একটি কথা না বললেই নয়, অমীমাংসিত ইস্যুগুলোর সুষ্ঠু সমাধান না করে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের যেকোনো পদক্ষেপ হবে বাংলাদেশের জাতীয় চেতনাকে উপেক্ষা করার শামিল। পাকিস্তান যত দিন একাত্তরের গণহত্যার দায় স্বীকার না করবে তত দিন দেশটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর উদ্যোগ মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতি অবমাননারও শামিল।
আজাদুর রহমান চন্দন
‘হাসিনা পরবর্তী বাংলাদেশ-পাকিস্তানের সম্পর্কের নতুন মোড়’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন একটি দৈনিকে প্রকাশিত হয় গত ১৭ জানুয়ারি। আল জাজিরা সূত্রের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্কের ইতিহাস দীর্ঘদিন ধরেই উত্তেজনাপূর্ণ। তবে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তনের কারণে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক ও সামরিক যোগাযোগ বাড়ছে। বিশেষ করে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর, দুই দেশ নিজেদের ঐতিহাসিক শত্রুতা পেছনে রেখে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করছে। প্রতিবেদনে ওই মাসেই রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম কামরুল হাসানের মধ্যে বৈঠকের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলা হয়, এ বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা জোরদার এবং পারস্পরিক সম্পর্ককে বহিরাগত প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার বিষয়ে আলোচনা হয়।
১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে। সেই সময় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী এবং এ দেশে তার অক্সিলারি ফোর্স বা সহযোগী বাহিনীগুলো গণহত্যার পাশাপাশি মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছিল, যা দুই দেশের মধ্যে গভীর বিভেদ সৃষ্টি করে। মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক ছিল উত্তেজনাপূর্ণ। আল জাজিরার প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, এই ঐতিহাসিক ক্ষত আরও গভীর হয়েছিল বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৬ বছরের শাসনকালে। কিন্তু ২০২৪ সালে গণবিক্ষোভের কারণে হাসিনার পদত্যাগ ও ভারতে চলে যাওয়ার পর থেকে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং হাসিনা সরকারের প্রতি ভারতের দীর্ঘমেয়াদি সমর্থন দুই দেশের রাজনৈতিক গতিপথ পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে। নতুন অন্তর্বর্তী সরকার ভারতের কাছ থেকে শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণ চেয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে, পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বন্ধুত্বের বৃদ্ধি একটি নতুন কূটনৈতিক বাস্তবতা তৈরি করছে। গত ডিসেম্বরে মিসরের রাজধানী কায়রোতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সাক্ষাৎ করার বিষয়টি উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, এর আগে তারা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠকে একত্রে আলোচনা করেছিলেন। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সাম্প্রতিক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকগুলো সম্পর্কের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়ার সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে আল জাজিরা। ২০২৪ সালে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৭০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি। বাংলাদেশ তার ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির মাধ্যমে পাকিস্তানের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদার হয়ে উঠতে পারে বলে আল জাজিরার অভিমত। ওই প্রতিবেদনে দুই দেশের যেসব উচ্চপর্যায়ের বৈঠককে সম্পর্ক পরিবর্তনের ইঙ্গিত হিসেবে বর্ণনা করা হয়, সে ধরনের বৈঠক-সফর চলমান। পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার গত শনিবার দুদিনের সফরে ঢাকায় আসেন। সফরের প্রথম দিনেই তিনি বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাদের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করেন। এসব বৈঠকে তিনি রাজনৈতিক পরিসরসহ নানা ক্ষেত্রে দুই দেশের সম্পর্ক বৃদ্ধির বিষয়ে আলোচনা করেন। পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও স্বার্থের ভিত্তিতে এই সম্পর্ক জোরদার করার বিষয়ে তিনি পাকিস্তানের অঙ্গীকারও ব্যক্ত করেন। তবে দ্বিতীয় দিন হোটেল সোনারগাঁওয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে বৈঠকের পর তিনি অতি স্পর্শকাতর বিষয়ে মন্তব্য করেন। ইসহাক দার দাবি করে বলেন, একাত্তরের গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাওয়াসহ অমীমাংসিত তিন সমস্যার নাকি দুবার সমাধান হয়েছে। অমীমাংসিত ইস্যু নিয়ে তিনি বলতে চান, ১৯৭৪ সালে প্রথমবারের মতো বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়েছে। আর ওই সময়ের দলিলটি দুই দেশের জন্য ঐতিহাসিক। এরপর জেনারেল পারভেজ মোশাররফ এখানে (বাংলাদেশে) এসে প্রকাশ্যে ও খোলামনে বিষয়টির সমাধান করেছেন। ফলে বিষয়টির দুবার সমাধান হয়েছে। একবার ১৯৭৪ সালে, আরেকবার ২০০০ সালের শুরুতে।
ইসহাক দারের এই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে অমীমাংসিত ইস্যুগুলো আসলে কী? অমীমাংসিত ইস্যু তিনটি ধরা হলে প্রথমেই আসে একাত্তরে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য বাংলাদেশের জনগণের কাছে পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার প্রসঙ্গ। ইসহাক দার যেমনটি দাবি করেছেন, সে মতো পাকিস্তান কি আসলেই কখনো ক্ষমা চেয়েছে? হ্যাঁ, ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের কাছে ‘ক্ষমা করো এবং ভুলে যাও’ আবেদন করা হয়েছিল বৈকি। তিন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সই করা চুক্তিতে আবেদনটি ছিল পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত ১৯৫ জন পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তাকে পাকিস্তানের কাছে তুলে দেওয়া হয়েছিল। ওই চুক্তি করার আগে পাকিস্তানের তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আজিজ আহমেদ সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ যদি এদের ক্ষমা করে, তবে আমরা এই ১৯৫ জনের যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ পাব, তাদের বিচার নিশ্চিত করব।’ কিন্তু সেই বিচার করার কোনো উদ্যোগ তো দূরের কথা, তেমন কোনো মনোভাবও পরে আর দেখায়নি ইসলামাবাদ।
এর বাইরেও চুক্তির আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত পাকিস্তান লঙ্ঘন করে। যেমন চুক্তিতে ছিল, বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ফিরিয়ে নেবে পাকিস্তান। কিন্তু এত বছরেও দেশটি এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়নি, ইচ্ছাও প্রকাশ করেনি। আইন মতে, কোনো পক্ষ চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করলে তবে তা আপনা-আপনিই বাতিল হয়ে যায়। সংগত কারণেই বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ চুক্তিটি কখনো অনুমোদন করেনি। পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের অমীমাংসিত ইস্যুর মধ্যে আরেকটি হলো দেশটির কাছে বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন (৪৫০ কোটি) ডলার পাওনা। গত এপ্রিলে ঢাকায় পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকেও অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সমাধান করতে তাগিদ দেওয়া হয়েছিল পাকিস্তানকে। একাত্তরে গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা এবং প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার পাওনা পরিশোধের বিষয়টি তখন আলোচনায় তোলা হয়েছিল। তখনকার পররাষ্ট্রসচিব জসীম উদ্দিন সেদিন বলেছিলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে বিদ্যমান অমীমাংসিত বিষয়গুলো তিনি বৈঠকে তুলেছেন। যেমন আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসন, অবিভাজিত সম্পদে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা প্রদান, ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রেরিত বিদেশি সাহায্যের অর্থ হস্তান্তর এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়া।
২০০০ সালে পাকিস্তানের তখনকার প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মোশাররফ বাংলাদেশে এসে প্রকাশ্যে ও খোলামনে ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি সমাধান করেছেন বলে যে দাবি ইসহাক দারের, সেটির কোনো সত্যতা নেই। প্রকৃতপক্ষে ২০০২ সালের ৩১ জুলাই পারভেজ মোশাররফ বাংলাদেশের জাতীয় স্মৃতিসৌধ পরিদর্শনের সময় দর্শনার্থী বইয়ে লিখেছিলেন, ‘১৯৭১ সালের ঘটনাগুলোর বেদনায় পাকিস্তানের আপনার ভাই ও বোনেরা সমব্যথী। সেই দুর্ভাগ্যজনক সময়ের বাড়াবাড়ির জন্য আমরা দুঃখিত।’ দুঃখ প্রকাশ আর ক্ষমা প্রার্থনা কি এক জিনিস! অর্ধ শতক পরও পাকিস্তান গণহত্যা ও ৩০ লাখ মানুষ হত্যার বিষয়টি স্বীকারই করেনি, রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমাও চায়নি।
পারভেজ মোশাররফ বাংলাদেশে এসে একাত্তরের ‘বাড়াবাড়ির জন্য’ সাধারণভাবে ‘দুঃখপ্রকাশ’ করেছিলেন কেবল।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ ও পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর গণহত্যা এখনো বেদনাদায়ক বাস্তবতা। সম্প্রতি দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এই বাস্তবতা নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে বলেও সম্প্রতি অভিযোগ করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। অন্যদিকে পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম এখনো বাংলাদেশকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ বানানোর স্বপ্নে বিভোর। পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে প্রকাশিত শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি সংবাদপত্র দ্য ক্যাচলাইন ১৬ আগস্ট এক নিবন্ধে বলেছে, ৫৪ বছর পর হিসাব-নিকাশের সময় এসেছে। ‘পূর্ব পাকিস্তান’কে ফিরে আসতে হবে। এর চার দিনের মাথায় পত্রিকাটি আরেকটি নিবন্ধ প্রকাশ করে ‘পাকিস্তান অ্যান্ড বাংলাদেশ: ইমাজিনিং অ্যা লস্ট ইউনিয়ন’ শিরোনামে।
একটি কথা না বললেই নয়, অমীমাংসিত ইস্যুগুলোর সুষ্ঠু সমাধান না করে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের যেকোনো পদক্ষেপ হবে বাংলাদেশের জাতীয় চেতনাকে উপেক্ষা করার শামিল। পাকিস্তান যত দিন একাত্তরের গণহত্যার দায় স্বীকার না করবে, তত দিন দেশটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর উদ্যোগ মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতি অবমাননারও শামিল।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
‘হাসিনা পরবর্তী বাংলাদেশ-পাকিস্তানের সম্পর্কের নতুন মোড়’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন একটি দৈনিকে প্রকাশিত হয় গত ১৭ জানুয়ারি। আল জাজিরা সূত্রের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্কের ইতিহাস দীর্ঘদিন ধরেই উত্তেজনাপূর্ণ। তবে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তনের কারণে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক ও সামরিক যোগাযোগ বাড়ছে। বিশেষ করে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর, দুই দেশ নিজেদের ঐতিহাসিক শত্রুতা পেছনে রেখে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করছে। প্রতিবেদনে ওই মাসেই রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম কামরুল হাসানের মধ্যে বৈঠকের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলা হয়, এ বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা জোরদার এবং পারস্পরিক সম্পর্ককে বহিরাগত প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার বিষয়ে আলোচনা হয়।
১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে। সেই সময় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী এবং এ দেশে তার অক্সিলারি ফোর্স বা সহযোগী বাহিনীগুলো গণহত্যার পাশাপাশি মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছিল, যা দুই দেশের মধ্যে গভীর বিভেদ সৃষ্টি করে। মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক ছিল উত্তেজনাপূর্ণ। আল জাজিরার প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, এই ঐতিহাসিক ক্ষত আরও গভীর হয়েছিল বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৬ বছরের শাসনকালে। কিন্তু ২০২৪ সালে গণবিক্ষোভের কারণে হাসিনার পদত্যাগ ও ভারতে চলে যাওয়ার পর থেকে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং হাসিনা সরকারের প্রতি ভারতের দীর্ঘমেয়াদি সমর্থন দুই দেশের রাজনৈতিক গতিপথ পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে। নতুন অন্তর্বর্তী সরকার ভারতের কাছ থেকে শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণ চেয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে, পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বন্ধুত্বের বৃদ্ধি একটি নতুন কূটনৈতিক বাস্তবতা তৈরি করছে। গত ডিসেম্বরে মিসরের রাজধানী কায়রোতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সাক্ষাৎ করার বিষয়টি উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, এর আগে তারা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠকে একত্রে আলোচনা করেছিলেন। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সাম্প্রতিক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকগুলো সম্পর্কের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়ার সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে আল জাজিরা। ২০২৪ সালে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৭০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি। বাংলাদেশ তার ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির মাধ্যমে পাকিস্তানের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদার হয়ে উঠতে পারে বলে আল জাজিরার অভিমত। ওই প্রতিবেদনে দুই দেশের যেসব উচ্চপর্যায়ের বৈঠককে সম্পর্ক পরিবর্তনের ইঙ্গিত হিসেবে বর্ণনা করা হয়, সে ধরনের বৈঠক-সফর চলমান। পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার গত শনিবার দুদিনের সফরে ঢাকায় আসেন। সফরের প্রথম দিনেই তিনি বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাদের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করেন। এসব বৈঠকে তিনি রাজনৈতিক পরিসরসহ নানা ক্ষেত্রে দুই দেশের সম্পর্ক বৃদ্ধির বিষয়ে আলোচনা করেন। পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও স্বার্থের ভিত্তিতে এই সম্পর্ক জোরদার করার বিষয়ে তিনি পাকিস্তানের অঙ্গীকারও ব্যক্ত করেন। তবে দ্বিতীয় দিন হোটেল সোনারগাঁওয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে বৈঠকের পর তিনি অতি স্পর্শকাতর বিষয়ে মন্তব্য করেন। ইসহাক দার দাবি করে বলেন, একাত্তরের গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাওয়াসহ অমীমাংসিত তিন সমস্যার নাকি দুবার সমাধান হয়েছে। অমীমাংসিত ইস্যু নিয়ে তিনি বলতে চান, ১৯৭৪ সালে প্রথমবারের মতো বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়েছে। আর ওই সময়ের দলিলটি দুই দেশের জন্য ঐতিহাসিক। এরপর জেনারেল পারভেজ মোশাররফ এখানে (বাংলাদেশে) এসে প্রকাশ্যে ও খোলামনে বিষয়টির সমাধান করেছেন। ফলে বিষয়টির দুবার সমাধান হয়েছে। একবার ১৯৭৪ সালে, আরেকবার ২০০০ সালের শুরুতে।
ইসহাক দারের এই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে অমীমাংসিত ইস্যুগুলো আসলে কী? অমীমাংসিত ইস্যু তিনটি ধরা হলে প্রথমেই আসে একাত্তরে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য বাংলাদেশের জনগণের কাছে পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার প্রসঙ্গ। ইসহাক দার যেমনটি দাবি করেছেন, সে মতো পাকিস্তান কি আসলেই কখনো ক্ষমা চেয়েছে? হ্যাঁ, ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের কাছে ‘ক্ষমা করো এবং ভুলে যাও’ আবেদন করা হয়েছিল বৈকি। তিন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সই করা চুক্তিতে আবেদনটি ছিল পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত ১৯৫ জন পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তাকে পাকিস্তানের কাছে তুলে দেওয়া হয়েছিল। ওই চুক্তি করার আগে পাকিস্তানের তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আজিজ আহমেদ সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ যদি এদের ক্ষমা করে, তবে আমরা এই ১৯৫ জনের যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ পাব, তাদের বিচার নিশ্চিত করব।’ কিন্তু সেই বিচার করার কোনো উদ্যোগ তো দূরের কথা, তেমন কোনো মনোভাবও পরে আর দেখায়নি ইসলামাবাদ।
এর বাইরেও চুক্তির আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত পাকিস্তান লঙ্ঘন করে। যেমন চুক্তিতে ছিল, বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ফিরিয়ে নেবে পাকিস্তান। কিন্তু এত বছরেও দেশটি এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়নি, ইচ্ছাও প্রকাশ করেনি। আইন মতে, কোনো পক্ষ চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করলে তবে তা আপনা-আপনিই বাতিল হয়ে যায়। সংগত কারণেই বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ চুক্তিটি কখনো অনুমোদন করেনি। পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের অমীমাংসিত ইস্যুর মধ্যে আরেকটি হলো দেশটির কাছে বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন (৪৫০ কোটি) ডলার পাওনা। গত এপ্রিলে ঢাকায় পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকেও অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সমাধান করতে তাগিদ দেওয়া হয়েছিল পাকিস্তানকে। একাত্তরে গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা এবং প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার পাওনা পরিশোধের বিষয়টি তখন আলোচনায় তোলা হয়েছিল। তখনকার পররাষ্ট্রসচিব জসীম উদ্দিন সেদিন বলেছিলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে বিদ্যমান অমীমাংসিত বিষয়গুলো তিনি বৈঠকে তুলেছেন। যেমন আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসন, অবিভাজিত সম্পদে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা প্রদান, ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রেরিত বিদেশি সাহায্যের অর্থ হস্তান্তর এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়া।
২০০০ সালে পাকিস্তানের তখনকার প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মোশাররফ বাংলাদেশে এসে প্রকাশ্যে ও খোলামনে ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি সমাধান করেছেন বলে যে দাবি ইসহাক দারের, সেটির কোনো সত্যতা নেই। প্রকৃতপক্ষে ২০০২ সালের ৩১ জুলাই পারভেজ মোশাররফ বাংলাদেশের জাতীয় স্মৃতিসৌধ পরিদর্শনের সময় দর্শনার্থী বইয়ে লিখেছিলেন, ‘১৯৭১ সালের ঘটনাগুলোর বেদনায় পাকিস্তানের আপনার ভাই ও বোনেরা সমব্যথী। সেই দুর্ভাগ্যজনক সময়ের বাড়াবাড়ির জন্য আমরা দুঃখিত।’ দুঃখ প্রকাশ আর ক্ষমা প্রার্থনা কি এক জিনিস! অর্ধ শতক পরও পাকিস্তান গণহত্যা ও ৩০ লাখ মানুষ হত্যার বিষয়টি স্বীকারই করেনি, রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমাও চায়নি।
পারভেজ মোশাররফ বাংলাদেশে এসে একাত্তরের ‘বাড়াবাড়ির জন্য’ সাধারণভাবে ‘দুঃখপ্রকাশ’ করেছিলেন কেবল।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ ও পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর গণহত্যা এখনো বেদনাদায়ক বাস্তবতা। সম্প্রতি দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এই বাস্তবতা নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে বলেও সম্প্রতি অভিযোগ করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। অন্যদিকে পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম এখনো বাংলাদেশকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ বানানোর স্বপ্নে বিভোর। পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে প্রকাশিত শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি সংবাদপত্র দ্য ক্যাচলাইন ১৬ আগস্ট এক নিবন্ধে বলেছে, ৫৪ বছর পর হিসাব-নিকাশের সময় এসেছে। ‘পূর্ব পাকিস্তান’কে ফিরে আসতে হবে। এর চার দিনের মাথায় পত্রিকাটি আরেকটি নিবন্ধ প্রকাশ করে ‘পাকিস্তান অ্যান্ড বাংলাদেশ: ইমাজিনিং অ্যা লস্ট ইউনিয়ন’ শিরোনামে।
একটি কথা না বললেই নয়, অমীমাংসিত ইস্যুগুলোর সুষ্ঠু সমাধান না করে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের যেকোনো পদক্ষেপ হবে বাংলাদেশের জাতীয় চেতনাকে উপেক্ষা করার শামিল। পাকিস্তান যত দিন একাত্তরের গণহত্যার দায় স্বীকার না করবে, তত দিন দেশটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর উদ্যোগ মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতি অবমাননারও শামিল।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
দেশে এখন অলৌকিকত্বের জয়জয়কার। এত অলৌকিকতা আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি। এখন যারা অন্ধকারের দিকে টানে, তারা একাত্তর মানে না, শহীদ মানে না। তাদের জন্য এই লেখাটা, হয়তো আসল অলৌকিকত্ব তাদের স্পর্শ করবে।
১০ ঘণ্টা আগেগাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে তিস্তা নদীর ওপর নির্মিত সেতুটির উদ্বোধন করা হয় ২০ আগস্ট, বুধবার। এরপর ঘটে ম্যাজিক কারবার। বৃহস্পতিবার এই সেতুর ল্যাম্পপোস্টের বিদ্যুৎ সরবরাহের তার বেমালুম চুরি হয়ে যায়। এরপর যা হয়, তাই হয়েছে
১০ ঘণ্টা আগেফাহমিদুল হক চলচ্চিত্র সমালোচক, গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ ও গল্পকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের বার্ড কলেজের ফ্যাকাল্টি মেম্বার। একসময় ‘যোগাযোগ’ পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। তিনি জুলাই আন্দোলনের অর্জন-ব্যর্থতা, অন্তর্বর্তী সরকারের বিফলতা..
১ দিন আগেডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে ভারত-মার্কিন সম্পর্ক এক নতুন মোড় নিয়েছে। কিছুদিন আগেও ‘হাউডি মোদি’ বা ‘নমস্তে ট্রাম্প’-এর মতো উষ্ণ ব্যক্তিগত সম্পর্ক হঠাৎ করেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ভারতীয় পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক মোকাবিলা করতে গিয়ে দিশেহারা ব্যবসায়ীরা। রাশিয়া থেকে সস্তা জ্বালানি কেনাও কঠিন হয়ে উঠছে।
১ দিন আগে