটি ভিন্ন ভাষা—তবু একটাই ছায়া: সাম্রাজ্যবাদ। সেই ছায়া যখন ঘন হয়, তখন জাতিসংঘ শুধু বিবৃতি দেয়, যুক্তরাষ্ট্র কেবল উদ্বেগ জানায়, আর বেইজিং-মস্কো-ওয়াশিংটন—সবাই কৌশলে হাসে। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে দাঁড়িয়ে যে রক্ত ঝরে, তা কোনো ক্ষমতাধর মানে না। ইতিহাস কেবল ‘মিত্র’ আর ‘শত্রু’র গল্প বলে।

এই উত্তেজনা, এই যুদ্ধের হুংকার—সবই পুরোনো এক যন্ত্রের পুনরাবৃত্তি, যেখানে রাষ্ট্র নামক শিকারিরা নিজেরাই তাদের জনগণকে ভয়ে রাখে, ভুলিয়ে রাখে। কিন্তু আসল শিকার কে? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গেলে পৌঁছাতে হয় ১৯৪৭-এর বিভাজনে, যেখানে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেন এক শাসকের মতো খণ্ড-বিচ্ছিন্ন করে দিল দুই ভ্রাতৃপ্রতিম জাতিকে। কেবল ধর্মের বিভাজন নয়, ছিল ভূগোলের ভাগাভাগি, ইতিহাসের বিকৃতি এবং জনগণের আত্মপরিচয় মুছে ফেলার এক নিষ্ঠুর প্রয়াস।

এই বিভাজনের সুফল আজও ভোগ করছে সাম্রাজ্যবাদ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সামরিক সাম্রাজ্য ন্যাটো—এই উপমহাদেশের দ্বন্দ্বকে ব্যবহার করছে একটি ‘ডিপ ফ্রন্টিয়ার’ হিসেবে, যেখানে অস্ত্র বিক্রি, সামরিক চুক্তি এবং ‘সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা’র নামে লালিত হচ্ছে স্থায়ী উত্তেজনা। যখন আমেরিকার সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়া করে ভারত, কিংবা আইএমএফের ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়ে পাকিস্তান, তখন আসলে কারা জয়ী হয়?

আমরা কি ভুলে গেছি, কীভাবে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতকে যুগের পর যুগ ধরে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ নিজের বৈধতা প্রতিষ্ঠার কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছে? ভারত-পাকিস্তান পরিস্থিতিও আজ সেই একই ছাঁচে প্রবেশ করছে। কাশ্মীর আজ আর কেবল একটি ভৌগোলিক সংকট নয়—এটি এক সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক লড়াই। এক দিকে রাষ্ট্রযন্ত্রের ট্যাংক, আরেক দিকে জনগণের বঞ্চিত চিৎকার।

যখন কৃষক আন্দোলনের দাবিগুলো দমিয়ে ফেলা হয়, যখন শ্রমিকদের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়, তখন ভারত সরকার অভ্যন্তরীণ সংকট থেকে জনগণের দৃষ্টি সরাতে সীমান্ত উত্তেজনাকে ব্যবহার করে। পাকিস্তানও একই কৌশল নেয়, যখন অভ্যন্তরীণ ধর্মীয় মৌলবাদ কিংবা অর্থনৈতিক বিপর্যয় চাপ বাড়ায়। কিন্তু এ দুই রাষ্ট্রের আপাতত বিরোধের মাঝেই রয়েছে গভীর এক সংযোগ—উভয়েই সাম্রাজ্যবাদের ছায়াতলে দাঁড়িয়ে। আমেরিকার ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ কৌশলের প্রধান মিত্র ভারত আর চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ পরিকল্পনায় যুক্ত পাকিস্তান। অর্থাৎ, উভয়েই একেকটি সাম্রাজ্যবাদী জোটের মঞ্চে খেলছে জনগণের দুঃখকে পণ্যে পরিণত করে।

আজকের বিশ্বে যুদ্ধ আর রাজনীতির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। যুদ্ধ এখন রাজনীতির ব্যাকরণ—সেখানে অস্ত্র হলো ব্যাকরণবিধি আর কূটনীতি তার ছদ্ম-সমালোচক। ভারতের জাতীয়তাবাদ ও পাকিস্তানের ধর্মীয় জুজু, উভয়ই মূলত জনমত নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার। বাংলাদেশ? এক অনির্ধারিত দর্শক, যে না চাইলেও টিকিট কেটে বসে আছে—একটি ভূতুড়ে নাটকের প্রথম সারিতে।

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র রাষ্ট্র, যার একদিকে ভারত, অন্যদিকে বঙ্গোপসাগর—যেখানে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার কৌশলগত প্রতিযোগিতা দিনে দিনে বাড়ছে। সুতরাং ভারত-পাকিস্তান সংঘাত কেবল ‘দুই দেশের বিষয়’ নয়। এর পরোক্ষ অভিঘাত গভীরভাবে বাংলাদেশকে ছুঁয়ে যায়। ভারত চাইবে বাংলাদেশের নৈতিক সমর্থন। চীন চাইবে নিরপেক্ষতা। যুক্তরাষ্ট্র চাইবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা।

যুদ্ধ মানে জ্বালানির দাম বাড়া, পণ্য সরবরাহে বিঘ্ন, বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা। ইউক্রেন যুদ্ধ যেমন বাংলাদেশের তৈরি পোশাকনির্ভর বাজারে ধাক্কা দিয়েছে, ভারত-পাকিস্তান সংঘাতেও রপ্তানিনির্ভর খাত, বিশেষ করে গার্মেন্টস ও ওষুধশিল্প প্রভাবিত হবে। যুদ্ধ মানে চরমপন্থার উত্থান, বিভাজনের রাজনীতি, উদ্বাস্তু প্রবাহ ও সন্ত্রাসবাদের জৈবিক উষ্ণতা। কাশ্মীরের যেকোনো অস্থিরতা বাংলাদেশে মৌলবাদী তৎপরতার অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়ায়—ইতিহাস বলেছে তেমনই। ভারত যদি দীর্ঘ মেয়াদে পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সামরিক ঘাঁটি ও নজরদারি বাড়ায়, তাহলে তার ছায়া বাংলাদেশে পড়বেই।

বাংলাদেশ যদি কেবল ‘কোনো পক্ষ না নেওয়া’ নীতিতে চলে, তাহলে সে আন্তর্জাতিক রাজনীতির বোর্ডে ঘুঁটি হয়ে থাকবে। সময় এসেছে এক নতুন ‘আধা-অবস্থানীয় কূটনীতি’ চালুর, যেখানে আমরা শুধু প্রতিবেশী নই, আমরা পথনির্দেশক হতে পারি। বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, দক্ষিণ আফ্রিকা—এই দেশগুলোর একটি স্বতন্ত্র জোট প্রয়োজন, যারা ‘উন্নয়নভিত্তিক নিরপেক্ষতা’ চালাতে পারে। ভারত বা চীননির্ভরতার বদলে বাংলাদেশকে মাল্টিন্যাশনাল প্রশিক্ষণ, ক্ষুদ্র প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং সাইবার নিরাপত্তায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। যুদ্ধজীবী রাষ্ট্র নয়, চতুর কৌশলগত মধ্যপন্থী রাষ্ট্র হতে হবে।

ভারত ও পাকিস্তানের সাম্প্রতিক সংঘাতকে যদি কেবল ‘সীমান্ত উত্তেজনা’ হিসেবে দেখি, তাহলে আমরা কেবল খবর পড়ি, ইতিহাস বুঝি না। এপ্রিলের শেষে কাশ্মীরে যেসব প্রাণ হারাল, সেগুলোর দায় পাকিস্তানকে দিয়ে ভারত বিমান হামলা চালায়, পাল্টা জবাব আসে এবং দক্ষিণ এশিয়ার দুই পরমাণু শক্তির মাঝে আবারও যুদ্ধের প্রহর গোনা শুরু হয়।

এদিকে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন যেন আরেক উন্মত্ত অধ্যায়—হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে গাজাকে জনমানবহীন করতে চাইছে তারা। জাতিসংঘ এই আগ্রাসনকে গণহত্যার দিকে এগোনো বললেও পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো নীরব, বরং যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে ইসরায়েল আরও সাহসী।

দুই অঞ্চল, দুই যুদ্ধ কিন্তু লক্ষ্য এক—অস্ত্র বিক্রি ও ভূরাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ। ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের সুযোগে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে আর চীন পাকিস্তানকে সামরিক সহায়তা দিয়ে দক্ষিণ এশিয়াকে অস্ত্রভান্ডারে পরিণত করছে। এই সহায়তা প্রকৃত অর্থে একধরনের রাজনৈতিক পুঁজি, যা দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে বাজার ও প্রভাব দখল করা হয়।

সবচেয়ে চরম সত্য হলো—এই যুদ্ধগুলো আসলে ‘আমাদের যুদ্ধ’ নয়, তবে ফলাফল আমাদেরও ভোগ করতে হয়। অর্থনৈতিক চাপ, সামাজিক উত্তেজনা, ভূরাজনৈতিক কোণঠাসা হওয়া—এ সবই বাংলাদেশের নিত্যদিনের বাস্তবতা হয়ে দাঁড়ায়। আর আমরা তর্ক করি—কে পাকিস্তানের পক্ষে, কে ভারতের। একটি সংঘাতের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমরা ভুলে যাচ্ছি যে এই যুদ্ধ আমাদের নয়। তবু আমরা যেন কেউ না কেউ একটা পক্ষেই দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছি। আমাদের রাজনীতিও সেই বিভক্তির প্রতিচ্ছবি—একটা অংশ ভারতের প্রতি অতিনির্ভর, আরেক অংশ মুসলিম বিশ্বে পাকিস্তান বা আরব শক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় নিজেদের কল্পিত বিজয় খোঁজে। এই বিভাজনের ফলেই অন্তর্বর্তী সরকার গোপনে কোনো পক্ষের হয়ে ‘নেতৃত্ব’ নিতে চায়, আবার জনগণের সামনে নিরপেক্ষতার মুখোশ পরে। কিন্তু সত্য হলো—যে রাষ্ট্র অন্যের যুদ্ধে জড়ায়, সে নিজের ভবিষ্যৎ হারায়। আমাদের কূটনীতি যদি একসময় অন্যের ফ্ল্যাগে রং চায়, তবে একদিন নিজের পতাকা ম্লান হয়।

প্রকৃতপক্ষে, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হলো—বিভক্ত হয়ে পড়া নয়, বরং আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধচিন্তা গড়ে তোলা। ফিলিস্তিনের প্রশ্নে স্পষ্ট অবস্থান নেওয়া যেমন নৈতিক দায়িত্ব, তেমনি ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে ‘অন্ধ পক্ষপাত’ নয়, চাই তৃতীয় বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থান।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

কী লিখেছিলেন মাহফুজ আলম, ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে ডিলিট করলেন কেন

প্রশাসনিক আদেশে জামায়াত নিষিদ্ধ ভুল, আ.লীগের কার্যক্রম বন্ধ সঠিক: বিএনপি

এবার ‘পাকিস্তানপন্থার’ বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলেন আসিফ মাহমুদ

সমাবেশে দলীয় স্লোগান ও জাতীয় সংগীত পরিবেশনে বাধা দেওয়া প্রসঙ্গে এনসিপির বিবৃতি

পাকিস্তানে হামলায় ভারত কি ‘ব্রহ্মস’ ছুড়েছিল

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত