Ajker Patrika

দেখেছি, কিন্তু দেখা হয়নি

সেলিম জাহান 
শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত
শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত

তাঁকে আমি দেখেছি, কিন্তু তাঁকে আমার দেখা হয়নি। আমার কিশোর বয়সের একেবারে প্রারম্ভে, খুব সম্ভবত পঞ্চাশের দশকের একদম প্রান্তসীমায় আমি তাঁকে প্রথম চাক্ষুষ দেখেছি। তারপর তাঁকে দেখেছি ষাটের দশকের একেবারে শেষদিকে, যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এলাম। বৈবাহিক সূত্রে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে যখন তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হতে পারত, তার ঠিক চার বছর আগেই ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে ঘাতকেরা তাঁর জীবন কেড়ে নেয়। আমার দেখা-না দেখার সে মানুষটি শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী। আজ তাঁর জন্মদিন। বেঁচে থাকলে ২৭ নভেম্বর তাঁর বয়স হতো ৯৯ বছর। আগামী বছর শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর জন্মশতবার্ষিকী।

খুব সম্ভবত ১৯৫৯-৬০ সালের কথা। আমার প্রয়াত শিক্ষক পিতা বরিশাল থেকে ঢাকায় এলেন পরীক্ষক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরীক্ষার খাতা তুলতে। সঙ্গে নিয়ে এলেন তাঁর কিশোর পুত্রটিকে প্রথমবারের মতো ঢাকা শহর দেখাবেন বলে। কত-কী সব দ্রষ্টব্য বস্তু যে তিনি দেখিয়েছিলেন, চিনিয়েছিলেন এবং বুঝিয়েছিলেন বাল্যকালের প্রখর স্মৃতির কারণে তা আজও মনে আছে। ঢাকা তাঁর যৌবনের শহর। তাই এ শহরের প্রতি স্বাভাবিকভাবেই আমার পিতার আবেগ অন্তহীন।

এর মাঝে এক ভরদুপুরে তিনি আমাকে নিয়ে চললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দপ্তরে, যা কি না তখন জগন্নাথ হলের আদি ভবনে প্রতিষ্ঠিত ছিল। আমার মনে আছে, একটি বড় দরজা দিয়ে ভেতরে ঢোকার পর একটি বড়সড় অপেক্ষা হলঘর, যার নানা পাশে চেয়ার-বেঞ্চি ছড়ানো। ওই ঘরের শেষ মাথায় একটি লোহার টানাযোগ্য দরজা। সব পরীক্ষককে ওটা পেরিয়ে নিজ নিজ বরাদ্দের খাতা নিয়ে আসতে হবে। ওখানে বহিরাগতের প্রবেশাধিকার নেই।

সুতরাং আমার চিন্তিত পিতা যখন ভাবছেন, আমাকে কোথায় রেখে যাবেন, তখন সদর দরজা দিয়ে আরেকজন ভদ্রলোক ঢুকলেন। লম্বামতো, এলোমেলো চুল, পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি আর পায়ে চটি। আগন্তুক ও আমার পিতা একে অপরকে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন, আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলেন একে অন্যকে—বোঝা গেল তাঁরা পরস্পরের পূর্বপরিচিত এবং বন্ধুও বটে। আমার পিতা আমাকে ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং তিনি সস্নেহে আমার মাথার চুল নেড়ে দিলেন। জানলাম, আগন্তুকের নাম অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী।

অতএব, আমার একটা ব্যবস্থা হয়ে গেল। আমার পিতা ভেতরে চলে গেলেন আর অধ্যাপক চৌধুরী একটি চেয়ার টেনে নিয়ে আমাকে তাঁর বাঁ হাঁটুতে বসিয়ে বাঁ হাত দিয়ে বেড়িয়ে ধরলেন। লক্ষ করলাম, তিনি একটু একটু করে পা নাচিয়ে আমাকে দোল দিচ্ছেন। আরও লক্ষ করলাম যে তাঁর ডান হাতে একটু উঁচু করে ধরা একটি বই, যেটি তিনি গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন। বলতে দ্বিধা নেই যে সবকিছুর মধ্যে তাঁর ওই গ্রন্থপাঠই আমার বালক-মনে সবচেয়ে বড় দাগ কেটেছিল।

পরে আমার পিতা আমাকে বলেছিলেন যে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী এবং তিনি সতীর্থ ও সহপাঠী, যদিও ভিন্নতর বিষয়ে। একত্রে সলিমুল্লাহ ছাত্রাবাসে নির্বাচন করেছেন। অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর নেতৃত্বের দলটি প্রয়াত আমলা শফিউল আজমের দলটির কাছে সহসভাপতির পদটিসহ সবকটি আসন খুইয়েছিল, শুধু মিলনায়তন সম্পাদকের পদটি ছাড়া—যে আসনে আমার পিতা প্রার্থী ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে দুজনেই চাকরির জন্য দক্ষিণবঙ্গে গিয়েছিলেন একই দিনে—অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী খুলনার বিএল কলেজ আর আমার পিতা বরিশালের বিএম কলেজে। একই স্টিমারে তাঁদের দেখা হয়েছিল বলেও শুনেছি।

ষাটের দশকের প্রথম দিকে সংবাদপত্রের মাধ্যমে কতবার অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর নামের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। খবরে দেখেছি, পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে তাঁর নাটক ‘দন্ড এ দন্ডধর’ মঞ্চস্থ হচ্ছে। তাঁর নাটক ‘জমা, খরচ ও ইজা’ পড়েছি সাপ্তাহিক ‘পাকিস্তানী খবরে’। দুই ভাই-ই একই নাটকের অনুবাদ করেছেন—একজন ‘রানীসাহেবার হীরে’ নামে (প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী), অন্যজন ‘গুর্গন খাঁর হীরে’ নামে (শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী)। বলতে দ্বিধা নেই, ‘গুর্গন খাঁ’ নামটি মন কেড়েছিল। মন কেড়েছিল তাঁর অন্য দুটি অনূদিত নাটকের শিরোনামও—‘মুখরা রমণী বশীকরণ’ এবং ‘গাড়ীর নাম বাসনাপুর’।

ষাটের দশকের প্রথম দিকে বেতারে প্রচারিত নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় লেখা নাটক ‘সারেং’ শুনেছিলাম মনে আছে। স্মৃতি যদি আমার সঙ্গে প্রতারণা না করে, তাহলে সারেং চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী। অনেক স্মৃতি হাতড়েও বের করতে পারছি না ঢাকা বেতারের সে সময়কার শক্তিময়ী অভিনেত্রী লিলি চৌধুরী সে নাটকে অভিনয় করেছিলেন কি না। ঢাকা টেলিভিশনের প্রথম নাটক অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর ‘একতলা দোতলা’। দেখিনি, কিন্তু গল্প শুনেছি কতজনের কাছে। উচ্চমাধ্যমিকে আমাদের পাঠ্য ছিল তাঁর নাটক ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’। তাঁর অমর সৃষ্টি ‘কবর’ নাটক যে কতবার পড়েছি এবং কত জায়গায় যে তার অভিনয় দেখেছি।

১৯৬৯-এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হয়ে ঢোকার পরে আবার অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীকে দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কতভাবে। বাংলা বিভাগের সামনের বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন একটু ঝুঁকে পড়ে—পিঠে একটা ব্যথা ছিল পরে শুনেছি। কখনো দেখেছি ফুলার রোডের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে তিনি ও অধ্যাপক মনিরুজ্জামান কথা বলছেন। কখনো দেখেছি গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন, পাশে লিলি চৌধুরী বসা।

১৯৭১-এর ১৪ ডিসেম্বর ঘাতকেরা তাঁকে তুলে নিয়ে গেল তাঁর পৈতৃক নিবাস ‘দারুল আফিয়া’ থেকে। আর তিনি ফেরেননি। আমরা হয়তো শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীকে সব সময়ে চিনতে পারিনি, কিন্তু পাকিস্তানি হানাদারেরা তাঁকে চিনতে ভুল করেনি। একইভাবে তারা ঠিকই চিনেছিল আমাদের অন্য বুদ্ধিজীবীদের—যাঁদের নিশ্চিহ্ন করে তারা বাঙালি জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে চেয়েছিল। মনে আছে, বিজয়ের আনন্দের সঙ্গে এই হারানোর অশ্রু মিশে গিয়েছিল।

একাত্তর-পরবর্তী সময়ে তিনটি লেখার মাধ্যমে শহীদ মুনীর চৌধুরীকে কিছুটা দেখা হয়ে উঠেছিল। একটি তাঁর অগ্রজ প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর স্মৃতি-তর্পণ, দ্বিতীয়টি অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের লেখা ‘মুনীর চৌধুরী’ এবং তৃতীয়টি প্রয়াত অধ্যাপক আবু হেনা মোস্তফা কামালের একটি খোলা চিঠি—অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীকে উদ্দেশ করে লেখা।

১৯৭৫ সালে যখন ‘দারুল আফিয়ার’ বৃহত্তর পরিবারের সদস্য হলাম, তখন অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী সম্পর্কে কত স্মৃতিমূলক ঘটনা শুনেছি তাঁর মা, ভাই-বোনদের লেখা ও কথায়। পারিবারিক আলাপ-আলোচনায় অভ্রান্তভাবে উঠে এসেছেন তিনি—তাঁর মেধা ও ব্যক্তিত্বের কথা যেমন উঠে এসেছে, তেমনি উচ্চারিত হয়েছে মানুষের প্রতি তাঁর নিঃস্বার্থ মমতার কথা, অন্যকে সাহায্য করার জন্য তাঁর কর্মকাণ্ডের কথা। আর যখনই সবার মনে হয়েছে ১৯৭১-এর ১৪ ডিসেম্বরের কথা, তখনই একটা শীতল নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে চারদিকে, ঘন হয়ে এসেছে চারদিক।

একটা জিনিস জানি, শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীকে যাঁরা দেখেছেন এবং তাঁর সঙ্গে যাঁদের দেখা হয়েছে, তাঁরা পরম ভাগ্যবান। ভাগ্যবান শামীমসহ (কবি শামীম আজাদ) আমার সহপাঠী বন্ধুবান্ধবেরাও, যাঁরা তাঁর শিক্ষার্থী হতে পেরেছেন। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও তো মানি যে আমার মতো যাঁরা তাঁকে দেখেছেন, কিন্তু যাঁদের তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি, ভাগ্যের ভান্ড তাঁদেরও কম পূর্ণ নয়। কারণ কত মানুষ তাঁকে দেখেননি, দেখবেন না, তাঁর সঙ্গে দেখাও হবে না তাঁদের। আমার সেই সৌভাগ্য নিয়ে আজ শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীকে স্মরণ করি, তাঁর কাছে নমিত হই।

লেখক: অর্থনীতিবিদ

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত