Ajker Patrika

অনিশ্চয়তার আবর্তে নেপাল

সুমন কায়সার
আগুন জ্বলেছে নেপালের পার্লামেন্ট ভবনসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায়। ছবি: এএফপি
আগুন জ্বলেছে নেপালের পার্লামেন্ট ভবনসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায়। ছবি: এএফপি

হিমালয়কন্যা নেপালের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ভূদৃশ্যটি পর্বতমালার মতোই চড়াই-উতরাইয়ে ভরা। ১০ বছরের মাওবাদী বিদ্রোহের রক্তক্ষরণের পর ২০০৮ সালে উচ্ছেদ হয়েছিল রাজতন্ত্র। সেই থেকে ১৩ বার সরকার বদল হয়েছে। ক্ষমতার মসনদে ঘুরেফিরে দেখা যাচ্ছিল গুটিকয়েক নেতাকে। রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন যেমন ঘটেনি, তেমনি বদলায়নি সাধারণ মানুষের ভাগ্য। কিন্তু তলেতলে ঠিকই জমছিল হতাশ জনগণের ক্ষোভের বাষ্প। জেন-জিরা মাঠে নেমে সেই ক্ষোভের বারুদের স্তূপে আগুন দিতেই নজিরবিহীন রাজনৈতিক ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছে নেপাল। দুই দিনের সহিংস বিক্ষোভে নিহত হয়েছে অন্তত ২২ জন। দেশটির সাম্প্রতিক ইতিহাসে এত অল্প সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক সহিংসতায় এত মানুষের মৃত্যুর নজির নেই।

সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা নেপালি তরুণদের ক্ষুব্ধ করে পথে নামিয়েছে। কিন্তু সবাই বলছেন, তা নেহাতই তাৎক্ষণিক কারণ মাত্র। তরুণ-যুবকদের অসন্তোষের আসল কারণ আরও অনেক গভীরে। চরম দুর্নীতি আর অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হয়ে ক্ষুব্ধ তারা। এই অবস্থায় মতপ্রকাশের সুযোগটুকুও কেড়ে নেওয়া মেনে নিতে পারেনি। বিশেষ কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়াই ফুঁসে উঠে পথে নেমেছে। সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের পরও তাদের ক্ষোভে রাশ টানা যায়নি। কারফিউ উপেক্ষা করে বিক্ষোভ চালিয়ে গেছে তরুণেরা। আগুন জ্বলেছে পার্লামেন্ট ভবনসহ নানান গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায়। জ্বালিয়ে দেওয়া বা ভাঙচুর করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবাসহ বেশ কয়েকজন রাজনীতিকের বাড়ি।

অন্তত দুর্নীতি ও মতপ্রকাশের অধিকার কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে তরুণদের যে অবস্থান, তার পেছনে নেপালের আমজনতার সমর্থন না থাকার কোনো কারণ নেই। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে নেপালে ১৫-২৪ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার ছিল ২০.৮ শতাংশ। দেশের অনেক মানুষ রুটি-রুজির জন্য বিদেশে পাড়ি জমাতে বাধ্য হয়েছে। দেশের জিডিপির এক-তৃতীয়াংশের কিছু বেশি (৩৩.১ শতাংশ) আসে রেমিট্যান্স থেকেই। মাথাপিছু মাত্র ১ হাজার ৩০০ ডলার আয়ে ধুঁকছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ।

২০২১ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, নেপালের ৩ কোটি মানুষের প্রায় ৯০ শতাংশই ইন্টারনেট ব্যবহার করে। প্রায় সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবাসী দেশে থাকা স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ব্যাপকভাবে মেসেঞ্জার ও ভাইবার অ্যাপের ওপর নির্ভরশীল। অনলাইনে ছোটখাটো ব্যবসায়িক উদ্যোগ চালিয়ে বহু নেপালি করেকর্মে খাচ্ছে। ৪ সেপ্টেম্বর হুট করে তাই প্রায় সব জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ করে দেওয়াটা সবাইকেই খেপিয়ে তোলে। একমাত্র চালু থাকা টিকটকের মাধ্যমে এবারের বিক্ষোভের ডাক দেন হামি নেপাল নামে একটি এনজিওর তরুণ প্রতিষ্ঠাতা সুদান গুরুং। ২০১৫ সালের প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পের পর যুব আন্দোলন হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল হামি নেপাল। ওই ভূমিকম্পে নিজের শিশুসন্তানকে হারিয়ে জীবনের ধারা বদলে গিয়েছিল ডিজে সুদানের।

সুদানের ডাকে কাঠমান্ডুর জনপ্রিয় পর্যটন দ্রষ্টব্য মাইতিঘর মণ্ডলে জড়ো হয় স্কুল-কলেজের ছাত্ররা। সেখান থেকে ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে যায় সবখানে। বিক্ষোভকারীদের মুখে ছিল, ‘যথেষ্ট হয়েছে আর না’, ‘দুর্নীতি বন্ধ কর, সোশ্যাল মিডিয়া না’ এইসব স্লোগান।

বিক্ষোভে উপস্থিত মাস্টার্সের ছাত্র আয়ুশ বাসিয়াল বলেছেন, অনেক কিশোর-তরুণ জড়ো হয়েছিল সেখানে। কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত কাউকে দেখেননি তিনি। তবে বিক্ষোভ চলার সময় একদল ‘স্বাস্থ্যবান’ ও ব্যাপক শব্দ করা মোটরসাইকেলধারী যুবক এসে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে আগে পার্লামেন্টে প্রবেশ করে। কয়েকজন সংগঠক এ-ও বলেছেন, পার্লামেন্টে হামলা চালানো তাঁদের পরিকল্পনার মধ্যে ছিল না। কোনো গোষ্ঠী নিজস্বার্থে ভাঙচুর, আগুন, লুটপাট চালিয়েছে। বিক্ষোভকারীদের মধ্যে কয়েকজন আধুনিক অস্ত্রধারীর ছবিও প্রচারিত হয়েছে। তবে মূলত এটি যে আন্দোলনকারীদের ক্ষোভের স্বতঃস্ফূর্ত বিস্ফোরণ, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার সরকারবিরোধী আন্দোলন থেকে অনুপ্রেরণা পাওয়ার কথা বলেছে বিক্ষোভকারীরা।

বলা হচ্ছে, সাম্প্রতিক সময়ে রাজনীতিতে তাদের আগ্রহী হয়ে ওঠার পেছনে ভূমিকা রেখেছে সোশ্যাল মিডিয়ায় মতামত প্রকাশের সুযোগ। সেখানে নেপালের দুর্নীতি, অনিয়ম ও রাজনৈতিক নেতাদের ব্যর্থতা নিয়ে মনের ক্ষোভ ঝেড়ে আসছিল তরুণ-যুবকেরা। স্থানীয় পর্যবেক্ষকদের মতে, বিদেশি অনলাইনভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিবন্ধনের আদেশ অমান্যের শাস্তি দেওয়া নয়, বরং প্রতিবাদী তরুণ কণ্ঠের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করাই ছিল সরকারের মূল উদ্দেশ্য।

হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, ইউটিউবের মতো সোশ্যাল মিডিয়াগুলোকে নেপাল সরকার নতুন এক আইনের আওতায় নিবন্ধন করার জন্য সময় বেঁধে দিয়েছিল। তারা সে নির্দেশনা না মানাতেই নেমে আসে নিষেধাজ্ঞার খাঁড়া। সরকারের ভাষ্য ছিল, ভুয়া খবর, বিদ্বেষমূলক কথাবার্তা আর অনলাইন প্রতারণা ঠেকানোর জন্যই সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর এই নিয়ন্ত্রণটা দরকার। নিবন্ধনের পাশাপাশি সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করতেও বলা হয়েছিল যোগাযোগমাধ্যমগুলোকে।

সরকার ৪ সেপ্টেম্বর ২৬টি সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ করার কয়েক সপ্তাহ আগেই শুরু হয় ‘নেপোকিড’ নামের প্রচারণা। আন্দোলনে বারবার উঠে এসেছে সুবিধাভোগী ‘নেপোকিড’দের কথা। দেশের রাজনীতিকসহ সুবিধাভোগী শ্রেণির অবৈধ আয়ের সুবাদে প্রাচুর্যের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা সন্তানদেরই এ নাম দিয়েছে ক্ষুব্ধ তরুণেরা। স্বজনপ্রীতির ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘নেপোটিজম’ থেকেই দৃশ্যত প্রত্যয়টির জন্ম। সাধারণ ঘরের তরুণেরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রভাবশালী রাজনীতিকসহ ধনীর দুলালদের দামি বাড়ি-গাড়ি, বিপুল অর্থ ব্যয়ে বিদেশ ভ্রমণ এবং সার্বিক বিলাসবহুল জীবনযাপনের প্রচার দেখে ক্ষুব্ধ। সম্পদ এবং সুযোগ-সুবিধার এই উৎকট প্রদর্শনী নেপালের ধনী এবং গরিবের মধ্যে বৈষম্যকে প্রকটভাবে তুলে ধরেছে। বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, ‘নেপোকিডদের’ বড় অংশেরই এই বিলাসবহুল জীবনযাত্রার পেছনের অর্থ আসছে সর্বব্যাপী দুর্নীতি থেকে।

এই মুহূর্তে নেপালের অবস্থা এখন চরম অস্থিতিশীল। কাঠমান্ডুতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব বলে কিছু নেই। নৈরাজ্য ঠেকাতে নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে সেনাবাহিনী। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা আশীষ প্রধান বলেছেন, অবিলম্বে একধরনের অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করা দরকার। তাতে থাকবেন বিশেষ করে তরুণদের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিরা।

সর্বশেষ সরকারের অংশীদার ছিল দুই আঞ্চলিক পরাশক্তি চীন ও ভারত উভয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ থাকা দল। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি বামপন্থী ইউনাইটেড মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী পার্টির (ইউএমএল) নেতা। গত বছর তিনি জোট বেঁধে সরকার গড়েছিলেন নেপালি কংগ্রেসের সঙ্গে। অলি নিজে চীনপন্থী হিসেবে পরিচিত। আর নেপালি কংগ্রেসের সঙ্গে বরাবরই ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।

নেপালের শেষ দিকের রাজা বীরেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ ছিলেন নিছক সাংবিধানিক প্রধান। ২০০১ সালে বীরেন্দ্র সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। সিংহাসনে আসীন হন তাঁর ছোট ভাই জ্ঞানেন্দ্র। মাওবাদী বিদ্রোহীদের দমন করার দোহাই দিয়ে তিনি ২০০৫ সালে রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতা দখল করেন। পার্লামেন্ট তথা সরকার ভেঙে দেন। কিন্তু গণতন্ত্রকামী ও মাওবাদী আন্দোলনের জেরে ২০০৮ সালে নেপালের ২৪০ বছরের পুরোনো হিন্দুধর্মভিত্তিক রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয়। পার্লামেন্টে ভোটাভুটিতে রাজতন্ত্র বিলোপের পক্ষে রায় এলে রাজা জ্ঞানেন্দ্র পদত্যাগে বাধ্য হন। এরপর দেশটিতে ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজনীতিকদের ব্যর্থতার জেরে সেই জ্ঞানেন্দ্র আবার পাদপ্রদীপের আলোয়। সাম্প্রতিককালে তাঁর জনপ্রিয়তাও বেড়েছে।

বিক্ষোভকারী তরুণেরা বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল ও নেতার ওপর বীতশ্রদ্ধ। তাদের সমর্থন ঝুঁকেছে ক্ষমতার অলিন্দ থেকে অনেক দিন ধরে দূরে থাকা রাজতন্ত্রপন্থীদের দিকে। সুদান গুরুং নিজেও বেশ কিছুদিন ধরে রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার দাবি করে আসছিলেন। এ দাবিতে হিন্দুত্ববাদীদের নেতৃত্বে অবশ্য আরও অনেক আগে থেকেই আন্দোলন চলছিল। নেপালের রাজনীতির খোঁজখবর রাখেন এমন পর্যবেক্ষকদের মতে, গায়ের জোরে রাজতন্ত্রীদের ক্ষমতায় আনার চেষ্টা করা হলে হিতে বিপরীত হতে পারে। কারণ, গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন কমিউনিস্ট দল এবং নেপালি কংগ্রেসের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। তাই পেছন দিকে হেঁটে সেনা সমর্থন নিয়ে বা অন্য কোনো উপায়ে রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার চেষ্টা সফল হবে কি না, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। ভারত বা চীন কী করবে (বা করবে না) সেই ভূরাজনীতির বিবেচনা তো আছেই।

গত কয়েক দশকের অভিজ্ঞতা বলে, আমজনতার ভাগ্য উন্নয়নের জন্য কাজ করার বদলে নেপালের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো ব্যস্ত ছিল মূলত ক্ষমতায় যাওয়া ও টিকে থাকা নিয়ে। অর্থনীতির দুই চালিকাশক্তি কৃষি বা শিল্প খাত কোনোটির উন্নয়নেই উল্লেখযোগ্য কাজ হয়নি। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাও আবার তার অন্যতম কারণ। কাঠমান্ডু উপত্যকার ঘন কুজ্ঝটিকা ভেদ করে পাহাড়চূড়ার ফাঁকে সত্যিকারের ‘নতুন দিনের আলো’ দেখার জন্য নেপালিদের হয়তো তাই আরও বহুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত