শাইখ সিরাজ
বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলের এক বিশাল জলাভূমি—আড়িয়ল বিল। এটি যেন এক প্রাচীন প্রাণকোষ, যা যুগ যুগ ধরে দেশের মধ্যাঞ্চলের কৃষি, মৎস্য ও জীববৈচিত্র্যের কেন্দ্র হিসেবে টিকে আছে। মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলা এবং ঢাকার নবাবগঞ্জ ও দোহার উপজেলার বিস্তীর্ণ অংশজুড়ে বিস্তৃত প্রায় ১ লাখ ৬৭ হাজার একর আয়তনের এই বিল পদ্মা ও ধলেশ্বরীর মাঝে অবস্থিত। প্রাচীন ভূপ্রকৃতির এই জলাভূমি দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ, যেখানে প্রকৃতি, কৃষি ও মানবজীবন একে অপরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত।
বিগত কয়েক দশকে আমি বহুবার গিয়েছি আড়িয়ল বিলে। কখনো বর্ষায় নৌকায় চড়ে জেলেদের মাছ ধরা দেখেছি, কখনো শুকনো মৌসুমে কৃষকের সঙ্গে মাঠে নেমেছি। টেলিভিশনে এই বিলে নির্ভর মানুষের জীবন, তাদের সুখ-দুঃখ, বেঁচে থাকার সংগ্রাম তুলে ধরেছি।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আবার যখন আড়িয়ল বিলে যাওয়ার সুযোগ হলো, তখন এক ভয়ানক পরিবর্তনের মুখোমুখি হলাম। ভোরের অন্ধকার কাটিয়ে ফজরের সময় পৌঁছালাম মুন্সিগঞ্জের হাসাড়া মাছবাজারে। একসময় এই বাজারের খ্যাতি ছিল পুরো দেশে। হাসাড়া বাজারে একসময় সকালবেলা বিলের দেশি মাছের হাট বসত। কিন্তু এবার গিয়ে দেখি, সেই চিত্র বদলে গেছে। বিলের মাছ নেই বললেই চলে। বাজারভর্তি চাষের মাছ—তেলাপিয়া, পাঙাশ, রুই। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানালেন, বিলে এখন আর আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না; ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়ে তাঁরা এখন চাষের মাছ বিক্রি করছেন। মনে পড়ে গেল চলনবিলের মহিষলুটি বাজারের কথা। সেখানেও একই বিষয় দেখেছি। বিল ভরাট, পুকুর খনন, পরিবেশ ধ্বংস—সব মিলিয়ে বিলের স্বাভাবিক মাছ উৎপাদন শেষ হয়ে গেছে। মনে হলো, আড়িয়ল বিলও যেন সেই পথেই হাঁটছে।
হাসাড়া থেকে আমরা রওনা হলাম ইছামতী নদীর ঘাটে। ভোরের আলো ফুটছে, নদীতীরের মানুষ ঘুম থেকে জেগে উঠছে। ট্রলারে চড়ে যখন আমরা নদীর বুক চিরে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন মনে হচ্ছিল একসময়ের উজ্জ্বল প্রকৃতি এখন ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। নদীর জল ঘোলা, পাড়ের গাছপালা কেমন ধূসর হয়ে গেছে। দুই তীরজুড়ে এখন গড়ে উঠেছে আধুনিক ঘরবাড়ি, শহুরে রূপ নিচ্ছে গ্রাম। কোথাও কোথাও চলছে আবাসন প্রকল্প, ঝুলছে জমি বিক্রির সাইনবোর্ড।
ইছামতী নদী শেষ হয়ে মিশেছে আড়িয়ল বিলে। ১৩৬ বর্গকিলোমিটারের এক বিস্তীর্ণ জলাভূমি, যা একসময় ছিল প্রাণবৈচিত্র্যের অভয়ারণ্য। বিলে কেউ জাল ফেলছেন, কেউ কচুরিপানা জড়ো করে শুকনো মৌসুমের সবজিচাষের ধাপ তৈরি করছেন, কেউবা বিলের বুক থেকে শাপলা তুলছেন। কিন্তু আগের মতো মাছের প্রাচুর্য আর নেই। স্থানীয় জেলেরা জানালেন, সারা রাত জাল ফেলে হাতে আসে অল্প কিছু মাছ। এমনকি নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল দিয়েও তেমন কিছু ধরা পড়ে না। অথচ একসময় এই বিল ছিল দেশি মাছের ভান্ডার। রুই, কাতলা, মৃগেল, ট্যাংরা, শিং, পাবদাসহ নানান মাছ পাওয়া যেত এখানে।
আড়িয়ল বিল একসময় দেশের মাছের পুষ্টি চাহিদার বড় একটি অংশ জোগাত। বিলসংলগ্ন কৃষকেরা নিজেরাই তৈরি করতেন মাছের অভয়াশ্রম। বাঁশ, গাছের ডাল ও ঝোপঝাড় দিয়ে বানানো ‘ডেঙ্গা’ থেকে একেকজন কৃষক বছরে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার মাছ বিক্রি করতে পারতেন। আমি একাধিকবার সেই দৃশ্য টেলিভিশনের জন্য ধারণ করেছি নৌকাভর্তি মাছ, উৎসবের মতো আনন্দ। আজ সে দৃশ্য যেন শুধুই স্মৃতি।
বিলের অর্থনীতি শুধু মাছের ওপর নির্ভরশীল নয়। শুকনো মৌসুমে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো কচুরিপানার ধাপ শুকিয়ে তৈরি হয় সবজিচাষের জমি। কৃষকেরা একত্র হয়ে এখনো সেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, আড়িয়ল বিলে প্রায় ৭,৯৭০ হেক্টর আবাদযোগ্য জমি আছে। ধানই প্রধান ফসল, তবে শীতকালে প্রচুর সবজি হয় এখানে। বেগুন, লালশাক, মিষ্টিকুমড়া, কাঁচা মরিচ, টমেটো, ঢ্যাঁড়স, আরও অনেক কিছু। বিশেষ করে আড়িয়ল বিলের মিষ্টিকুমড়া বড় আকারের, ঘন মিষ্টি স্বাদের জন্য সুপরিচিত। এমন কুমড়া দেশের আর কোথাও জন্মে না।
আড়িয়ল বিলের আরেক আশ্চর্য সৌন্দর্য হলো শাপলা। বর্ষা ও শরতের সংযোগকালে পুরো বিল ঢেকে যায় শাপলায়। হাজার হাজার শাপলার ফুল যেন বিলের বুকজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এক জীবন্ত রঙিন চাদর। এই শাপলা শুধু সৌন্দর্যের নয়, অর্থনীতিরও উৎস। অনেক নারী-পুরুষ শাপলা তুলে বাজারে বিক্রি করেন, কেউ শিকড় শুকিয়ে বিক্রি করেন। বিল যেন হয়ে ওঠে জীবিকার উৎসস্থল।
কিন্তু এই আশীর্বাদপূর্ণ ভূমি এখন মারাত্মক হুমকির মুখে। বিলে দেখা যায় মাটিভর্তি ট্রলারের সারি, মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে, কোথাও আবার বিল ভরাট করা হচ্ছে। বড় বড় ট্রলারের বিকট শব্দ। এভাবে চলতে থাকলে কয়েক শতাব্দী ধরে গড়ে ওঠা প্রাকৃতিক ভারসাম্য একেবারে ধ্বংস হয়ে যাবে। জলাশয়ের গভীরতা কমে যাচ্ছে, মাছের প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে, জলজ উদ্ভিদ মরে যাচ্ছে।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ে কথা বললাম স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে। তাঁরা বললেন, শৈশবে যে আড়িয়ল বিল দেখেছেন, সেই বিল আজ আর নেই। দখল, ভূমিদস্যুতা, ড্রেজার দিয়ে ভরাট, সব মিলিয়ে বিল হারিয়ে ফেলছে তার জীবনশক্তি। তাঁদের ভাষায়, আড়িয়ল বিল এখন টিকে থাকার লড়াই করছে। তাঁরা বুঝতে পারছেন, বিলের অস্তিত্ব হারিয়ে গেলে শুধু এই এলাকার মানুষ নয়, পুরো দেশের খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে।
একসময় দেশের খাল-বিল ছিল স্বাদুপানির মাছের অভয়াশ্রম। সেসব জলাশয়েই ছিল জীববৈচিত্র্যের সমৃদ্ধ কেন্দ্র। মানুষ ও প্রকৃতি মিলেমিশে সেখানে গড়ে তুলেছিল এক ভারসাম্যপূর্ণ বাস্তুতন্ত্র। কিন্তু লোভ, অব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের ভুল পথে হাঁটার কারণে আমরা সেই সম্পদ ধ্বংস করছি নিজেরাই। গবেষকেরা বলছেন, পরিবেশ বিনষ্ট করে উন্নয়ন কখনো টেকসই হতে পারে না।
আজকের উন্নয়ন চিন্তায় যদি আগামী প্রজন্মের জীবন ভুলে যাই, তাহলে তা হবে এক অপূরণীয় ক্ষতি। আমাদের বুঝতে হবে, প্রকৃতির ভারসাম্যের সঙ্গে মানুষের টিকে থাকা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আড়িয়ল বিলের প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য আজ দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে, তার সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের প্রকৃত সমৃদ্ধি ও জীবনের ভারসাম্য।
এখনই সময় সচেতন হওয়ার। সরকারের সুপরিকল্পিত নীতিমালা, বাস্তবসম্মত উদ্যোগ ও স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া আড়িয়ল বিলকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। একই সঙ্গে আমাদের প্রতিটি নাগরিককেও হতে হবে দায়িত্বশীল।
আমরা যদি আজই উদ্যোগ নিই, তবে হয়তো একদিন আবার দেখা যাবে বিলের বুকভরা শাপলা, মাছভরা ঘাট, কৃষকের মুখে হাসি। কিন্তু যদি চুপচাপ বসে থাকি, তাহলে একদিন হয়তো মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে এই ঐতিহ্যবাহী আড়িয়ল বিল। আর সেই ক্ষতি আর কোনো উন্নয়ন দিয়েই হয়তো পূরণ করা যাবে না।
লেখক: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই
বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলের এক বিশাল জলাভূমি—আড়িয়ল বিল। এটি যেন এক প্রাচীন প্রাণকোষ, যা যুগ যুগ ধরে দেশের মধ্যাঞ্চলের কৃষি, মৎস্য ও জীববৈচিত্র্যের কেন্দ্র হিসেবে টিকে আছে। মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলা এবং ঢাকার নবাবগঞ্জ ও দোহার উপজেলার বিস্তীর্ণ অংশজুড়ে বিস্তৃত প্রায় ১ লাখ ৬৭ হাজার একর আয়তনের এই বিল পদ্মা ও ধলেশ্বরীর মাঝে অবস্থিত। প্রাচীন ভূপ্রকৃতির এই জলাভূমি দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ, যেখানে প্রকৃতি, কৃষি ও মানবজীবন একে অপরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত।
বিগত কয়েক দশকে আমি বহুবার গিয়েছি আড়িয়ল বিলে। কখনো বর্ষায় নৌকায় চড়ে জেলেদের মাছ ধরা দেখেছি, কখনো শুকনো মৌসুমে কৃষকের সঙ্গে মাঠে নেমেছি। টেলিভিশনে এই বিলে নির্ভর মানুষের জীবন, তাদের সুখ-দুঃখ, বেঁচে থাকার সংগ্রাম তুলে ধরেছি।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আবার যখন আড়িয়ল বিলে যাওয়ার সুযোগ হলো, তখন এক ভয়ানক পরিবর্তনের মুখোমুখি হলাম। ভোরের অন্ধকার কাটিয়ে ফজরের সময় পৌঁছালাম মুন্সিগঞ্জের হাসাড়া মাছবাজারে। একসময় এই বাজারের খ্যাতি ছিল পুরো দেশে। হাসাড়া বাজারে একসময় সকালবেলা বিলের দেশি মাছের হাট বসত। কিন্তু এবার গিয়ে দেখি, সেই চিত্র বদলে গেছে। বিলের মাছ নেই বললেই চলে। বাজারভর্তি চাষের মাছ—তেলাপিয়া, পাঙাশ, রুই। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানালেন, বিলে এখন আর আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না; ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়ে তাঁরা এখন চাষের মাছ বিক্রি করছেন। মনে পড়ে গেল চলনবিলের মহিষলুটি বাজারের কথা। সেখানেও একই বিষয় দেখেছি। বিল ভরাট, পুকুর খনন, পরিবেশ ধ্বংস—সব মিলিয়ে বিলের স্বাভাবিক মাছ উৎপাদন শেষ হয়ে গেছে। মনে হলো, আড়িয়ল বিলও যেন সেই পথেই হাঁটছে।
হাসাড়া থেকে আমরা রওনা হলাম ইছামতী নদীর ঘাটে। ভোরের আলো ফুটছে, নদীতীরের মানুষ ঘুম থেকে জেগে উঠছে। ট্রলারে চড়ে যখন আমরা নদীর বুক চিরে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন মনে হচ্ছিল একসময়ের উজ্জ্বল প্রকৃতি এখন ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। নদীর জল ঘোলা, পাড়ের গাছপালা কেমন ধূসর হয়ে গেছে। দুই তীরজুড়ে এখন গড়ে উঠেছে আধুনিক ঘরবাড়ি, শহুরে রূপ নিচ্ছে গ্রাম। কোথাও কোথাও চলছে আবাসন প্রকল্প, ঝুলছে জমি বিক্রির সাইনবোর্ড।
ইছামতী নদী শেষ হয়ে মিশেছে আড়িয়ল বিলে। ১৩৬ বর্গকিলোমিটারের এক বিস্তীর্ণ জলাভূমি, যা একসময় ছিল প্রাণবৈচিত্র্যের অভয়ারণ্য। বিলে কেউ জাল ফেলছেন, কেউ কচুরিপানা জড়ো করে শুকনো মৌসুমের সবজিচাষের ধাপ তৈরি করছেন, কেউবা বিলের বুক থেকে শাপলা তুলছেন। কিন্তু আগের মতো মাছের প্রাচুর্য আর নেই। স্থানীয় জেলেরা জানালেন, সারা রাত জাল ফেলে হাতে আসে অল্প কিছু মাছ। এমনকি নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল দিয়েও তেমন কিছু ধরা পড়ে না। অথচ একসময় এই বিল ছিল দেশি মাছের ভান্ডার। রুই, কাতলা, মৃগেল, ট্যাংরা, শিং, পাবদাসহ নানান মাছ পাওয়া যেত এখানে।
আড়িয়ল বিল একসময় দেশের মাছের পুষ্টি চাহিদার বড় একটি অংশ জোগাত। বিলসংলগ্ন কৃষকেরা নিজেরাই তৈরি করতেন মাছের অভয়াশ্রম। বাঁশ, গাছের ডাল ও ঝোপঝাড় দিয়ে বানানো ‘ডেঙ্গা’ থেকে একেকজন কৃষক বছরে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার মাছ বিক্রি করতে পারতেন। আমি একাধিকবার সেই দৃশ্য টেলিভিশনের জন্য ধারণ করেছি নৌকাভর্তি মাছ, উৎসবের মতো আনন্দ। আজ সে দৃশ্য যেন শুধুই স্মৃতি।
বিলের অর্থনীতি শুধু মাছের ওপর নির্ভরশীল নয়। শুকনো মৌসুমে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো কচুরিপানার ধাপ শুকিয়ে তৈরি হয় সবজিচাষের জমি। কৃষকেরা একত্র হয়ে এখনো সেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, আড়িয়ল বিলে প্রায় ৭,৯৭০ হেক্টর আবাদযোগ্য জমি আছে। ধানই প্রধান ফসল, তবে শীতকালে প্রচুর সবজি হয় এখানে। বেগুন, লালশাক, মিষ্টিকুমড়া, কাঁচা মরিচ, টমেটো, ঢ্যাঁড়স, আরও অনেক কিছু। বিশেষ করে আড়িয়ল বিলের মিষ্টিকুমড়া বড় আকারের, ঘন মিষ্টি স্বাদের জন্য সুপরিচিত। এমন কুমড়া দেশের আর কোথাও জন্মে না।
আড়িয়ল বিলের আরেক আশ্চর্য সৌন্দর্য হলো শাপলা। বর্ষা ও শরতের সংযোগকালে পুরো বিল ঢেকে যায় শাপলায়। হাজার হাজার শাপলার ফুল যেন বিলের বুকজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এক জীবন্ত রঙিন চাদর। এই শাপলা শুধু সৌন্দর্যের নয়, অর্থনীতিরও উৎস। অনেক নারী-পুরুষ শাপলা তুলে বাজারে বিক্রি করেন, কেউ শিকড় শুকিয়ে বিক্রি করেন। বিল যেন হয়ে ওঠে জীবিকার উৎসস্থল।
কিন্তু এই আশীর্বাদপূর্ণ ভূমি এখন মারাত্মক হুমকির মুখে। বিলে দেখা যায় মাটিভর্তি ট্রলারের সারি, মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে, কোথাও আবার বিল ভরাট করা হচ্ছে। বড় বড় ট্রলারের বিকট শব্দ। এভাবে চলতে থাকলে কয়েক শতাব্দী ধরে গড়ে ওঠা প্রাকৃতিক ভারসাম্য একেবারে ধ্বংস হয়ে যাবে। জলাশয়ের গভীরতা কমে যাচ্ছে, মাছের প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে, জলজ উদ্ভিদ মরে যাচ্ছে।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ে কথা বললাম স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে। তাঁরা বললেন, শৈশবে যে আড়িয়ল বিল দেখেছেন, সেই বিল আজ আর নেই। দখল, ভূমিদস্যুতা, ড্রেজার দিয়ে ভরাট, সব মিলিয়ে বিল হারিয়ে ফেলছে তার জীবনশক্তি। তাঁদের ভাষায়, আড়িয়ল বিল এখন টিকে থাকার লড়াই করছে। তাঁরা বুঝতে পারছেন, বিলের অস্তিত্ব হারিয়ে গেলে শুধু এই এলাকার মানুষ নয়, পুরো দেশের খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে।
একসময় দেশের খাল-বিল ছিল স্বাদুপানির মাছের অভয়াশ্রম। সেসব জলাশয়েই ছিল জীববৈচিত্র্যের সমৃদ্ধ কেন্দ্র। মানুষ ও প্রকৃতি মিলেমিশে সেখানে গড়ে তুলেছিল এক ভারসাম্যপূর্ণ বাস্তুতন্ত্র। কিন্তু লোভ, অব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের ভুল পথে হাঁটার কারণে আমরা সেই সম্পদ ধ্বংস করছি নিজেরাই। গবেষকেরা বলছেন, পরিবেশ বিনষ্ট করে উন্নয়ন কখনো টেকসই হতে পারে না।
আজকের উন্নয়ন চিন্তায় যদি আগামী প্রজন্মের জীবন ভুলে যাই, তাহলে তা হবে এক অপূরণীয় ক্ষতি। আমাদের বুঝতে হবে, প্রকৃতির ভারসাম্যের সঙ্গে মানুষের টিকে থাকা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আড়িয়ল বিলের প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য আজ দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে, তার সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের প্রকৃত সমৃদ্ধি ও জীবনের ভারসাম্য।
এখনই সময় সচেতন হওয়ার। সরকারের সুপরিকল্পিত নীতিমালা, বাস্তবসম্মত উদ্যোগ ও স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া আড়িয়ল বিলকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। একই সঙ্গে আমাদের প্রতিটি নাগরিককেও হতে হবে দায়িত্বশীল।
আমরা যদি আজই উদ্যোগ নিই, তবে হয়তো একদিন আবার দেখা যাবে বিলের বুকভরা শাপলা, মাছভরা ঘাট, কৃষকের মুখে হাসি। কিন্তু যদি চুপচাপ বসে থাকি, তাহলে একদিন হয়তো মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে এই ঐতিহ্যবাহী আড়িয়ল বিল। আর সেই ক্ষতি আর কোনো উন্নয়ন দিয়েই হয়তো পূরণ করা যাবে না।
লেখক: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই
ইউরোপিয়ান জার্নাল অব পলিটিক্যাল ইকোনমিতে প্রকাশিত গ্রিক অর্থনীতিবিদ মাইকেল ক্লেটসস ও আন্দ্রেয়াস সিন্টোসের লেখা ‘দ্য ইফেক্টস অব আইএমএফ কন্ডিশনাল প্রোগ্রাম অন দ্য আনএমপ্লয়মেন্ট রেট’ শীর্ষক প্রবন্ধের উদ্ধৃতি দিয়ে বাংলাদেশের একটি দৈনিক পত্রিকায় ‘আইএমএফ থেকে ঋণ গ্রহণকারী দেশগুলোয় বেকারত্ব বেড়েছে...
৮ ঘণ্টা আগেএকসময় বিমা খাত ছিল ভবিষ্যতের আর্থিক সুরক্ষার ক্ষেত্র, আজ তা পরিণত হয়েছে গ্রাহকদের হতাশা আর উদ্বেগের কেন্দ্রে। বছর বছর বিমা কোম্পানির দ্বারে দ্বারে ঘুরেও গ্রাহকেরা তাঁদের প্রাপ্য টাকা পাচ্ছেন না। কারণ দেশের বিমা কোম্পানিগুলোর কাছে গ্রাহকদের আটকে আছে ৭ হাজার কোটি টাকা, অথচ বেশির ভাগ কোম্পানিই...
৮ ঘণ্টা আগেকয়েক দিন ধরে ‘সেফ এক্সিট’ নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। কথাটার অর্থ কী? আপনাদের কার কী অভিজ্ঞতা আমি জানি না, তবে নিজের কথা বলতে পারি, ‘এক্সিট’ শব্দটা আমি প্রথম দেখেছি সিনেমা হলে। মুভি যখন চলে, তখন পুরো হল অন্ধকার থাকলেও দরজাগুলোর ওপর ‘এক্সিট’ লেখাটা জ্বলজ্বল করতে থাকে।
১ দিন আগেরাষ্ট্র সংস্কারের কথা চলছে অনেক আগে থেকে। শোনা যাচ্ছে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের কথা। সবকিছু সংস্কার ও বিনির্মাণ করা হবে। কিন্তু সংস্কার কি শুধু রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই প্রয়োজন? ব্যক্তির সংস্কার প্রয়োজন নেই?
১ দিন আগে