প্রয়াণ দিবস
নজরুলের মূল শক্তি ছিল তাঁর গতি এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। কোমলে-কঠোরে গড়া ছিল তাঁর জীবন। তাই প্রেমের কবিতা, সাম্যের কবিতা, ইসলামি কবিতা কিংবা শ্যামা সংগীত, কোনোখানেই তিনি স্থির হয়ে দাঁড়াননি। যা কিছু সুন্দর, তার প্রতি আস্থা রেখেছেন আজীবন।
জাহীদ রেজা নূর
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বর্তমানে যে স্থূল বিতর্ক শুরু করেছে একদল লোক, তাদের হাত থেকে নজরুল বেঁচে গেছেন স্রেফ তাঁর নামটি মুসলিম বলে। নজরুল তাঁর জীবদ্দশায় যে পথটি অতিক্রম করেছেন, তার পুরোটাই মানবতার রঙে রাঙানো। হিন্দু-মুসলিম দুই দিক থেকেই কটুকাটব্যে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন নজরুল। এ নিয়ে তাঁর আক্ষেপ দেখা যাবে ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতায়। এই কবিতাটিই যেন নজরুল-জীবনের সংক্ষিপ্তসার। কত দিক থেকেই-না তাঁকে আক্রমণ চালানো হয়েছে! তারই উত্তর কাব্যিক ভাষায় উপস্থাপিত হয়েছে কবিতাটিতে। ধর্মের নামে, রাজনীতির নামে যে কুরুচিপূর্ণ প্রচার চালানো হয়, তার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। তাই তাঁকে নিয়ে টানাটানি করতে গিয়ে বিপদে পড়ে যায় মতলববাজের দল। নিজের পছন্দমতো নজরুলকে ব্যবহার করতে গিয়ে তারা আবিষ্কার করে, আদতে নজরুল তাদের সীমিত গণ্ডিতে আবদ্ধ নন। নজরুল অনেক বড়। নজরুল দিয়েই ঘায়েল করা যায় সংকীর্ণতার স্তবকারীদের।
স্বল্প পরিসরে নজরুলকে নিয়ে লিখতে যাওয়ার বিপদ আছে। তাঁর ভাবনার জগৎটি খুবই পরিষ্কার। কোনো এক জায়গায় নোঙর ফেলেননি তিনি। যখন যা মনে হয়েছে দরকারি, তখন তা নিয়েই কথা বলেছেন। বুঁদ হয়ে গান লিখেছেন, কবিতা লিখেছেন, সাংবাদিকতা করেছেন, রাজনীতিতে জড়িয়েছেন, প্রেম করেছেন, আড্ডা দিয়েছেন, আরও কত-কী। মৌনতার আগপর্যন্ত তাঁর মতো গতিশীল ও বর্ণাঢ্য জীবন কজন মানুষ পায়?
২.
কোনো ধরনের সংকীর্ণ ট্যাগ দিয়ে নজরুলকে আটকানো যাবে না। বিশেষ করে যাঁরা ধর্মান্ধ হয়ে নজরুলকে ব্যবহার করতে চান, তাঁদের বিপদেই ফেলেছেন নজরুল। হামদ-নাত নিয়ে যিনি গর্ব করবেন, তিনি ভাবতেই পারবেন না, কত সুন্দর শ্যামাসংগীত লিখেছেন নজরুল। শিল্পে-কাব্যে ধর্মীয় সংকীর্ণতার স্থান নেই, সে কথা নজরুল বুঝতেন। সৃষ্টিশীল মানুষ সেভাবেই লেখালেখি করেন। তাই সকল ধর্মের মানুষকেই শ্রদ্ধা করার বাণী রয়েছে নজরুলের রচনায়। ধর্ম নিয়ে যেকোনো ধরনের বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধেই সোচ্চার ছিলেন নজরুল।
মূলত ঘুরেফিরে তাঁর কয়েকটি কবিতাই এ রকম আলোচনায় আনা হয়। নিজের দিকে ঝোল টেনে নেওয়ার জন্য কেউ কেউ কবিতাগুলোকে ব্যবহার করতে যান বটে, কিন্তু জীবনের পথপরিক্রমায় দেখা যায়, সব ধর্মের সব মানুষেরই অধিকার রয়েছে নজরুলের প্রতি।
৩.
কলকাতার অ্যালবার্ট হলে বাংলার হিন্দু-মুসলমানদের পক্ষ থেকে কবি নজরুলকে ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর (১৩৩৬ বঙ্গাব্দের ১৯ অগ্রহায়ণ) যে সংবর্ধনা দেওয়া হয়, তাতে সভাপতি ছিলেন বিজ্ঞানাচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। তাঁর অভিভাষণের পর ‘নজরুল-সংবর্ধনা সমিতি’র সভাপতির সভ্যদের দেওয়া মানপত্রটি পাঠ করেন এস ওয়াজেদ আলি। অভিনন্দনের উত্তরে কবি কাজী নজরুল ইসলাম যে প্রতিভাষণ দেন, তার কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হলো: ‘কেউ বলেন, আমি যবন, কেউ বলেন, কাফের। আমি বলি ও দুটোর কিছুই নই। আমি মাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি। গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি। সে হাতে হাত মিলানো যদি হাতাহাতির চেয়েও অশোভন হয়ে থাকে, তাহলে ওরা আপনি আলাদা হয়ে যাবে, আমার গাঁটছড়ার বাঁধন কাটতে তাদের কোনো বেগ পেতে হবে না। কেননা, একজনের হাতে আছে লাঠি, আর একজনের আস্তিনে আছে ছুরি।’
কবি এই ভাষণ দেওয়ার পর নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু নজরুলের স্বদেশি সংগীত ও দেশাত্মবোধমূলক কবিতার প্রশংসা করে আবেগময় এক ভাষণ দেন।
বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত নজরুল রচনাবলীর অষ্টম খণ্ডে নজরুলের যে অভিভাষণগুলো রয়েছে, সেদিকে আরও নিবিষ্ট মনোযোগ দেওয়া জরুরি। মুসলিমদের গোঁড়ামি নিয়ে নজরুল যে কথাগুলো বলেছেন, তা কি এখনো কম প্রাসঙ্গিক? শোনা যাক তেমন একটি রচনার অংশ, ‘আমাদের বাঙালি মুসলিমদের মধ্যে যে গোঁড়ামি, যে কুসংস্কার, তাহা পৃথিবীর আর কোনো দেশে কোনো মুসলমানের মধ্যে নাই বলিলে বোধ হয় অত্যুক্তি হইবে না। আমাদের দেশের কল্যাণকামী যেসব মওলানা সাহেবান খাল কাটিয়া বেনোজল আনিয়াছিলেন, তাহারা যদি ভবিষ্যৎদর্শী হইতেন, তাহা হইলে দেখিতে পাইতেন—বেনোজলের সাথে সাথে ঘরের পুকুরের জলও সব বাহির হইয়া গিয়াছে। উপরন্তু সেই খাল বাহিয়া কুসংস্কারের অজস্র কুমির আসিয়া ভিড় করিয়াছে। মওলানা মৌলবি সাহেবদের সওয়া যায়, মোল্লাকেও চক্ষু-কর্ণ বুঁজিয়া সহিতে পারি, কিন্তু কাঠমোল্লার অত্যাচার অসহ্য হইয়া উঠিয়াছে, ইসলামের কল্যাণের নামে ইহারা যে কওমের, জাতির, ধর্মের কী অনিষ্ট করিতেছেন, তাহা বুঝিবার মতো জ্ঞান নাই বলিয়াই ইহাদের ক্ষমা করা যায়।’
আমাদের প্রবহমান সংস্কৃতিতে স্থিত হওয়া সব ধরনের মিথই ব্যবহার করেছেন নজরুল। ধর্মের কুসংস্কারগুলোকেই তিনি আঘাত করেছেন, নিজের মত প্রকাশ করার জন্য তিনি নির্দিষ্ট কোনো ধর্ম বেছে নেননি। যেখানেই দেখেছেন স্থবিরতা, সেখানেই আঘাত করেছেন।
আমাদের দেশে হিন্দু-মুসলিম বিরোধ নিয়ে চাছাছোলাভাবে তিনি বলেছেন, ‘এক দেশের জলে-বায়ুতে ফলে-ফসলে, এক মায়ের স্তন্যে পুষ্ট হিন্দু-মুসলমানে যে কদর্য বিরোধের সৃষ্টি হইয়াছে, তাহাতে সভ্যজগতে আমাদের সভ্য বলিয়া পরিচয় দিবার আর মুখ নাই। জননায়ক হইবার নেশায় হিন্দু-মুসলমান নেতাগণ আজ জনসাধারণকে কেবলই ধর্মের নামে উগ্র মদ পান করাইয়া করাইয়া মাতাল করিয়া তুলিয়াছেন। এই অশিক্ষিত হতভাগ্যদের জীবন হইয়া উঠিয়াছে ইহাদের হাতের ক্রীড়নক।’
৪.
‘মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান, মুসলিম তার নয়নমণি, হিন্দু তাহার প্রাণ’। এই হলো আসল নজরুল। ধর্ম দিয়ে বিভাজিত না করে বরং মিলনের পথে এগিয়ে আসার এই আর্তি নজরুলের সব সময়ই ছিল। ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতার ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন? কাণ্ডারী বল ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা’র।—এ রকম উচ্চারণ বাংলা সাহিত্যে বিরল। উগ্র হিন্দু এবং উগ্র মুসলমান নজরুলের নামে কুৎসা রটিয়ে গেছে। তাঁকে নিয়ে রসিকতা, ব্যঙ্গ করেছে। নজরুলের অসাধারণ সৃষ্টি ‘বিদ্রোহী’ কবিতা নিয়ে রক্ষণশীল মানুষ নজরুলকে আঘাত করেছে।
নজরুল আজীবন অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। ব্রিটিশ ভারতে সমাজের বিভিন্ন অংশে হিন্দুরা ছিল অগ্রগামী। হিন্দু জাতীয়তাবাদ যখন ভিত্তি পাচ্ছিল, তখন তা মুসলিমদেরকে হেয় করেছে। মুসলমানরা হিন্দুদের কাছে ‘ম্লেচ্ছ’, ‘যবন’ ইত্যাদি নামে পরিচিত ছিল। অন্যদিকে মুসলমানরাও নজরুলের ধার ও ভার সহ্য করতে পারেনি। তাঁকে ‘ইসলামের শত্রু’, ‘কাফের’, ‘শয়তান’ নামেও ডাকা হয়েছে। মুনসী মোহাম্মদ রেয়াজউদ্দীন আহমেদ ‘ইসলাম দর্শন’ পত্রিকায় ‘লোকটা মুসলমান না শয়তান’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘নরাধম ইসলাম ধর্মের মানে জানে কি? খোদাদ্রোহী নরাধম শয়তানের পূর্ণাবতার। এমন অনেক পাপীই পৃথিবীতে জন্মিয়াছে এবং শেষটা নিকৃষ্ট জীবের মতো স্বীয় পাগলামির অবসান করিয়াছে। খাঁটি ইসলামী আমলদারী থাকিলে এই ফেরাউন নজরুলকে শূলবিদ্ধ করা হইত কিংবা উহার মুণ্ডুপাত করা হইত নিশ্চয়।’
ভাগ্যিস সমাজে সে রকম কিছু বিরাজ করছিল না, নইলে পূর্ণ বিকাশের আগেই নজরুলকে শূলে চড়তে হতো, নইলে তাঁর শিরশ্ছেদ ঘটে যেত!
যে ব্যঙ্গাত্মক কবিতার কথা বলেছিলাম, সেটি এখানে উদ্ধৃত করছি। কোনো সন্দেহ নেই, ‘বিদ্রোহী’ কবিতা আজও তার স্বমহিমায় ভাস্বর। কিন্তু তৎকালীন সমাজ এই কবিতাকেও আক্রমণ করেছে। কবি গোলাম মোস্তফা ‘বিদ্রোহী’র আদলে লেখেন ‘নিয়ন্ত্রিত’ নামে কবিতা। তাঁর কয়েকটি পঙ্ক্তি এ রকম,
‘ওগো বিদ্রোহী বীর/সংযত কর সংহত কর উন্নত তব শির/বাঁধন কারার মাঝারে দাঁড়ায়ে/খালি দুটি হাত ঊর্ধ্বে বাড়ায়ে/তুই যদি ভাই বলিস চেঁচিয়ে—উন্নত মম শির/আমি বিদ্রোহী বীর/সে শুধু প্রলাপ, শুধুই খেয়াল, নাই নাই তার কোনো গুণ/শুনে স্তম্ভিত হবে নমরুদ আর ফেরাউন। শুনো শিহরি উঠিবে শয়তান/হবে নাকো সে-ও সঙ্গের সাথী গাবে নাকো তোর জয়গান।’
আর সজনীকান্ত দাস তো ব্যঙ্গ করে কাজী নজরুল ইসলামের নামই দিয়েছিলেন ‘গাজী আব্বাস বিটকেল’। তিনি লিখলেন, ‘ওরে ভাই গাজীরে/কোথা তুই আজিরে/কোথা তোর রসময়ী জ্বালাময়ী কবিতা/, কোথা গিয়ে নিরিবিলি/ঝোপে ঝাড়ে ডুব দিলি/তুই যেরে কাব্যগ্রন্থের সবিতা।/দাবানল বীণা আর/শহরের বাঁশীতে/শান্ত এ দেশে ঝড় একলাই তুললি/পুষ্পকে দোলা দিয়া/মজালি দোল পিয়া/ব্যথার দানেতে কত হৃদি দ্বার খুললি।’ কেউ একটু গভীরভাবে দেখলে বুঝতে পারবেন, এখানে নজরুলের অগ্নিবীণা, বিশের বাঁশী আর ব্যথার দান গ্রন্থগুলোর প্রতি বিদ্বেষমূলক উক্তি করা হয়েছে।
৫.
নজরুলের মূল শক্তি ছিল তাঁর গতি এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। কোমলে-কঠোরে গড়া ছিল তাঁর জীবন। তাই প্রেমের কবিতা, সাম্যের কবিতা, ইসলামি কবিতা কিংবা শ্যামা সংগীত, কোনোখানেই তিনি স্থির হয়ে দাঁড়াননি। যা কিছু সুন্দর, তার প্রতি আস্থা রেখেছেন আজীবন।
এই নজরুলকে জীবনে প্রাসঙ্গিক করে তুলতে পারলেই তাঁকে ঠিকভাবে পাওয়া যাবে। নইলে আলাদাভাবে দেখতে গিয়ে অন্ধের হাতি দর্শনের মতো ঘটনার জন্ম হবে, তাতে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকবেন তিনি। শুরুতেই বলেছিলাম, মুসলিম নামটাই রক্ষণশীলদের অনেক আক্রমণ থেকে নজরুলকে অনেকটা বাঁচিয়ে দিয়েছে, কিন্তু তাঁকে পেতে হলে নামটাই যথেষ্ট নয়, মানুষটার উচ্চতা আরও অনেক অনেক বেশি।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বর্তমানে যে স্থূল বিতর্ক শুরু করেছে একদল লোক, তাদের হাত থেকে নজরুল বেঁচে গেছেন স্রেফ তাঁর নামটি মুসলিম বলে। নজরুল তাঁর জীবদ্দশায় যে পথটি অতিক্রম করেছেন, তার পুরোটাই মানবতার রঙে রাঙানো। হিন্দু-মুসলিম দুই দিক থেকেই কটুকাটব্যে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন নজরুল। এ নিয়ে তাঁর আক্ষেপ দেখা যাবে ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতায়। এই কবিতাটিই যেন নজরুল-জীবনের সংক্ষিপ্তসার। কত দিক থেকেই-না তাঁকে আক্রমণ চালানো হয়েছে! তারই উত্তর কাব্যিক ভাষায় উপস্থাপিত হয়েছে কবিতাটিতে। ধর্মের নামে, রাজনীতির নামে যে কুরুচিপূর্ণ প্রচার চালানো হয়, তার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। তাই তাঁকে নিয়ে টানাটানি করতে গিয়ে বিপদে পড়ে যায় মতলববাজের দল। নিজের পছন্দমতো নজরুলকে ব্যবহার করতে গিয়ে তারা আবিষ্কার করে, আদতে নজরুল তাদের সীমিত গণ্ডিতে আবদ্ধ নন। নজরুল অনেক বড়। নজরুল দিয়েই ঘায়েল করা যায় সংকীর্ণতার স্তবকারীদের।
স্বল্প পরিসরে নজরুলকে নিয়ে লিখতে যাওয়ার বিপদ আছে। তাঁর ভাবনার জগৎটি খুবই পরিষ্কার। কোনো এক জায়গায় নোঙর ফেলেননি তিনি। যখন যা মনে হয়েছে দরকারি, তখন তা নিয়েই কথা বলেছেন। বুঁদ হয়ে গান লিখেছেন, কবিতা লিখেছেন, সাংবাদিকতা করেছেন, রাজনীতিতে জড়িয়েছেন, প্রেম করেছেন, আড্ডা দিয়েছেন, আরও কত-কী। মৌনতার আগপর্যন্ত তাঁর মতো গতিশীল ও বর্ণাঢ্য জীবন কজন মানুষ পায়?
২.
কোনো ধরনের সংকীর্ণ ট্যাগ দিয়ে নজরুলকে আটকানো যাবে না। বিশেষ করে যাঁরা ধর্মান্ধ হয়ে নজরুলকে ব্যবহার করতে চান, তাঁদের বিপদেই ফেলেছেন নজরুল। হামদ-নাত নিয়ে যিনি গর্ব করবেন, তিনি ভাবতেই পারবেন না, কত সুন্দর শ্যামাসংগীত লিখেছেন নজরুল। শিল্পে-কাব্যে ধর্মীয় সংকীর্ণতার স্থান নেই, সে কথা নজরুল বুঝতেন। সৃষ্টিশীল মানুষ সেভাবেই লেখালেখি করেন। তাই সকল ধর্মের মানুষকেই শ্রদ্ধা করার বাণী রয়েছে নজরুলের রচনায়। ধর্ম নিয়ে যেকোনো ধরনের বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধেই সোচ্চার ছিলেন নজরুল।
মূলত ঘুরেফিরে তাঁর কয়েকটি কবিতাই এ রকম আলোচনায় আনা হয়। নিজের দিকে ঝোল টেনে নেওয়ার জন্য কেউ কেউ কবিতাগুলোকে ব্যবহার করতে যান বটে, কিন্তু জীবনের পথপরিক্রমায় দেখা যায়, সব ধর্মের সব মানুষেরই অধিকার রয়েছে নজরুলের প্রতি।
৩.
কলকাতার অ্যালবার্ট হলে বাংলার হিন্দু-মুসলমানদের পক্ষ থেকে কবি নজরুলকে ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর (১৩৩৬ বঙ্গাব্দের ১৯ অগ্রহায়ণ) যে সংবর্ধনা দেওয়া হয়, তাতে সভাপতি ছিলেন বিজ্ঞানাচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। তাঁর অভিভাষণের পর ‘নজরুল-সংবর্ধনা সমিতি’র সভাপতির সভ্যদের দেওয়া মানপত্রটি পাঠ করেন এস ওয়াজেদ আলি। অভিনন্দনের উত্তরে কবি কাজী নজরুল ইসলাম যে প্রতিভাষণ দেন, তার কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হলো: ‘কেউ বলেন, আমি যবন, কেউ বলেন, কাফের। আমি বলি ও দুটোর কিছুই নই। আমি মাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি। গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি। সে হাতে হাত মিলানো যদি হাতাহাতির চেয়েও অশোভন হয়ে থাকে, তাহলে ওরা আপনি আলাদা হয়ে যাবে, আমার গাঁটছড়ার বাঁধন কাটতে তাদের কোনো বেগ পেতে হবে না। কেননা, একজনের হাতে আছে লাঠি, আর একজনের আস্তিনে আছে ছুরি।’
কবি এই ভাষণ দেওয়ার পর নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু নজরুলের স্বদেশি সংগীত ও দেশাত্মবোধমূলক কবিতার প্রশংসা করে আবেগময় এক ভাষণ দেন।
বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত নজরুল রচনাবলীর অষ্টম খণ্ডে নজরুলের যে অভিভাষণগুলো রয়েছে, সেদিকে আরও নিবিষ্ট মনোযোগ দেওয়া জরুরি। মুসলিমদের গোঁড়ামি নিয়ে নজরুল যে কথাগুলো বলেছেন, তা কি এখনো কম প্রাসঙ্গিক? শোনা যাক তেমন একটি রচনার অংশ, ‘আমাদের বাঙালি মুসলিমদের মধ্যে যে গোঁড়ামি, যে কুসংস্কার, তাহা পৃথিবীর আর কোনো দেশে কোনো মুসলমানের মধ্যে নাই বলিলে বোধ হয় অত্যুক্তি হইবে না। আমাদের দেশের কল্যাণকামী যেসব মওলানা সাহেবান খাল কাটিয়া বেনোজল আনিয়াছিলেন, তাহারা যদি ভবিষ্যৎদর্শী হইতেন, তাহা হইলে দেখিতে পাইতেন—বেনোজলের সাথে সাথে ঘরের পুকুরের জলও সব বাহির হইয়া গিয়াছে। উপরন্তু সেই খাল বাহিয়া কুসংস্কারের অজস্র কুমির আসিয়া ভিড় করিয়াছে। মওলানা মৌলবি সাহেবদের সওয়া যায়, মোল্লাকেও চক্ষু-কর্ণ বুঁজিয়া সহিতে পারি, কিন্তু কাঠমোল্লার অত্যাচার অসহ্য হইয়া উঠিয়াছে, ইসলামের কল্যাণের নামে ইহারা যে কওমের, জাতির, ধর্মের কী অনিষ্ট করিতেছেন, তাহা বুঝিবার মতো জ্ঞান নাই বলিয়াই ইহাদের ক্ষমা করা যায়।’
আমাদের প্রবহমান সংস্কৃতিতে স্থিত হওয়া সব ধরনের মিথই ব্যবহার করেছেন নজরুল। ধর্মের কুসংস্কারগুলোকেই তিনি আঘাত করেছেন, নিজের মত প্রকাশ করার জন্য তিনি নির্দিষ্ট কোনো ধর্ম বেছে নেননি। যেখানেই দেখেছেন স্থবিরতা, সেখানেই আঘাত করেছেন।
আমাদের দেশে হিন্দু-মুসলিম বিরোধ নিয়ে চাছাছোলাভাবে তিনি বলেছেন, ‘এক দেশের জলে-বায়ুতে ফলে-ফসলে, এক মায়ের স্তন্যে পুষ্ট হিন্দু-মুসলমানে যে কদর্য বিরোধের সৃষ্টি হইয়াছে, তাহাতে সভ্যজগতে আমাদের সভ্য বলিয়া পরিচয় দিবার আর মুখ নাই। জননায়ক হইবার নেশায় হিন্দু-মুসলমান নেতাগণ আজ জনসাধারণকে কেবলই ধর্মের নামে উগ্র মদ পান করাইয়া করাইয়া মাতাল করিয়া তুলিয়াছেন। এই অশিক্ষিত হতভাগ্যদের জীবন হইয়া উঠিয়াছে ইহাদের হাতের ক্রীড়নক।’
৪.
‘মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান, মুসলিম তার নয়নমণি, হিন্দু তাহার প্রাণ’। এই হলো আসল নজরুল। ধর্ম দিয়ে বিভাজিত না করে বরং মিলনের পথে এগিয়ে আসার এই আর্তি নজরুলের সব সময়ই ছিল। ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতার ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন? কাণ্ডারী বল ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা’র।—এ রকম উচ্চারণ বাংলা সাহিত্যে বিরল। উগ্র হিন্দু এবং উগ্র মুসলমান নজরুলের নামে কুৎসা রটিয়ে গেছে। তাঁকে নিয়ে রসিকতা, ব্যঙ্গ করেছে। নজরুলের অসাধারণ সৃষ্টি ‘বিদ্রোহী’ কবিতা নিয়ে রক্ষণশীল মানুষ নজরুলকে আঘাত করেছে।
নজরুল আজীবন অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। ব্রিটিশ ভারতে সমাজের বিভিন্ন অংশে হিন্দুরা ছিল অগ্রগামী। হিন্দু জাতীয়তাবাদ যখন ভিত্তি পাচ্ছিল, তখন তা মুসলিমদেরকে হেয় করেছে। মুসলমানরা হিন্দুদের কাছে ‘ম্লেচ্ছ’, ‘যবন’ ইত্যাদি নামে পরিচিত ছিল। অন্যদিকে মুসলমানরাও নজরুলের ধার ও ভার সহ্য করতে পারেনি। তাঁকে ‘ইসলামের শত্রু’, ‘কাফের’, ‘শয়তান’ নামেও ডাকা হয়েছে। মুনসী মোহাম্মদ রেয়াজউদ্দীন আহমেদ ‘ইসলাম দর্শন’ পত্রিকায় ‘লোকটা মুসলমান না শয়তান’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘নরাধম ইসলাম ধর্মের মানে জানে কি? খোদাদ্রোহী নরাধম শয়তানের পূর্ণাবতার। এমন অনেক পাপীই পৃথিবীতে জন্মিয়াছে এবং শেষটা নিকৃষ্ট জীবের মতো স্বীয় পাগলামির অবসান করিয়াছে। খাঁটি ইসলামী আমলদারী থাকিলে এই ফেরাউন নজরুলকে শূলবিদ্ধ করা হইত কিংবা উহার মুণ্ডুপাত করা হইত নিশ্চয়।’
ভাগ্যিস সমাজে সে রকম কিছু বিরাজ করছিল না, নইলে পূর্ণ বিকাশের আগেই নজরুলকে শূলে চড়তে হতো, নইলে তাঁর শিরশ্ছেদ ঘটে যেত!
যে ব্যঙ্গাত্মক কবিতার কথা বলেছিলাম, সেটি এখানে উদ্ধৃত করছি। কোনো সন্দেহ নেই, ‘বিদ্রোহী’ কবিতা আজও তার স্বমহিমায় ভাস্বর। কিন্তু তৎকালীন সমাজ এই কবিতাকেও আক্রমণ করেছে। কবি গোলাম মোস্তফা ‘বিদ্রোহী’র আদলে লেখেন ‘নিয়ন্ত্রিত’ নামে কবিতা। তাঁর কয়েকটি পঙ্ক্তি এ রকম,
‘ওগো বিদ্রোহী বীর/সংযত কর সংহত কর উন্নত তব শির/বাঁধন কারার মাঝারে দাঁড়ায়ে/খালি দুটি হাত ঊর্ধ্বে বাড়ায়ে/তুই যদি ভাই বলিস চেঁচিয়ে—উন্নত মম শির/আমি বিদ্রোহী বীর/সে শুধু প্রলাপ, শুধুই খেয়াল, নাই নাই তার কোনো গুণ/শুনে স্তম্ভিত হবে নমরুদ আর ফেরাউন। শুনো শিহরি উঠিবে শয়তান/হবে নাকো সে-ও সঙ্গের সাথী গাবে নাকো তোর জয়গান।’
আর সজনীকান্ত দাস তো ব্যঙ্গ করে কাজী নজরুল ইসলামের নামই দিয়েছিলেন ‘গাজী আব্বাস বিটকেল’। তিনি লিখলেন, ‘ওরে ভাই গাজীরে/কোথা তুই আজিরে/কোথা তোর রসময়ী জ্বালাময়ী কবিতা/, কোথা গিয়ে নিরিবিলি/ঝোপে ঝাড়ে ডুব দিলি/তুই যেরে কাব্যগ্রন্থের সবিতা।/দাবানল বীণা আর/শহরের বাঁশীতে/শান্ত এ দেশে ঝড় একলাই তুললি/পুষ্পকে দোলা দিয়া/মজালি দোল পিয়া/ব্যথার দানেতে কত হৃদি দ্বার খুললি।’ কেউ একটু গভীরভাবে দেখলে বুঝতে পারবেন, এখানে নজরুলের অগ্নিবীণা, বিশের বাঁশী আর ব্যথার দান গ্রন্থগুলোর প্রতি বিদ্বেষমূলক উক্তি করা হয়েছে।
৫.
নজরুলের মূল শক্তি ছিল তাঁর গতি এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। কোমলে-কঠোরে গড়া ছিল তাঁর জীবন। তাই প্রেমের কবিতা, সাম্যের কবিতা, ইসলামি কবিতা কিংবা শ্যামা সংগীত, কোনোখানেই তিনি স্থির হয়ে দাঁড়াননি। যা কিছু সুন্দর, তার প্রতি আস্থা রেখেছেন আজীবন।
এই নজরুলকে জীবনে প্রাসঙ্গিক করে তুলতে পারলেই তাঁকে ঠিকভাবে পাওয়া যাবে। নইলে আলাদাভাবে দেখতে গিয়ে অন্ধের হাতি দর্শনের মতো ঘটনার জন্ম হবে, তাতে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকবেন তিনি। শুরুতেই বলেছিলাম, মুসলিম নামটাই রক্ষণশীলদের অনেক আক্রমণ থেকে নজরুলকে অনেকটা বাঁচিয়ে দিয়েছে, কিন্তু তাঁকে পেতে হলে নামটাই যথেষ্ট নয়, মানুষটার উচ্চতা আরও অনেক অনেক বেশি।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
হোয়াইট হাউসে সপ্তাহখানেক আগে গুরুত্বপূর্ণ এক বৈঠক করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বৈঠকে ছিলেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার, জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রেডেরিখ মার্জ, ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ, ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভনডার...
৬ ঘণ্টা আগেময়মনসিংহের তারাকান্দা এন ইসলামিয়া একাডেমি কলেজে একজন আয়াকে প্রভাষক ও নিয়মবহির্ভূতভাবে অফিস সহকারী নিয়োগ এবং একই প্রভাষককে দুই বিষয়ে নিয়োগ দেখিয়ে ২২ জনকে অবৈধভাবে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে অধ্যক্ষ মো. নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে। ঘটনাটি ঘটেছে গত বছরের...
৬ ঘণ্টা আগে২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য কৃষি ও পল্লিঋণের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর ১২ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘কৃষিঋণের সবটাই কৃষকের কাছে পৌঁছায় কি না, বাংলাদেশ ব্যাংক তা পর্যালোচনা করছে। আমরা চাই, শতভাগ কৃষিঋণ কৃষকের কাছে যাক। দালালের কাছে যেন না যায়।
১ দিন আগেকিছুদিন আগে ভোলাগঞ্জের পাথর নিয়ে সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে—পাথর অপসারণ করা হয়েছে। দৃষ্টিনন্দন সাদাপাথর, যেখানে পর্যটকেরা এই পাথর দেখার টানে ভ্রমণে যেতেন। পাথর সরানোর পরে সেখানে গেলে দেখতে পাবেন মাটি ও বালুর বিছানা পাতা। যা হোক, প্রশাসনের উদ্যোগ ও সচেতন জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে বিষয়টি, পাথর আবার
১ দিন আগে