উৎপল কান্তি ধর
কয়েকশ বছর আগের একদিন, বিশাল অচিন গাছের ছায়ার নিচে ঠাই নিয়েছে রঙ-বেরঙের সব পসরা, প্রতিদিনের নির্জন প্রান্তর গমগম করছে মানুষের কোলাহলে, দূর-দূরান্ত থেকে কত ধরনের মানুষ এসেছে-জাত-বেজাতের ব্যবসায়ী, সন্ন্যাসী, বাজনদার, আর সাধারণ মানুষ, সারা বছর ধরে যারা অপেক্ষা করেছে হিন্দুবাঘার মেলার জন্য, বিশেষ করে নারীদের উল্লাসভরা মুখ আর শিশুদের নিবিষ্ট কৌতূহলভরা ড্যাবড্যাবে চাহনি নজর কাড়ে সহজেই।
ঝাঁকড়া গাছকে কেন্দ্র করে মূল মেলা, সন্তান না হওয়া দম্পতি, বিশেষ করে মহিলারা সারা দিন মাটিতে আঁচল পেতে সাষ্টাঙ্গে প্রমাণ করে থাকে গাছের নিচে এবং প্রার্থনা করে ভূতনাথ (শিবের আরেক রূপ বা নাম) যেন তার কোল এক টুকরো আলোয় ভরিয়ে দেয়, আলতো বাতাসে খসে পড়া কোনো জীর্ণ পাতা যদি পাক খেয়ে পাক খেয়ে তার আঁচলে আশ্রয় নেয়, ব্যস কেল্লাফতে!
তার মানে ভূতনাথ তার প্রার্থনা মঞ্জুর করেছেন! প্রার্থনায় বসার আগে অবশ্য তারা সেই গাছের ডালে লোভী দেবতার ভোগ হিসেবে গজার মাছ ঝুলিয়ে দেন এবং মেলার শেষে এই ভোগ অনেকে মিলে খাওয়া হয়।
এই কয়েকশ বছর এক প্রাচীন বাংলার বিকেলে আমাদের নিয়ে গিয়েছিল ভূতনাথের মেলা, ফি বছরের ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমাকালে ৩ দিনের জন্য শত বছরের ঐতিহ্যবাহী মেলাটি হয়। ফোকলোরবিদ বন্ধু উদয় শঙ্কর আগেই বলে রেখেছিল মেলাটি সম্পর্কে, সাথে নতুন যাত্রী হিসেবে জুটলেন তোজাম ভাই।
রাজশাহী–নওগাঁর বাসে চেপে এক ঘণ্টার মাঝে বলিহার পর্যন্ত যেয়েই লাল-নীল-হলদে তেরপলে ঢাকা মেলার এলাকা দেখা দিল। বাসের রাস্তার পাশেই বিস্তীর্ণ মাঠ, অন্যদিকে ফসলের ভূমি, মেঠো পথে খানিকটা হাঁটতেই মেলা শুরু, তারও ঢের আগে থেকে মেলায় আগত মানুষের লাইন।
প্রথমেই কিছু ভাজা-ভুজি জাতীয় খাবারের দোকান, যাদের দর্শনে তেঁতুলের মতো লালা না ঝরলেও মুখগহ্বর সিক্ত হয় বটেই! তার পরপরই থোকা থোকা আঙ্গুরের মতো দেখতে এক অজানা মিষ্টির আড়ত। কিন্তু পেটে তখন ছুঁচো ডিগবাজি দিচ্ছে, উদয় ব্যাটা মেলার গজার মাছের ভোগের কথা বলে এতক্ষণ কেত্তন করলেও মেলায় প্রবেশের পর জানাচ্ছে, এই প্রসাদ পেতে হলে মাঝরাত্তির পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে!
কী চিত্তির! শেষে মাছ-ভাতের হোটেল ঢোকা হলো, আগুন গরম ভাত, গোটা একটা রুই মাছের পাকা পোনা দিয়ে চমৎকার স্বাদের আলুর ঝোল, সাথে অল্প সালাদ আর চাইলে বোনাস ঝোল, দাম-মাত্র ৪০ টাকা! শায়েস্তা খার আমল না হলেও মগের মুল্লুক পৌঁছে গেছি যেন!
বেশ তরিবৎ খেয়ে জঠরের আগুনে জল ঢেলে একটু মিষ্টি জিলাপি দিয়ে পেঁচিয়ে মুখশুদ্ধি করে বেরোলাম মেলা দেখতে। একদিকে মাঠের জিনিসপত্র, অন্যদিকে গেরস্থালির, মিষ্টির দোকানের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, সেই সাথে মিষ্টিখাদকরাও পাল্লা দিয়ে রসভোজন করেই যাচ্ছেন, দেখেও সুখ। কচিকাঁচাদের উল্লাস মূলত নাগরদোলা ঘিরে, আর আছে মৃত্যুকূপ।
বাংলাদেশের মানুষ গলার ক্যামেরা ঝোলালেই সাংবাদিক এবং চুল লম্বা হলেই ব্যান্ডের গায়ক মনে করে, এখানেও তার ব্যতিক্রম হলো না, কয়েকজন মুরুব্বী এসে সরাসরি বললেন, আপনার খবরের কাগজে লিখবেন যে জুয়া এবং পুতুল নাচের নাম করে অশ্লীল নাচ দেখিয়ে এই মেলার সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের ওপরে আঘাত হেনে নগদ পয়সার কারবার করছে একটি বিশেষ মহল, এর প্রতিবাদে তারা সড়ক অবরোধ করে প্রশাসনের কাছে বার্তা পৌঁছে দিলেও কেউ জুয়া এবং নাচ বন্ধ করতে এগিয়ে আসেনি। তাদের ভাষ্যমতে, এইভাবে মেলাটির পরিবেশ কলুষিত বলে প্রচার পাওয়াতে অনেক মহিলা আর মেলাতে আসেন না। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ দোকানিরা অথচ আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে কিছু ক্ষমতাশালীর।
আসলে আজ থেকে নয়, কয়েক দশক ধরে বাঙালির ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক এই মেলাগুলো ধ্বংসের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করে একনিষ্ঠ কাজ করে যাচ্ছে দেশের মৌলবাদী চক্র, সেই হিসেবে কোথাও প্রকাণ্ড গাছ দেখলে তারা চেষ্টা করে গাছটি সমূলে উৎপাটন করতে, কারণ ঝাঁকড়া গাছ মানেই তাকে ঘিরে ছোট বাজার বা হাট বসবে, মানুষজনের সমাগম হবে প্রতিনিয়ত, হয়তো গাছের পূজা হতে পারে, সেখানে থান বসিয়ে মন্দির করা হতেও পারে—তাই এমন গাছ তাদের বিশাল শত্রু। সেই সাথে গত কয়েক বছর ধরে শুরু হয়েছে, যেখানে লোকমেলাগুলো বসে তারই আসেপাশে সেই সময়েই উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে ওরস বা ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করা, যাতে ধর্মপ্রাণ সরল মানুষদের মেলা সম্পর্কে ভুল কুশ্রী ধারণা দেওয়া যায়।
মৌলবাদীরা সবচেয়ে বেশি ভয় করে মুক্তচিন্তার চর্চাকে, তাই তারা সবচেয়ে বেশি চেষ্টা করে তাদের মতের বাইরের মানুষগুলো যেন কোথাও সংগঠিত না হতে পারে, তারা যেন একাকী থাকে, তাই মেলাগুলো হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের অন্যতম টার্গেটে, এবং সেই সাথে আছে মেলায় হিন্দুয়ানি সংস্কৃতির কথা বলে উস্কানি দেওয়া, অথচ মেলা হচ্ছে বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর সুকৌশলে জুয়া এবং অশ্লীল নাচের অনুপ্রবেশ কে বা কারা সব জায়গাতে করাচ্ছে, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন আছে, আপাতদৃষ্টিতে গ্রামের মাতব্বর বা স্থানীয় রাজনৈতিক পাণ্ডা জড়িত থাকলেও মূল শেকড় আরো গভীরে। কারণ মেলাকে সাধারণ মানুষের কাছে অজনপ্রিয় করে তোলা।
কিছু কিছু মেলায় কৌশলে প্রশাসনকে ব্যবহার করা হচ্ছে গাঁজা-ভাঙের আড্ডা ভাঙার নামে মেলাকে নিস্ক্রিয় করার কাজে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের শিক্ষক উদয় বললেন, যেই কারণে তিনি যখন ফিল্ড ওয়ার্কের কাজে ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে এই মেলাতে এসেছিলেন, তখন অনেক ছাত্রীই আড়ালে বলেছে, নিজের বোন হলে কি স্যার আমাদের এভাবে আনতেন? মেলাতে কি ভদ্রমেয়েরা যায়?
