কেউ যখন ক্ষমতায় থাকেন, আমাদের দেশে সাধারণত তাঁকে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় না। এই সংস্কৃতিতে তাঁরা এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েন যে ক্ষমতা চলে গেলে নতুন কী বাস্তবতার মুখে তাঁদের পড়তে হবে, সেটা তাঁরা চিন্তাও করতে পারেন না।
মাসুদ কামাল
কয়েক দিন ধরে ‘সেফ এক্সিট’ নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। কথাটার অর্থ কী? আপনাদের কার কী অভিজ্ঞতা আমি জানি না, তবে নিজের কথা বলতে পারি, ‘এক্সিট’ শব্দটা আমি প্রথম দেখেছি সিনেমা হলে। মুভি যখন চলে, তখন পুরো হল অন্ধকার থাকলেও দরজাগুলোর ওপর ‘এক্সিট’ লেখাটা জ্বলজ্বল করতে থাকে। তখন আমি ছোট, অর্থটা ঠিক বুঝতাম না। পরে আব্বাকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নিয়েছি। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেছেন, হঠাৎ করে বের হতে গিয়ে যাতে কেউ বিভ্রান্ত না হয়, সে জন্য। আরও পরে অনেক মুভি হলে ‘এক্সিট’-এর পরিবর্তে ‘প্রস্থান’ লেখাও দেখেছি।
তখন আমার মনে হতো, এক্সিট মানেই তো সেফ, নিরাপদ। সেখানে আবার এক্সিটের আগে ‘সেফ’ কথাটার দরকার কী? কিন্তু এখন রাজনীতির এবং জীবনের নানা জটিলতা দেখার পর বুঝতে পারছি সব এক্সিটই সেফ হয় না। অনেককে গলাধাক্কা দিয়েও বের করা হয়। আবার অনেকে প্রস্থানের পরপরই নানা বিপদে পড়েন। ক্ষমতায় থাকার কারণে তাঁর যেসব কর্মকাণ্ড নিয়ে বিচার দূরে থাক, প্রশ্ন করারই সাহস সাধারণ মানুষ পায় না, ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ামাত্র সেসব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। ফলে ‘এক্সিট’ আর ‘সেফ এক্সিট’ বিষয়টা প্রায়ই ভিন্ন অর্থ বহন করে।
মাস কয়েক আগের কথা, গত ৩০ জুলাই গুলশানের একটা হোটেলে ‘ডেমোক্রেসি ডায়াস বাংলাদেশ’ নামের একটা সংগঠনের সেমিনারে গিয়েছিলাম। সেখানে আরও অনেকের মধ্যে সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য উপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের এক্সিট পলিসি চিন্তা করার সময় এসেছে।’ সেই সঙ্গে তিনি এমনও বললেন, এই সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে আগামী সরকারের মূল্যায়ন কেমন হবে, সেসব নিয়ে চিন্তাভাবনার সময় এখন এসে গেছে।
ড. দেবপ্রিয়র এমন কথায় খুব স্পষ্ট কিছু ইঙ্গিত ছিল। পরদিন অধিকাংশ মিডিয়া এই ‘এক্সিট’ শব্দটিকে ব্যবহার করে তাদের শিরোনাম করেছিল। সেই থেকে শব্দটি প্রায়ই বিভিন্নজন সরকারের, উপদেষ্টাদের নানা কর্মকাণ্ডের কথা বলতে গিয়ে ব্যবহার করেছেন। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুতরভাবে শব্দটির ব্যবহার দেখা গেল এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের কণ্ঠে। তিনি বললেন, সরকারের উপদেষ্টাদের কেউ কেউ সেফ এক্সিটের লক্ষ্যে অনেক রাজনীতিবিদের সঙ্গে লিয়াজোঁ করছেন!
ঠিক এই জায়গাটিতে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। ফেব্রুয়ারিতে যদি নির্বাচন হয়, বর্তমানে যাঁরা সরকারে আছেন, তাঁদের চলে যেতে হবে। এটা তো তাঁরা জানেনই। তাহলে তাঁদের কেউ কেউ রাজনীতিবিদদের সঙ্গে লিয়াজোঁ কেন করছেন? কেন এ রকম যোগাযোগ করতে হচ্ছে? আসলে এটাই হচ্ছে মূল কথা। তাঁরা জানেন, গত এক বছরের বেশি সময়ে তাঁরা কী কী করেছেন। তাঁদের কয়টা কাজ এই গণ-আন্দোলনের মূল চেতনার পক্ষে ছিল। কয়টা কাজ কেবলই তাঁর ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য করেছেন। নতুন যে সরকার আসবে, তারা এসব নিয়ে প্রশ্ন তুলবেই। সেই প্রশ্ন তাঁকে কোথায় নিয়ে যাবে, কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে? বিচারের কাঠগড়ায় নিয়ে যাবে না তো? হয়তো এ কারণেই যে রাজনৈতিক দল আগামী নির্বাচনে ক্ষমতায় আসবে বলে তাঁরা মনে করেন, সেই দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।
এমন প্র্যাকটিস কিন্তু এই দেশে নতুন কিছু নয়। আওয়ামী লীগ আমলে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে বিএনপির অনেক নেতাই কিন্তু বহাল তবিয়তে দেশে অবস্থান করেছেন, এমনকি অনেকে দাপটের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যও করেছেন। আবার বর্তমান সরকারের অনেক উপদেষ্টার সঙ্গে ব্যক্তিগত অথবা পারিবারিক সম্পর্কের জোরে আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক দুর্নীতিবাজ ব্যক্তির অর্থসম্পদ ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। এসব অনেক দিন ধরেই চলে আসছে এই দেশে। সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করেই হয়তো উপদেষ্টাদের কেউ কেউ রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন।
নাহিদ ইসলামের এ রকম খোলামেলা অভিযোগ নিয়েও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি কি সত্যিই কিছু জানেন? নাকি হাওয়ার ওপর দিয়ে মেরে দিয়েছেন? সেটাই-বা কীভাবে হয়? তিনি তো এলেবেলে লোক নন। একটা গুরুত্বপূর্ণ দলের শীর্ষ নেতা। নিজেও একসময় এই সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। ফলে সাবেক সহকর্মী হিসেবে উপদেষ্টাদের অনেকের সঙ্গেই তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকাটা স্বাভাবিক। কাজেই তাঁর অভিযোগ ভিত্তিহীন হওয়ার আশঙ্কা খুবই কম। সে ক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি খুবই জরুরি, ওই আলোচিত উপদেষ্টারা আসলে কারা? কী অপরাধ তাঁরা করেছেন যে সেফ এক্সিট পাওয়ার জন্য তাঁদের এখন থেকেই লিয়াজোঁ করতে হচ্ছে?
উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ কিন্তু নতুন কিছু নয়। এর আগে ৮ আগস্ট সাবেক এক সচিব, যিনি খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব হিসেবেও কাজ করছেন, তিনি প্রকাশ্যে বলেছিলেন, আটজন উপদেষ্টার দুর্নীতির বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ তাঁর কাছে রয়েছে। কথাগুলো বলেছিলেন তিনি প্রশাসন ক্যাডারদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত এক সেমিনারে। সেখানে প্রশাসন ক্যাডারের বর্তমান এবং সাবেক অনেক কর্মকর্তাই উপস্থিত ছিলেন। সাবেক ওই সচিব এ বি এম আবদুস সাত্তার যখন এই কথাগুলো বলছিলেন, সেখানে উপস্থিত কর্মকর্তারা তখন ‘ঠিক ঠিক’ বলে তাঁকে সমর্থনও দিয়েছিলেন। তার মানে বিষয়গুলো তাঁরাও জানতেন।
এই যে এমন প্রকাশ্য অভিযোগ, তথ্য-প্রমাণ আছে বলে ঘোষণা, তারপর কী হলো? দৃশ্যত কিছুই হয়নি। কেন হয়নি? হয়তো সরকার চায়নি বলে হয়নি। এই সরকার চায়নি বলে কি আগামী সরকার চাইবে না? গোয়েন্দা রিপোর্টগুলো তো রয়েই গেছে। এরই মধ্যে কপি হয়ে হয়তো অনেকের হাতেও চলে গেছে। এখন ক্ষমতার জোরে হয়তো ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে, সরকার পরিবর্তনের পরপরই কি সেগুলো আবার ভেসে উঠবে না? নিশ্চিত থাকতে পারেন, অবশ্যই সেগুলো আলোচনায় চলে আসবে। যাঁরা এগুলো ধামাচাপা দিয়েছেন, দিতে সাহায্য করেছেন, তাঁদেরও নাম তখন আসবে। এ কারণেই ক্ষমতার শেষ দিকে এসে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েন সেফ এক্সিটের জন্য। সেটা নিশ্চিত করতে ছোটাছুটি করেন রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক করতে।
এই সেফ এক্সিট নিয়ে এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন উপদেষ্টা অবশ্য কথা বলেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন আইনবিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। তিনি বলেছেন, ‘এখন সেফ এক্সিট নিয়ে কথা হচ্ছে। আমরা উপদেষ্টারা নিশ্চিতভাবে জানি, আমাদের কারও কোনো সেফ এক্সিটের প্রয়োজন নেই।’ এরপর উল্টো তিনি এমন কথাও বলেছেন, উপদেষ্টাদের নয়, বরং সেফ এক্সিট দরকার এখন দেশের।
আইনবিষয়ক উপদেষ্টার এই দ্বিতীয় কথাটার সঙ্গে আমি খুবই একমত। আসলেই আমাদের দেশ অনেক বছর ধরেই একটা গাড্ডায় পড়ে আছে। রাষ্ট্রকাঠামোকে এমন এক চরিত্র দেওয়া হয়েছে, যা নিজেই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে। এখান থেকে বের হতে হবে। এই বের হওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষা নিয়েই কিন্তু ড. ইউনূসকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। উনি আসিফ নজরুলসহ বেশ কয়েকজনকে তাঁর উপদেষ্টামণ্ডলীতে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তাঁরা দেশকে সেই সমস্যাসংকুল রাষ্ট্রকাঠামো থেকে বের করতে পেরেছেন? তাঁরা কি সেই জন-আকাঙ্ক্ষাকে তাঁদের চিন্তায় ধারণ করতে পেরেছেন? যদি না করতে পারেন, এই ব্যর্থতার জন্যও কি তাঁদের দায়ী করা যাবে না?
আর প্রথম যে কথাটা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, সেটাকে আমি তাঁর জন্য কিছুটা আত্মঘাতী বলেই মনে করি। তিনি কীভাবে বলেন, ‘আমাদের কারও কোনো সেফ এক্সিটের প্রয়োজন নেই!’ সব উপদেষ্টার দায়িত্ব তিনি একাই নিয়ে নিলেন! অতি আত্মবিশ্বাসী হলে উনি বড়জোর নিজের কথাটা বলতে পারতেন। কিন্তু বাকিদের দায়িত্ব উনি কীভাবে নিলেন? আমি নিশ্চিত, নতুন সরকার আসার সঙ্গে সঙ্গে অনেক উপদেষ্টার কর্মকাণ্ড প্রকাশিত হতে থাকবে। আসিফ নজরুল কি তখন অন্যদের দায়ও নিজের কাঁধে নেবেন?
আসলে সমস্যা হয় কি, কেউ যখন ক্ষমতায় থাকেন, আমাদের দেশে সাধারণত তাঁকে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় না। এই সংস্কৃতিতে তাঁরা এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েন যে ক্ষমতা চলে গেলে নতুন কী বাস্তবতার মুখে তাঁদের পড়তে হবে, সেটা তাঁরা চিন্তাও করতে পারেন না। সবার সুমতি হোক।
লেখক: সাংবাদিক
কয়েক দিন ধরে ‘সেফ এক্সিট’ নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। কথাটার অর্থ কী? আপনাদের কার কী অভিজ্ঞতা আমি জানি না, তবে নিজের কথা বলতে পারি, ‘এক্সিট’ শব্দটা আমি প্রথম দেখেছি সিনেমা হলে। মুভি যখন চলে, তখন পুরো হল অন্ধকার থাকলেও দরজাগুলোর ওপর ‘এক্সিট’ লেখাটা জ্বলজ্বল করতে থাকে। তখন আমি ছোট, অর্থটা ঠিক বুঝতাম না। পরে আব্বাকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নিয়েছি। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেছেন, হঠাৎ করে বের হতে গিয়ে যাতে কেউ বিভ্রান্ত না হয়, সে জন্য। আরও পরে অনেক মুভি হলে ‘এক্সিট’-এর পরিবর্তে ‘প্রস্থান’ লেখাও দেখেছি।
তখন আমার মনে হতো, এক্সিট মানেই তো সেফ, নিরাপদ। সেখানে আবার এক্সিটের আগে ‘সেফ’ কথাটার দরকার কী? কিন্তু এখন রাজনীতির এবং জীবনের নানা জটিলতা দেখার পর বুঝতে পারছি সব এক্সিটই সেফ হয় না। অনেককে গলাধাক্কা দিয়েও বের করা হয়। আবার অনেকে প্রস্থানের পরপরই নানা বিপদে পড়েন। ক্ষমতায় থাকার কারণে তাঁর যেসব কর্মকাণ্ড নিয়ে বিচার দূরে থাক, প্রশ্ন করারই সাহস সাধারণ মানুষ পায় না, ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ামাত্র সেসব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। ফলে ‘এক্সিট’ আর ‘সেফ এক্সিট’ বিষয়টা প্রায়ই ভিন্ন অর্থ বহন করে।
মাস কয়েক আগের কথা, গত ৩০ জুলাই গুলশানের একটা হোটেলে ‘ডেমোক্রেসি ডায়াস বাংলাদেশ’ নামের একটা সংগঠনের সেমিনারে গিয়েছিলাম। সেখানে আরও অনেকের মধ্যে সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য উপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের এক্সিট পলিসি চিন্তা করার সময় এসেছে।’ সেই সঙ্গে তিনি এমনও বললেন, এই সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে আগামী সরকারের মূল্যায়ন কেমন হবে, সেসব নিয়ে চিন্তাভাবনার সময় এখন এসে গেছে।
ড. দেবপ্রিয়র এমন কথায় খুব স্পষ্ট কিছু ইঙ্গিত ছিল। পরদিন অধিকাংশ মিডিয়া এই ‘এক্সিট’ শব্দটিকে ব্যবহার করে তাদের শিরোনাম করেছিল। সেই থেকে শব্দটি প্রায়ই বিভিন্নজন সরকারের, উপদেষ্টাদের নানা কর্মকাণ্ডের কথা বলতে গিয়ে ব্যবহার করেছেন। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুতরভাবে শব্দটির ব্যবহার দেখা গেল এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের কণ্ঠে। তিনি বললেন, সরকারের উপদেষ্টাদের কেউ কেউ সেফ এক্সিটের লক্ষ্যে অনেক রাজনীতিবিদের সঙ্গে লিয়াজোঁ করছেন!
ঠিক এই জায়গাটিতে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। ফেব্রুয়ারিতে যদি নির্বাচন হয়, বর্তমানে যাঁরা সরকারে আছেন, তাঁদের চলে যেতে হবে। এটা তো তাঁরা জানেনই। তাহলে তাঁদের কেউ কেউ রাজনীতিবিদদের সঙ্গে লিয়াজোঁ কেন করছেন? কেন এ রকম যোগাযোগ করতে হচ্ছে? আসলে এটাই হচ্ছে মূল কথা। তাঁরা জানেন, গত এক বছরের বেশি সময়ে তাঁরা কী কী করেছেন। তাঁদের কয়টা কাজ এই গণ-আন্দোলনের মূল চেতনার পক্ষে ছিল। কয়টা কাজ কেবলই তাঁর ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য করেছেন। নতুন যে সরকার আসবে, তারা এসব নিয়ে প্রশ্ন তুলবেই। সেই প্রশ্ন তাঁকে কোথায় নিয়ে যাবে, কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে? বিচারের কাঠগড়ায় নিয়ে যাবে না তো? হয়তো এ কারণেই যে রাজনৈতিক দল আগামী নির্বাচনে ক্ষমতায় আসবে বলে তাঁরা মনে করেন, সেই দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।
এমন প্র্যাকটিস কিন্তু এই দেশে নতুন কিছু নয়। আওয়ামী লীগ আমলে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে বিএনপির অনেক নেতাই কিন্তু বহাল তবিয়তে দেশে অবস্থান করেছেন, এমনকি অনেকে দাপটের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যও করেছেন। আবার বর্তমান সরকারের অনেক উপদেষ্টার সঙ্গে ব্যক্তিগত অথবা পারিবারিক সম্পর্কের জোরে আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক দুর্নীতিবাজ ব্যক্তির অর্থসম্পদ ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। এসব অনেক দিন ধরেই চলে আসছে এই দেশে। সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করেই হয়তো উপদেষ্টাদের কেউ কেউ রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন।
নাহিদ ইসলামের এ রকম খোলামেলা অভিযোগ নিয়েও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি কি সত্যিই কিছু জানেন? নাকি হাওয়ার ওপর দিয়ে মেরে দিয়েছেন? সেটাই-বা কীভাবে হয়? তিনি তো এলেবেলে লোক নন। একটা গুরুত্বপূর্ণ দলের শীর্ষ নেতা। নিজেও একসময় এই সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। ফলে সাবেক সহকর্মী হিসেবে উপদেষ্টাদের অনেকের সঙ্গেই তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকাটা স্বাভাবিক। কাজেই তাঁর অভিযোগ ভিত্তিহীন হওয়ার আশঙ্কা খুবই কম। সে ক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি খুবই জরুরি, ওই আলোচিত উপদেষ্টারা আসলে কারা? কী অপরাধ তাঁরা করেছেন যে সেফ এক্সিট পাওয়ার জন্য তাঁদের এখন থেকেই লিয়াজোঁ করতে হচ্ছে?
উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ কিন্তু নতুন কিছু নয়। এর আগে ৮ আগস্ট সাবেক এক সচিব, যিনি খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব হিসেবেও কাজ করছেন, তিনি প্রকাশ্যে বলেছিলেন, আটজন উপদেষ্টার দুর্নীতির বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ তাঁর কাছে রয়েছে। কথাগুলো বলেছিলেন তিনি প্রশাসন ক্যাডারদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত এক সেমিনারে। সেখানে প্রশাসন ক্যাডারের বর্তমান এবং সাবেক অনেক কর্মকর্তাই উপস্থিত ছিলেন। সাবেক ওই সচিব এ বি এম আবদুস সাত্তার যখন এই কথাগুলো বলছিলেন, সেখানে উপস্থিত কর্মকর্তারা তখন ‘ঠিক ঠিক’ বলে তাঁকে সমর্থনও দিয়েছিলেন। তার মানে বিষয়গুলো তাঁরাও জানতেন।
এই যে এমন প্রকাশ্য অভিযোগ, তথ্য-প্রমাণ আছে বলে ঘোষণা, তারপর কী হলো? দৃশ্যত কিছুই হয়নি। কেন হয়নি? হয়তো সরকার চায়নি বলে হয়নি। এই সরকার চায়নি বলে কি আগামী সরকার চাইবে না? গোয়েন্দা রিপোর্টগুলো তো রয়েই গেছে। এরই মধ্যে কপি হয়ে হয়তো অনেকের হাতেও চলে গেছে। এখন ক্ষমতার জোরে হয়তো ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে, সরকার পরিবর্তনের পরপরই কি সেগুলো আবার ভেসে উঠবে না? নিশ্চিত থাকতে পারেন, অবশ্যই সেগুলো আলোচনায় চলে আসবে। যাঁরা এগুলো ধামাচাপা দিয়েছেন, দিতে সাহায্য করেছেন, তাঁদেরও নাম তখন আসবে। এ কারণেই ক্ষমতার শেষ দিকে এসে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েন সেফ এক্সিটের জন্য। সেটা নিশ্চিত করতে ছোটাছুটি করেন রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক করতে।
এই সেফ এক্সিট নিয়ে এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন উপদেষ্টা অবশ্য কথা বলেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন আইনবিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। তিনি বলেছেন, ‘এখন সেফ এক্সিট নিয়ে কথা হচ্ছে। আমরা উপদেষ্টারা নিশ্চিতভাবে জানি, আমাদের কারও কোনো সেফ এক্সিটের প্রয়োজন নেই।’ এরপর উল্টো তিনি এমন কথাও বলেছেন, উপদেষ্টাদের নয়, বরং সেফ এক্সিট দরকার এখন দেশের।
আইনবিষয়ক উপদেষ্টার এই দ্বিতীয় কথাটার সঙ্গে আমি খুবই একমত। আসলেই আমাদের দেশ অনেক বছর ধরেই একটা গাড্ডায় পড়ে আছে। রাষ্ট্রকাঠামোকে এমন এক চরিত্র দেওয়া হয়েছে, যা নিজেই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে। এখান থেকে বের হতে হবে। এই বের হওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষা নিয়েই কিন্তু ড. ইউনূসকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। উনি আসিফ নজরুলসহ বেশ কয়েকজনকে তাঁর উপদেষ্টামণ্ডলীতে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তাঁরা দেশকে সেই সমস্যাসংকুল রাষ্ট্রকাঠামো থেকে বের করতে পেরেছেন? তাঁরা কি সেই জন-আকাঙ্ক্ষাকে তাঁদের চিন্তায় ধারণ করতে পেরেছেন? যদি না করতে পারেন, এই ব্যর্থতার জন্যও কি তাঁদের দায়ী করা যাবে না?
আর প্রথম যে কথাটা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, সেটাকে আমি তাঁর জন্য কিছুটা আত্মঘাতী বলেই মনে করি। তিনি কীভাবে বলেন, ‘আমাদের কারও কোনো সেফ এক্সিটের প্রয়োজন নেই!’ সব উপদেষ্টার দায়িত্ব তিনি একাই নিয়ে নিলেন! অতি আত্মবিশ্বাসী হলে উনি বড়জোর নিজের কথাটা বলতে পারতেন। কিন্তু বাকিদের দায়িত্ব উনি কীভাবে নিলেন? আমি নিশ্চিত, নতুন সরকার আসার সঙ্গে সঙ্গে অনেক উপদেষ্টার কর্মকাণ্ড প্রকাশিত হতে থাকবে। আসিফ নজরুল কি তখন অন্যদের দায়ও নিজের কাঁধে নেবেন?
আসলে সমস্যা হয় কি, কেউ যখন ক্ষমতায় থাকেন, আমাদের দেশে সাধারণত তাঁকে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় না। এই সংস্কৃতিতে তাঁরা এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েন যে ক্ষমতা চলে গেলে নতুন কী বাস্তবতার মুখে তাঁদের পড়তে হবে, সেটা তাঁরা চিন্তাও করতে পারেন না। সবার সুমতি হোক।
লেখক: সাংবাদিক
ইউরোপিয়ান জার্নাল অব পলিটিক্যাল ইকোনমিতে প্রকাশিত গ্রিক অর্থনীতিবিদ মাইকেল ক্লেটসস ও আন্দ্রেয়াস সিন্টোসের লেখা ‘দ্য ইফেক্টস অব আইএমএফ কন্ডিশনাল প্রোগ্রাম অন দ্য আনএমপ্লয়মেন্ট রেট’ শীর্ষক প্রবন্ধের উদ্ধৃতি দিয়ে বাংলাদেশের একটি দৈনিক পত্রিকায় ‘আইএমএফ থেকে ঋণ গ্রহণকারী দেশগুলোয় বেকারত্ব বেড়েছে...
৮ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলের এক বিশাল জলাভূমি—আড়িয়ল বিল। এটি যেন এক প্রাচীন প্রাণকোষ, যা যুগ যুগ ধরে দেশের মধ্যাঞ্চলের কৃষি, মৎস্য ও জীববৈচিত্র্যের কেন্দ্র হিসেবে টিকে আছে। মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলা এবং ঢাকার নবাবগঞ্জ ও দোহার উপজেলার বিস্তীর্ণ অংশজুড়ে বিস্তৃত প্রায় ১ লাখ ৬৭ হাজার একর আয়তনের এই বিল...
৮ ঘণ্টা আগেএকসময় বিমা খাত ছিল ভবিষ্যতের আর্থিক সুরক্ষার ক্ষেত্র, আজ তা পরিণত হয়েছে গ্রাহকদের হতাশা আর উদ্বেগের কেন্দ্রে। বছর বছর বিমা কোম্পানির দ্বারে দ্বারে ঘুরেও গ্রাহকেরা তাঁদের প্রাপ্য টাকা পাচ্ছেন না। কারণ দেশের বিমা কোম্পানিগুলোর কাছে গ্রাহকদের আটকে আছে ৭ হাজার কোটি টাকা, অথচ বেশির ভাগ কোম্পানিই...
৮ ঘণ্টা আগেরাষ্ট্র সংস্কারের কথা চলছে অনেক আগে থেকে। শোনা যাচ্ছে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের কথা। সবকিছু সংস্কার ও বিনির্মাণ করা হবে। কিন্তু সংস্কার কি শুধু রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই প্রয়োজন? ব্যক্তির সংস্কার প্রয়োজন নেই?
১ দিন আগে