Ajker Patrika

সম্ভাবনার জটিল পথ

মামুনুর রশীদ
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

গত এক বছরে আমাদের জাতি এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক প্রজ্ঞা লাভ করেছে। জাতীয় গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ঘরের ভেতর থেকে চায়ের দোকান, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়—সর্বত্রই রাজনৈতিক আলোচনা, পর্যালোচনা এবং সেই সঙ্গে যাঁর যাঁর সুচিন্তিত মন্তব্যও দিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিদিনই সকাল-বিকেল কিছু না কিছু ঘটনা ঘটছে, সেসবের ওপরও তাৎক্ষণিক মন্তব্য হয়ে যাচ্ছে। এবারের উচ্চমাধ্যমিকের ফলেও তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরাও পড়াশোনায় তেমন মনোযোগী হতে পারছে না। সমগ্র আলোচনা ওই রাজনীতিতে। চায়ের কাপেই বড় বড় সিদ্ধান্ত হয়ে যাচ্ছে।

মধ্যবিত্তের বাজারঘাটে টান পড়লেও তা আলোচনায় খুব একটা জায়গা পাচ্ছে না। রাজনীতিই মুখ্য এবং মুখ্য আলোচনার বিষয়। একটা বিষয় অবশ্য দেখার আছে—ক্লান্তিহীন, আড্ডাবাজ বাঙালি যেকোনো বিষয়ের ওপর আলোচনা করতে এবং সিদ্ধান্ত দিতে বড়ই উৎসাহী। ক্রিকেট খেলা দেখতে দেখতে অবলীলায় বিশ্ববিখ্যাত ব্যাটার বা বোলারদের ভুল ধরতে একটুও বিলম্ব করে না।

বলা হয়ে থাকে, সম্মিলিতভাবে বাঙালি সব সময়ই সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। জাতি যে এত রাজনীতিসচেতন হয়ে পড়ল, সেও ভালো কথা। কিন্তু যখন দেখি কোথাও সড়ক দুর্ঘটনা হলো বা পুলিশের লাঠিপেটায় রক্তাক্ত দেহ পড়ে আছে, কোথাও কোনো নারীর অসম্মান হচ্ছে, তখন তার ফোনের ক্যামেরাটি গর্জে ওঠে বটে কিন্তু মানুষ আগায় না। সবকিছু যে ক্যামেরায় ধারণ করার বিষয় নয়, প্রতিবাদী হওয়া প্রয়োজন, তা বোঝার বোধ হয় এখন আর দরকার নেই।

আমাদের লেখাপড়ার সময়টা ছিল ষাটের দশক, যখন দেশে বিপুল পরিমাণে নানা জায়গায় আন্দোলন চলছিল। তার মধ্যে শিল্প-সাহিত্য, বিজ্ঞানচিন্তা এবং বড় বড় রাজনৈতিক তত্ত্ব নিয়েও কথাবার্তা হতো। মিছিলে যাওয়ার আগে ও পরে এসব বিষয় নিয়ে তর্কের ঝড় উঠত। এই তর্কাতর্কির ফলেই একটা বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু এখন এমন একটা সময় এসেছে, যখন রাজনীতিই একমাত্র আলোচনা, তর্কবিতর্কের বিষয়।

এই সময়ের মধ্যে যে কত মানবিক বিপর্যয় ঘটে গেল, দুর্নীতি সকল সময়ের রেকর্ড অতিক্রম করল। শিক্ষাব্যবস্থা নিম্নমুখী, কতিপয় দুর্বৃত্ত আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠল—তার আলোচনা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ করে না। অসহায় কিছু মানুষকে দেখা যায় কোর্ট-কাচারিতে, জেলখানায় দৌড়াদৌড়ি করতে। আবার থানায় প্রচুর মানুষের ভিড়। মানুষ ভেবেছিল একটা পরিবর্তন আসবে, দুর্নীতির কবর রচনা হবে, সরকার একটি কল্যাণমুখী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে, দুর্নীতি বিদায় করতে যেমন কমিশন গঠন করেছে, তা দিয়েই চিরতরে এই অসুখটি নির্মূল হয়ে যাবে। কিন্তু তা হলো না। নির্বাচনই এখন একমাত্র আলোচনার বিষয়। অধিকাংশ লোক ভাবছে নির্বাচন হবে না। এই অবিশ্বাসই-বা কেন? মানুষ একটা আস্থাহীনতা এবং অবিশ্বাসের জায়গায় দাঁড়িয়ে গেল কেন?

বাঙালি চিরকালই সরকারবিরোধী। কারণ আছে অনেক। কিন্তু আস্থাহীনতা যদি সংক্রামক হয়ে জাতির সর্বক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে যায়, তাহলে তার পরিণতি কী হবে? উত্তরের জন্য বহু দূর অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। এখনই দেখা যাচ্ছে মানবিক মূল্যবোধে ধস নেমেছে, যার হাজার হাজার উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে। আরও বহুবার বলেছি, রাষ্ট্রকে আমরা মানবিক করতে পারিনি। সব দল মিলেই ব্যবস্থাটা এমন হয়েছে যে সরকার রাষ্ট্রকে অধিকার করে ফেলেছে, সমাজ কোনোমতে ধিকিধিকি জ্বলছে। তবে সমাজের শক্তি এখনো আছে। নইলে যে নৈরাজ্যকে আমরা দেখেছি, তাতে দেশে বিপুল পরিমাণে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়ে অনেক কিছুই তছনছ হয়ে যেত। কোনো কোনো ওয়াজ-মাহফিল থেকে যেসব উসকানিমূলক বক্তব্য আসে, তাতে সব জায়গায় অগ্ন্যুৎপাত হওয়ার কথা। কিছু কিছু জায়গায় যে তা হয়নি, তা-ও সত্য নয়। অনেক জায়গায়ই ফেসবুকের একটি পোস্ট অনেক দাঙ্গাবাজির কারণ হয়েছে। সেসব ঘটনায় আমাদের সমাজ সত্যিই একটা ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এবার কোনো শক্তিই তেমন দুর্বার হয়ে উঠতে পারেনি। আর সমাজের সবচেয়ে বড় শক্তিটি এখনো সোচ্চার হতে পারেনি।

আমাদের অর্ধশতকের শিক্ষাব্যবস্থা মানুষকে সত্য বলতে শেখায়নি। রাজনীতিবিদ, আমলা, বিচারক, শিক্ষক ও শিক্ষাব্যবস্থার নিয়ন্ত্রকও সত্য ভাষাকে উৎসাহিত করেনি। একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা সর্বত্রই উৎসাহিত হয়েছে। আজকে যে শুধু রাজনীতিই একমাত্র আলোচ্য বিষয়, তার কারণও হচ্ছে সমাজের অন্য সমস্যাগুলোর সমাধান না করে একটি দুর্নীতির পথই বেছে নিয়েছে সবাই। যদি সব জায়গায়ই একটা সুস্থ-স্বাভাবিক ধারা অব্যাহত থাকত, তাহলে এ জায়গায় এসে দাঁড়াতাম না আমরা। সমাজের সর্বত্র সত্যকে মূল্যায়ন করার একটা ব্যবস্থাই পারত সমাজকে রক্ষা করতে। রাজনীতির বৃহত্তর অর্থে প্রয়োগটাও হয়নি।

মানুষের মহত্তম কল্যাণের পথটা রাজনীতিই খুলে দেয়। চীন, রাশিয়া, কিউবার বিপ্লবে সে দেশগুলোর জনগণ একটা মুক্তির পথ পেয়েছিল। তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক সব ধর্মান্ধতা এবং গোঁড়ামি থেকে একটা মুক্ত সমাজ গড়েছিলেন। আমাদের দেশেও লাখ লাখ মানুষ দেশের জন্য বড় বড় ত্যাগ স্বীকার করেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্ব তা সমাজের কাজে ব্যবহার করতে পারেননি। একটাই বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা হলো ক্ষমতা। ক্ষমতার ব্যবহার এবং অপব্যবহার একটি সমাজের জন্য যে কত ভয়ংকর হতে পারে, তা আমরা দেখেছি। এটা সবাই স্বীকার করছেন, আমরা একটি সংকটকাল পার করছি। তার মধ্যেও মানুষের মনে আশা জাগে—একটা সুদিন আসবে। কীভাবে যে সে আশা পূর্ণ হবে আমি জানি না, কেউ জানে কি না জানি না, তবে কেউ না কেউ নিশ্চয়ই জানেন। জেনে থাকলে আমাদের খবর দেবেন।

লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

আরও ক্ষমতাধর হচ্ছেন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনির, দুর্বল হচ্ছে সুপ্রিম কোর্ট

উত্তরায় শিক্ষকের ডাস্টারের আঘাতে ছাত্র রক্তাক্ত, বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ

মুহূর্তেই উধাও ৬ হাজার কোটি টাকা—৫ ইসলামী ধারার ব্যাংকের শেয়ার ‘শূন্য’ ঘোষণা

মুগদা-মান্ডা সড়ক: উচ্ছেদের পর ফের দখল

চট্টগ্রামে যুবদল কর্মী নিহত: মেয়রের ক্ষোভ ঝাড়া সেই ওসিকে বদলি

এলাকার খবর
Loading...