অথচ গ্রাম্যমেলাতে নরনারীর মাঝে সাধারণত কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার হদিস পাওয়া যায় না, যেখানে শহুরে মেলাতে ইভটিজিং ঘটে অহরহ। মেলা সম্পর্কে এই ধারণা তৈরি করা হয়েছে সুচিন্তিতভাবে, অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে।
মেলার মূল কেন্দ্র সেই অচিন গাছের দিকে যেতে কত যে জাতবেজাতের দোকান চক্ষু সার্থক করল- রক্ত লাল গাঢ় সিদুর, স্নিগ্ধ সফেদ বাতাসা, রোদ পিছলে যায় এমন পিতল আর কাঁসার তৈজসপত্রের সম্ভার, রুদ্রাক্ষের মালা, চন্দনের ফোঁটা, সেই সাথে জ্ঞানগর্ভ পুস্তক! এবং অবশ্যই অসংখ্য ভূতনাথ! স্বয়ং ঈশ্বরের পূজারিদের যেহেতু অর্থের ভীষণ প্রয়োজন তাই বিকিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাকেও।
আমার দেশটা এমনই ছিল, হিন্দু মুসলমান এবং অন্যান্য ধর্মের নারী-পুরুষ মিলে পালন করতে সমস্ত উৎসব, মুক্ত কণ্ঠে গান চলত :
গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম আমরা
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।
অথচ আজ ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে আমাদের বন্ধুত্ব সহনশীলতার ইতিহাস। বুনে দেওয়া হচ্ছে বিদ্বেষ।
সেই অচিন গাছের নিচে ভক্তদের মাতম, মাটিতে পা ঠেকিয়ে প্রণাম চলছে, সেই সাথে চলছে প্রণামির ছড়াছড়ি। বাড়ছে টাকার স্তূপের উচ্চতা, ঢাকির বাদ্যের আওয়াজ, সন্ন্যাসীর হাসি আর পূজারির আহাজারি। কী নাম সেই অচিন বৃক্ষের? জানার আগ্রহ হলো না, থাক না কিছু রহস্য, আবার ফেরার তাগিদ।
প্রাচীন বাংলার সেই সময়টুকু ভীষণ ভাবে উপভোগ করলাম আমরা, সেই সাথে আরেকবার নতুন করে উপলব্ধি হলো যে বাংলার মানুষ এমনই, সকল ধর্মের সকল জাতের মানুষ একসাথে মিলেমিশেই থাকবে। যতই চেষ্টা করা হোক বাংলাদেশ কোনোদিন আফগানিস্তান বা পাকিস্তানের মতো নরককুণ্ডে পরিণত হবে না, সবকিছুর পরেও বাঙালির পরিচয় বাঙালিই।
এর মাঝে এক দিদিমা আসলেন কপালে তিলক কেটে দিতে, সেই ফোঁটা নিয়ে আমরা তিন মুসাফির মশগুল হয়ে রইলাম প্রাচীন বাংলায়।
কয়েকশ বছর আগের একদিন, বিশাল অচিন গাছের ছায়ার নিচে ঠাই নিয়েছে রঙ-বেরঙের সব পসরা, প্রতিদিনের নির্জন প্রান্তর গমগম করছে মানুষের কোলাহলে, দূর-দূরান্ত থেকে কত ধরনের মানুষ এসেছে-জাত-বেজাতের ব্যবসায়ী, সন্ন্যাসী, বাজনদার, আর সাধারণ মানুষ, সারা বছর ধরে যারা অপেক্ষা করেছে হিন্দুবাঘার মেলার জন্য, বিশেষ করে নারীদের উল্লাসভরা মুখ আর শিশুদের নিবিষ্ট কৌতূহলভরা ড্যাবড্যাবে চাহনি নজর কাড়ে সহজেই।
ঝাঁকড়া গাছকে কেন্দ্র করে মূল মেলা, সন্তান না হওয়া দম্পতি, বিশেষ করে মহিলারা সারা দিন মাটিতে আঁচল পেতে সাষ্টাঙ্গে প্রমাণ করে থাকে গাছের নিচে এবং প্রার্থনা করে ভূতনাথ (শিবের আরেক রূপ বা নাম) যেন তার কোল এক টুকরো আলোয় ভরিয়ে দেয়, আলতো বাতাসে খসে পড়া কোনো জীর্ণ পাতা যদি পাক খেয়ে পাক খেয়ে তার আঁচলে আশ্রয় নেয়, ব্যস কেল্লাফতে!
তার মানে ভূতনাথ তার প্রার্থনা মঞ্জুর করেছেন! প্রার্থনায় বসার আগে অবশ্য তারা সেই গাছের ডালে লোভী দেবতার ভোগ হিসেবে গজার মাছ ঝুলিয়ে দেন এবং মেলার শেষে এই ভোগ অনেকে মিলে খাওয়া হয়।
এই কয়েকশ বছর এক প্রাচীন বাংলার বিকেলে আমাদের নিয়ে গিয়েছিল ভূতনাথের মেলা, ফি বছরের ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমাকালে ৩ দিনের জন্য শত বছরের ঐতিহ্যবাহী মেলাটি হয়। ফোকলোরবিদ বন্ধু উদয় শঙ্কর আগেই বলে রেখেছিল মেলাটি সম্পর্কে, সাথে নতুন যাত্রী হিসেবে জুটলেন তোজাম ভাই।
রাজশাহী–নওগাঁর বাসে চেপে এক ঘণ্টার মাঝে বলিহার পর্যন্ত যেয়েই লাল-নীল-হলদে তেরপলে ঢাকা মেলার এলাকা দেখা দিল। বাসের রাস্তার পাশেই বিস্তীর্ণ মাঠ, অন্যদিকে ফসলের ভূমি, মেঠো পথে খানিকটা হাঁটতেই মেলা শুরু, তারও ঢের আগে থেকে মেলায় আগত মানুষের লাইন।
প্রথমেই কিছু ভাজা-ভুজি জাতীয় খাবারের দোকান, যাদের দর্শনে তেঁতুলের মতো লালা না ঝরলেও মুখগহ্বর সিক্ত হয় বটেই! তার পরপরই থোকা থোকা আঙ্গুরের মতো দেখতে এক অজানা মিষ্টির আড়ত। কিন্তু পেটে তখন ছুঁচো ডিগবাজি দিচ্ছে, উদয় ব্যাটা মেলার গজার মাছের ভোগের কথা বলে এতক্ষণ কেত্তন করলেও মেলায় প্রবেশের পর জানাচ্ছে, এই প্রসাদ পেতে হলে মাঝরাত্তির পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে!
কী চিত্তির! শেষে মাছ-ভাতের হোটেল ঢোকা হলো, আগুন গরম ভাত, গোটা একটা রুই মাছের পাকা পোনা দিয়ে চমৎকার স্বাদের আলুর ঝোল, সাথে অল্প সালাদ আর চাইলে বোনাস ঝোল, দাম-মাত্র ৪০ টাকা! শায়েস্তা খার আমল না হলেও মগের মুল্লুক পৌঁছে গেছি যেন!
বেশ তরিবৎ খেয়ে জঠরের আগুনে জল ঢেলে একটু মিষ্টি জিলাপি দিয়ে পেঁচিয়ে মুখশুদ্ধি করে বেরোলাম মেলা দেখতে। একদিকে মাঠের জিনিসপত্র, অন্যদিকে গেরস্থালির, মিষ্টির দোকানের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, সেই সাথে মিষ্টিখাদকরাও পাল্লা দিয়ে রসভোজন করেই যাচ্ছেন, দেখেও সুখ। কচিকাঁচাদের উল্লাস মূলত নাগরদোলা ঘিরে, আর আছে মৃত্যুকূপ।
বাংলাদেশের মানুষ গলার ক্যামেরা ঝোলালেই সাংবাদিক এবং চুল লম্বা হলেই ব্যান্ডের গায়ক মনে করে, এখানেও তার ব্যতিক্রম হলো না, কয়েকজন মুরুব্বী এসে সরাসরি বললেন, আপনার খবরের কাগজে লিখবেন যে জুয়া এবং পুতুল নাচের নাম করে অশ্লীল নাচ দেখিয়ে এই মেলার সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের ওপরে আঘাত হেনে নগদ পয়সার কারবার করছে একটি বিশেষ মহল, এর প্রতিবাদে তারা সড়ক অবরোধ করে প্রশাসনের কাছে বার্তা পৌঁছে দিলেও কেউ জুয়া এবং নাচ বন্ধ করতে এগিয়ে আসেনি। তাদের ভাষ্যমতে, এইভাবে মেলাটির পরিবেশ কলুষিত বলে প্রচার পাওয়াতে অনেক মহিলা আর মেলাতে আসেন না। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ দোকানিরা অথচ আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে কিছু ক্ষমতাশালীর।
আসলে আজ থেকে নয়, কয়েক দশক ধরে বাঙালির ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক এই মেলাগুলো ধ্বংসের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করে একনিষ্ঠ কাজ করে যাচ্ছে দেশের মৌলবাদী চক্র, সেই হিসেবে কোথাও প্রকাণ্ড গাছ দেখলে তারা চেষ্টা করে গাছটি সমূলে উৎপাটন করতে, কারণ ঝাঁকড়া গাছ মানেই তাকে ঘিরে ছোট বাজার বা হাট বসবে, মানুষজনের সমাগম হবে প্রতিনিয়ত, হয়তো গাছের পূজা হতে পারে, সেখানে থান বসিয়ে মন্দির করা হতেও পারে—তাই এমন গাছ তাদের বিশাল শত্রু। সেই সাথে গত কয়েক বছর ধরে শুরু হয়েছে, যেখানে লোকমেলাগুলো বসে তারই আসেপাশে সেই সময়েই উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে ওরস বা ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করা, যাতে ধর্মপ্রাণ সরল মানুষদের মেলা সম্পর্কে ভুল কুশ্রী ধারণা দেওয়া যায়।
মৌলবাদীরা সবচেয়ে বেশি ভয় করে মুক্তচিন্তার চর্চাকে, তাই তারা সবচেয়ে বেশি চেষ্টা করে তাদের মতের বাইরের মানুষগুলো যেন কোথাও সংগঠিত না হতে পারে, তারা যেন একাকী থাকে, তাই মেলাগুলো হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের অন্যতম টার্গেটে, এবং সেই সাথে আছে মেলায় হিন্দুয়ানি সংস্কৃতির কথা বলে উস্কানি দেওয়া, অথচ মেলা হচ্ছে বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর সুকৌশলে জুয়া এবং অশ্লীল নাচের অনুপ্রবেশ কে বা কারা সব জায়গাতে করাচ্ছে, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন আছে, আপাতদৃষ্টিতে গ্রামের মাতব্বর বা স্থানীয় রাজনৈতিক পাণ্ডা জড়িত থাকলেও মূল শেকড় আরো গভীরে। কারণ মেলাকে সাধারণ মানুষের কাছে অজনপ্রিয় করে তোলা।
কিছু কিছু মেলায় কৌশলে প্রশাসনকে ব্যবহার করা হচ্ছে গাঁজা-ভাঙের আড্ডা ভাঙার নামে মেলাকে নিস্ক্রিয় করার কাজে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের শিক্ষক উদয় বললেন, যেই কারণে তিনি যখন ফিল্ড ওয়ার্কের কাজে ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে এই মেলাতে এসেছিলেন, তখন অনেক ছাত্রীই আড়ালে বলেছে, নিজের বোন হলে কি স্যার আমাদের এভাবে আনতেন? মেলাতে কি ভদ্রমেয়েরা যায়?
অথচ গ্রাম্যমেলাতে নরনারীর মাঝে সাধারণত কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার হদিস পাওয়া যায় না, যেখানে শহুরে মেলাতে ইভটিজিং ঘটে অহরহ। মেলা সম্পর্কে এই ধারণা তৈরি করা হয়েছে সুচিন্তিতভাবে, অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে।
মেলার মূল কেন্দ্র সেই অচিন গাছের দিকে যেতে কত যে জাতবেজাতের দোকান চক্ষু সার্থক করল- রক্ত লাল গাঢ় সিদুর, স্নিগ্ধ সফেদ বাতাসা, রোদ পিছলে যায় এমন পিতল আর কাঁসার তৈজসপত্রের সম্ভার, রুদ্রাক্ষের মালা, চন্দনের ফোঁটা, সেই সাথে জ্ঞানগর্ভ পুস্তক! এবং অবশ্যই অসংখ্য ভূতনাথ! স্বয়ং ঈশ্বরের পূজারিদের যেহেতু অর্থের ভীষণ প্রয়োজন তাই বিকিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাকেও।
আমার দেশটা এমনই ছিল, হিন্দু মুসলমান এবং অন্যান্য ধর্মের নারী-পুরুষ মিলে পালন করতে সমস্ত উৎসব, মুক্ত কণ্ঠে গান চলত :
গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম আমরা
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।
অথচ আজ ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে আমাদের বন্ধুত্ব সহনশীলতার ইতিহাস। বুনে দেওয়া হচ্ছে বিদ্বেষ।
সেই অচিন গাছের নিচে ভক্তদের মাতম, মাটিতে পা ঠেকিয়ে প্রণাম চলছে, সেই সাথে চলছে প্রণামির ছড়াছড়ি। বাড়ছে টাকার স্তূপের উচ্চতা, ঢাকির বাদ্যের আওয়াজ, সন্ন্যাসীর হাসি আর পূজারির আহাজারি। কী নাম সেই অচিন বৃক্ষের? জানার আগ্রহ হলো না, থাক না কিছু রহস্য, আবার ফেরার তাগিদ।
প্রাচীন বাংলার সেই সময়টুকু ভীষণ ভাবে উপভোগ করলাম আমরা, সেই সাথে আরেকবার নতুন করে উপলব্ধি হলো যে বাংলার মানুষ এমনই, সকল ধর্মের সকল জাতের মানুষ একসাথে মিলেমিশেই থাকবে। যতই চেষ্টা করা হোক বাংলাদেশ কোনোদিন আফগানিস্তান বা পাকিস্তানের মতো নরককুণ্ডে পরিণত হবে না, সবকিছুর পরেও বাঙালির পরিচয় বাঙালিই।
এর মাঝে এক দিদিমা আসলেন কপালে তিলক কেটে দিতে, সেই ফোঁটা নিয়ে আমরা তিন মুসাফির মশগুল হয়ে রইলাম প্রাচীন বাংলায়।
গত কয়েক দিনে তিনজন জামায়াত নেতার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। এই একটা রাজনৈতিক দল, যাদের নেতাদের মধ্যে পরিমিতিবোধ অসাধারণ। প্রায়ই তাঁরা জানেন, কোথায় থামতে হয়। হাসতে হলে ঠোঁট দুটো কতটুকু প্রসারিত করতে হবে, দাঁত কটা প্রকাশিত হতে পারবে—সে হিসাবও সম্ভবত দল তাদের শিখিয়ে দেয়।
১২ ঘণ্টা আগেইন্দোনেশিয়া আজ বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বীকৃত। প্রায় ২৮ কোটি মানুষের এই বহুজাতিক ও বহু সাংস্কৃতিক দেশটি দীর্ঘ সামরিক শাসন, কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি ও দুর্নীতির গভীর সংকট অতিক্রম করে গণতান্ত্রিক ধারায় প্রবেশ করেছে।
১২ ঘণ্টা আগেইদানীং; কেবল ইদানীং কেন, অনেক আগে থেকেই আমার মনে একটি প্রশ্ন বারবার উঁকি দিয়ে ওঠে যে, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ কিংবা সমাজে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব কী, তা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারি? জানা আছে কিংবা জানা থেকে থাকলে মনে রাখতে পেরেছি এক একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠা অথবা গড়ে তোলার প্রেক্ষাপট কী?
১২ ঘণ্টা আগেরাজনীতির মাঠটাকে যাঁরা অশ্লীল বাক্যবাণের চারণক্ষেত্র বানিয়েছিলেন, তাঁদেরই একজন গ্রেপ্তার হয়েছে চাঁদাবাজি করতে গিয়ে। উত্তরা থেকে গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। কাহিনি সেই আগের মতোই।
১২ ঘণ্টা আগে