নুরুল ইজ্জাহ আনোয়ার
২০২৪ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা এক বিদ্রোহের দাবানল তৈরি করে। দ্রুতই তা দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। তারা এমন এক স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছিল, যার আমলে জিডিপি বাড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমাজে ব্যাপক বৈষম্য ও দুর্নীতি বাড়ে। এ কারণে, জিডিপি প্রবৃদ্ধির পরও তরুণ-যুবাদের কাঙ্ক্ষিত কর্মসংস্থানের সংকট সমাধানে ব্যর্থ হন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়েছিল সেটি কেবল প্রতিবাদ ছিল না; এটি ছিল জনগণের মর্যাদার লড়াই। এর লক্ষ্য ছিল—এটি স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে দেশের ভবিষ্যৎ জনগণই নির্ধারণ করবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জুলাই বিপ্লব নিয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ভাষণ দেওয়ার সময় আমি এটি আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করি। বাংলাদেশে আমি যে উদ্দীপনা দেখেছি, তা মালয়েশিয়াতেও ফুটে উঠেছিল—১৯৭৪ সালে বালিংয়ে ক্ষুধায় এক কৃষকের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া এক আন্দোলনের সময়। সে সময় মালয়েশিয়ার শিক্ষার্থীরাই আন্দোলন করেছিলেন। এরপর, ১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়ার তরুণ-যুবকেরা সক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক দমন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। আমি নিজেও এই আন্দোলনে ছিলাম।
যখন তরুণ-যুবকেরা অন্যায্য ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করে, তখন তারা এক সহজ সত্যকে তুলে ধরে—ভয়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সাহসের মাধ্যমে ভেঙে ফেলা যায়, কিন্তু ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা অটুট থাকে। কিন্তু অন্যায়-ভুল সংশোধনের জন্য কেবল সাহসই যথেষ্ট নয়। প্রতিবাদের পর অবশ্যই বাস্তব সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার আসা প্রয়োজন, যা কেবল স্লোগানেই সীমাবদ্ধ না থেকে অসন্তোষের মূল কারণ—অসাম্য, দুর্নীতি ও বেকারত্ব দূর করে, মানুষের রাজপথে নামার প্রয়োজনীয়তা মিটিয়ে দিতে সাহায্য করবে।
বাংলাদেশের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ। বিপ্লবের উজ্জ্বল দিনগুলোর এক বছর পর, অন্তর্বর্তী সরকার—যারা মসৃণভাবে অন্তর্বর্তী সময়ে শাসনকার্য নিশ্চিত করার দায়িত্ব পেয়েছিল এবং তার জন্য কৃতিত্বও পেয়েছে—এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি। বাংলাদেশ শ্রমিকদের নিরাপত্তা উন্নয়নে অনেকটা এগিয়ে গেলেও আন্দোলনকারীরা যেসব অভিযোগ নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন, সেগুলো সমাধানে কাঠামোগত সংস্কার বাস্তবায়নে এখনো অনেক বাধা রয়ে গেছে।
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের বিপরীতে এত দিন রাজনীতি করা প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) আশা করছে, জামায়াতে ইসলামী ও আন্দোলনের পর গঠিত নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)—আসন্ন নির্বাচনে পরাজিত হবে। জামায়াত ও এনসিপি ভোটারদের মনোযোগ আকর্ষণে ঐক্যবদ্ধ জোট গড়তে ব্যর্থ হলে, সবচেয়ে সম্ভাব্য ফলাফল হবে বিএনপির বিজয়।
গণতান্ত্রিক যাত্রার নতুন সূচনা হিসেবে নতুন শাসক দল যতই ভালো মনে হোক না কেন, গভীর প্রশ্ন হলো—এটি কি সত্যিকারের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে পারবে, নাকি কেবলই এক ধ্বংসাত্মক চক্রকে পুনরায় টেনে আনবে? পূর্ববর্তী সরকারের পৃষ্ঠপোষক নেটওয়ার্ক এবং বিভাজনমূলক শাসন থেকে মৌলিক পরিবর্তন না ঘটিয়ে এবং ন্যায়ভিত্তিক ব্যবস্থা অনুসরণ না করে বিএনপির জয় হয়তো প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর মধ্যে পরিবর্তনশীল শাসনের সেই ক্ষয়িষ্ণু ধারারই পুনরাবৃত্তির প্রতীক হবে, যা কখনো স্থিতিশীলতার কাঠামোগত কারণগুলোর সমাধান করে না। একটি সত্যিকারের ন্যায়সংগত ব্যবস্থা কেবল নির্বাচনী ফলাফলের ওপর নির্ভর করে না, বরং এমন সংস্কারের ওপর নির্ভর, যা এক্সক্লুশনের বা প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করে রাখার নিপীড়ক যন্ত্রকে ভেঙে দেয় এবং এমন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে, যা কোনো একক দলের ইচ্ছের ওপর নির্ভর করে না।
বাংলাদেশের সামনে কঠিন পথ। ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি বাংলাদেশ মূলত শ্রম, বস্ত্র ও পরিধেয় সামগ্রী রপ্তানি করে, যার একটি বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্রে যায়। কিন্তু সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক চাপিয়েছেন। ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধ তীব্র হওয়ায়, বিশ্ব অর্থনীতি প্রতিদ্বন্দ্বী শিবিরে বিভক্ত হচ্ছে, যার ফলে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর হাতে দর–কষাকষির সুযোগ খুব একটা থাকছে না।
বাংলাদেশের বিষয়টি আমলে নিয়ে বলা যায়—গ্লোবাল সাউথের (তৃতীয় বিশ্ব) জন্য শিক্ষা স্পষ্ট: যদি আমরা আমাদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিজেদের হাতে না নিই, অন্যরা সেটি আমাদের জন্য নির্ধারণ করবে। কিন্তু আমাদের নিজ ভবিষ্যতের স্থপতি হতে হলে, সন্দেহের বদলে একতার ভাব থাকতে হবে। এর মানে হলো—দেশের ভেতরে বৈষম্য মোকাবিলা ও বিদেশে সত্যিকারের জোট গড়ে তোলা। সরকারকে জাতীয় সম্পদ এমনভাবে পরিচালনা করতে হবে যা শুধু কিছু উচ্চশ্রেণির ব্যক্তির জন্য নয়, বরং সবার কল্যাণে কাজে লাগবে। মালয়েশিয়ার পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড, যেমন—এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং পারমোদালান ন্যাসিওনাল বেরহাদ দেখিয়েছে কীভাবে বৈদেশিক ঋণের ঝুঁকি কমানো যায় এবং প্রাকৃতিক সম্পদগুলোকে জনগণের কাজে লাগানো যায়।
সামাজিক ব্যবসার ধারণা, যা সমাজের চ্যালেঞ্জ যেমন জলবায়ু পরিবর্তন এবং অপুষ্টি সমাধান করতে এবং একই সঙ্গে আর্থিকভাবে স্বনির্ভর হতে তৈরি করা হয়, গ্লোবাল সাউথে ইতিমধ্যেই সেই দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে। মালয়েশিয়ায় সার্বভৌম সম্পদ ফান্ডের ইয়ায়াসাহানাহ এই ধরনের উদ্যোগকে সমর্থন করে, যা কৃষি থেকে শিক্ষা পর্যন্ত বিভিন্ন খাতে পরিমাপযোগ্য সামাজিক ও পরিবেশগত ফলাফল দিচ্ছে। শিল্পনীতির এমনভাবে কাজ করা উচিত, যা অনেকের ক্ষমতায়ন করে, শুধু কিছুসংখ্যক মানুষের জন্য নয়। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য অবিরত মূল্যায়ন, স্বচ্ছতা এবং উদ্ভাবনের প্রয়োজন।
আজকের যেসব সংকট আমরা দেখছি—গাজা থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত—তা প্রমাণ করছে, সার্বভৌমত্ব এবং ঐক্য অবিচ্ছেদ্য। ন্যায়কে মুনাফার ওপরে স্থান দিতে হবে। সরকার পরিচালনায় আমদানি করা নীতির বদলে স্থানীয় জ্ঞানকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফল সবারই ভাগ্যে সমানভাবে বণ্টিত হওয়া উচিত।
যখন সম্পদ সংকুচিত ও একপক্ষের হাতে কেন্দ্রীভূত হয় তখন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা কীভাবে ভেঙে পড়ে তা বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লব দেখিয়েছে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাওয়ার পথে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের গুরুত্ব মনে রাখা খুবই জরুরি। দেশের নেতারা যদি পরিবর্তনের আহ্বানকে বাস্তব, ন্যায়সংগত অর্জনে রূপান্তরিত করতে ব্যর্থ হন, তাহলে সামাজিক বিভাজন আরও গভীর হবে, সত্যিকারের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন কঠিন হবে এবং অপূর্ণ প্রতিশ্রুতির চক্র চলতে থাকবে।
কখনো কখনো ছোট এক স্ফূলিঙ্গ—যেমন ছাত্র আন্দোলন বা নীতিগত সৎ পদক্ষেপ—মৌলিক পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে। কিন্তু তা ঘটাতে হলে সেটি এক সম্মিলিত উদ্দেশ্যের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। গ্লোবাল সাউথের দায়িত্ব হলো এটি নিশ্চিত করা যে—ন্যায্যতা ও সমৃদ্ধি পরস্পরের সঙ্গে হাত ধরাধরি করেই এগিয়ে নিতে হবে।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইস ইনাসিও লুলা দা সিলভার প্রস্তাবকে স্বাগত জানাই। তিনি ব্রিকস জোটের নেতাদের বৈশ্বিক সংঘাত শেষ করতে এবং ন্যায়সংগত উন্নয়ন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। যদি আন্তরিকভাবে এই প্রতিশ্রুতি অনুসরণ করা হয়, তবে এটি গ্লোবাল সাউথের জন্য জরুরি ন্যায়, সংহতি এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার আদর্শে পরিণত হতে পারে।
লেখক: নুরুল ইজ্জাহ আনোয়ার মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের মেয়ে এবং দেশটির পিপলস জাস্টিস পার্টির সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং ডেপুটি প্রেসিডেন্ট। তিনি মালয়েশিয়ার এমপি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে অনুবাদ করেছে আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান
২০২৪ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা এক বিদ্রোহের দাবানল তৈরি করে। দ্রুতই তা দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। তারা এমন এক স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছিল, যার আমলে জিডিপি বাড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমাজে ব্যাপক বৈষম্য ও দুর্নীতি বাড়ে। এ কারণে, জিডিপি প্রবৃদ্ধির পরও তরুণ-যুবাদের কাঙ্ক্ষিত কর্মসংস্থানের সংকট সমাধানে ব্যর্থ হন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়েছিল সেটি কেবল প্রতিবাদ ছিল না; এটি ছিল জনগণের মর্যাদার লড়াই। এর লক্ষ্য ছিল—এটি স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে দেশের ভবিষ্যৎ জনগণই নির্ধারণ করবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জুলাই বিপ্লব নিয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ভাষণ দেওয়ার সময় আমি এটি আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করি। বাংলাদেশে আমি যে উদ্দীপনা দেখেছি, তা মালয়েশিয়াতেও ফুটে উঠেছিল—১৯৭৪ সালে বালিংয়ে ক্ষুধায় এক কৃষকের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া এক আন্দোলনের সময়। সে সময় মালয়েশিয়ার শিক্ষার্থীরাই আন্দোলন করেছিলেন। এরপর, ১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়ার তরুণ-যুবকেরা সক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক দমন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। আমি নিজেও এই আন্দোলনে ছিলাম।
যখন তরুণ-যুবকেরা অন্যায্য ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করে, তখন তারা এক সহজ সত্যকে তুলে ধরে—ভয়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সাহসের মাধ্যমে ভেঙে ফেলা যায়, কিন্তু ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা অটুট থাকে। কিন্তু অন্যায়-ভুল সংশোধনের জন্য কেবল সাহসই যথেষ্ট নয়। প্রতিবাদের পর অবশ্যই বাস্তব সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার আসা প্রয়োজন, যা কেবল স্লোগানেই সীমাবদ্ধ না থেকে অসন্তোষের মূল কারণ—অসাম্য, দুর্নীতি ও বেকারত্ব দূর করে, মানুষের রাজপথে নামার প্রয়োজনীয়তা মিটিয়ে দিতে সাহায্য করবে।
বাংলাদেশের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ। বিপ্লবের উজ্জ্বল দিনগুলোর এক বছর পর, অন্তর্বর্তী সরকার—যারা মসৃণভাবে অন্তর্বর্তী সময়ে শাসনকার্য নিশ্চিত করার দায়িত্ব পেয়েছিল এবং তার জন্য কৃতিত্বও পেয়েছে—এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি। বাংলাদেশ শ্রমিকদের নিরাপত্তা উন্নয়নে অনেকটা এগিয়ে গেলেও আন্দোলনকারীরা যেসব অভিযোগ নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন, সেগুলো সমাধানে কাঠামোগত সংস্কার বাস্তবায়নে এখনো অনেক বাধা রয়ে গেছে।
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের বিপরীতে এত দিন রাজনীতি করা প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) আশা করছে, জামায়াতে ইসলামী ও আন্দোলনের পর গঠিত নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)—আসন্ন নির্বাচনে পরাজিত হবে। জামায়াত ও এনসিপি ভোটারদের মনোযোগ আকর্ষণে ঐক্যবদ্ধ জোট গড়তে ব্যর্থ হলে, সবচেয়ে সম্ভাব্য ফলাফল হবে বিএনপির বিজয়।
গণতান্ত্রিক যাত্রার নতুন সূচনা হিসেবে নতুন শাসক দল যতই ভালো মনে হোক না কেন, গভীর প্রশ্ন হলো—এটি কি সত্যিকারের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে পারবে, নাকি কেবলই এক ধ্বংসাত্মক চক্রকে পুনরায় টেনে আনবে? পূর্ববর্তী সরকারের পৃষ্ঠপোষক নেটওয়ার্ক এবং বিভাজনমূলক শাসন থেকে মৌলিক পরিবর্তন না ঘটিয়ে এবং ন্যায়ভিত্তিক ব্যবস্থা অনুসরণ না করে বিএনপির জয় হয়তো প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর মধ্যে পরিবর্তনশীল শাসনের সেই ক্ষয়িষ্ণু ধারারই পুনরাবৃত্তির প্রতীক হবে, যা কখনো স্থিতিশীলতার কাঠামোগত কারণগুলোর সমাধান করে না। একটি সত্যিকারের ন্যায়সংগত ব্যবস্থা কেবল নির্বাচনী ফলাফলের ওপর নির্ভর করে না, বরং এমন সংস্কারের ওপর নির্ভর, যা এক্সক্লুশনের বা প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করে রাখার নিপীড়ক যন্ত্রকে ভেঙে দেয় এবং এমন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে, যা কোনো একক দলের ইচ্ছের ওপর নির্ভর করে না।
বাংলাদেশের সামনে কঠিন পথ। ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি বাংলাদেশ মূলত শ্রম, বস্ত্র ও পরিধেয় সামগ্রী রপ্তানি করে, যার একটি বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্রে যায়। কিন্তু সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক চাপিয়েছেন। ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধ তীব্র হওয়ায়, বিশ্ব অর্থনীতি প্রতিদ্বন্দ্বী শিবিরে বিভক্ত হচ্ছে, যার ফলে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর হাতে দর–কষাকষির সুযোগ খুব একটা থাকছে না।
বাংলাদেশের বিষয়টি আমলে নিয়ে বলা যায়—গ্লোবাল সাউথের (তৃতীয় বিশ্ব) জন্য শিক্ষা স্পষ্ট: যদি আমরা আমাদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিজেদের হাতে না নিই, অন্যরা সেটি আমাদের জন্য নির্ধারণ করবে। কিন্তু আমাদের নিজ ভবিষ্যতের স্থপতি হতে হলে, সন্দেহের বদলে একতার ভাব থাকতে হবে। এর মানে হলো—দেশের ভেতরে বৈষম্য মোকাবিলা ও বিদেশে সত্যিকারের জোট গড়ে তোলা। সরকারকে জাতীয় সম্পদ এমনভাবে পরিচালনা করতে হবে যা শুধু কিছু উচ্চশ্রেণির ব্যক্তির জন্য নয়, বরং সবার কল্যাণে কাজে লাগবে। মালয়েশিয়ার পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড, যেমন—এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং পারমোদালান ন্যাসিওনাল বেরহাদ দেখিয়েছে কীভাবে বৈদেশিক ঋণের ঝুঁকি কমানো যায় এবং প্রাকৃতিক সম্পদগুলোকে জনগণের কাজে লাগানো যায়।
সামাজিক ব্যবসার ধারণা, যা সমাজের চ্যালেঞ্জ যেমন জলবায়ু পরিবর্তন এবং অপুষ্টি সমাধান করতে এবং একই সঙ্গে আর্থিকভাবে স্বনির্ভর হতে তৈরি করা হয়, গ্লোবাল সাউথে ইতিমধ্যেই সেই দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে। মালয়েশিয়ায় সার্বভৌম সম্পদ ফান্ডের ইয়ায়াসাহানাহ এই ধরনের উদ্যোগকে সমর্থন করে, যা কৃষি থেকে শিক্ষা পর্যন্ত বিভিন্ন খাতে পরিমাপযোগ্য সামাজিক ও পরিবেশগত ফলাফল দিচ্ছে। শিল্পনীতির এমনভাবে কাজ করা উচিত, যা অনেকের ক্ষমতায়ন করে, শুধু কিছুসংখ্যক মানুষের জন্য নয়। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য অবিরত মূল্যায়ন, স্বচ্ছতা এবং উদ্ভাবনের প্রয়োজন।
আজকের যেসব সংকট আমরা দেখছি—গাজা থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত—তা প্রমাণ করছে, সার্বভৌমত্ব এবং ঐক্য অবিচ্ছেদ্য। ন্যায়কে মুনাফার ওপরে স্থান দিতে হবে। সরকার পরিচালনায় আমদানি করা নীতির বদলে স্থানীয় জ্ঞানকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফল সবারই ভাগ্যে সমানভাবে বণ্টিত হওয়া উচিত।
যখন সম্পদ সংকুচিত ও একপক্ষের হাতে কেন্দ্রীভূত হয় তখন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা কীভাবে ভেঙে পড়ে তা বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লব দেখিয়েছে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাওয়ার পথে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের গুরুত্ব মনে রাখা খুবই জরুরি। দেশের নেতারা যদি পরিবর্তনের আহ্বানকে বাস্তব, ন্যায়সংগত অর্জনে রূপান্তরিত করতে ব্যর্থ হন, তাহলে সামাজিক বিভাজন আরও গভীর হবে, সত্যিকারের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন কঠিন হবে এবং অপূর্ণ প্রতিশ্রুতির চক্র চলতে থাকবে।
কখনো কখনো ছোট এক স্ফূলিঙ্গ—যেমন ছাত্র আন্দোলন বা নীতিগত সৎ পদক্ষেপ—মৌলিক পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে। কিন্তু তা ঘটাতে হলে সেটি এক সম্মিলিত উদ্দেশ্যের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। গ্লোবাল সাউথের দায়িত্ব হলো এটি নিশ্চিত করা যে—ন্যায্যতা ও সমৃদ্ধি পরস্পরের সঙ্গে হাত ধরাধরি করেই এগিয়ে নিতে হবে।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইস ইনাসিও লুলা দা সিলভার প্রস্তাবকে স্বাগত জানাই। তিনি ব্রিকস জোটের নেতাদের বৈশ্বিক সংঘাত শেষ করতে এবং ন্যায়সংগত উন্নয়ন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। যদি আন্তরিকভাবে এই প্রতিশ্রুতি অনুসরণ করা হয়, তবে এটি গ্লোবাল সাউথের জন্য জরুরি ন্যায়, সংহতি এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার আদর্শে পরিণত হতে পারে।
লেখক: নুরুল ইজ্জাহ আনোয়ার মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের মেয়ে এবং দেশটির পিপলস জাস্টিস পার্টির সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং ডেপুটি প্রেসিডেন্ট। তিনি মালয়েশিয়ার এমপি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে অনুবাদ করেছে আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান
বিগত সরকারের শাসনামলে একটা প্রশ্ন বেশ আলোচিত হতো। এর পরে কী? একটা বক্তব্য চালু ছিল যে নৈরাজ্য দেখা দেবে। তেমনটা ঘটবার আগেই অবশ্য গণ-আন্দোলনের মুখে সরকারের পতন ঘটেছে; কিন্তু পতনের পরে অবস্থাটা এখন যে খুব শান্ত ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে, তা তো নয়। না হওয়ার প্রধান কারণ এটা যে অভ্যুত্থানের পেছনে কোনো সংগঠিত..
১ দিন আগেসাম্প্রতিক একটি সংবাদ দিয়ে শুরু করছি। জাপানে ২০২৪ সালে যত মানুষ জন্মেছে, তার চেয়ে ৯ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর অর্থ, দ্রুত কমছে জাপানের জনসংখ্যা। এটি যে কেবল ২০২৪ সালেই ঘটেছে, তা কিন্তু নয়। ধারাবাহিকভাবে প্রতিবছরই দেশটির জনসংখ্যা ছোট হচ্ছে। বিষয়টি জাপানের জন্য অবশ্যই উদ্বেগের...
১ দিন আগেবেহিসাবি মানুষের জীবন কখনোই সুখের দেখা পায় না। সুখ সুখ করে আর তার পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে জীবনটাই শেষ; সুখ বেচারার আর দেখা মেলে না। হিসাবের খাতায় গরমিল থাকলে পুরো জীবনটাই দুর্ভোগের শিকার হয়। জীবনের অঙ্ক নির্ভুল না হলে জীবন হয় অভিশপ্ত। হিসাব ছাড়া মানুষেরা সামাজিক বা পারিবারিক—সবভাবেই নিগৃহীত হয়...
১ দিন আগেকাশেমের সামর্থ্য নেই। মেয়ের শখ পূরণ করতে প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে তাই পরপর চারটি হাঁস চুরি করে। কিন্তু বাপ-বেটির মধ্যে অনুশোচনা কাজ করলে তারা সিদ্ধান্ত নেয় চারটি হাঁস কিনে প্রতিবেশীকে ফেরত দিয়ে ক্ষমা চাইবে। যা-ই হোক, বৃত্তিতে ভালো ফল করায় গ্রামের চেয়ারম্যান তাদের উপহার হিসেবে কিছু দিতে...
১ দিন আগে