Ajker Patrika

জনগণের মনে রয়েছে প্রশ্ন, উত্তর নেই কোথাও

জাহীদ রেজা নূর
জনগণের মনে রয়েছে প্রশ্ন, উত্তর নেই কোথাও

দেশ কোন পথে যাত্রা করেছে, তা নিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে দেশের জনগণ। এক বছর আগে স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে যে ঐক্য দেখা দিয়েছিল, এখন সেই ঐক্যের ছিটেফোঁটাও দেখা যাচ্ছে না কোথাও। বিভিন্ন দল তাদের নিজেদের পথ বেছে নিয়েছে। একে অন্যের শত্রুতে পরিণত হয়েছে। সংস্কার ও নির্বাচন বিষয়ে বিভিন্ন দল বিভিন্ন অবস্থান নেওয়ায় আদৌ ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে কি না, তা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। এর ওপর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশাল ধাক্কা! ৩৫ শতাংশ শুল্কের বাড়তি চাপের বোঝা মাথা থেকে নামানোর জন্য কোনো গোপন চুক্তি হচ্ছে কি না, তা নিয়েও জনমনে সংশয় রয়েছে। ‘পাবলিক’ তার নিজের মতো করেই অনেক ঘটনা বুঝে নেয়। মার্কিনরা কী চাইতে পারে, তা নিয়েও তারা তাদের মতো করেই কিছু জবাব তৈরি করে নিয়েছে। মার্কিনদের কাছে দেশ বিক্রি হয়ে যাচ্ছে না তো?—এমন প্রশ্নও উঠছে আড্ডায়।

রাজনীতির মাঠ মোটেই মসৃণ নয়। সব সময় একই জায়গায় দাঁড়িয়ে একই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ তাতে নেই। দেশের পরিবর্তিত অবস্থায় কীভাবে জনমত গঠন করা যায় কিংবা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে কীভাবে এগিয়ে যাওয়া যায়, তার কৌশল নির্ণয় করার মধ্যে রাজনৈতিক ক্যারিশমার প্রকাশ ঘটে। এক রাজনৈতিক দল অন্য রাজনৈতিক দলের দোষ-ত্রুটি নিয়ে কথা বলবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই কথা বলতে গিয়ে মিথ্যাচার করা হলে সেটা রাজনীতিকে কলুষিত করে। এই কলুষতার বহিঃপ্রকাশ দেখা যাচ্ছে বিস্তর।

২.অনেকের মনেই প্রশ্ন, বিএনপি কি সত্যিই ফাঁদে পড়েছে? জুন মাসের মাঝামাঝি লন্ডনে ‘ইউনূস-তারেক বৈঠক’টি কি আসলেই ছিল এক পরিহাস? প্রধান উপদেষ্টার লন্ডন সফরের উদ্দেশ্য নিয়েও সে সময় প্রশ্ন তুলেছিলেন অনেকে। অনেকেই মনে করেছেন, মূলত তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করার জন্যই ছিল এই সফর। এ বছর ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হতে হবে—বিএনপি এ রকম একটি কঠোর অবস্থান থেকে সরে গেল ওই বৈঠকের পর। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে আদৌ নির্বাচন হবে কি না, তার অঙ্গীকার করলেন না প্রধান উপদেষ্টা। বরং বিচার-সংস্কার ইত্যাদির কিছু শর্ত দিয়ে এক ম্যাজিক রিয়ালিজমের দিকে নিয়ে গেলেন পরিস্থিতি।

এর ফল ফলল দুই রকম। বিএনপি প্রচার করতে লাগল, সমস্যার একটা সমাধান হয়েছে। জামায়াত আর এনসিপি এই বৈঠক নিয়ে প্রশ্ন তুলতে লাগল। কিন্তু আদতেই নির্বাচন কবে হবে, সে বিষয়ে ধোঁয়াশা দূর হলো না। একসময় মনে হয়েছিল, বিএনপি আর এনসিপির মধ্যে আসন ভাগাভাগি নিয়ে কোনো আলোচনার জন্ম হবে। কিন্তু দেখা গেল, বিএনপির সঙ্গে জামায়াত আর এনসিপির মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হলো। এনসিপির নেতারা বিএনপিকে সন্ত্রাসী দল হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। বিএনপিকে মুজিববাদের নতুন পাহারাদার বলেও তাদের পক্ষ থেকে অভিযোগ আনা হয়েছে।

আগস্টের পটপরিবর্তনের পর বিএনপি ভেবে নিয়েছিল, তারাই চলে এসেছে ক্ষমতায়। কিন্তু দেশের সর্বত্রই দেখা গেল ক্ষমতায় না আসা বিএনপির লোকেদের দখলদারি আর লুটপাট। বিভিন্ন জায়গায় তাদের পেশিশক্তির আভাস দেখা দিল। ক্ষমতায় আসার আগেই এ ধরনের আচরণ করায় বিএনপির ওপর জনগণের আস্থা কিছুটা কমেছে, এ কথা বললে ভুল বলা হবে না। অন্যদিকে, গ্রেনেড হামলা মামলায় খালাসপ্রাপ্ত তারেক রহমানসহ অনেক বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে সরকারপক্ষ থেকে আপিল করা হচ্ছে, তাতে বিএনপি নেতা দেশে ফিরবেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্নের জন্ম হয়েছে। লন্ডনে বসে ঢাকা নিয়ন্ত্রণ করা সহজ নয়। সম্ভবও নয়। তাই বিএনপি কোনো দুর্দশার মধ্যে পতিত হচ্ছে কি না, সেটা নিয়ে এখন বিএনপির নেতা-কর্মীরাও ভাবছেন।

৩. সম্প্রতি মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে ভাঙারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগ হত্যা নিয়ে অনেক জল ঘোলা হয়েছে। যুবদল, ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাদের দিকেই উঠেছে অভিযোগের আঙুল। কিন্তু জনমানুষের একটি অংশ মনে করছে, এই হত্যাকাণ্ড রহস্যময়। এটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড হতে পারে। যদি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড হয়ে থাকে, তাহলে কারা এর পরিকল্পনাকারী? কেন এই পরিকল্পনা? দেশের আইনশৃঙ্খলার অবস্থা ভালো নয়, এটা প্রমাণ করে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা নয়তো? এ রকম নৃশংসতা তো সচরাচর দেখা যায় না। যারা সোহাগকে হত্যা করেছে, তারা কতটা পাশবিক আচরণ করেছে, সেটা ভিডিও ফুটেজ দেখলেই বোঝা যায়। কয়েকজন আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে। যেই লোকটি সোহাগের মাথা থেঁতলে দিয়েছিল, পটুয়াখালীর সদর উপজেলার ইটবাড়িয়া এলাকা থেকে সে গ্রেপ্তার হয়েছে ১৫ জুলাই গভীর রাতে। এই দুর্বৃত্তদের কাছ থেকে জানতে হবে এই নৃশংসতা কেন ঘটানো হলো এবং এর পরিকল্পনাকারী কারা? তাদের আনতে হবে আইনের আওতায়। সমস্যা হচ্ছে, এ রকম কথা অনেক বলা হয়। কিন্তু এদের বিচার বা শাস্তি খুব একটা হয় না। নাটের গুরু কারা, তাদের কথাও জানতে পারে না কেউ।

৪. দেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিবিসিকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় নির্বাচন কবে হবে, সে ব্যাপারে কিছুই বলতে পারেননি। প্রধান উপদেষ্টার বিভিন্ন সময়ের কথাবার্তা থেকে যা বোঝা গেছে, তাতে মনে হয়, তিনি মূলত এপ্রিলের দিকেই নির্বাচন চাইছেন। তবে তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় তারিখটি এগিয়ে আনার গুঞ্জন শোনা গিয়েছিল। তাই ফেব্রুয়ারি বা এপ্রিলের কোনো একটি দিনকে নির্বাচনের দিন হিসেবে ধরে নিয়েই নিজেদের কাজ শুরু করতে পারে নির্বাচন কমিশন।

প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ঘাড়ে এবার গুরুভার বর্তেছে। পূর্ববর্তী দুই প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে যেভাবে জনসমক্ষে হেনস্তা করা হয়েছে, সেটা যদি তিনি মনে রাখেন, তাহলে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন না দিলে তাঁর পরিণতি কী হবে, তা নিশ্চয়ই তিনি বুঝতে পারছেন। পুলিশের সামনেই একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের গলায় জুতার মালা পরানো হয়েছে, তাঁর গালে চপেটাঘাত করা হয়েছে, অথচ সামনে থাকা পুলিশ সে সময় ‘নিরপেক্ষ বা নির্বিকার’ ভূমিকা পালন করেছে। অর্থাৎ আইনের রক্ষকেরাও অনেক সময় নীরব থাকতে পারেন, যা অনাকাঙ্ক্ষিত। তা নিয়ে সমালোচনা করা যায় বটে, কিন্তু অপমানটা হজম করে নিতে হয়। অন্যায় করলে আইনের হাতে সোপর্দ করার আগেই জনতার হাতে নিগৃহীত হওয়ার ঘটনা এত বেশি ঘটছে যে, সামাজিক সম্পর্কগুলোই বদলে গেল কি না, সে প্রশ্নও জেগেছে অনেকের মনে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারের একপর্যায়ে বলেছেন, ‘আমাদের প্রস্তুতি নিয়ে সরকারের কাছ থেকে কোনো গাইডেন্সও নাই, পরামর্শও নাই, আদেশও নাই, নির্দেশও নাই, নাথিং। আমরা অ্যাবসোলিউটলি ইনডিপেন্ডেন্টলি এই প্রস্তুতি নিচ্ছি।’ নিজেরাই প্রস্তুতি নিচ্ছেন, সেটা খুব ভালো কথা। কিন্তু জনগণকে তো এ ব্যাপারে কিছু বার্তা দিতে হবে। প্রথমত, প্রধান উপদেষ্টা বিদেশে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘তুমি টাকা দাও, আমি ভোট দেব। দেশে ভোটের চর্চা সেটাই।’ —অর্থাৎ এই দেশের মানুষ টাকা খেয়ে ভোট দেয়। প্রধান উপদেষ্টার এই কথা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। দেশের জনগণ ক্ষমতার উৎস হলেও ভোটের সময় তারা রাজনৈতিক দলের কাছে বিক্রি হয়ে যায়, এ রকম কথা মেনে নেওয়া একটু কঠিন বটে। প্রধান উপদেষ্টার কথার ভিত্তি আছে বলে যদি মনে করে থাকে নির্বাচন কমিশন, তাহলে সংস্কারটা তো এমন হতে হবে যেন কেউ টাকা খেয়ে ভোট দিতে না আসতে পারে। নইলে একটি ভালো নির্বাচন তারা করবে কী করে?

এ সময়ে যিনি প্রথমবারের মতো ভোট দিতে যাবেন, তাঁকে ভোট দিতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য কী কী পদক্ষেপ নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন? তাঁকে সচেতন করার জন্য কী কী পরিকল্পনা রয়েছে তাদের? তফসিল ঘোষণার পর কত দিনের মধ্যে কমিশন নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হতে পারবে? নির্বাচনী প্রশাসন যেন দলীয়করণ না হয়, তা নিশ্চিত করবে কীভাবে? এ রকম বহু প্রশ্ন আছে, যার উত্তর খুঁজতে হবে। যেহেতু বহুদিন পর একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের অঙ্গীকার করা হচ্ছে, সেহেতু পান থেকে চুন খসলেই সবকিছু বরবাদ হয়ে যেতে পারে—এ কথা প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মনে রাখা উচিত।

৫. নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের ব্যাপারে কঠোর না হলে সামনে আরও বিপদ আছে। নতুন বাংলাদেশের যে স্বপ্ন দেখেছিল দেশের জনগণ, সেই স্বপ্নের কতটা এখনো হৃদয়ে জাগরূক আছে আর কতটা হতাশা এসে গিলে খেয়েছে, তা নিয়েও জনগণের মনে প্রশ্ন আছে। আন্দোলনে অংশ নেওয়া তরুণদের থোড়াই কেয়ার করে তরুণ প্রজন্মের কেউ কেউ হঠাৎ করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে, এমন ফিসফিস আলোচনাও শোনা যায় চায়ের দোকানের আড্ডায়। মানুষ সহজেই ভুলতে চায়। নতুন কিছু নিয়ে মেতে থাকতে চায়। কিন্তু নতুন কিছু গড়ে ওঠার অঙ্গীকারের মধ্যে ফাঁকি দেখলে মানুষ হতাশ হয়। সেই হতাশা মনে বেদনার জন্ম দেয়। সেই বেদনায় মানুষের মনের আশা ভঙ্গ হয়। আর আশা ভঙ্গ হলে মানুষ তা থেকে মুক্তি খোঁজে। বুদ্ধিমান নেতা মানুষের সেই মানসিক অবস্থাকে আমলে নেন। তিনি মানুষের ভাবনাকে সম্মান করেন। আর যদি তিনি তা না করেন, তবে তিনি পরিণত হন স্বৈরাচারে। জনগণ তখন সেই নেতার বিবেচ্য বিষয় আর থাকে না।

আমরা আসলে আত্মজিজ্ঞাসার যে ক্রসরোডে এসে দাঁড়িয়েছি, তাতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় ভুল করার আর সুযোগ নেই। দেশের দলমত-নির্বিশেষে তরুণেরা আশার বাণী শোনাতে পারবে কি না, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। দলবাজ তরুণ নয়, মুক্তির দিশা রচনাকারী তরুণদের দিকেই তাকিয়ে আছি আমরা।

লেখক:– উপসম্পাদক আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‘চিটাংঅর মইদ্যে সরোয়াইজ্জা মরিব’— ফোনে চট্টগ্রামের শীর্ষ সন্ত্রাসী ছোট সাজ্জাদের চেলা রায়হানের হুমকি

সরকারি ছুটি ২৮ দিন, ১১ দিনই শুক্র-শনিবার

বিএনপি মহাসচিবকে ফোন করে বলেছিলাম, আমরা একটু আলোচনায় বসি: জামায়াত নেতা তাহের

জাহানারার যৌন নিপীড়নের অভিযোগ খতিয়ে দেখবে বিসিবি

ছোট ভাইয়ের সঙ্গে মারামারি করতে বড় ভাইয়ের মাইকিং, স্থান পানের বরজ

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

সুদান ক্ষমতার দ্বন্দ্বের এক নিষ্ঠুর অধ্যায়

আব্দুর রহমান 
আপডেট : ০৬ নভেম্বর ২০২৫, ০৯: ২৭
রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ সুদানে মানবিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক সংকট তৈরি করেছে। ছবি: সংগৃহীত
রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ সুদানে মানবিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক সংকট তৈরি করেছে। ছবি: সংগৃহীত

সুদান আফ্রিকার আলোচিত একটি দেশ। ২০১১ সালে একদফা ভাঙনের পর আবারও দেশটি সেই শঙ্কায় পড়েছে। ২০২৩ সাল থেকে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লড়াইরত আছে সুদানিজ আর্মড ফোর্সেস (এসএফ) বা সেনাবাহিনী এবং আধা সামরিক বাহিনী র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)। এই রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ মানবিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক সংকট তৈরি করেছে সুদানে।

দারফুরের সোনার জন্য লড়াই-ই এই গৃহযুদ্ধের অন্যতম কারণ। তবে এই সংকট বোঝার জন্য একটু অতীতে ফিরে যাওয়া জরুরি। আরএসএফের যাত্রা শুরু ২০০৩ সালে, দারফুর যুদ্ধের সময়। তখন তাদের নাম ছিল ‘জানজাওয়িদ’। তারা ছিল এক যাযাবর সশস্ত্র দল। সে সময় তারা প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরের পক্ষে লড়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তারা স্থানীয় জাতিগোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে জাতিগত নিধনযজ্ঞ চালিয়েছিল। এতে ১ লাখ থেকে ৩ লাখ মানুষ নিহত হয় এবং ২৫ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়।

২০১৩ সালে আল-বশির জানজাওয়িদ বাহিনীকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস’ নামে প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১৭ সালে আইন করে এই বাহিনীকে স্বাধীন নিরাপত্তা সংস্থার মর্যাদা দেওয়া হয়। ২০১৯ সালে আরএসএফ গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেয় এবং ওমর আল- বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সহায়তা করে। পরে ২০২১ সালে সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলে তারা বেসামরিক প্রধানমন্ত্রী আবদাল্লাহ হামদককে উৎখাত করে। এতে দেশটির বেসামরিক-সামরিক যৌথ শাসনব্যবস্থা শেষ হয়ে যায়।

এরপর ক্রমেই আরএসএফ নেতা হেমেদতি ও সেনাপ্রধান আল-বুরহানের মধ্যে মতবিরোধ বাড়তে থাকে দেশটির শাসনব্যবস্থায় অংশীদারত্বকে কেন্দ্র করে। মূল প্রশ্ন ছিল, আরএসএফ কবে সেনাবাহিনীর সঙ্গে একীভূত হবে এবং কে দেশের নেতৃত্ব দেবে। ২০২৩ সালের ১৫ এপ্রিল এই বিরোধ পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নেয়। সেনাবাহিনী চায়, আরএসএফ পুরোপুরি তাদের অধীনে আসুক। কিন্তু আরএসএফ স্বাধীন থাকতে চায়। দুই পক্ষের এই টানাপোড়েনই শেষ পর্যন্ত গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়।

এই গৃহযুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক দিক থেকে সুদানের অবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। দেশটির অর্থনীতির মূল ভরকেন্দ্র কৃষি প্রায় ধ্বংসের মুখে। ২০২৩ সালে শস্য উৎপাদন প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। কৃষি ও শিল্প উৎপাদন কমে যাওয়ায় খাদ্যসংকট বেড়েছে, আমদানিনির্ভরতা বাড়ছে এবং মুদ্রাস্ফীতি আকাশছোঁয়া পর্যায়ে পৌঁছেছে। সামগ্রিকভাবে দেশটির অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছে ৩০-৪০ শতাংশ। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। রাজস্ব কমে যাওয়ায় প্রশাসনিক কার্যক্রমও ভেঙে পড়েছে। একসময় তেলের আয় ও কৃষির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা অর্থনীতি এখন মূলত সোনা রপ্তানির মতো একক খাতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, যা দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা আরও অনিশ্চিত করে তুলছে। এই সোনার বেশির ভাগই আবার উত্তোলন করা দারফুর অঞ্চলে, যা আবার আরএসএফের নিয়ন্ত্রণে।

সুদান দীর্ঘদিন ধরে সামরিক প্রভাবাধীন হয়ে আছে। ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরের পতনের পর দেশটিতে বেসামরিক শাসনব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হওয়ার আশা দেখা গেলেও তা দ্রুতই ভেস্তে যায়। ক্ষমতার ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে সেনাবাহিনী ও আরএসএফের দ্বন্দ্বই আজকের এই বিপর্যয়ের কারণ। দুই পক্ষই দেশের সম্পদ, অস্ত্র এবং রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নিজেদের দখলে রাখতে চায়।

এই সংঘাতের কারণে দেশটির শাসনকাঠামো কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছে। প্রশাসন ভেঙে পড়েছে, বিচারব্যবস্থা পঙ্গু এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। গণহত্যা, নারী নির্যাতন, শিশু সৈনিক নিয়োগের মতো ঘটনাগুলো এখন নিয়মিত ঘটনা। স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আরএসএফ দারফুরের এল-ফাশেরে যে ‘গণহত্যা’ চালিয়েছে, তার প্রমাণ লোপাটে তারা গণকবর খুঁড়ছে।

দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলা গৃহযুদ্ধে সুদানের ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, যার অর্ধেকের বেশি নারী। বিভিন্ন প্রতিবেদন মতে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের মে মাসের মধ্যে সুদানে ২ কোটি ৪০ লাখের বেশি মানুষ তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার শিকার হয়েছে।

সুদানের এই সংকট কেবল অভ্যন্তরীণ নয়, দেশটি এখন আন্তর্জাতিক স্বার্থের সংঘাতের এক রক্তাক্ত রণক্ষেত্র। লোহিতসাগরের তীরে অবস্থিত হওয়ায় দেশটি আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যের অন্যতম মূল কেন্দ্র। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো উপসাগরীয় দেশগুলো এখানে নিজেদের প্রভাব বিস্তারে সক্রিয় আছে। প্রমাণ আছে, আরব আমিরাত বিদ্রোহী আরএসএফকে গোপনে সমর্থন দিচ্ছে। অপর দিকে মিসর, তুরস্ক, ইরান ও রাশিয়া সেনাবাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখছে। ফলে সুদান এখন একধরনের প্রক্সি যুদ্ধের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে, যেখানে দেশীয় সংঘাতকে উসকে দিচ্ছে বিদেশি স্বার্থ।

এই বহিরাগত প্রভাব শুধু রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং আফ্রিকার অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতিতেও এর প্রতিক্রিয়া পড়ছে। লাখ লাখ সুদানি শরণার্থী পার্শ্ববর্তী দেশ চাদ, দক্ষিণ সুদান, ইথিওপিয়া ও মিসরে আশ্রয় নিয়েছে। এতে সীমান্ত উত্তেজনা বাড়ছে এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা আরও নড়বড়ে হচ্ছে।

সুদানের সংকট তাই কেবল একটি দেশের সমস্যা নয়, এটি গোটা আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে। বিশ্ববাজারেও এর প্রভাব পড়ছে। কারণ, সুদান সোনা ও কৃষিপণ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। যুদ্ধের কারণে উৎপাদন ও রপ্তানি বন্ধ থাকায় আন্তর্জাতিক বাজারেও অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে।

সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্র ও আফ্রিকান ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় বহুবার আলোচনার চেষ্টা হয়েছে এই সংঘাত নিরসনে। কিন্তু কোনো ফল মেলেনি। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, মিসর ও সংযুক্ত আরব আমিরাত মিলে ‘কোয়াড’ জোট গঠন করেছে। তারা ১২ সেপ্টেম্বর যুদ্ধবিরতির পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে।

পরিকল্পনায় বলা হয়েছিল, তিন মাসের মানবিক বিরতি দেওয়া হবে, যাতে ত্রাণ সহায়তা প্রবেশ করতে পারে। এরপর স্থায়ী যুদ্ধবিরতি এবং ৯ মাসের মধ্যে বেসামরিক সরকারে ফেরার প্রক্রিয়া শুরু হবে। প্রথমে সেনাপ্রধান আল-বুরহান এই পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি চান, আরএসএফ ভেঙে দেওয়া হোক। কিন্তু ১৫ অক্টোবর মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির সঙ্গে বৈঠকের পর তিনি কিছুটা নমনীয় হন।

কিছুদিন আগে ওয়াশিংটনে দুই পক্ষের মধ্যে পরোক্ষ আলোচনা হয়। অক্টোবরের শেষে আরও বৈঠকের কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই আরএসএফ এল-ফাশের দখল করে নেয়। এখন আলোচনা কোন পথে যাবে, তা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ফলে এই অবস্থায় আশঙ্কা বাড়ছে, যেহেতু দারফুর অঞ্চল প্রায় পুরোটাই আরএসএফের হাতে চলে গেছে, তাহলে কি সুদান আরও একবার ভাঙতে চলেছে?

সবশেষে বলা যায়, সুদান এখন এক গভীর বিভাজনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতি ধ্বংসস্তূপে পরিণত, রাজনীতি অস্ত্রনির্ভর, আর ভূরাজনৈতিক কারণে দেশটি পরিণত হয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলোর খেলাঘরে। এই অবস্থায় সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশটির সাধারণ মানুষ—যারা না সেনাবাহিনীর পক্ষে আর না আরএসএফের পক্ষে, বরং তারা কেবলই বেঁচে থাকার লড়াই করছে।

এই সংকট যদি দ্রুত সমাধানের পথে না যায়, তবে শুধু সুদান নয়; সমগ্র পূর্ব আফ্রিকা ও লোহিতসাগর উপকূলীয় অঞ্চলের স্থিতিশীলতাই ভেঙে পড়বে। তাই এখন প্রয়োজন কূটনৈতিক চাপ, মানবিক সহায়তা এবং একটি বাস্তবসম্মত রাজনৈতিক সমাধানের দিকে এগিয়ে যাওয়া। অন্যথায় সুদান আরও একবার ইতিহাসের সেই নিষ্ঠুর অধ্যায়ে ঢুকে পড়বে, যেখান থেকে সাধারণত আর ফেরার পথ থাকবে না।

লেখক: সাংবাদিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‘চিটাংঅর মইদ্যে সরোয়াইজ্জা মরিব’— ফোনে চট্টগ্রামের শীর্ষ সন্ত্রাসী ছোট সাজ্জাদের চেলা রায়হানের হুমকি

সরকারি ছুটি ২৮ দিন, ১১ দিনই শুক্র-শনিবার

বিএনপি মহাসচিবকে ফোন করে বলেছিলাম, আমরা একটু আলোচনায় বসি: জামায়াত নেতা তাহের

জাহানারার যৌন নিপীড়নের অভিযোগ খতিয়ে দেখবে বিসিবি

ছোট ভাইয়ের সঙ্গে মারামারি করতে বড় ভাইয়ের মাইকিং, স্থান পানের বরজ

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

বিরল খনিজ নিয়ে কেন এত টানাটানি

রাজিউল হাসান
বিরল খনিজের সরবরাহ বিপর্যস্ত হয়ে পড়লে প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা হয়তো থেমে যাবে। ছবি: সংগৃহীত
বিরল খনিজের সরবরাহ বিপর্যস্ত হয়ে পড়লে প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা হয়তো থেমে যাবে। ছবি: সংগৃহীত

এই পৃথিবীর সবকিছু মূল্যবান। প্রতিটা প্রাণ, প্রতিটা উদ্ভিদ, প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে থাকা প্রতিটা উপাদান—সবই অমূল্য। তবে কিছু বিষয় রয়েছে, যেগুলোর জন্য টানাটানিতে জীবন-সম্পদ-পরিবেশ বিপন্ন হয়ে ওঠে। কখনো কখনো যুদ্ধও লেগে যায়। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হতে পারে ‘কলা যুদ্ধ’। এই কলার সঙ্গে শিল্পকলার কোনো সম্পর্ক নেই। এই কলা গাছে ধরে, আয়রনসমৃদ্ধ একটি ফল।

কলা নিয়ে সেই যুদ্ধ চলেছে ৩৫ বছর, ১৮৯৮ সালের ১৩ আগস্ট থেকে ১৯৩৪ সালের ১ আগস্ট পর্যন্ত। অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় মধ্য আমেরিকা এবং ক্যারিবীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র দফায় দফায় যে সামরিক হস্তক্ষেপ করেছিল, সেটিই কলা যুদ্ধ নামে পরিচিতি পায় পরবর্তী সময়ে। পৃথিবীর ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, এমন অনেক বিষয় নিয়ে মানুষ সংঘাতে জড়িয়েছে। তবে এবার যুক্তরাষ্ট্র ও চীন যে বাণিজ্য যুদ্ধে নেমেছিল, তা মোটেই কোনো তুচ্ছ বিষয় নিয়ে নয়। এবারের দ্বন্দ্ব বিরল খনিজ নিয়ে। এই খনিজ উপাদানগুলোর একচ্ছত্র মালিক হলো (বলা চলে) চীন।

বিরল খনিজ নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণ অনুসন্ধানের আগে জেনে নেওয়া যাক, জিনিসটা আসলে কী। আর সে জন্য আমাদের কিছুটা রসায়ন শাস্ত্রের পাঠ নিতে হবে। বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত ১১৮টি মৌলিক পদার্থের সন্ধান পেয়েছেন। এগুলোর মধ্যে ৯৪টি প্রকৃতিতে নানাভাবে, নানা রূপে পাওয়া যায়। বাকি ২৪টি গবেষণাগারে উদ্ভাবন করেছেন বিজ্ঞানীরা। রসায়ন শাস্ত্রের পর্যায় সারণিতে এই ১১৮টি মৌলিক পদার্থকে তাদের বৈশিষ্ট্য অনুসারে তালিকাবদ্ধ করা হয়েছে। এসব মৌলের কোনোটা কঠিন, কোনোটা তরল, আবার কোনোটা গ্যাস। কোনো কোনো মৌলিক পদার্থ আবার তেজস্ক্রিয়ও। এগুলোর মধ্যে ১৭টি মৌলিক পদার্থ রয়েছে, যাদের বৈশিষ্ট্য প্রায় একই রকম এবং প্রকৃতিতে অন্য মৌলিক পদার্থের সঙ্গে এমনভাবে মিশে থাকে, যে কারণে তাদের আলাদা করা কঠিন। এগুলোকে একসঙ্গে ল্যান্থেনাইড সিরিজ বলা হয়। এই মৌলগুলো হলো ল্যানথেনিয়াম, সিরিয়াম, নিওডিমিয়াম, প্রমিথিয়াম, সামারিয়াম, ইউরোপিয়াম, গাডোলিনিয়াম, টারবিয়াম, ডিসপ্রোসিয়াস, হোলমিয়াম, এরবিয়াম, থুলিয়াম, ইটারবিয়াম, প্রাসিওডিমিয়াম এবং লুটেটিয়াম। এগুলোই বিরল খনিজ নামে পরিচিত। এ ছাড়া স্ক্যানডিয়াম ও ইট্রিয়ামও বিরল খনিজের অন্তর্ভুক্ত।

এখন জানা যাক এই মৌলগুলোকে কেন বিরল খনিজ বলা হয়, সেই প্রশ্নে। এই মৌলিক পদার্থগুলো আবার খনিজ। অর্থাৎ খনি থেকে তোলা যায়। তবে সোনা, রুপার মতো এগুলো পুঞ্জীভূত অবস্থায় খনিতে পাওয়া যায় না। বিরল খনিজগুলো অন্যান্য মৌলিক পদার্থের সঙ্গে মিশে থাকায় এগুলো উত্তোলন ও পরিশোধন অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ ও কষ্টসাধ্য। তাই এগুলোকে বিরল খনিজ বলা হয়। বিশ্বে বিরল খনিজের সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী চীন।

বিরল খনিজ আধুনিক প্রযুক্তির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে স্মার্টফোন, বিদ্যুচ্চালিত গাড়ি এবং প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম তৈরিতে এসব খনিজ খুবই জরুরি উপাদান। ইলেকট্রনিকস, পরিচ্ছন্ন জ্বালানি ও সামরিক সরঞ্জামের জন্য এসব মৌল দিয়ে শক্তিশালী চুম্বক, কাচসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তৈরি হয়। এসব কারণে বিরল খনিজের চাহিদা বিশ্বজুড়ে। তবে এই মৌলগুলোর ওপর সব সময় যুক্তরাষ্ট্রের নজর রয়েছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর ক্ষমতার প্রথম মেয়াদের শেষ দিকে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধে নেমেছিলেন। তবে তিনি সেবার তা চালিয়ে যেতে পারেননি। সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে হেরে তাঁকে যুদ্ধ শেষ না করেই হোয়াইট হাউস থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল। এবার নির্বাচনে জিতে দায়িত্ব নিয়েই আবার বাণিজ্যযুদ্ধে নেমেছেন। তবে শুধু চীনের সঙ্গে নয়, শত্রু-মিত্র সবার সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করেছেন। পাল্টা শুল্ক চাপিয়ে সবাইকে বশে আনার চেষ্টা করছেন ট্রাম্প। বশে এসেছেও অনেকে। কিন্তু চীন সে পথের পথিক নয়। তারা যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কের জবাবে উল্টো মার্কিন পণ্যে শুল্ক বাড়িয়েছে। শুধু তা-ই নয়, বিরল খনিজ রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। আর এতেই পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠেছিল। প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদনকারী দেশগুলোর কপালে পড়েছিল দুশ্চিন্তার ভাঁজ। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোই প্রমাদ গুনেছিল। আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল, বিরল খনিজের সরবরাহ যদি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, তাহলে প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা থেমে যাবে। বিশেষ করে প্রযুক্তিপণ্য উদ্ভাবন এবং এই পণ্যের বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যে ভাটা পড়ার শঙ্কায় পড়েছিলেন মার্কিন ব্যবসায়ী এবং উদ্যোক্তারা।

তবে শেষ পর্যন্ত সেই শঙ্কা কিছুটা হলেও কেটেছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় এপেক সম্মেলনের ফাঁকে সম্প্রতি বৈঠক করেছেন ট্রাম্প ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। তাঁদের এই বৈঠকের পর যদিও দুজন একসঙ্গে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হননি, তবে আশার কথা শুনিয়েছে দুই পক্ষই। বৈঠকের পর ট্রাম্প সোজা গিয়ে ওঠেন এয়ারফোর্স ওয়ানে। সেখানে সাংবাদিকদের তিনি যা বলেছেন, তাতে বাণিজ্য যুদ্ধ কিছুদিনের জন্য হলেও স্তিমিত হবে বলে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। ওদিকে বৈঠকের পর সি চিন পিং গিয়ে ওঠেন তাঁর লিমোজিনে। এর কিছু সময় পর চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ঘোষণা দেয়, তারা আগামী এক বছরের জন্য বিরল খনিজ রপ্তানিতে আরোপিত নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত স্থগিত করেছে।

চীনের এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আপাতত বিরল খনিজের সরবরাহ নিয়ে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল, তা কেটেছে; তবে শঙ্কা কাটেনি। কারণ, অতীত অভিজ্ঞতা বলে, ট্রাম্পের সঙ্গে নানা ইস্যুতে চীনের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। কখনো কখনো সেই ইস্যুর জন্য বড় কোনো কারণও লাগে না। এর আগে প্রথম মেয়াদে ট্রাম্প চীনের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে প্রথম বাগ্‌যুদ্ধে জড়িয়েছিলেন কোভিড-১৯ মহামারি নিয়ে। মহামারির কবলে পড়ে যখন মানুষের প্রাণ ঝরছিল, তখন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে তর্ক শুরু হয়েছিল এই ভাইরাস কোত্থেকে ছড়িয়েছে, তা নিয়ে। ট্রাম্পের অভিযোগ ছিল, চীন থেকে ভাইরাসটি ছড়িয়েছে। কিন্তু চীন সেই অভিযোগ মেনে নিতে নারাজ ছিল। তারপর সেই বাগ্‌যুদ্ধ চলতে চলতেই কখন কীভাবে যেন দুই পক্ষ বাণিজ্য যুদ্ধে জড়িয়ে গিয়েছিল। অথচ যে কোভিড নিয়ে কথার এত ‘মারামারি’, তার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কিন্তু ট্রাম্পের ততটা ‘মাথাব্যথা’ ছিল না। করোনায় তখন যুক্তরাষ্ট্রেই মানুষ আক্রান্ত হচ্ছিল বেশি, মারাও যাচ্ছিল বেশি। ট্রাম্পের মাথাব্যথা ছিল তখন করোনা ছড়ালো কোত্থেকে, তা নিয়ে। এ কারণেই লেখাটির শুরুতে ‘কলা যুদ্ধের’ অবতারণা করেছি। কারণ, আপাতদৃষ্টে কলা যুদ্ধও ছিল ‘তুচ্ছ’ বিষয় নিয়ে। যদিও এই যুদ্ধের পেছনের কারণ জানার চেষ্টা করলে ধারণা পাল্টে যাবে। তখন আর তাকে তুচ্ছ মনে হবে না।

সে যা-ই হোক, দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে যে কেবল দ্বন্দ্বেই জড়িয়েছেন, তা কিন্তু নয়। তাঁর দাবি অনুযায়ী কমপক্ষে সাতটি সম্ভাব্য যুদ্ধ হয় শুরুর আগেই থামিয়েছেন তিনি, না হয় আটকিয়েছেন। গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে যে ব্যাপক প্রাণহানি ও ধ্বংসযজ্ঞ চলছিল, তার আপাত-অবসানের পেছনেও ট্রাম্পের বড় ভূমিকা রয়েছে। কাজেই আমরা প্রত্যাশা করতেই পারি, বিরল খনিজ নিয়ে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটেছিল, তা আর জটিল হবে না। কারণ, বিশ্বের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের জন্য এই মৌলগুলো জরুরি।

লেখক: সাংবাদিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‘চিটাংঅর মইদ্যে সরোয়াইজ্জা মরিব’— ফোনে চট্টগ্রামের শীর্ষ সন্ত্রাসী ছোট সাজ্জাদের চেলা রায়হানের হুমকি

সরকারি ছুটি ২৮ দিন, ১১ দিনই শুক্র-শনিবার

বিএনপি মহাসচিবকে ফোন করে বলেছিলাম, আমরা একটু আলোচনায় বসি: জামায়াত নেতা তাহের

জাহানারার যৌন নিপীড়নের অভিযোগ খতিয়ে দেখবে বিসিবি

ছোট ভাইয়ের সঙ্গে মারামারি করতে বড় ভাইয়ের মাইকিং, স্থান পানের বরজ

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

প্রধান শিক্ষকের ফাঁকিবাজি

সম্পাদকীয়
প্রধান শিক্ষকের ফাঁকিবাজি

একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান দীর্ঘ সময় ধরে উপস্থিত না থাকলে, সেখানে পাঠদান ব্যাহতসহ বিভিন্ন সমস্যা তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। ফাঁকিবাজির জন্য যদিও তেমন কোনো অজুহাতের দরকার হয় না।

তবে ফাঁকিবাজির অভিযোগ উঠেছে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার চান্দেরকান্দি ইউনিয়নের বাহেরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে। তাঁর নাম তাহমিনা সরকার। তিনি এই বিদ্যালয়ে প্রায় দেড় বছর ধরে অনুপস্থিত। কিন্তু প্রতি মাসে বেতন ঠিকই তুলে নিচ্ছেন। কেন তিনি এত দিন ধরে বিদ্যালয়ে আসছেন না এবং কেন তাঁর বিরুদ্ধে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি উপজেলা শিক্ষা কার্যালয় থেকে, সেই প্রশ্নেরও উত্তর নেই।

২০২৩ সালে এই বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ বিরোধের জেরে কয়েক দফায় অগ্নিসংযোগ ও নলকূপের পানিতে বিষ মেশানো হয়। সে বছরের ২ সেপ্টেম্বর রাতে বিদ্যালয়ের অফিসকক্ষে দুর্বৃত্তরা আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে প্রধান শিক্ষক মামলা করলে অফিস সহকারী কাম নৈশপ্রহরী মামুনসহ স্থানীয় তিনজন জেলে যান। এ ঘটনার পর থেকে তিনি নানা অজুহাত দেখিয়ে বিদ্যালয়ে আসা বন্ধ করে দেন। কিন্তু নিয়মিত উপজেলা শিক্ষা কার্যালয়ে তিনি ঠিকই যান।

কী নিয়ে বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ বিরোধটি হয়েছিল, তা জানা যায়নি। একই সঙ্গে জানা যায়নি, কারা কী কারণে অগ্নিসংযোগ করেছিল এবং নলকূপে বিষ দিয়েছিল। যেকোনো সময় নানা ধরনের সমস্যা তৈরি হতে পারে, কিন্তু তা সমাধান না করে এভাবে বিদ্যালয়ের একজন প্রধান শিক্ষক কীভাবে দিনের পর দিন অনুপস্থিত থাকতে পারেন? বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ বিরোধ বা সেই ব্যক্তিগত সমস্যার অজুহাতে তিনি তাঁর দায়িত্বে অবহেলা করতে পারেন না।

প্রধান শিক্ষকের ওই বিদ্যালয়ে যেতে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে তিনি তাঁর সুবিধামতো জায়গায় বদলি হতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটা করেননি বলে জানা যায়। এখানে অভিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে সঙ্গে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যে গাফিলতি আছে, তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। প্রধান শিক্ষকের খুঁটির জোর যদি শক্ত না হয়, তাহলে তিনি এভাবে দায়িত্বে অবহেলা করতে পারতেন না। তাঁর খুঁটির জোর কোথায়, সেটাও অনুসন্ধান করা দরকার।

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রক্সি শিক্ষক দিয়ে দায়িত্ব পালন করার অভিযোগও রয়েছে। কোনো কোনো শিক্ষক অন্য কাউকে দিয়ে অর্থের বিনিময়ে তাঁর দায়িত্ব পালন করিয়ে নেন। কিন্তু তিনি তাঁর সুবিধাজনক জায়গায় অবস্থান করেও চাকরিতে বহাল তবিয়তে থাকেন। এই অপকর্ম করতে গিয়ে তাঁরা প্রচলিত আইন অমান্য করেন। তবে ভয়াবহ ব্যাপার হলো, তাঁদের কাছ থেকে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা নৈতিকতার ভালো দীক্ষা কীভাবে নেবে। এ ছাড়া ফাঁকিবাজেরা ভালো শিক্ষক কখনো হতে পারেন না।

আমাদের সমাজদেহের সর্বত্র যেভাবে পচন ধরেছে, সেখান থেকে বের হওয়ার জন্য শিক্ষকদের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু শিক্ষকেরাই যদি এ ধরনের অনৈতিক কাজ করেন, তাহলে আমরা আর যাব কোথায়?

এখন সেই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার জন্য আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা খুব জরুরি। আর তা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার ওপরই একান্তভাবে বর্তায়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‘চিটাংঅর মইদ্যে সরোয়াইজ্জা মরিব’— ফোনে চট্টগ্রামের শীর্ষ সন্ত্রাসী ছোট সাজ্জাদের চেলা রায়হানের হুমকি

সরকারি ছুটি ২৮ দিন, ১১ দিনই শুক্র-শনিবার

বিএনপি মহাসচিবকে ফোন করে বলেছিলাম, আমরা একটু আলোচনায় বসি: জামায়াত নেতা তাহের

জাহানারার যৌন নিপীড়নের অভিযোগ খতিয়ে দেখবে বিসিবি

ছোট ভাইয়ের সঙ্গে মারামারি করতে বড় ভাইয়ের মাইকিং, স্থান পানের বরজ

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

অবিভক্ত বঙ্গের নেতৃত্ব বাঙালির ছিল না

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
অবিভক্ত বঙ্গের নেতৃত্ব বাঙালির ছিল না

গত এক শতাব্দীতে বাঙালির জন্য রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কম কিছু ঘটেনি। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটছে ১৯৪৭ সালে, বঙ্গভঙ্গের সময়। দেশভাগের চেষ্টা আগেও একবার হয়েছিল, ১৯০৫ সালে; তখন তা কার্যকর হয়নি। ৪২ বছর পরে আবার চেষ্টা হলো, এবার তা সফল হলো। সাতচল্লিশে ভঙ্গ হলো বঙ্গ।

সেটা যেন শুধু মাটির বিভাজন নয়, মানুষেরও বিভাজন হলো প্রথম। এই বিভাজন একদা অখণ্ড বঙ্গদেশের একাংশকে যুক্ত করে দিল ভারতের সঙ্গে। সেখানকার বাঙালির রাজনৈতিক পরিচয় দাঁড়াল ভারতীয় বলে; আরেক অংশকে শামিল করে দিল পাকিস্তানের সঙ্গে, সেখানকার বাঙালির পরিচয় দাঁড়াল পাকিস্তানি বলে। এপারের মানুষ ওপারে গেছে, ওপারের মানুষ এসেছে এপারে, মানুষের রক্তে রঙিন হয়েছে বিভক্ত মাটি ও নদী। দুই রাষ্ট্র—ভারত ও পাকিস্তান। দেশ দুটি মিত্র হলো না পরস্পরের এবং সেই বৈরিতা ছড়িয়ে পড়ল দুই পাশের বাঙালির মনেও। ভারতের অংশ হয়ে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি যতটা না অসন্তুষ্ট হয়েছে, পাকিস্তানে বিলীন হওয়ার আশঙ্কায় পূর্ববঙ্গের বাঙালি অসন্তুষ্ট হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি। ফলে সে আরও এক বিভাজন ঘটিয়েছে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ত্যাগ-আত্মত্যাগে, রক্তের বিনিময়ে।

স্বাধীন বাংলাদেশের ভৌগোলিক কাঠামো আসলে সাতচল্লিশেই তৈরি হয়ে গেছে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাকে ইদানীং বেশি করে ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদী এবং আধা মৌলবাদীরা তথাকথিত লাহোর প্রস্তাবের বাস্তবায়ন বলতে পছন্দ করে। কথাটা মিথ্যা, আদতেই।

কেননা, লাহোর প্রস্তাব ছিল অস্পষ্ট, হয়তো তাকে ইচ্ছা করেই অস্পষ্ট করে রাখা হয়েছিল। তাতে পাকিস্তানের কিংবা ভারত বিভাজনের কথা স্পষ্ট করে উল্লেখ পর্যন্ত করা হয়নি এবং দুই অঞ্চলে দুটি ‘স্বাধীন’ রাষ্ট্রের কথা বলা হলেও পরে দিল্লি সম্মেলনে প্রস্তাবটি সংশোধন করে একটা রাষ্ট্রের পক্ষেই বক্তব্য দাঁড় করানো হয়েছিল। কিন্তু একাত্তরে একটা পাকিস্তান ভেঙে দুটি পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা ঘটেনি। বাংলাদেশ একটা স্বাধীন, ধর্মনিরপেক্ষ ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা নিয়ে রক্তের মধ্য দিয়ে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এবং সেটা করেছে দ্বিজাতিতত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান করে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে।

আমরা বলি এবং মিথ্যা বলি না যে বঙ্গবিভাগের পেছনে ইংরেজদের কারসাজি ছিল। যেমন সেটা ১৯০৫ সালে, তেমনি ১৯৪৭ সালেও বোঝা গেছে। সে সময়ের ব্রিটিশ হোম সেক্রেটারি তাঁর নোটে লিখেছিলেন, ‘ঐক্যবদ্ধ বঙ্গ একটা শক্তি, বিভক্ত বঙ্গ নানা দিকে টানবে এবং সেটাই হবে ওই পরিকল্পনার (বঙ্গবিভাগের) একটা বড় গুণ।’ এ ছিল ইংরেজের অভিপ্রায়, কিন্তু বঙ্গদেশের নিজের মধ্যেও নিশ্চয় সেই উপাদানগুলো বিদ্যমান ছিল, যাদের অস্তিত্ব ওই আশাবাদকে সমর্থন করেছে। নানা দিকে টানাপোড়েন ছিল। আর তার কারণ অন্য কিছু নয়—মধ্যবিত্ত শ্রেণি। মধ্যবিত্ত সর্বত্রই একটা অগোছালো ব্যাপার। তার একেক অংশে একেক প্রবণতা, তার একদিকের সঙ্গে অপর দিকের বিরোধ; পরাধীন বাংলায় পরাধীনতার কারণেই পরস্পর বিরোধিতাটা ছিল বরং বেশি। এই মধ্যবিত্ত মোটেই স্বাধীন ছিল না। তার ভিত প্রোথিত ছিল চাকরিতে, পেশায় এবং কিছুটা ভূমিরাজস্বে। শিল্প ও বাণিজ্যের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্কই ছিল না। দুর্বল মেরুদণ্ডের এই শ্রেণির একাংশ তাই আত্মসমর্পণ করেছিল। আত্মসমর্পণকারীরা আবার দুই ভাগে বিভক্ত, এক ভাগ সাহেবমুখী; অপর ভাগ ইয়ং বেঙ্গল। অর্থাৎ একই সঙ্গে সাহেবমুখী ও সামন্তবাদবিরোধী। আর যে অংশটি ছিল সর্বাধিক প্রভাবশালী, সেটা ছিল অধীনতার বিষয়ে সচেতন এবং তাদেরকে জাতীয়তাবাদীও বলতে হবে। কিন্তু এরা মূলত সংস্কারপন্থী এবং চূড়ান্ত বিচারে, নিজেদের শ্রেণিগত স্বার্থের জন্য আপসপন্থী ছিল। এর সূত্রপাতে আছেন রামমোহন এবং মাঝখানে বঙ্কিমচন্দ্র।

বঙ্কিমচন্দ্রের নাম বিশেষভাবে করতে হয়, কেননা তিনি ছিলেন মধ্যবিত্তের এই ধারার সবচেয়ে উজ্জ্বল ও প্রভাবশালী মুখপাত্র। বঙ্কিম ছিলেন অত্যন্ত আধুনিক এবং পরাধীনতার গ্লানিতে অত্যধিক পীড়িত। কিন্তু শ্রেণিগত কারণেই তিনিও আটকা পড়ে গেলেন একটা গণ্ডিতে। তিনি বলেছেন, ‘আমরা সামাজিক বিপ্লবের অনুমোদক নহি’। তাঁর এই বক্তব্য ছিল বড় স্পষ্ট। এই অনুমোদন ছিল না বলেই বঙ্কিমচন্দ্র চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের হৃদয়হীনতার কথা জেনেও তার পুরোপুরি উচ্ছেদ চাননি। ইংরেজ অসন্তুষ্ট হবে ভেবে, স্বাধীনতার জন্য প্রবল আকাঙ্ক্ষা সত্ত্বেও প্রকাশ্যে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লিখতে পারেননি। ইংরেজের বদলে তিনি যবনকে দাঁড় করালেন এবং সেই মৃত অশ্বকে যখন প্রহার শুরু করলেন, তখন সেই প্রহারের ভেতরে ইংরেজের প্রতি অক্ষম অসন্তোষ ছিল ঠিকই, কিন্তু তা প্রকাশ পেল না। বিকাশে আগ্রহী মুসলমান বাঙালি মনে করল এ আর এমন কিছু নয়, তার প্রতি ঘৃণা বটে।

এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, বাংলায় সাম্প্রদায়িকতা কৃষকদের মধ্যে ছিল না, তা ছিল মধ্যবিত্তেরই ব্যাধি। তবে পরাধীন বঙ্গে জাতীয়তাবাদীরা আন্তরিক ছিলেন। কিন্তু জাতীয় ছিলেন না, তাঁরা সাম্প্রদায়িক হয়ে পড়েছিলেন। তাদের কাছে জাতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল এক অংশের জন্য হিন্দু জাতি, আরেক অংশের জন্য মুসলিম জাতি। তাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। তবে সেটা ছিল জনগণের সঙ্গে নয়। তা ছিল দুটি মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে—যাদের একটা উঠেছে, আরেকটা উঠতে চাইছে।

একটা দ্বন্দ্ব ছিল ইংরেজের সঙ্গে বাঙালির; আরেকটা দ্বন্দ্ব গড়ে উঠেছিল বাঙালি হিন্দুর সঙ্গে বাঙালি মুসলমানের। প্রথম দ্বন্দ্বটা তার তীব্রতা অক্ষুণ্ন রাখতে পারেনি দ্বিতীয় দ্বন্দ্বের কারণে। আর হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব ছিল বলেই দেশভাগ হলো। না হলে বাইরে থেকে চতুর ইংরেজ যতই কলকাঠি নাডুক না কেন, ঘটনাটি ঘটত না। ১৯০৫-এ কাজ হয়নি, তখন অগ্রসর হিন্দু মধ্যবিত্ত এটা চায়নি। তারা অখণ্ড বঙ্গ সংস্কৃতির ব্যবচ্ছেদের আশঙ্কা করেছে। সে আশঙ্কা মোটেই অন্যায় ছিল না। কিন্তু অন্তরে ছিল আরও এক গভীর শঙ্কা, সে হচ্ছে খণ্ডিত বঙ্গে পেশাগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও জমির মালিকানা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার শঙ্কা। ১৯৪৭ সালে সেই শ্রেণিই আবার বঙ্গভঙ্গে বিশ্বাসী হয়ে পড়ল, মূলত সেই অর্থনৈতিক শঙ্কাতেই। এবারের ভয়টা ছিল অবিভক্ত বঙ্গে মুসলিম সংখ্যাধিক্যের। অপর দিকে মুসলিম সম্প্রদায়ের যে অংশ উঠতে চাচ্ছিল, তারা ১৯০৫ সালেও বঙ্গভঙ্গ চেয়েছে, যেভাবে চেয়েছে সাতচল্লিশেও। সেটা ছিল নিজেদের শ্রেণিস্বার্থে।

ভারতের অন্তর্ভুক্ত বাঙালি তার সংস্কৃতির ওপর হিন্দির চাপ কম পোহায়নি। ওই চাপ, বলা বাহুল্য, ক্রমাগত বেড়েছে। কংগ্রেসের শাসন পশ্চিমবঙ্গের জন্য দুঃশাসনই ছিল। হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপির শাসনামল তো দুঃশাসনের সীমা-পরিসীমা অতিক্রম করে হিন্দু রাষ্ট্রের পথে এগোতে চাচ্ছে।

লক্ষ করার বিষয়, অবিভক্ত বঙ্গে নেতৃত্ব ছিল মধ্যবিত্তের হাতেই। কিন্তু বাঙালি মধ্যবিত্ত বাংলার রাজনীতিকে ভারতবর্ষের রাজনীতি থেকে আলাদা রাখতে পারেনি। একদিক দিয়ে প্রবেশ করেছেন গান্ধী, আরেক দিক দিয়ে জিন্নাহ। বাংলার রাজনীতি অংশ হয়ে গেছে সর্বভারতীয় রাজনীতির এবং তার চাবিকাঠি বাংলার এ কে ফজলুল হক কিংবা সুভাষচন্দ্র বসুর হাতে থাকেনি, থেকেছে অবাঙালিদের হাতেই। এর কারণও শ্রেণিগত। বাঙালি মধ্যবিত্ত অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ছিল, অবাঙালি মধ্যবিত্তের তুলনায়। শ্রেণি অবস্থান এসব ঘটনার সুন্দর ব্যাখ্যা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‘চিটাংঅর মইদ্যে সরোয়াইজ্জা মরিব’— ফোনে চট্টগ্রামের শীর্ষ সন্ত্রাসী ছোট সাজ্জাদের চেলা রায়হানের হুমকি

সরকারি ছুটি ২৮ দিন, ১১ দিনই শুক্র-শনিবার

বিএনপি মহাসচিবকে ফোন করে বলেছিলাম, আমরা একটু আলোচনায় বসি: জামায়াত নেতা তাহের

জাহানারার যৌন নিপীড়নের অভিযোগ খতিয়ে দেখবে বিসিবি

ছোট ভাইয়ের সঙ্গে মারামারি করতে বড় ভাইয়ের মাইকিং, স্থান পানের বরজ

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত