Ajker Patrika

যা কিছু লৌকিক ও অলৌকিক

অজয় দাশগুপ্ত
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

দেশে এখন অলৌকিকত্বের জয়জয়কার। এত অলৌকিকতা আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি। এখন যারা অন্ধকারের দিকে টানে, তারা একাত্তর মানে না, শহীদ মানে না। তাদের জন্য এই লেখাটা, হয়তো আসল অলৌকিকত্ব তাদের স্পর্শ করবে।

অলৌকিক বলে কি আসলেই কিছু আছে? নাকি এটা সম্পূর্ণ মনোজাগতিক? এ নিয়ে মানুষের মধ্যে প্রচুর তর্ক হয়েছে, চলছে এবং চলবে। সে হোক, আমি সংশয়বাদী মানুষ। ঈশ্বর ও প্রকৃতি, শূন্য ও মহাশূন্য—দুই-ই টানে সমানভাবে। কয়েকটি ছোট্ট ঘটনার কথা বলছি, যার সবগুলোই সত্য অথচ ব্যাখ্যাহীন।

বাংলাদেশের জনপ্রিয়তম লেখক হুমায়ূন আহমেদ। তাঁকে আপনি গালমন্দ করতে পারলেও এড়াতে পারেন না। চমৎকার গদ্য লিখতেন। একবার লিখেছিলেন, তাঁর এক আমেরিকাপ্রবাসী বন্ধুর সঙ্গে রাতে ঘুরছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। ঘুরতে ঘুরতে রাতদুপুরে তাঁদের চায়ের তেষ্টা পেলে তাঁরা এগোতে থাকলেন চায়ের দোকানের দিকে। দেখলেন ওদিক থেকে হন হন করে হেঁটে আসছেন একজন পাগল কিসিমের মানুষ। দূর থেকে দেখেই বুঝলেন রাতবিরাতে ঘুরে বেড়ানো মানুষ। উদোম গা। লুঙ্গি আর হাতে কিছু একটা। হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন, তাঁর খুব ইচ্ছে হচ্ছিল এই পাগলা লোকটিকে বলেন, ‘সালাম আলাইকুম’, কিন্তু পারছেন না। পাশে আমেরিকাপ্রবাসী বিজ্ঞানী বন্ধু। ভাববে, ওর মুখে মুখে প্রগতিশীলতা আর রাতদুপুরে ফকির দেখে ভক্তিতে গদগদ। তো তাঁরা হাঁটছেন, পাগলাও এগিয়ে আসছেন। কাছাকাছি হতেই লোকটি হুমায়ূন আহমেদের দিকে তাকিয়ে বেশ জোর গলায় হাঁক দিয়ে বললেন, ‘ওয়ালাইকুম আসসালাম’। স্তম্ভিত বিচলিত হুমায়ূন আহমেদ থতমত খেয়ে গেলেন বটে, কিন্তু এর জট খুলতে পারেননি কোনো দিন।

আমি তখন চট্টগ্রামে। একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকে চাকরি করি। আমি কাজ করতাম জেনারেল ম্যানেজারের অফিসে। সেখানে দারোয়ান, পিয়ন, মেসেঞ্জারের ছড়াছড়ি। এর মধ্যে একজন ছিলেন, যিনি দেখতে ছোটখাটো। যত দূর জেনেছি, দুই বিবি নিয়ে থাকেন। সংসারও কম বড় না। কিন্তু কাজে ফাঁকি দেওয়ার লোক ছিলেন না তিনি। যেটা হয়, ফাই-ফরমাশ খাটলে সবাই কিছু না কিছু দেয়, তাঁকে কিছু দিলে পাই-পয়সা হিসাব করে ফেরত দিতেন। আমার প্রতি তাঁর কেমন জানি একটা টান ছিল। জানতেন, আমি চা খাই। ভালোবাসি চা পান করতে। অন্যদের জন্য তিনি চা আনলেও এক কাপ আমার টেবিলে হাজির হবেই। মাঝে মাঝে এমন সব কথা বলতেন আর কাজ করতেন, আমি বেশ হিমশিম খেয়ে যেতাম তার কারণ খুঁজে বের করতে। একবার হইহই কাণ্ড। আমাদের অফিসে এলেন ব্যাংকের এমডি। বাংলাদেশে যা হয়, পারলে তাঁর জুতা সাফ করে দিতে প্রস্তুত এক শ জন। আমরা তখন নবীন অফিসার। কে আমাদের খবর রাখে? ব্যাংকের ফ্লোরজুড়ে একটা ছোট কাচঘেরা রুম ছিল মন্দিরের মতো। সেখানে ঢুকতে জুতা খুলতে হতো। আর যখন-তখন কেউ ঢোকা মানে পরদিন পাহাড়-জঙ্গলে বদলি! যে দুজন ওই রুমে বসতেন, তাঁদের হাবভাব ছিল আলাদা। তাঁরা যে কী করতেন, কেন করতেন, কেউ জানত না। এখন বুঝি, সারা দিনে দু-একটা এক্সেল সিট তৈরি করা ছাড়া আর কিছুই হতো না ওখানে।

সে যাই হোক। এমডি এলে সাজ সাজ রব পড়ে গেল অফিসে। সন্ধ্যার পর তিনি ঢুকলেন সেই রুমে। বাইরে ফ্লোরে আমরা যাঁর যাঁর আসনে দাঁড়িয়ে। যত সময় তিনি ফ্লোরে থাকবেন, তখন কেউ বসে থাকবে, এটা কি হয়? দেশি কায়দায় আদব বলে কথা। আমার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন সেই লোক, ইলিয়াস আলী। বিড়বিড় করে সুরা বা কিছু পাঠ করা তাঁর স্বভাব। তেমন কিছু করছিলেন মনে হয়। হঠাৎ একটা বড় ফুঁ দিয়ে আমাকে ফিসফিস করে বললেন, ‘এমডি সাহেব কিন্তু এখন আপনার কাছে আসবে।’ আমি তো বিরক্তির চরমে। চাপা গলায় জোর দিয়ে বললাম, ‘চুপ কর। তোর কিন্তু খবর আছে আজকে।’ দেখি, তিনি মিটমিট করে হাসছেন। আমার রাগ তখন তুঙ্গে। এমডি কম্পিউটার রুম থেকে বেরিয়ে গটগট করে জিএমের চেম্বারের দিকে যাওয়ার পথে হঠাৎই ঘুরে দাঁড়িয়ে সোজা মাঝখানের সারিতে আমার সামনে চলে এলেন। আমার তো রীতিমতো ঘাম বেরোচ্ছে! আমি কী কাজ করি, কী কী দেখি—এসব দু-একটা মামুলি প্রশ্ন করেই পাশে দাঁড়ানো বড় এক কর্তাকে বললেন, ‘একে আমাদের হেড অফিসে বদলি করুন। পাবলিক রিলেশনস অফিসার হিসেবে।’ পাশের কর্তা তো পারলে আমাকে তখনই ট্রেনে তুলে দেন। আমার তখন মাথা ঘুরছে। বলা নেই, কওয়া নেই, আমি যাব ঢাকায়! পাবলিক রিলেশনস যতটা আর যত বেশি আকর্ষক হোক না কেন, আমি তো প্রস্তুত না। তখন আমার অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসন ভিসা হাতের মুঠোয়। সেটা ভিন্ন কাহিনি। হঠাৎ করে এমডি পোর্টফোলিওর কেউ আমার কাছে চলে আসবেন, তাও ইলিয়াস হুজুরের আগাম বলা কথামতো—এ ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা আমি পাইনি আজও! যেমন পাইনি অন্ধ হাফেজের বাণীর। যিনি আমার হাত ধরে বলেছিলেন, ‘বিদেশেই যাবে। ওখানেই হবে যা হবার।’

তারুণ্যে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলতে পছন্দ করতাম। আসলে স্বপ্নগুলো সফল হতো না তো, তাই এভাবে বলেই আমরা শান্তি পেতাম হয়তো। সন্ধ্যায় আমি প্রায়ই চট্টগ্রাম রামকৃষ্ণ মিশনে যেতাম। একবার গিয়ে দেখি স্বামীজি এসেছেন ঢাকা থেকে। স্বামী অক্ষরানন্দজি। আমিও গেলাম একান্তে দেখা করতে। কী চমৎকার গৈরিক বসন! মাথায় টুপি। দেখে-শুনে মুগ্ধ আমি তাঁকে বললাম, ‘সাধু হতে চাই। কী করতে হবে?’ সব শুনে স্মিতহাস্যে বললেন, ‘তোমার দরকার নেই সাধু হবার, তুমি যা ভালোবাসো তা-ই করো।’ আমি আমার ছোট লাল নোট বইটা মেলে দিয়ে কিছু লিখে দিতে অনুরোধ জানালে তিনি আমাকে বিস্মিত করে লিখেছিলেন, ‘আজীবন সত্য কথা বলিবে।’ আমি তখন ঘামছি। আমি যে মিথ্যা বলি, তিনি জানলেন কীভাবে! সে-ই বোধ হয় আমার বানিয়ে বানিয়ে বলা গল্পের শেষকাল। এমন অভিজ্ঞতা বিদেশেও ঘটেছে। বারান্তরে বলা যাবে সেসব।

লেখক: অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী কলামিস্ট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত