Ajker Patrika

রাজনীতিতে তরুণদের জায়গা দিতে হবে

আব্দুর রাজ্জাক খান
রাজনীতিতে তরুণদের জায়গা দিতে হবে

৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের রাজনীতিতে পালাবদলের হাওয়া বইছে। রাজপথের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবার রাজনৈতিক অঙ্গনেও এসেছে জোয়ার। একের পর এক নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটছে। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ নিবন্ধনের জন্য ৬৫টি নতুন রাজনৈতিক দল আবেদন করেছে, যার অনেকগুলোই গত ৯ মাসের মধ্যে গঠিত।

নতুন দলগুলোর মধ্যে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’, গণঅধিকার পরিষদের একাংশের নেতৃত্বে আমজনতার দল, ডেসটিনি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল আমীনের নেতৃত্বে ‘বাংলাদেশ আ-আম জনতা পার্টি’, চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের নেতৃত্বে ‘জনতা পার্টি বাংলাদেশ’ এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। সামনে আরও কিছু দলের আত্মপ্রকাশ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

যেসব নতুন রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করেছে, সেগুলোর কোনোটির নেতৃত্বে আসছেন ছাত্র আন্দোলন থেকে, কেউ সামাজিক সংগঠনের অভিজ্ঞতা নিয়ে, আবার কেউ বিতর্কিত অতীত পেছনে ফেলে নতুন করে রাজনীতির ময়দানে নামছেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিংবা চায়ের কাপের অড্ডায় এসব দল নিয়ে চলছে সরব আলোচনা—কেউ সম্ভাবনা দেখছেন, কেউ করছেন বিদ্রুপ।

তবে মনে রাখতে হবে, নতুন রাজনৈতিক দল গঠন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকদের মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার। এই অধিকার শুধু কাগজে-কলমে নয়, বাস্তব জীবনেও চর্চা করার সুযোগ থাকা দরকার। কারণ এর মধ্য দিয়েই জনগণ রাষ্ট্র পরিচালনার প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারে।

নতুন রাজনৈতিক দল গঠন মানে শুধু নতুন একটি সংগঠন নয়, বরং এটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, নতুন চিন্তাধারা ও বিকল্প রাজনৈতিক দর্শনের প্রতিফলন। এটি রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং বিকল্প নেতৃত্ব গঠনের পথও সুগম করে, যা সুস্থ ও প্রাণবন্ত গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য। এভাবে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত হলেই একটি কার্যকর, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক সরকারব্যবস্থা গড়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হয়। ফলে সরকার জনমতের প্রতি সংবেদনশীল হয় এবং ক্ষমতার অপব্যবহার কমে আসার লক্ষণ ফুটে ওঠে। সমাজে শুধু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাই নয়, সামাজিক ন্যায়বিচার, উন্নয়নের পথও সুগম হয়।

দীর্ঘদিন ধরে আমাদের দেশে ভিন্নমত দমনের একটি প্রবণতা ছিল। নতুন কোনো রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টা মানেই ‘দেশদ্রোহী’, ‘বিদেশি এজেন্ট’ কিংবা ‘অপরাজনৈতিক’ তকমা জুড়ে দেওয়া—এটি ছিল নিয়মিত ঘটনা। নতুন রাজনৈতিক দলকে প্রকৃত অর্থে গড়ে উঠতে দেওয়া হয় না। তারা নামমাত্র অবস্থায় থাকলে তেমন বাধা আসে না। কিন্তু যখনই তারা জনসমর্থন পেতে শুরু করে বা রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তখনই নানা কূটকৌশল, ষড়যন্ত্র ও মিথ্যা অপবাদ দিয়ে তাদের দমন করার চেষ্টা শুরু হয়। উদ্দেশ্য একটাই—তাদের অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেওয়া। এ ধরনের রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা দরকার। এখনই সময় একটি সহনশীল, বহুমাত্রিক ও ন্যায়ের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করার।

সাম্প্রতিক সময়ের কিছু পরিবর্তন আশাব্যঞ্জক। নতুন দল গঠনের যে ধারা সূচিত হয়েছে, তা যদি নিঃসংকোচে ও বাধাহীনভাবে এগিয়ে যেতে পারে, তাহলে তা দেশের গণতন্ত্রের জন্য একটি ইতিবাচক ধারা তৈরিতে সহায়ক হবে।

রাজনীতি কেবল ক্ষমতার লড়াই না হয়ে হওয়া উচিত দেশ ও সমাজের সেবা ও ত্যাগের ক্ষেত্র। রাজনীতি খ্যাতিমান, বিত্তবান কিংবা কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর একচেটিয়া খেলার মাঠ হতে পারে না। শিক্ষক, কৃষক, কামার, কুমার—সব পেশার মানুষের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ অবারিত হওয়া উচিত। সুবিধাবাদী, সুবিধাভোগী চাটুকারদের হাত থেকে মুক্ত হয়ে রাজনীতি ভালো মানুষদের অধিকারে না আসা পর্যন্ত দেশের সুস্থ ধারার রাজনীতি গড়ে উঠবে না। ভালো মানুষেরা রাজনীতি থেকে দূরে থাকলে রাজনীতির মাঠ দখল করে নেবে অযোগ্যরা।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, স্থান কখনো ফাঁকা থাকে না—ভালোরা না এলে খারাপেরাই জায়গা দখল করে নেয়। তখন সমালোচনা করে লাভ হয় না। তাই প্রকৃত অর্থেই যাঁদের দেশ পরিচালনার স্বপ্ন আছে, দেশকে ভালোবাসেন—তাঁদের রাজনীতিতে আসা দরকার। আর দেশের পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত নতুনদের স্বাগত জানানো। রাজনীতি কেবল দলের প্রতিযোগিতা না হয়ে হতে হবে নীতির প্রতিযোগিতা, জনসেবার প্রতিযোগিতা, ভালো কাজের প্রতিযোগিতা।

পরনিন্দা ও পরচর্চা যেন বাঙালির এক সাধারণ বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। নিজের খুঁত আড়াল করে অন্যের খুঁত খুঁজে বের করাতেই আমরা যেন বেশি আনন্দ পাই। আমরা ভালো মানুষ দেখলেই সন্দেহ করি; তার ব্যক্তিজীবন টেনে এনে তাকে ছোট করি, তাকে নিরুৎসাহিত করি। অথচ আমাদের ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ নানা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাস নির্মিত হয়েছে ত্যাগী মানুষের জীবনদানে। সেই সব মানুষের অনেকেই আজ উপেক্ষিত ও অবহেলিত। যদি আমরা তাদের যথাযথ সম্মান না করি, তাহলে কখনোই কৃতজ্ঞ জাতি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পারব না।

বর্তমানে আমাদের প্রয়োজন একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি, যেখানে ভালো মানুষ রাজনীতিতে এগিয়ে আসার সুযোগ পাবে এবং নিজ যোগ্যতার ভিত্তিতে নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে। তরুণ সমাজের একটি বড় অংশ ‘হেট পলিটিকস’ বলে রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তাদের আবার রাজনীতিতে আগ্রহী করে তুলতে হবে এবং এ দায়িত্ব মূলত প্রবীণ রাজনীতিবিদদেরই নিতে হবে।

সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর ‘ছাড়পত্র’ কবিতায় লিখেছিলেন—‘এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান।’ কিন্তু আমাদের প্রবীণ রাজনীতিবিদদের অনেকেই চেয়ার ছাড়তে চান না। এই মানসিকতায় পরিবর্তন আনতেই হবে। আজ যারা নবীন, কাল তাঁরাই প্রবীণ হবেন—তাঁরাই ভবিষ্যতে রাষ্ট্র পরিচালনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবেন।

আগস্ট অভ্যুত্থানের পর রাজনীতির প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে, অনেকেই নতুনভাবে রাজনীতিতে যুক্ত হচ্ছেন। মত প্রকাশ ও দল গঠনের সুযোগও আগের চেয়ে প্রসারিত হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক লক্ষণ। তবে এই ধারা টিকিয়ে রাখতে হলে আমাদের প্রয়োজন সহনশীলতা, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা এবং একটি উদার গণতান্ত্রিক মানসিকতা।

রাজনীতি মানে শুধু নিজের ভাগ্য গড়ার ধান্দা নয়, আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার অপচেষ্টা নয়। রাজনীতি মানে দেশ ও দশের কল্যাণ সাধন। আমাদের এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেখানে ভালো মানুষ রাজনীতিতে আসতে সাহস পায় এবং জনগণও তাদের পাশে দাঁড়ায়। সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সম্মিলিত উদ্যোগেই গড়ে উঠবে একটি স্বপ্নের দেশ—একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যেখানে কেউ উপেক্ষিত হবে না, অবহেলিত হবে না, বৈষম্যের শিকার হবে না। আসুন, সবাই মিলে সমতার বাংলাদেশ গড়ে তোলার কাজে হাতে হাত রেখে চলি।

লেখক: সাংবাদিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

কী লিখেছিলেন মাহফুজ আলম, ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে ডিলিট করলেন কেন

প্রশাসনিক আদেশে জামায়াত নিষিদ্ধ ভুল, আ.লীগের কার্যক্রম বন্ধ সঠিক: বিএনপি

এবার ‘পাকিস্তানপন্থার’ বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলেন আসিফ মাহমুদ

প্রথম ভাষণে গাজা প্রসঙ্গে যা বললেন পোপ লিও চতুর্দশ

সমাবেশে দলীয় স্লোগান ও জাতীয় সংগীত পরিবেশনে বাধা দেওয়া প্রসঙ্গে এনসিপির বিবৃতি

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত