Ajker Patrika

মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা

মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা

গত বছরের মতো এবারও বাংলা নববর্ষকে বরণ করা হচ্ছে এক ভিন্নতর পরিস্থিতিতে। উৎসবের মেজাজে নেই দেশের মানুষ। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-মৃত্যুভয়ে তৈরি হয়েছে এক অসহনীয় অবস্থা। এক অদৃশ্য মানবঘাতী ভাইরাসের দাপটে গোটা পৃথিবী এখন টালমাটাল। করোনাভাইরাসে মৃত্যু ঘটছে হাজার হাজার মানুষের। এই মৃত্যু-মিছিলের শেষ কোথায় কেউ জানি না। মানুষে মানুষে নৈকট্য নয়, দূরত্ব এখন কাম্য। এই অবস্থায় এবার বৈশাখ বরণ হবে একসঙ্গে নয়–ঘরে ঘরে, যার যার মতো করে, পারিবারিক পরিবেশে।

ভোরের সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রমনার বটমূলে ছায়ানটের উদ্যোগে ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’ গানের মাধ্যমে শুরু হবে না বৈশাখবন্দনা। বের হবে না চারুকলা থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা। পরিস্থিতির কারণে নতুন বছরকে বরণ করার আয়োজনে এবার থাকবে হয়তো কিছু নতুনত্ব।

বাধার মুখে বাঙালি সৃজনশীলতার পরিচয়দানে সক্ষমতা আগেও দেখিয়েছে। এবারও দেখাবে। ঘরেই হতে পারে নতুন নতুন আয়োজন। পারিবারিকভাবেই হতে পারে গানের অনুষ্ঠান, কবিতা পাঠ, ছবি আঁকা–এ রকম আরও কত-কী! হয়তো তাতে উদ্দামতা, তারুণ্যের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস থাকবে না, তবে থাকবে ‘রসের আবেশরাশি’। মোট কথা পয়লা বৈশাখে বিষণ্ণতা তা নয়, অবসাদ নয়–হোক সৃষ্টি সুখের উল্লাস।

চিত্তকে ভয়শূন্য রেখে আমরা মেতে উঠব সীমিত বৈশাখী উৎসবে। সীমার মাঝেই তো হয় অসীমের সন্ধান। স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘন করব না, নিজে আনন্দ করতে গিয়ে অনেকের জীবন নিরানন্দ ও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলব না।

পয়লা বৈশাখ বাঙালির উৎসবের দিন, আনন্দের দিন, সম্প্রীতির দিন, সৌহার্দ্যের দিন। পয়লা বৈশাখ মানে হালখাতা, পয়লা বৈশাখ মানে গ্রাম্য মেলা। নাগরদোলা, হাওয়াই মিঠাই, বাতাসা, পুতুল নাচ, গান, সার্কাস, মুখোশ নৃত্য– আরও কত-কী! আজকাল আয়োজনে ব্যাপকতা এসেছে, এসেছে কিছুটা পরিবর্তনও। কিন্ত পয়লা বৈশাখ বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে বাঙালির আবেগ ও ভালোবাসা আছে চিরজাগরূক। শুভ নববর্ষ বলে একে অপরের শান্তি, সুখ, সমৃদ্ধি ও কল্যাণ কামনায় কোনো পরিবর্তন নেই, ব্যত্যয় নেই।

ঈদ কিংবা পূজাও উৎসব। ওই উৎসবেও আনন্দ হয়। আর আমাদের আনন্দ মানেই তো খাওয়াদাওয়া, নতুন পোশাক পরা, দলবেঁধে ঘুরে বেড়ানো, আড্ডায় মেতে ওঠা। ঈদ-পূজার উৎসব আয়োজন সর্বজনীন নয়। তাতে ধর্ম বিশ্বাসের গণ্ডি আছে। মুখে বলা হয়–ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। কিন্তু বাস্তবে তা আচরিত হওয়া কঠিন। হিন্দু যাবেন না ঈদের নামাজের মাঠে। মুসলমান মন্দিরে করবেন না নৈবেদ্য নিবেদন। কিন্তু পয়লা বৈশাখের উৎসবটা প্রকৃত অর্থেই সবার, সব বাঙালির, ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে বাঙালির উৎসব বর্ষবরণ।

সে হিসেবে বর্ষবরণের উৎসবই হওয়ার কথা বাঙালির প্রধান জাতীয় উৎসব। কিন্তু হয়েছে কি? না, পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপন নিয়েও বিভেদ-বিভ্রান্তির অপচেষ্টা আছে, ছিল। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালির কৃষ্টি-ঐতিহ্যকে অবদমনের চেষ্টা করেছে। একে ‘হিন্দুয়ানি’ বলে প্রচার করেছে। তবে বাঙালি সেটা মানেনি। পয়লা বৈশাখকে একটি অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব হিসেবেই পালন করে আসা হচ্ছে। বাধা দিলে বাধা না-মানাই হলো বাঙালির এক সহজাত প্রবণতা। পয়লা বৈশাখ পালনে বাধা দিয়ে পাকিস্তানিরা বাঙালিকে হারাতে পারেনি, নিজেরাই হেরেছে।

এখনও যারা বাঙালির বর্ষবরণের উৎসবের বিরোধিতা করেন, মঙ্গল শোভাযাত্রায় অমঙ্গলের চিহ্ন দেখেন, তাদেরও পিছু হঠতে হবে।

কারণ বাঙালির রক্তে আছে দ্রোহ, এ রক্ত পরাভব মানে না। ‘জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়’। বাঙালি বিশ্বাস করে–মুছে যাবে গ্লানি, ঘুচে যাবে জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হবে ধরা।

আমাদের জীবনে দুঃখ-বেদনা আছে। জয়ের আনন্দের পাশাপাশি সাময়িক পরাজয়ের কাতরতাও আছে। আমরা পাই, আবার পেয়েও হারাই। কিন্তু এগিয়ে যাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা অবদমিত হয় না। পুরাতন বছরকে বিদায় দিয়ে নতুন বছরকে আমরা বরণ করি এই আশা নিয়ে যে, নতুন বছরে আমরা ‘পুরাতন অপরাধ’-এর পুনরাবৃত্তি করব না। বৈশাখ চির নতুনকেই ডাক দিতে এসেছে। আমরা নতুন করে সংকল্পবদ্ধ হব, দুবেলা মরার আগে মরব না, আমরা ভয় করব না। আমরা মানুষ হয়ে ওঠার সাধনা করব। মনুষ্যত্বের জয়গান গাইব। ধর্ম যেন আমাদের যুক্তিবোধ ও শুভবোধকে আচ্ছন্ন করতে না পারে। আমরা যেন ভুলে না যাই, মানুষের জন্যই ধর্ম, ধর্মের জন্য মানুষ নয়।

“মানুষেরে ঘৃণা করি
ও’ কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি!
ও’ মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ নাও জোর করে কেড়ে
যাহারা আনিল গ্রন্থ-কিতাব সেই মানুষেরে মেরে।
পূজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল! -মূর্খরা সব শোনো,
মানুষ এনেছে গ্রন্থ;- গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।”

যেকোনো পশ্চাৎগামিতাকে প্রতিরোধ করে, আঁধারের বুকে আলো জ্বালানোর প্রতিজ্ঞা নিয়েই আমরা বরণ করে নেব নতুন বছরকে–১৪২৮ বঙ্গাব্দকে।

করোনাভাইরাসকাল চিরস্থায়ী হবে না। এখন আমরা চারিদিকে মৃত্যু দেখছি, বিষাদ-বিপন্নতা দেখছি। কিন্তু অচিরেই আমরা জীবন দেখব, দেখব জীবনের জয়োল্লাস। মৃত্যু চিরসত্য, জীবন অনিত্য। তবু জীবনের জয়গানই আমরা করি। বিদায়ী বছর আমাদের ওপর করোনাভাইরাসের ‘আবর্জনা’ চাপিয়ে দিয়েছে। নতুন বছরে এই আবর্জনা দূর করে আমরা মানুষে মানুষে দূরত্ব ঘুচিয়ে জীবনকে ভালোবাসার দিগন্তে
প্রসারিত করব।

শুভ নববর্ষ। জয় হোক বাঙালির। জয় হোক মানুষের।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বিক্ষোভ থেকে সহিংসতায় উত্তাল ভাঙ্গা, মসজিদে আশ্রয় নিয়েছেন পুলিশ সদস্যরা

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নতুন বেতনকাঠামো ৬ মাসের আগেই চূড়ান্ত করার আশ্বাস

দাওয়াত না দেওয়ায় মাদ্রাসার সব খাবার খেয়ে গেলেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা

উত্তাল ভাঙ্গা: থানাসহ চারটি সরকারি দপ্তরে হামলা-ভাঙচুর, পুলিশসহ আহত অনেকে

সন্তানের গলা কেটে লাশ বাবার হাতে তুলে দিলেন মা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত