Ajker Patrika

তারুণ্যের ভ্রান্তি কাটুক, জাগুক ইতিহাস

অজয় দাশগুপ্ত
আপডেট : ২১ আগস্ট ২০২৩, ০৯: ৪৯
তারুণ্যের ভ্রান্তি কাটুক, জাগুক ইতিহাস

আমি যখন কম্বোডিয়ার জাদুঘরে গিয়েছিলাম, কেবল যে বেদনা অনুভব করেছি তা কিন্তু নয়। আমার মনে হয়েছিল, দেশ ও জাতিকে অতীত জানানোর আসল কাজটি আমরা করিনি। ওরা করেছে।

ওদের জাদুঘরে যেসব মানুষ বিপ্লবের নামে মানুষ খুন করত বা যাদের অপকর্মে দেশ-জাতি ভুগেছিল, তাদের নাম-ঠিকানা তো আছেই, পরবর্তীকালে তাদের সমাজে ফেরার আকুল আকুতি ও মার্জনা চাওয়ার দলিলও আছে; যেন কোনোকালে তারা অস্বীকার করতে না পারে। এখন আমার মনে হয়, ওরা ভবিষ্যৎ ভেবেই এমন কাজ করে রেখেছে। যা করা হয়নি বলে আমরা যেকোনো বৈরী পরিবেশ সামনে এলেই তারুণ্যকে দায়ী করি। বলতে থাকি—তারা আসলে উচ্ছন্নে গেছে, তাদের ভেতর দেশপ্রেম বলে কিছু নেই।

আমরা যখন তরুণ, তখন বা তারও আগে, তারুণ্যের ভেতর দেশপ্রেম ছিল। কিন্তু কেন ছিল? মানলাম, দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পাকিস্তানবিরোধিতার কারণে দেশপ্রেম টগবগ করত। কিন্তু স্বাধীনতার পরও কি তার কিছু কম ছিল? যে বাংলাদেশের টাকা-পয়সা ছিল না, যে দেশে বিদেশের পুরোনো কাপড় আসত পোশাক হিসেবে, খাবারের ঠিক ছিল না, সে দেশকে পাগলের মতো ভালোবেসেছি আমরা।

চাকরি নেই, ব্যবসা নেই; সারা দেশ দ্রোহের আগুনে জ্বলছে, তখনো আমরা আশা ছাড়িনি। একদিকে রাজপথে স্বৈরাচার হটানোর আন্দোলন, অন্যদিকে আমাদের জীবনে ছিল প্রেম। আজ ফিরে তাকালে দেখি সে সময়কালের যুবক-যুবতীরা ভালোবাসায় বাঁচত। আজকের দিনে ভালোবাসা নেই, এ কথা বলি না কিন্তু এত পছন্দ-অপছন্দের সুযোগ ছিল না। ছিল না যৌনতার ছড়াছড়ি।

কথাগুলো বলার কারণ, যৌনতানির্ভর ডিজিটাল জগতের বাসিন্দারাই আবার সমাজে প্রবল প্রতিক্রিয়াশীল; যা সময়-সময় আমাদের সামনে চলে আসে। আর তখন একদল হাহাকার করে, আরেক দল করে জান্তব উল্লাস।

তারুণ্য যদি অস্বাভাবিক আচরণ করে বা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কিংবা ইতিহাসের প্রতি দায়িত্ববান না হয়, তার দায় কি আসলে তাদের? বিতর্ক না করে ধারাবাহিকভাবে ইতিহাসের দিকে তাকালেই এর জবাব মিলবে।

আজকে যারা পথভ্রষ্ট বা ইতিহাস মানছে না, ইতিহাস তাদের জন্য কী করেছে? কী করেছেন ইতিহাস লিখিয়েরা? দু-একটা টক শো আর কলাম লিখলেই দায়িত্ব শেষ? মনে রাখার মতো একটা কথা আছে, যেখানে বলা হয়েছে—রাজনীতি ও ভালোবাসার ভেতর মেটাফরিক মিল আছে।

তারুণ্য প্রেমে পড়ে সুন্দর মুখশ্রী দেখে, তারুণ্য পেরিয়ে যাওয়া মানুষ প্রেমে পড়ে শরীর দেখে, তরুণেরা রাজনীতি করে আদর্শ মনে রেখে আর বেশি বয়সের রাজনীতিক নেতারা দেখেন এমপি বা মন্ত্রিত্ব।

উধাও আদর্শের দেশ বা সমাজে কেন তারুণ্য ভালো দিকে পা বাড়াবে? কেন তারা রাজাকারি আদর্শ ধারণ করবে না? যারা চাইলে আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধকে সার্থক সর্বজনীন করতে পারতেন, তাঁরা হয় অদৃশ্যে, নয়তো কোণঠাসা। তাঁদের কাজ তাঁরা করতে পারেননি বা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। কদিন আগেই ভারতের স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপিত হলো।

সুদূর সিডনি শহরে ভারতীয় জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপন এখনো চলছে। নাচ, গান, আনন্দ এসব আছে, সঙ্গে আছে তাঁদের আন্তরিক আতিথেয়তা। দেখে মুগ্ধ হয়েছি ভারতীয় রেস্তোরাঁগুলোতে পতপত করে উড়ছে তাঁদের জাতীয় পতাকা। মানুষকে ডেকে ডেকে বিনা মূল্যে ভরপেট খাওয়াচ্ছিলেন তাঁরা। উদ্দেশ্য? ব্যবসা নয়, স্বাধীনতা ও ভারতীয়ত্বের প্রচার।

পাকিস্তানিরাও তাঁদের স্বাধীনতা দিবস পালনে তৎপর। আমাদের জাতি ২৬ মার্চের ঘরোয়া অনুষ্ঠান ছাড়া এখন পর্যন্ত আর কিছুই করেনি। আজ এ কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি—জাতীয় দিবসগুলোর ভেতর বাংলা নববর্ষ আর একুশে যেভাবে পালন করা হয়, ২৬ মার্চ আর বিজয় দিবস ঠিক সেভাবেই অবহেলিত। যেকোনো কারণেই হোক, এটা সত্য আর এর মূল্য আমরা চুকাচ্ছি। ৭০ বছর পর আমাদের স্বাধীনতা ও ইতিহাস কেমন হবে তার কোনো ধারণাও করা যায় না এখন।

যেকোনো দিবস আজ বিতর্কিত। রাজনীতির কঠিন কথা থাক। এটা তো মানতে হবে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই আগলে রেখেছেন সবকিছু। তিনি আছেন বলেই আমাদের বাংলাদেশ উন্নতির পথে। তাঁর প্রজ্ঞা আর বিবেকবোধে যে উন্নয়ন, তার সুফল কেন ঘরে তুলতে পারছে না তারা? এর কারণ জানা থাকলেও মানি না আমরা।

মানলে শেখ হাসিনার হাত শক্তিশালী করতে এগিয়ে আসত তারুণ্য। তারা তাঁকে পছন্দ করলেও এ কাজ করতে আসে না। কারণ সাংগঠনিকভাবে এসব কাজ করার মানুষ নেই। আখের গোছানোর রাজনীতি সংগঠনকে একা করে ফেললে যা হয়, তা-ই হচ্ছে। এখন যেটা দেখছি, দেশের বাইরের তারুণ্যও আজ বিভ্রান্ত।

তাদের হাতেই আমাদের ভবিষ্যৎ। তাদের যদি এখনই আমরা পথে আনতে না পারি, আমাদের কী হবে কে জানে? দেশের ইতিহাসে নানা ধরনের বিভ্রান্তি থাকায় গ্রেনেড হামলার মতো বর্বরোচিত ঘটনাও সবাই স্বীকার করে না।

আবারও বলি, আমরা যারা দেশের বাইরে উন্নত নামে পরিচিত গণতান্ত্রিক দেশে বসবাস করি, আমাদের চোখের সামনেই আছে খোলা পথ। যে পথ ধরে হাঁটছে আগামীর যুবসমাজ। দূর থেকে মনে হয় তারা রাজনীতি করে না। ঠিক, কিন্তু রাজনীতি বোঝে, জানেও। প্রতিবার ভোট এগিয়ে এলে তাদের সঙ্গে কথা বললে টের পাই, তারা রাজনীতি ও অর্থনীতির সমীকরণ কতটা ভালো বোঝে।

সে কারণেই গণতন্ত্র ব্যাহত হয় না। তরতর করে এগিয়ে চলে মুক্ত সমাজ। আসল কথা এটাই, অবরুদ্ধ আর সীমাবদ্ধ কোনো জাতিসত্তা এগোতে পারে না। তার গ্রহণ-বর্জনের শক্তি যখন কমে আসে, তখনই তার বুকে তাণ্ডব আর আঘাত এসে হানা দেয়। আজ সে অবস্থাই ভোগ করছে প্রিয় স্বদেশ।

সম্ভাবনাময় দেশের জন্য এটা ভালো কিছু নয়। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার সুফলভোগকারী নতুন প্রজন্মের মনের অন্ধত্ব বা আমাদের চেতনার সঙ্গে যে ব্যবধান, তা ঘোচাতে হবে।

তারুণ্যের স্বভাবধর্ম কী? তারা প্রেমে পড়বে, কাঁদবে, হাসবে, সুস্থ জীবনে থাকবে। তার বাইরে যেকোনো বিষয়ে বাড়াবাড়ি মানেই নিজেদের ভবিষ্যৎ ঘোলাটে করে তোলা। যে দেশ আপন শক্তি ও পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে অগ্রসরমাণ, তার সঙ্গে চলতে হবে তাদের। তাদের মনে রাখা উচিত, কোনো আবেগ, অন্ধ ভক্তি আর দূরদেশের উসকানি দিয়ে দেশ চলতে পারে না।

এই দেশ তাদেরই চালাতে হবে। সে জন্য তাদের মনে বিশ্বাস আর শক্তি জাগানো জরুরি। কীভাবে? মিডিয়ানির্ভর হিরোদের জায়গায় আনতে হবে আসল হিরোদের। তারা সামনে এলেই বিভ্রান্তি দূর হবে। যে ইতিহাসে রুমী, জামি বা মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জ্বলতা, তাকে এত সহজে পরাস্ত হতে দেওয়া যায়? আমরা পারি এবং পারব। দেশ-বিদেশের প্রগতিশীল বাংলাদেশি জনগোষ্ঠী এক হলেই কাজ হবে।

কারণ দেশটা কেবল অন্ধদের নয়। চোখ থাকতে অন্ধদের জমানা দূর হোক। জাগুক তারুণ্য।

লেখক: অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী কলামিস্ট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত