গৌতম ভদ্র

তরবো (অ) পি হি জীবন্তি জীবন্তি মৃগপক্ষিণঃ।
স জীবতি মনো যস্য মননেন হি জীবতি।।
—যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণ
১
১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে অবিভক্ত বঙ্গের বাখরগঞ্জ (বর্তমান বরিশাল বিভাগের ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলায় অবস্থিত) এলাকার সিদ্ধকাঠি গ্রামে গুহ-বকসীদের খাস তালুকদার বংশে রণজিৎ গুহর জন্ম। গ্রামের নামে অনুষঙ্গে জড়িত বৌদ্ধতন্ত্র, গ্রাম সমাজ একেবারে আধা-সামন্ততান্ত্রিক। তবে বংশে ঠাকুরদা পণ্ডিত ও শিক্ষক, বাবা পেশায় আইনজীবী। একশো বছর পরেই অস্ট্রিয়াবাসী, অথচ আদ্যন্ত বাঙালি বলে গর্বিত রণজিৎ গুহর স্মৃতিতে সেই কুলজি-চিহ্ন মুছে যায়নি। তাঁর সাম্প্রতিকতম রচনায় শৈশবের কালকেই তিনি তাঁর জীবনের সবচেয়ে ‘ফর্ম্যাটিভ পিরিয়ড’ বলেছেন। ‘বরিশালনামা’ তো নানা স্মরণীয় বাঙালের কথাকীর্তিতে সমুজ্জ্বল। কিন্তু রণজিৎ গুহর তুলনায় অন্য কারও জীবন, চরিত্র ও রচনা এত বিতর্কিত, এত রঙ্গিবিরঙ্গি নয়, দেশ-বিদেশে, ব্যক্তি ও সমূহের বহুধা সম্পর্কের টানাপড়েনে ছড়িয়ে পড়েনি। শতায়ুজীবীর প্রতি এই শ্রদ্ধার্ঘ্যটি তাঁর জীবনী নয়; তাঁর বিশাল চিন্তনকর্মের পর্যালোচনা দূর অস্ত্। এই নিবেদনটি কেবল এক অনন্য মেধাজীবীর অনুসন্ধিৎসার অভিমুখ, বাঁকবদল ও তাঁর ত্রি-পর্বী লেখালিখির পরিচয়ের রৈখিক খসড়ামাত্র।
সিদ্ধকাঠির এক খাটুলি পরিবারের নগা রণজিৎ গুহর শৈশব সুহৃদ, আবার ওই সব পরিবারের বয়স্করাই বাড়ির প্রজা, হয় দলিত, নয় মুসলমান। এই মনিব-প্রজা দ্বন্দ্বের (উভয়ার্থে) বোধটি যৌবনের ইতিহাসচর্চায় ও কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্যরূপে দেশ-বিদেশে কাজ করার অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হয়। তারই প্রকাশ দেখি ঔপনিবেশিক বাংলার প্রথম ভূমি আইন চিন্তার উপর তাঁর লেখা বোধি-উজ্জ্বল সন্দর্ভটিতে, যার নাম ‘আ রুল অব প্রপার্টি ফর বেঙ্গল: অ্যান এসে অন দি আইডিয়া অব পার্মানেন্ট সেটলমেন্ট’ (প্যারিস ১৯৬৩ /নিউ দিল্লি ১৯৮২)। নানা কায়েমি স্বার্থের বিরোধের কথা ও ধন লুট করার সরল ইতিবৃত্তের বাইরে তিনি দেখালেন কোম্পানির আমলাদের নানা তর্কের মধ্যে কীভাবে ফিজ়িয়োক্র্যাসি বা প্রাকৃত ধনবাদী ভূমিতত্ত্ব বাংলায় বিনিয়োগনিষ্ঠ, উন্নতিকামী অথচ বশংবদ ভূম্যধিকারী সম্প্রদায় গড়তে চেয়েছিল। অথচ বাস্তবে জন্ম নিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের খাজনাগৃধ্নু, নানা স্তরে বিভক্ত, জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগীর দল। উপনিবেশে প্রবুদ্ধ ইউরোপীয় জ্ঞানের এ-হেন আকারপ্রাপ্তিকে রণজিৎ গুহ বলেছেন ‘জ্ঞানতাত্ত্বিক বিপর্যাস’ বা ‘এপিস্টেমোলজিক্যাল ভায়োলেন্স’; তাঁর প্রাকৃত লব্জে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এক ‘ত্রিশঙ্কুর জগৎ’ তৈরি করল—উন্নতির ইচ্ছা ও জ্ঞানফল উল্টোমুখী হতে চলল। দ্বিতীয়ত, তাঁর সন্দর্ভে স্পষ্ট যে সাম্রাজ্যের যুগে জ্ঞানতত্ত্বের নির্মিতিতে ইউরোপীয় চিন্তাভাবনার জগৎ ও ঔপনিবেশিক শাসন থেকে পাওয়া জ্ঞানধারণা একেবারে জড়াপট্টি, ইতরেতর সম্বন্ধে আবদ্ধ। আজ এ কথাটা সবাই জানে ও মানে। কিন্তু সে দিন জ্ঞানতত্ত্বের এই ইতিহাসচিন্তার পথিকৃৎ ছিলেন রণজিৎ গুহই।
এই সন্দর্ভের অনুষঙ্গে লেখা হয়েছিল এক রাশ প্রবন্ধ, যেমন মেদিনীপুরের লবণ শিল্পে মলঙ্গী তথা লবণ উৎপাদকদের প্রতিরোধ আন্দোলনের বিশ্লেষণী ইতিবৃত্ত থেকে স্থানীয় আর্কাইভস ব্যবহার করে বর্ধমান জেলার আঞ্চলিক অর্থনৈতিক বিবরণী। স্বদেশের ইতিবৃত্তে ঔপনিবেশিক শাসনের অভিঘাতের আদি স্পন্দনগুলি রণজিৎ স্পর্শ করার চেষ্টা করেছিলেন। জ্ঞানতাত্ত্বিক আলোচনায় তিনি দৈশিক ও কালিক অভিজ্ঞতার সতত উপস্থিতিকে কোনও দিন ভোলেননি।
লিখনশৈলীর জন্য প্রশংসিত হলেও আ রুল অব প্রপার্টি প্রথাসম্মত ইতিহাস আলোচক ও দরবারি মার্ক্সবাদীদের কাছে আদৃত হয়নি। ঘটনার প্রবাহে ১৯৫৯-এ ইংল্যান্ডে ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্স-এ অধ্যাপনার কাজে রত হওয়ার পরও রণজিৎ গুহ থাকবন্দি ঔপনিবেশিক সমাজে শাসকের সর্বেশ্বরতার ক্ষমতাসীমা ও বিন্যাস নিয়ে ভাবনা থামাননি, সেই ভাবনাসূত্রে স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের গণতন্ত্রে চিন্তার পরিসরে ঔপনিবেশিকতার দায়ভারের সজীব অস্তিত্বকে দাগাতে শুরু করেছিলেন। ইতিহাস-চিন্তায় বাঁক নেওয়ার সেই প্রস্তুতি-পর্বের স্ফুরণ দেখা যায় ১৯৭০-এর দশকের ফ্রন্টিয়ার-এর মতো রাজনৈতিক পত্রিকায় লেখা তিনটি প্রবন্ধে। যেমন- উদারনৈতিক সংস্কারচিন্তা ও সদিচ্ছায় আবদ্ধ নীলদর্পণ-এর মতো নাটকে বিদ্রোহী চৈতন্যের ‘ভদ্রস্থ’ উপস্থাপনের সমালোচনা, গণতন্ত্রের সুভদ্র সংস্কৃতিতে নির্মম পুলিশি অত্যাচারের তীক্ষ্ণ ব্যাখ্যা আর জেলে আটক মেরি টাইটলার- এর দেখা ভারতীয় সমাজে জারিত সন্ত্রাসের বিবরণীর এক মর্মস্পর্শী বিশ্লেষণ।
১৯৭০-৭১ সালে গান্ধীর গণ-আন্দোলনের স্বরূপ-সন্ধানে গবেষণা করতে ভারতে এসে নকশালবাড়ির রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে তাঁর গবেষণার অভিমুখ পাল্টে গেল। সৃজনশীল ইতিহাসচর্চার দ্বিতীয় পর্বে তাঁর ক্রিয়াকর্ম দুটি শাখায় প্রসারিত হল। প্রথমত, কয়েক জন অতি-তরুণ গবেষককে জড়ো করে তিনি ‘নিম্নবর্গ ইতিহাসচর্চা’র ধারা প্রবর্তন করলেন। উদ্দেশ্য—ভারতে চালু আধুনিক ইতিহাসবিদ্যার আদিকল্পের বিরুদ্ধে নতুন এক আদিকল্পের অনুসন্ধান করা। ১৯৮০ সালে তাঁর বহুচর্চিত ও বিতর্কিত ইংরেজি ম্যানিফেস্টো ও বাংলা প্রবন্ধে বলা হল যে, আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চার কেন্দ্রে আছে রাষ্ট্রিকতা, সেই ইতিহাসবিদ্যা আসলে ‘বকলমে’ লেখা রাষ্ট্রশক্তির ইতিকথা, ইংরেজ শাসনজাত প্রগতি ও সভ্যতার পক্ষে নানা ধাঁচের বৃত্তান্ত। অন্য পক্ষে, সমালোচনাত্মক জাতীয়তাবাদী, এমনকি মার্ক্সবাদী ইতিহাসচর্চাও পর্যবসিত হয়েছে দেশজ উচ্চবর্গের আদর্শবাদের মহিমাগাথায় ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের সাফল্যের নান্দীপাঠে। এই দ্বিবিধ উচ্চবর্ণকেন্দ্রিক ইতিহাসচর্চায় নিম্নবর্গের ক্রিয়াকাণ্ডের বৃত্তান্ত যে গরহাজির, তা কিন্তু একদম নয়। কিন্তু সেই বৃত্তান্ত উচ্চবর্গীয় উদ্যোগ আখ্যানের অনুপর্ব মাত্র, কালু ডোমরা চিরকাল যেন প্রভুর জন্য প্রাণদান করে।
এই ধারণার বিরুদ্ধে ‘নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চা’র আদিকল্প ভারতীয় রাজনীতির জগৎকে দু’টি বর্গের রাজনীতিক্ষেত্রে বিভক্ত করল। দমনকারী ও দমিতের ক্ষমতার বৈপরীত্যের নানা সূত্র ধরে কর্ম ও মানসজগতে নিম্নবর্গের আনুগত্য, সহকারিতা ও প্রতিবাদের রূপগুলি তুলে ধরল। অবশ্যই উচ্চবর্গীয় ও নিম্নবর্গীয় রাজনীতি সময় বুঝে প্রতিচ্ছেদিত হতে পারে, ক্ষেত্রবিশেষে স্ব-উদ্যোগ আড়াআড়ি ও খাড়াখাড়ি সমাজের বেণিবন্ধন গড়তে পারে। সময় বুঝে ওই বন্ধনের গিঁটগুলি আলগা হয়, এমনকি খুলেও যায়। তবে দুই ক্ষেত্রের স্বাতন্ত্র্য অবশ্যধার্য। রণজিৎ গুহ প্রণোদিত ও বোধিত ‘নিম্নবর্গের চর্চা’ বলে নামাঙ্কিত নিবন্ধখণ্ডগুলিতে এই সতত সঞ্চারমাণ রাজনীতির কথন ও লেখনই তরুণ গবেষকরা সম্পন্ন করতে শুরু করলেন।
এই যৌথকর্মের সঙ্গে শ্লিষ্ট তাঁর লেখা বহুবিতর্কিত বই এলিমেন্টারি আসপেক্টস অব পেজ়্যান্ট ইনসার্জেন্সি ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়াতে (১৯৮৩) এল ভারতের কৃষক বিদ্রোহের মুহূর্তগুলি, আর তার তুলনাসূত্রে, ইউরোপের কৃষক বিদ্রোহ ও চিনের কৃষক বিদ্রোহের অভিজ্ঞতা। বিদ্রোহী চৈতন্যে জাত কর্মকাণ্ডের কাঠামোয় রণজিৎ গুহ নিম্নবর্গের প্রতিস্পর্ধী রাজনৈতিক ভাবনার সাধারণ লক্ষণগুলি চিহ্নিত করলেন। তাঁর মতে, এই চৈতন্যের সাধারণ রূপ-লক্ষণগুলি প্রকীর্ণ থাকে জীবনযাপনের নানা ক্রিয়ায়। এই রূপ-লক্ষণগুলির সংহত ও জ্বলন্ত স্ফুরণ ঘটে কৃষক উপপ্লবের নানা ছোটবড় ঢেউয়ে, সরকার-সাহুকার-জমিদারের ক্ষমতাবিন্যাসের মৌহূর্তিক বিপর্যাসে। এই বিশ্লেষণী ছকে রণজিৎ জানালেন যে, কৃষক বিদ্রোহ শুধু কার্যকারণের শৃঙ্খলে আবদ্ধ অর্থনৈতিক বা সামাজিক শাসন শোষণের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ‘প্রাক্-রাজনৈতিক ভাবনা’র প্রকাশ নয়। বরং চরিত্রে তা আদ্যন্ত রাজনৈতিক—সার্বিক ক্ষমতাবিন্যাসকে উল্টে দেওয়ার ঈপ্সা থেকে জাত। দ্বিতীয়ত, বিদ্রোহী কৃষক সমাবেশের বা স্ব-উদ্যোগের ভিত্তি হল কোনও না কোনও সামূহিকতার বোধ। কৌম সম্বন্ধে, আঞ্চলিক সন্নিহিতি বা জাতপাত বিন্যাসে, গোষ্ঠীগত শ্রম অভ্যাসে, ধার্মিকতার ধারণায়, বা শ্রেণি-সংবিদে এই সামূহিকতার বোধ নিহিত থাকে। একাধিক সূত্রের টানে বোধটি ক্রিয়াশীল হয়, একমাত্রিকতার টানকে ছাপিয়ে যায়, সংহতির বার্তা ও অভিমুখে তার সরণ ঘটে।
রণজিৎ গুহ জানেন যে কোনও ঘটনা-বিশেষের অবয়বে ও ব্যক্তি-সংবেদনার কালিক অভিজ্ঞতায় সাধারণ লক্ষণের ঐতিহাসিকত্ব রক্ষা পায়, বিশেষের প্রেক্ষিতে ও প্রাখর্যে সাধারণ লক্ষণ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। তাই বিদ্রোহী চৈতন্যের সাধারণ লাক্ষণিক কাঠামো গ্রন্থনের ফাঁকফোকরে আখ্যান নির্মাণের আদি রীতিটি তিনি ত্যাগ করেননি। এলিমেন্টারি আসপেক্ট-এ ‘হুল’-এর চরিত্রবিচারে, ভাগনা মাঝি ও ডোমন দারোগার শোধ ও প্রতিশোধের রক্তাক্ত কাহিনি বর্ণিত হয় অনুপুঙ্খে। রাহুর পৌরাণিক কথার পার্থিব উদ্যাপনের মুহূর্তে, গ্রহণের ক্ষণে, বামুনদের ছুতমার্গী আচার ও শুদ্ধতা রক্ষার বিপরীতে দলিত মুসাহারদের উল্লাস ও আবাহনের বিবৃতি সামাজিক চৈতন্যের নানা স্তরের সাক্ষ্য হিসাবে হাজিরা দেয়। আবার রাঢ় অঞ্চলে অনুশাসনে দীর্ণ গ্রামসমাজে চাষির মেয়ে মৃত চন্দ্রার গর্ভপাতের মামলায় এজাহারে ধৃত নারীদের সংহতিবার্তা, বাঁচা ও বাঁচানোর আকুতির কথাকাহিনিতে দলিত গোষ্ঠী ও অবদমিত মানবীদের ঐকান্তিক অনুভূতির সহজ স্বীকৃতি আছে। এই স্বীকৃতির সূত্রেই নগা, ঢোঁড়াই বা বাঘারুদের জীবনচর্চা ও চৈতন্যের বিশ্লেষণনিষ্ঠ ইতিহাসবিদ্যা মানবিকতায় ঋদ্ধ হয়ে উঠল।
কোনও খোপে বেশি দিন আটকে থাকা চিন্তক রণজিৎ গুহের স্বভাব নয়। ১৯৯০-এর দশক থেকে আধুনিক ইউরোপীয় ইতিহাসবিদ্যার সর্বেশ্বরতার প্রতিকামী চিন্তার চর্চার ক্ষেত্র চিহ্নিত করতে গিয়ে তিনি হাজির হলেন সৃজনশীল ভাবনার অভিনব পরিসরে। এবং তাঁর সেই ভাবনার সেরা ফসল পাওয়া গেল বাংলা ভাষায় লেখা একাধিক মৌলিক প্রবন্ধের সঙ্কলনে, দুই খণ্ডের রচনাসংগ্রহতে (আনন্দ, ২০১৯)।
রণজিৎ গুহর মতে, মানুষ সত্তাময় জীব। এই সত্তাময়তার প্রকাশই মানুষী চৈতন্য, সেই চৈতন্যের উচ্চারণ ভাষা-ভাবনায় বিধৃত হয়। সত্তা, চৈতন্য ও ভাষা-ভাবনার ত্রিভুজে প্রকাশিত ইতিহাসবিদ্যার রূপানুসন্ধান প্রসারিত হল মানবিক অভিজ্ঞতার ভিন্ন অবয়বে, নিছক কার্যকারণ অন্বিত যুক্তিবোধ থেকে রসগ্রাহী সাহিত্য-আলাপে। এ বারের অন্বেষায় তিনি জানালেন যে, কোনও এক অতীতকালের অভিজ্ঞতাকে বর্তমানের বোধিতে ধরা, কোনও এক গোষ্ঠীর প্রাত্যহিক খণ্ড অভ্যাসের বৈশিষ্ট্য থেকে বৃহত্তর কোনও এক সমূহের অভিজ্ঞানে উত্তরিত হওয়া হল ইতিহাসবিদ্যার ঈপ্সা। ইতিহাসবিদের চিন্তনে জাত যুক্তির বিন্যাসে ও লেখনী নিঃসৃত ভাষাসজ্জায় যাচাই করা তথ্যাবলি আকাঙ্ক্ষিত আখ্যানের আকার নেয়। সদৃশার্থে নিজস্ব ঐকান্তিক অভিজ্ঞতাও অনুভূতি-সচেতন কবি-সাহিত্যিক শব্দের ব্যঞ্জনায় ভাসিত ও প্রসারিত করে নানা দেশে ও কালে নিজের রচনাকে ভিন্ন ভিন্ন সহৃদয়ের হৃদয় সংবাদী করে তোলে।
ওয়াকিবহাল পাঠক জানেন যে, তাঁর পূর্বতন রচনায় ইউরোপীয় সমাজবিজ্ঞান থেকে আহৃত ‘ইমপ্রুভমেন্ট’, ‘লয়্যালটি’, ‘হেজেমনি’ ইত্যাদি ধারণার প্রতিপার্শ্বে তিনি দণ্ড, ধর্ম, ভক্তি ও অতিদেশ-এর মতো দেশজ জ্ঞান ও ব্যবহার কাণ্ডের ধারণাগুলিকে সমমর্যাদায় স্থান দিয়েছেন, মোকাবিলায় দুই গোত্রের ধারণার ঠাঁই নড়ে গিয়ে নতুন বিশ্লেষণী পরিসর তৈরি হয়েছে। বাংলা প্রবন্ধাবলিতে তিনি ধ্রুপদী ভারতীয় দর্শনচিন্তার নানা ভাবনাবীজকে আত্মস্থ করে গবেষণার বিচার-অভিমুখকে বিশ্বমুখী করে তুললেন; যেমন, ভবভূতির ঔপচারিক বৃত্তির সৃজনশীল প্রয়োগ তাঁর মীমাংসাকে অনন্য প্রাখর্য দিল। দার্শনিক কৃষ্ণচন্দ্র ভট্টাচার্যের ঈপ্সিত ভারতীয় মননে স্বরাজসাধনার সিদ্ধপুরুষ রণজিৎ গুহ।
বাংলায় লেখা এই মৌলিক প্রবন্ধগুলির বিষয়গত ঝোঁক দ্বিমুখী। এক পক্ষে, পর্ব থেকে পর্বান্তরে সময়বোধ ও প্রকৃতিবোধের চলাচলের পথে সৃষ্টিশীল অহং-এর প্রসার ও পুষ্টির বিচার চলতে থাকে। খোঁজের সূত্র ছড়িয়ে থাকে রবীন্দ্রনাথের ‘ত্রি-গীত’-এর পাঠে, কখনও বা জীবনানন্দের সময়লগ্নতা থেকে বিভূতিভূষণের ঋতবোধের আলোচনায়, কখনও বা রবীন্দ্র-উত্তর কাব্যের তিন আধুনিক কবির কবিরূপের বিশ্লেষণে। অন্য পক্ষে, আমাদের আধুনিকতার কুলজি বিচারে তিনি সমত্ববোধ ও সামাজিক সমানুভূতির ছাপ-ছোপকে ঠাহর করার চেষ্টা করেন। তাঁর বিশ্লেষণী নজরে ধরা পড়ে, কী ভাবে রামমোহনের শাস্ত্রবিচার ও হিতবাদী দর্শনে পুষ্ট যুক্তিবোধটি দেশজ সমাজের গহনে ক্রিয়াময় দয়া-ধর্মের ছোঁয়া পায়, আর তৈরি হয় সংবেদনশীলতার নবানুভূতি।
‘আদি কবি আর প্রথম পাঠক: একটি পৌরাণিক সাক্ষাৎকারের কাহিনি’ নামে এতাবৎকাল সম্পূর্ণ অনালোচিত প্রবন্ধ বলে, রাষ্ট্রসর্বস্বতার বাইরে কাব্যকথার টানে কী ভাবে সামূহিকতার ইতিহাসবোধ জ্ঞানচেতনার ঐতিহ্যে শিকড়ের কথা। প্রাণী ও প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধাই তো সভ্যতার ভিত্তি।
যা নেই ভারতে, তা নেই ভারতে। ‘শেষ তর্পণ’ বলে মহাভারতীয় আখ্যানের নিজস্ব ব্যাখ্যায় রণজিৎ দেখান যে, কুরুক্ষেত্র ছড়িয়ে আছে সব মানবজাতির ইতিহাসে। কেবল আনৃশংস্য হওয়ার সাধ নয়, অনুকম্পা ও শোচনায় মানুষের মানবিক হওয়ার শেষ ভরসাটুকু জিয়ানো থাকে।
রাজনীতি থেকে মানবনীতির এ-হেন অন্বেষার অক্ষে ‘গ্লোবাল’ ও ‘লোকাল’-এর ভেদ তুচ্ছ হয়ে পড়ে। চৈতন্যের ইতিবৃত্ত রচনার কাছে নিবেদিত এক বাঙালি মেধাজীবীর মমত্ববোধ বহুজনীন হয়ে ওঠে। নানা কাল ও নানা দেশের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তাঁর বেদনাবোধ সংলগ্ন হতে চায়। সংবেদনশীলতার চর্চা ও লগ্নতার আকাঙ্ক্ষার আধারেই মেধাজীবীর দায়কে রণজিৎ গুহ অনুক্ষণ স্বীকার করেন।
ভাল থাকবেন, রণজিৎদা।
লেখক: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসবিদ ও সাবঅল্টার্ন স্টাডিজের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য।
(কৃতজ্ঞতা স্বীকার: গতবছর রণজিৎ গুহর ৯৯তম জন্মবার্ষিকীতে আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখাটি প্রকাশিত হয়। উপযোগিতা বিবেচনায় শুধু শিরোনাম পরিবর্তন করে লেখাটি হুবহু প্রকাশ করা হলো।)

তরবো (অ) পি হি জীবন্তি জীবন্তি মৃগপক্ষিণঃ।
স জীবতি মনো যস্য মননেন হি জীবতি।।
—যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণ
১
১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে অবিভক্ত বঙ্গের বাখরগঞ্জ (বর্তমান বরিশাল বিভাগের ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলায় অবস্থিত) এলাকার সিদ্ধকাঠি গ্রামে গুহ-বকসীদের খাস তালুকদার বংশে রণজিৎ গুহর জন্ম। গ্রামের নামে অনুষঙ্গে জড়িত বৌদ্ধতন্ত্র, গ্রাম সমাজ একেবারে আধা-সামন্ততান্ত্রিক। তবে বংশে ঠাকুরদা পণ্ডিত ও শিক্ষক, বাবা পেশায় আইনজীবী। একশো বছর পরেই অস্ট্রিয়াবাসী, অথচ আদ্যন্ত বাঙালি বলে গর্বিত রণজিৎ গুহর স্মৃতিতে সেই কুলজি-চিহ্ন মুছে যায়নি। তাঁর সাম্প্রতিকতম রচনায় শৈশবের কালকেই তিনি তাঁর জীবনের সবচেয়ে ‘ফর্ম্যাটিভ পিরিয়ড’ বলেছেন। ‘বরিশালনামা’ তো নানা স্মরণীয় বাঙালের কথাকীর্তিতে সমুজ্জ্বল। কিন্তু রণজিৎ গুহর তুলনায় অন্য কারও জীবন, চরিত্র ও রচনা এত বিতর্কিত, এত রঙ্গিবিরঙ্গি নয়, দেশ-বিদেশে, ব্যক্তি ও সমূহের বহুধা সম্পর্কের টানাপড়েনে ছড়িয়ে পড়েনি। শতায়ুজীবীর প্রতি এই শ্রদ্ধার্ঘ্যটি তাঁর জীবনী নয়; তাঁর বিশাল চিন্তনকর্মের পর্যালোচনা দূর অস্ত্। এই নিবেদনটি কেবল এক অনন্য মেধাজীবীর অনুসন্ধিৎসার অভিমুখ, বাঁকবদল ও তাঁর ত্রি-পর্বী লেখালিখির পরিচয়ের রৈখিক খসড়ামাত্র।
সিদ্ধকাঠির এক খাটুলি পরিবারের নগা রণজিৎ গুহর শৈশব সুহৃদ, আবার ওই সব পরিবারের বয়স্করাই বাড়ির প্রজা, হয় দলিত, নয় মুসলমান। এই মনিব-প্রজা দ্বন্দ্বের (উভয়ার্থে) বোধটি যৌবনের ইতিহাসচর্চায় ও কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্যরূপে দেশ-বিদেশে কাজ করার অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হয়। তারই প্রকাশ দেখি ঔপনিবেশিক বাংলার প্রথম ভূমি আইন চিন্তার উপর তাঁর লেখা বোধি-উজ্জ্বল সন্দর্ভটিতে, যার নাম ‘আ রুল অব প্রপার্টি ফর বেঙ্গল: অ্যান এসে অন দি আইডিয়া অব পার্মানেন্ট সেটলমেন্ট’ (প্যারিস ১৯৬৩ /নিউ দিল্লি ১৯৮২)। নানা কায়েমি স্বার্থের বিরোধের কথা ও ধন লুট করার সরল ইতিবৃত্তের বাইরে তিনি দেখালেন কোম্পানির আমলাদের নানা তর্কের মধ্যে কীভাবে ফিজ়িয়োক্র্যাসি বা প্রাকৃত ধনবাদী ভূমিতত্ত্ব বাংলায় বিনিয়োগনিষ্ঠ, উন্নতিকামী অথচ বশংবদ ভূম্যধিকারী সম্প্রদায় গড়তে চেয়েছিল। অথচ বাস্তবে জন্ম নিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের খাজনাগৃধ্নু, নানা স্তরে বিভক্ত, জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগীর দল। উপনিবেশে প্রবুদ্ধ ইউরোপীয় জ্ঞানের এ-হেন আকারপ্রাপ্তিকে রণজিৎ গুহ বলেছেন ‘জ্ঞানতাত্ত্বিক বিপর্যাস’ বা ‘এপিস্টেমোলজিক্যাল ভায়োলেন্স’; তাঁর প্রাকৃত লব্জে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এক ‘ত্রিশঙ্কুর জগৎ’ তৈরি করল—উন্নতির ইচ্ছা ও জ্ঞানফল উল্টোমুখী হতে চলল। দ্বিতীয়ত, তাঁর সন্দর্ভে স্পষ্ট যে সাম্রাজ্যের যুগে জ্ঞানতত্ত্বের নির্মিতিতে ইউরোপীয় চিন্তাভাবনার জগৎ ও ঔপনিবেশিক শাসন থেকে পাওয়া জ্ঞানধারণা একেবারে জড়াপট্টি, ইতরেতর সম্বন্ধে আবদ্ধ। আজ এ কথাটা সবাই জানে ও মানে। কিন্তু সে দিন জ্ঞানতত্ত্বের এই ইতিহাসচিন্তার পথিকৃৎ ছিলেন রণজিৎ গুহই।
এই সন্দর্ভের অনুষঙ্গে লেখা হয়েছিল এক রাশ প্রবন্ধ, যেমন মেদিনীপুরের লবণ শিল্পে মলঙ্গী তথা লবণ উৎপাদকদের প্রতিরোধ আন্দোলনের বিশ্লেষণী ইতিবৃত্ত থেকে স্থানীয় আর্কাইভস ব্যবহার করে বর্ধমান জেলার আঞ্চলিক অর্থনৈতিক বিবরণী। স্বদেশের ইতিবৃত্তে ঔপনিবেশিক শাসনের অভিঘাতের আদি স্পন্দনগুলি রণজিৎ স্পর্শ করার চেষ্টা করেছিলেন। জ্ঞানতাত্ত্বিক আলোচনায় তিনি দৈশিক ও কালিক অভিজ্ঞতার সতত উপস্থিতিকে কোনও দিন ভোলেননি।
লিখনশৈলীর জন্য প্রশংসিত হলেও আ রুল অব প্রপার্টি প্রথাসম্মত ইতিহাস আলোচক ও দরবারি মার্ক্সবাদীদের কাছে আদৃত হয়নি। ঘটনার প্রবাহে ১৯৫৯-এ ইংল্যান্ডে ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্স-এ অধ্যাপনার কাজে রত হওয়ার পরও রণজিৎ গুহ থাকবন্দি ঔপনিবেশিক সমাজে শাসকের সর্বেশ্বরতার ক্ষমতাসীমা ও বিন্যাস নিয়ে ভাবনা থামাননি, সেই ভাবনাসূত্রে স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের গণতন্ত্রে চিন্তার পরিসরে ঔপনিবেশিকতার দায়ভারের সজীব অস্তিত্বকে দাগাতে শুরু করেছিলেন। ইতিহাস-চিন্তায় বাঁক নেওয়ার সেই প্রস্তুতি-পর্বের স্ফুরণ দেখা যায় ১৯৭০-এর দশকের ফ্রন্টিয়ার-এর মতো রাজনৈতিক পত্রিকায় লেখা তিনটি প্রবন্ধে। যেমন- উদারনৈতিক সংস্কারচিন্তা ও সদিচ্ছায় আবদ্ধ নীলদর্পণ-এর মতো নাটকে বিদ্রোহী চৈতন্যের ‘ভদ্রস্থ’ উপস্থাপনের সমালোচনা, গণতন্ত্রের সুভদ্র সংস্কৃতিতে নির্মম পুলিশি অত্যাচারের তীক্ষ্ণ ব্যাখ্যা আর জেলে আটক মেরি টাইটলার- এর দেখা ভারতীয় সমাজে জারিত সন্ত্রাসের বিবরণীর এক মর্মস্পর্শী বিশ্লেষণ।
১৯৭০-৭১ সালে গান্ধীর গণ-আন্দোলনের স্বরূপ-সন্ধানে গবেষণা করতে ভারতে এসে নকশালবাড়ির রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে তাঁর গবেষণার অভিমুখ পাল্টে গেল। সৃজনশীল ইতিহাসচর্চার দ্বিতীয় পর্বে তাঁর ক্রিয়াকর্ম দুটি শাখায় প্রসারিত হল। প্রথমত, কয়েক জন অতি-তরুণ গবেষককে জড়ো করে তিনি ‘নিম্নবর্গ ইতিহাসচর্চা’র ধারা প্রবর্তন করলেন। উদ্দেশ্য—ভারতে চালু আধুনিক ইতিহাসবিদ্যার আদিকল্পের বিরুদ্ধে নতুন এক আদিকল্পের অনুসন্ধান করা। ১৯৮০ সালে তাঁর বহুচর্চিত ও বিতর্কিত ইংরেজি ম্যানিফেস্টো ও বাংলা প্রবন্ধে বলা হল যে, আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চার কেন্দ্রে আছে রাষ্ট্রিকতা, সেই ইতিহাসবিদ্যা আসলে ‘বকলমে’ লেখা রাষ্ট্রশক্তির ইতিকথা, ইংরেজ শাসনজাত প্রগতি ও সভ্যতার পক্ষে নানা ধাঁচের বৃত্তান্ত। অন্য পক্ষে, সমালোচনাত্মক জাতীয়তাবাদী, এমনকি মার্ক্সবাদী ইতিহাসচর্চাও পর্যবসিত হয়েছে দেশজ উচ্চবর্গের আদর্শবাদের মহিমাগাথায় ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের সাফল্যের নান্দীপাঠে। এই দ্বিবিধ উচ্চবর্ণকেন্দ্রিক ইতিহাসচর্চায় নিম্নবর্গের ক্রিয়াকাণ্ডের বৃত্তান্ত যে গরহাজির, তা কিন্তু একদম নয়। কিন্তু সেই বৃত্তান্ত উচ্চবর্গীয় উদ্যোগ আখ্যানের অনুপর্ব মাত্র, কালু ডোমরা চিরকাল যেন প্রভুর জন্য প্রাণদান করে।
এই ধারণার বিরুদ্ধে ‘নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চা’র আদিকল্প ভারতীয় রাজনীতির জগৎকে দু’টি বর্গের রাজনীতিক্ষেত্রে বিভক্ত করল। দমনকারী ও দমিতের ক্ষমতার বৈপরীত্যের নানা সূত্র ধরে কর্ম ও মানসজগতে নিম্নবর্গের আনুগত্য, সহকারিতা ও প্রতিবাদের রূপগুলি তুলে ধরল। অবশ্যই উচ্চবর্গীয় ও নিম্নবর্গীয় রাজনীতি সময় বুঝে প্রতিচ্ছেদিত হতে পারে, ক্ষেত্রবিশেষে স্ব-উদ্যোগ আড়াআড়ি ও খাড়াখাড়ি সমাজের বেণিবন্ধন গড়তে পারে। সময় বুঝে ওই বন্ধনের গিঁটগুলি আলগা হয়, এমনকি খুলেও যায়। তবে দুই ক্ষেত্রের স্বাতন্ত্র্য অবশ্যধার্য। রণজিৎ গুহ প্রণোদিত ও বোধিত ‘নিম্নবর্গের চর্চা’ বলে নামাঙ্কিত নিবন্ধখণ্ডগুলিতে এই সতত সঞ্চারমাণ রাজনীতির কথন ও লেখনই তরুণ গবেষকরা সম্পন্ন করতে শুরু করলেন।
এই যৌথকর্মের সঙ্গে শ্লিষ্ট তাঁর লেখা বহুবিতর্কিত বই এলিমেন্টারি আসপেক্টস অব পেজ়্যান্ট ইনসার্জেন্সি ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়াতে (১৯৮৩) এল ভারতের কৃষক বিদ্রোহের মুহূর্তগুলি, আর তার তুলনাসূত্রে, ইউরোপের কৃষক বিদ্রোহ ও চিনের কৃষক বিদ্রোহের অভিজ্ঞতা। বিদ্রোহী চৈতন্যে জাত কর্মকাণ্ডের কাঠামোয় রণজিৎ গুহ নিম্নবর্গের প্রতিস্পর্ধী রাজনৈতিক ভাবনার সাধারণ লক্ষণগুলি চিহ্নিত করলেন। তাঁর মতে, এই চৈতন্যের সাধারণ রূপ-লক্ষণগুলি প্রকীর্ণ থাকে জীবনযাপনের নানা ক্রিয়ায়। এই রূপ-লক্ষণগুলির সংহত ও জ্বলন্ত স্ফুরণ ঘটে কৃষক উপপ্লবের নানা ছোটবড় ঢেউয়ে, সরকার-সাহুকার-জমিদারের ক্ষমতাবিন্যাসের মৌহূর্তিক বিপর্যাসে। এই বিশ্লেষণী ছকে রণজিৎ জানালেন যে, কৃষক বিদ্রোহ শুধু কার্যকারণের শৃঙ্খলে আবদ্ধ অর্থনৈতিক বা সামাজিক শাসন শোষণের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ‘প্রাক্-রাজনৈতিক ভাবনা’র প্রকাশ নয়। বরং চরিত্রে তা আদ্যন্ত রাজনৈতিক—সার্বিক ক্ষমতাবিন্যাসকে উল্টে দেওয়ার ঈপ্সা থেকে জাত। দ্বিতীয়ত, বিদ্রোহী কৃষক সমাবেশের বা স্ব-উদ্যোগের ভিত্তি হল কোনও না কোনও সামূহিকতার বোধ। কৌম সম্বন্ধে, আঞ্চলিক সন্নিহিতি বা জাতপাত বিন্যাসে, গোষ্ঠীগত শ্রম অভ্যাসে, ধার্মিকতার ধারণায়, বা শ্রেণি-সংবিদে এই সামূহিকতার বোধ নিহিত থাকে। একাধিক সূত্রের টানে বোধটি ক্রিয়াশীল হয়, একমাত্রিকতার টানকে ছাপিয়ে যায়, সংহতির বার্তা ও অভিমুখে তার সরণ ঘটে।
রণজিৎ গুহ জানেন যে কোনও ঘটনা-বিশেষের অবয়বে ও ব্যক্তি-সংবেদনার কালিক অভিজ্ঞতায় সাধারণ লক্ষণের ঐতিহাসিকত্ব রক্ষা পায়, বিশেষের প্রেক্ষিতে ও প্রাখর্যে সাধারণ লক্ষণ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। তাই বিদ্রোহী চৈতন্যের সাধারণ লাক্ষণিক কাঠামো গ্রন্থনের ফাঁকফোকরে আখ্যান নির্মাণের আদি রীতিটি তিনি ত্যাগ করেননি। এলিমেন্টারি আসপেক্ট-এ ‘হুল’-এর চরিত্রবিচারে, ভাগনা মাঝি ও ডোমন দারোগার শোধ ও প্রতিশোধের রক্তাক্ত কাহিনি বর্ণিত হয় অনুপুঙ্খে। রাহুর পৌরাণিক কথার পার্থিব উদ্যাপনের মুহূর্তে, গ্রহণের ক্ষণে, বামুনদের ছুতমার্গী আচার ও শুদ্ধতা রক্ষার বিপরীতে দলিত মুসাহারদের উল্লাস ও আবাহনের বিবৃতি সামাজিক চৈতন্যের নানা স্তরের সাক্ষ্য হিসাবে হাজিরা দেয়। আবার রাঢ় অঞ্চলে অনুশাসনে দীর্ণ গ্রামসমাজে চাষির মেয়ে মৃত চন্দ্রার গর্ভপাতের মামলায় এজাহারে ধৃত নারীদের সংহতিবার্তা, বাঁচা ও বাঁচানোর আকুতির কথাকাহিনিতে দলিত গোষ্ঠী ও অবদমিত মানবীদের ঐকান্তিক অনুভূতির সহজ স্বীকৃতি আছে। এই স্বীকৃতির সূত্রেই নগা, ঢোঁড়াই বা বাঘারুদের জীবনচর্চা ও চৈতন্যের বিশ্লেষণনিষ্ঠ ইতিহাসবিদ্যা মানবিকতায় ঋদ্ধ হয়ে উঠল।
কোনও খোপে বেশি দিন আটকে থাকা চিন্তক রণজিৎ গুহের স্বভাব নয়। ১৯৯০-এর দশক থেকে আধুনিক ইউরোপীয় ইতিহাসবিদ্যার সর্বেশ্বরতার প্রতিকামী চিন্তার চর্চার ক্ষেত্র চিহ্নিত করতে গিয়ে তিনি হাজির হলেন সৃজনশীল ভাবনার অভিনব পরিসরে। এবং তাঁর সেই ভাবনার সেরা ফসল পাওয়া গেল বাংলা ভাষায় লেখা একাধিক মৌলিক প্রবন্ধের সঙ্কলনে, দুই খণ্ডের রচনাসংগ্রহতে (আনন্দ, ২০১৯)।
রণজিৎ গুহর মতে, মানুষ সত্তাময় জীব। এই সত্তাময়তার প্রকাশই মানুষী চৈতন্য, সেই চৈতন্যের উচ্চারণ ভাষা-ভাবনায় বিধৃত হয়। সত্তা, চৈতন্য ও ভাষা-ভাবনার ত্রিভুজে প্রকাশিত ইতিহাসবিদ্যার রূপানুসন্ধান প্রসারিত হল মানবিক অভিজ্ঞতার ভিন্ন অবয়বে, নিছক কার্যকারণ অন্বিত যুক্তিবোধ থেকে রসগ্রাহী সাহিত্য-আলাপে। এ বারের অন্বেষায় তিনি জানালেন যে, কোনও এক অতীতকালের অভিজ্ঞতাকে বর্তমানের বোধিতে ধরা, কোনও এক গোষ্ঠীর প্রাত্যহিক খণ্ড অভ্যাসের বৈশিষ্ট্য থেকে বৃহত্তর কোনও এক সমূহের অভিজ্ঞানে উত্তরিত হওয়া হল ইতিহাসবিদ্যার ঈপ্সা। ইতিহাসবিদের চিন্তনে জাত যুক্তির বিন্যাসে ও লেখনী নিঃসৃত ভাষাসজ্জায় যাচাই করা তথ্যাবলি আকাঙ্ক্ষিত আখ্যানের আকার নেয়। সদৃশার্থে নিজস্ব ঐকান্তিক অভিজ্ঞতাও অনুভূতি-সচেতন কবি-সাহিত্যিক শব্দের ব্যঞ্জনায় ভাসিত ও প্রসারিত করে নানা দেশে ও কালে নিজের রচনাকে ভিন্ন ভিন্ন সহৃদয়ের হৃদয় সংবাদী করে তোলে।
ওয়াকিবহাল পাঠক জানেন যে, তাঁর পূর্বতন রচনায় ইউরোপীয় সমাজবিজ্ঞান থেকে আহৃত ‘ইমপ্রুভমেন্ট’, ‘লয়্যালটি’, ‘হেজেমনি’ ইত্যাদি ধারণার প্রতিপার্শ্বে তিনি দণ্ড, ধর্ম, ভক্তি ও অতিদেশ-এর মতো দেশজ জ্ঞান ও ব্যবহার কাণ্ডের ধারণাগুলিকে সমমর্যাদায় স্থান দিয়েছেন, মোকাবিলায় দুই গোত্রের ধারণার ঠাঁই নড়ে গিয়ে নতুন বিশ্লেষণী পরিসর তৈরি হয়েছে। বাংলা প্রবন্ধাবলিতে তিনি ধ্রুপদী ভারতীয় দর্শনচিন্তার নানা ভাবনাবীজকে আত্মস্থ করে গবেষণার বিচার-অভিমুখকে বিশ্বমুখী করে তুললেন; যেমন, ভবভূতির ঔপচারিক বৃত্তির সৃজনশীল প্রয়োগ তাঁর মীমাংসাকে অনন্য প্রাখর্য দিল। দার্শনিক কৃষ্ণচন্দ্র ভট্টাচার্যের ঈপ্সিত ভারতীয় মননে স্বরাজসাধনার সিদ্ধপুরুষ রণজিৎ গুহ।
বাংলায় লেখা এই মৌলিক প্রবন্ধগুলির বিষয়গত ঝোঁক দ্বিমুখী। এক পক্ষে, পর্ব থেকে পর্বান্তরে সময়বোধ ও প্রকৃতিবোধের চলাচলের পথে সৃষ্টিশীল অহং-এর প্রসার ও পুষ্টির বিচার চলতে থাকে। খোঁজের সূত্র ছড়িয়ে থাকে রবীন্দ্রনাথের ‘ত্রি-গীত’-এর পাঠে, কখনও বা জীবনানন্দের সময়লগ্নতা থেকে বিভূতিভূষণের ঋতবোধের আলোচনায়, কখনও বা রবীন্দ্র-উত্তর কাব্যের তিন আধুনিক কবির কবিরূপের বিশ্লেষণে। অন্য পক্ষে, আমাদের আধুনিকতার কুলজি বিচারে তিনি সমত্ববোধ ও সামাজিক সমানুভূতির ছাপ-ছোপকে ঠাহর করার চেষ্টা করেন। তাঁর বিশ্লেষণী নজরে ধরা পড়ে, কী ভাবে রামমোহনের শাস্ত্রবিচার ও হিতবাদী দর্শনে পুষ্ট যুক্তিবোধটি দেশজ সমাজের গহনে ক্রিয়াময় দয়া-ধর্মের ছোঁয়া পায়, আর তৈরি হয় সংবেদনশীলতার নবানুভূতি।
‘আদি কবি আর প্রথম পাঠক: একটি পৌরাণিক সাক্ষাৎকারের কাহিনি’ নামে এতাবৎকাল সম্পূর্ণ অনালোচিত প্রবন্ধ বলে, রাষ্ট্রসর্বস্বতার বাইরে কাব্যকথার টানে কী ভাবে সামূহিকতার ইতিহাসবোধ জ্ঞানচেতনার ঐতিহ্যে শিকড়ের কথা। প্রাণী ও প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধাই তো সভ্যতার ভিত্তি।
যা নেই ভারতে, তা নেই ভারতে। ‘শেষ তর্পণ’ বলে মহাভারতীয় আখ্যানের নিজস্ব ব্যাখ্যায় রণজিৎ দেখান যে, কুরুক্ষেত্র ছড়িয়ে আছে সব মানবজাতির ইতিহাসে। কেবল আনৃশংস্য হওয়ার সাধ নয়, অনুকম্পা ও শোচনায় মানুষের মানবিক হওয়ার শেষ ভরসাটুকু জিয়ানো থাকে।
রাজনীতি থেকে মানবনীতির এ-হেন অন্বেষার অক্ষে ‘গ্লোবাল’ ও ‘লোকাল’-এর ভেদ তুচ্ছ হয়ে পড়ে। চৈতন্যের ইতিবৃত্ত রচনার কাছে নিবেদিত এক বাঙালি মেধাজীবীর মমত্ববোধ বহুজনীন হয়ে ওঠে। নানা কাল ও নানা দেশের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তাঁর বেদনাবোধ সংলগ্ন হতে চায়। সংবেদনশীলতার চর্চা ও লগ্নতার আকাঙ্ক্ষার আধারেই মেধাজীবীর দায়কে রণজিৎ গুহ অনুক্ষণ স্বীকার করেন।
ভাল থাকবেন, রণজিৎদা।
লেখক: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসবিদ ও সাবঅল্টার্ন স্টাডিজের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য।
(কৃতজ্ঞতা স্বীকার: গতবছর রণজিৎ গুহর ৯৯তম জন্মবার্ষিকীতে আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখাটি প্রকাশিত হয়। উপযোগিতা বিবেচনায় শুধু শিরোনাম পরিবর্তন করে লেখাটি হুবহু প্রকাশ করা হলো।)

ছোট ছিলাম যখন, তখন শোনা কথাগুলোকে অমূল্য মনে হতো। বুঝে না-বুঝে প্রচলিত কথাগুলোকেই বিশ্বাস করতাম। বয়স বাড়তে লাগল, বুঝতে পারলাম, জীবনে এমন অনেক কিছুই আছে, যা আদর্শবাদের সঙ্গে যায় না। বাস্তব একেবারে অন্য কিছু।
১০ ঘণ্টা আগে
এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল বেশ খারাপ। বলা যায়, সন্তোষজনক নয়। যদিও পরীক্ষার ফল যে ভালো হবে, পাসের হার বেশি হবে, তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য কারণ বা উদ্যোগ কিন্তু ছিল না। বরাবরের মতো গত নয়-দশ মাসে তেমন কোনো উদ্যোগ, তৎপরতা চোখে পড়েনি।
১০ ঘণ্টা আগে
গরিব ও দরিদ্র মানুষদের জন্য সরকারি বরাদ্দকৃত ভিজিডি কার্ড (পরিবর্তিত নাম ভিডব্লিউবি) বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। আজকের পত্রিকায় ২১ অক্টোবর সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে।
১০ ঘণ্টা আগে
হাত-পা বেঁধে ইচ্ছেমতো পিটিয়েছে স্থানীয় লোকজন। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় সেই ছিনতাইকারীর। সেখানে ঘটনা থেমে থাকেনি, লোকটির শরীরে লবণ দিয়ে উল্লাস করতে থাকে জনতা। টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকায় প্রতিদিন গড়ে ২০টি করে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এটা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবস্থারই ইঙ্গিত দেয়।
১ দিন আগেজাহীদ রেজা নূর

ছোট ছিলাম যখন, তখন শোনা কথাগুলোকে অমূল্য মনে হতো। বুঝে না-বুঝে প্রচলিত কথাগুলোকেই বিশ্বাস করতাম। বয়স বাড়তে লাগল, বুঝতে পারলাম, জীবনে এমন অনেক কিছুই আছে, যা আদর্শবাদের সঙ্গে যায় না। বাস্তব একেবারে অন্য কিছু।
গত শতকের গোটা সময়টায় দুনিয়াজুড়ে সাম্যবাদের দিকে ঝুঁকেছিল প্রগতিবাদী মানুষ। উপনিবেশের শৃঙ্খল ভেঙে এশিয়া-আফ্রিকায় জন্ম হচ্ছিল নতুন নতুন দেশ। সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের বিজয় আশার আলো জাগিয়েছিল শোষিত মানুষের মনে। সারা বিশ্বে বিপ্লব ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য চে গেভারা ঘুরে বেড়িয়েছেন বিভিন্ন দেশে, উদ্বুদ্ধ করেছেন লাঞ্ছিত-বঞ্চিত মানুষকে। পৃথিবীর মেধাবী মানুষেরা সমাজতন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। বিশেষ করে তরুণেরা ত্যাগ ও সংগ্রামকেই বেছে নিয়েছে জীবনের পথ হিসেবে। পুঁজিবাদ এই ভেঙে পড়ল বলে মনে হয়েছে।
কিন্তু আদৌ সে রকম কিছু ঘটেনি। নানা ধরনের অসংগতি নিয়ে পুঁজিবাদ টিকে আছে। সমাজতন্ত্রের দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে। চীনের শাসনব্যবস্থা সমাজতান্ত্রিক নাকি আধা-খ্যাঁচড়া পুঁজিবাদী কিছু—তা নিয়ে বিতর্ক এখনো চলছে। দেশে দেশে হানাহানি, নিজের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের জন্য যেকোনো পথ অবলম্বন করা, অন্যকে নিজের আয়ত্তে রাখার চেষ্টা করেই চলেছে পুঁজিবাদ।
২. আলোচনাটা তাত্ত্বিক আলোচনায় পরিণত হওয়ার আগেই থামা দরকার। যখন সমাজতান্ত্রিক জীবনের প্রতি মোহ ও মায়ায় আকৃষ্ট হয়েছে মানুষ, তখন তারা ভেবেও দেখেনি, তত্ত্ব থাকলেই তা রাষ্ট্রীয় জীবনে সুচারুভাবে প্রয়োগ করা যায় না। মানুষের সমাজে নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতে থাকে, তার সমাধানের জন্য তত্ত্বের বাইরেও চলে যান রাষ্ট্রের কর্তারা। তাঁরা নিজের তৈরি আইনে তখন দেশ চালান।
দেশে দেশে একনায়কতন্ত্র বা স্বৈরাচার এভাবেই দাঁড়িয়ে যায়। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নেও গড়ে উঠেছিল পার্টি-আমলাতন্ত্র, যা আদর্শকে বিলীন করে দিয়ে নিজস্ব এক কঠোর ও নির্যাতনবাদী সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। কমিউনিস্ট পার্টি আর জনগণের মধ্যে যখন বিস্তর ফারাক সৃষ্টি হলো, পার্টি ক্রমেই তার গোপন গোয়েন্দা বাহিনী দিয়ে জনগণের ওপর নজরদারি শুরু করল, পার্টির মতামতের বাইরে অন্য কোনো মতকে কঠোর হাতে দমন করা শুরু করল, বিরুদ্ধমতের মানুষকে নির্বাসনে পাঠাতে লাগল, দেশত্যাগে বাধ্য করতে থাকল কিংবা শারীরিকভাবে নিশ্চিহ্ন করতে শুরু করল, তখন বোঝা গেল সমাজতন্ত্রের স্বপ্নকে সমাজতান্ত্রিক মনীষীরাই ভয়ংকরভাবে বিপথে নিয়ে যেতে পারেন। সেই সঙ্গে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের ইন্ধন তো আছেই। কিন্তু ভেতরটা নষ্ট হওয়ার জন্য প্রস্তুত না থাকলে কোনো দেশকে অন্য কোনো দেশ এসে ধ্বংস করে দিতে পারে না।
সোভিয়েত ইউনিয়নে ১০ বছর ছিলাম। ৫ বছর ছিলাম গরবাচোভের পিরিস্ত্রোইকার আমলে, বাকি পাঁচ বছর ইয়েলৎসিনের গণতন্ত্রে। ইয়েলৎসিনের গণতন্ত্র ছিল এক কিম্ভূতকিমাকার ব্যবস্থা। চোখের নিমেষে বড় বড় মোড়লকে কোটিপতি হয়ে যেতে দেখেছি। এদের বেশির ভাগই একসময় সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির বড় বড় চাঁই ছিল। সারা দেশে মাফিয়া ছড়িয়ে পড়েছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হলে স্থানীয় মাফিয়াদের টাকা দিয়ে পালতে হতো। কিশোর গ্যাংয়ের জন্ম হতে থাকল প্রতিটি শহরেই। হঠাৎ করে নিষিদ্ধ পশ্চিমা সংস্কৃতির অবাধ প্রবেশ ঘটতে লাগল। তাতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বদহজম হতে থাকল। সে এক আজব সময় পার করেছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নবাসী।
প্রশ্ন হলো, গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যে দেশগুলো বের হলো, সে দেশগুলোয় কি গণতন্ত্র আদৌ জায়গা করে নিতে পেরেছে? কেন পারেনি, তার কারণগুলোও খতিয়ে দেখা দরকার।
৩. যে আমলাতন্ত্র গড়ে উঠেছিল সোভিয়েত দেশটিতে, তাতে পার্টির নামে যথেচ্ছাচার চলত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাশিয়া সফরে গিয়ে এই প্রশ্নটিই তুলেছিলেন। ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে শুধু সমষ্টি দিয়ে কিছু গড়ে তোলা যায় কি না, অর্থাৎ সম্মিলিত নেতৃত্ব টিকতে পারে কি না, সে প্রশ্নই তুলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ব্যক্তি যদি বিকশিত না হয়, সমষ্টিই যদি চলার পথের অনুপ্রেরণা হয়, তাহলে ভিন্নমত, বহুমত টিকবে কী করে? আসলেই টেকেনি। কারণ, বহুমতকে প্রবলভাবে হত্যা করে একটিমাত্র মতকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট নেতারা। মুখে বলেছেন সম্মিলিত নেতৃত্ব, কিন্তু দাঁড় করিয়েছেন পার্টি-স্বৈরাচার। দেয়ালেরও কান আছে—এই কথায় বিশ্বাস ছিল সোভিয়েত জনগণের।
বিতর্কটি আগামী দিনের জন্য তোলা থাকল। বিশ্বের সবচেয়ে প্রগতিশীল একটি মতবাদ কী কারণে এক শ বছর পার হওয়ার আগেই মুখ থুবড়ে পড়ল, তা নিয়ে বহু তাত্ত্বিক আলোচনা আছে। সে আলোচনাগুলোর কোনো কোনোটায় সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের জন্য শুধু বাইরের শক্তির ষড়যন্ত্রকেই দেখা হয়। আমাদের দেশের মনীষীদের মধ্যেও এ রকম ঝোঁক দেখতে পাই। কিন্তু কী করে ভেতরের সংকটটা ভাঙনকে ত্বরান্বিত করেছে এবং সেটাই হয়ে উঠেছে ভাঙনের মূল কারণ—সে কথা বুঝতে হলে সে সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নে বসবাসকারী মানুষের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করা জরুরি। সে কাজটাই ক্রমান্বয়ে করা হবে।
৪. আমাদের দেশের তরুণেরাও শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে তোলার জন্য জীবনপণ করেছিল। শুধু আমাদের দেশেই নয়, পৃথিবীব্যাপী প্রগতিশীল মানুষ বলতে মার্ক্স-এঙ্গেলস-লেনিন-মাও-পড়া মানুষদেরকেই বোঝাত। আক্ষরিক অর্থেই এই মানুষেরা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়ে শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের অঙ্গীকার করেছিলেন। নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা ধীরে ধীরে সংকট মোকাবিলায় নিজস্ব-সৃষ্ট তত্ত্বকে প্রাধান্য দিতে থাকায় মূল আদর্শের জায়গায় যে বিচ্যুতি ঘটেছিল, প্রাথমিকভাবে তা কর্মীদের দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছিল। সামনে শোষণহীন সমাজের অপার সম্ভাবনা, ফলে ছোটখাটো ভুলত্রুটিকে আমলে না নেওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছিল। এই এড়িয়ে যাওয়াটাই কাল হয়ে উঠেছিল। মানুষ প্রশ্ন করতে ভুলে গিয়েছিল এবং একসময় প্রশ্ন করাকেই ভয়াবহ অপরাধ বলে গণ্য করা শুরু হলো।
সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি শহরে যখন পড়াশোনা করছি, তখন পিরিস্ত্রোইকা আর গ্লাসনোস্ত এসে কাঁপিয়ে দিয়েছে সোভিয়েত সমাজকে। হঠাৎ করে এতটা মুক্তির আস্বাদ পাওয়া ছিল বিরল ঘটনা। মানুষ যখন মুখ খুলতে শুরু করেছে, তখন আর কিছুই ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। সমাজে প্রচলিত সব অসংগতি নিয়ে যেমন মানুষ কথা বলেছে, তেমনি কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি যে রাগ, অভিমান ছিল, সেটাও ধীরে ধীরে প্রকাশ করেছে। পার্টির ভেতরেই ভিন্ন ভিন্ন মত জেগে উঠেছে। এই বিপুল পরিবর্তন মোকাবিলা করার মতো ক্ষমতা গরবাচোভের ছিল না। আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ তত দিনে পশ্চিমা দুনিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে।
কিন্তু কী করে এই ভাঙনটি এল? সেটাই তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে আলোচনার চেষ্টা করব।
তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় রুশ সাহিত্যের ইতিহাস ক্লাসে ছিলেন এক তরুণ শিক্ষক। তিনি বললেন, বিখ্যাত সোভিয়েত সাহিত্যিক কনস্তান্তিন সিমোনভকে একবার এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি এখন কী লিখছেন?’ সিমোনভ উত্তর দিয়েছিলেন, ‘এখনো ঠিক করিনি। পার্টি যে নির্দেশ দেবে, সেটাই লিখব।’
তখন গ্লাসনোস্তের কাল। তাই শিক্ষক এই কথাটি বলতে পেরেছিলেন। একজন সৃজনশীল মানুষ কী লিখবে, সেটাও নির্ভর করছে পার্টির সিদ্ধান্তের ওপর—এই কথাটি কিসের ইঙ্গিত দেয়, তা নিয়েও কথা বলব। আজকের নাতিদীর্ঘ লেখাটি শেষ করি ওই সোভিয়েতজীবনের একটি ঘটনা দিয়েই। তখন সদ্য সে দেশে গেছি। অন্য একটি শহর থেকে আমাদেরই এক বন্ধু ছুটিতে বেড়াতে এসেছে। কথা প্রসঙ্গে ও বলছিল, এখনো প্রেমের সিদ্ধান্ত নেয়নি। এ ব্যাপারে ও নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। পার্টি যে সিদ্ধান্ত দেবে, সেটাই সে মেনে নেবে।
ঘটনাটি সত্য। পার্টির প্রতি আনুগত্য ব্যক্তিজীবনকেও ধ্বংস করে দিচ্ছিল, এ কথা তখন অনেকেই বোঝেনি। আর তখনই মনে পড়েছে মেকিয়াভেলির কথা। রাষ্ট্রের ‘নিরাপত্তা’ ও ‘স্থিতিশীলতা’ রক্ষার জন্য শাসককে যেকোনো উপায় অবলম্বন করতে হবে, তা নৈতিক বা অনৈতিক যা-ই হোক না কেন। মেকিয়াভেলি মনে করেন মানুষ স্বার্থপর, ভিতু ও অবিশ্বাসী। তাই শাসককে মানুষের এই প্রকৃতি বুঝে কাজ করতে হবে। পৃথিবীজুড়েই কি এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে না?
আমি কি সমাজতন্ত্র নিয়ে নিরাশার কথা বলছি? একেবারেই না। কেন তা নিরাশার জন্ম দিল, সে কারণগুলো খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছি মাত্র। আর তা বিশ্লেষণ করতে গেলে দেখা যাবে, আমাদের দেশের স্বপ্নগুলোও কেন ভাঙতে থাকে, তার ইঙ্গিতও আমরা পেয়ে যাব।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

ছোট ছিলাম যখন, তখন শোনা কথাগুলোকে অমূল্য মনে হতো। বুঝে না-বুঝে প্রচলিত কথাগুলোকেই বিশ্বাস করতাম। বয়স বাড়তে লাগল, বুঝতে পারলাম, জীবনে এমন অনেক কিছুই আছে, যা আদর্শবাদের সঙ্গে যায় না। বাস্তব একেবারে অন্য কিছু।
গত শতকের গোটা সময়টায় দুনিয়াজুড়ে সাম্যবাদের দিকে ঝুঁকেছিল প্রগতিবাদী মানুষ। উপনিবেশের শৃঙ্খল ভেঙে এশিয়া-আফ্রিকায় জন্ম হচ্ছিল নতুন নতুন দেশ। সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের বিজয় আশার আলো জাগিয়েছিল শোষিত মানুষের মনে। সারা বিশ্বে বিপ্লব ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য চে গেভারা ঘুরে বেড়িয়েছেন বিভিন্ন দেশে, উদ্বুদ্ধ করেছেন লাঞ্ছিত-বঞ্চিত মানুষকে। পৃথিবীর মেধাবী মানুষেরা সমাজতন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। বিশেষ করে তরুণেরা ত্যাগ ও সংগ্রামকেই বেছে নিয়েছে জীবনের পথ হিসেবে। পুঁজিবাদ এই ভেঙে পড়ল বলে মনে হয়েছে।
কিন্তু আদৌ সে রকম কিছু ঘটেনি। নানা ধরনের অসংগতি নিয়ে পুঁজিবাদ টিকে আছে। সমাজতন্ত্রের দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে। চীনের শাসনব্যবস্থা সমাজতান্ত্রিক নাকি আধা-খ্যাঁচড়া পুঁজিবাদী কিছু—তা নিয়ে বিতর্ক এখনো চলছে। দেশে দেশে হানাহানি, নিজের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের জন্য যেকোনো পথ অবলম্বন করা, অন্যকে নিজের আয়ত্তে রাখার চেষ্টা করেই চলেছে পুঁজিবাদ।
২. আলোচনাটা তাত্ত্বিক আলোচনায় পরিণত হওয়ার আগেই থামা দরকার। যখন সমাজতান্ত্রিক জীবনের প্রতি মোহ ও মায়ায় আকৃষ্ট হয়েছে মানুষ, তখন তারা ভেবেও দেখেনি, তত্ত্ব থাকলেই তা রাষ্ট্রীয় জীবনে সুচারুভাবে প্রয়োগ করা যায় না। মানুষের সমাজে নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতে থাকে, তার সমাধানের জন্য তত্ত্বের বাইরেও চলে যান রাষ্ট্রের কর্তারা। তাঁরা নিজের তৈরি আইনে তখন দেশ চালান।
দেশে দেশে একনায়কতন্ত্র বা স্বৈরাচার এভাবেই দাঁড়িয়ে যায়। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নেও গড়ে উঠেছিল পার্টি-আমলাতন্ত্র, যা আদর্শকে বিলীন করে দিয়ে নিজস্ব এক কঠোর ও নির্যাতনবাদী সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। কমিউনিস্ট পার্টি আর জনগণের মধ্যে যখন বিস্তর ফারাক সৃষ্টি হলো, পার্টি ক্রমেই তার গোপন গোয়েন্দা বাহিনী দিয়ে জনগণের ওপর নজরদারি শুরু করল, পার্টির মতামতের বাইরে অন্য কোনো মতকে কঠোর হাতে দমন করা শুরু করল, বিরুদ্ধমতের মানুষকে নির্বাসনে পাঠাতে লাগল, দেশত্যাগে বাধ্য করতে থাকল কিংবা শারীরিকভাবে নিশ্চিহ্ন করতে শুরু করল, তখন বোঝা গেল সমাজতন্ত্রের স্বপ্নকে সমাজতান্ত্রিক মনীষীরাই ভয়ংকরভাবে বিপথে নিয়ে যেতে পারেন। সেই সঙ্গে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের ইন্ধন তো আছেই। কিন্তু ভেতরটা নষ্ট হওয়ার জন্য প্রস্তুত না থাকলে কোনো দেশকে অন্য কোনো দেশ এসে ধ্বংস করে দিতে পারে না।
সোভিয়েত ইউনিয়নে ১০ বছর ছিলাম। ৫ বছর ছিলাম গরবাচোভের পিরিস্ত্রোইকার আমলে, বাকি পাঁচ বছর ইয়েলৎসিনের গণতন্ত্রে। ইয়েলৎসিনের গণতন্ত্র ছিল এক কিম্ভূতকিমাকার ব্যবস্থা। চোখের নিমেষে বড় বড় মোড়লকে কোটিপতি হয়ে যেতে দেখেছি। এদের বেশির ভাগই একসময় সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির বড় বড় চাঁই ছিল। সারা দেশে মাফিয়া ছড়িয়ে পড়েছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হলে স্থানীয় মাফিয়াদের টাকা দিয়ে পালতে হতো। কিশোর গ্যাংয়ের জন্ম হতে থাকল প্রতিটি শহরেই। হঠাৎ করে নিষিদ্ধ পশ্চিমা সংস্কৃতির অবাধ প্রবেশ ঘটতে লাগল। তাতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বদহজম হতে থাকল। সে এক আজব সময় পার করেছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নবাসী।
প্রশ্ন হলো, গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যে দেশগুলো বের হলো, সে দেশগুলোয় কি গণতন্ত্র আদৌ জায়গা করে নিতে পেরেছে? কেন পারেনি, তার কারণগুলোও খতিয়ে দেখা দরকার।
৩. যে আমলাতন্ত্র গড়ে উঠেছিল সোভিয়েত দেশটিতে, তাতে পার্টির নামে যথেচ্ছাচার চলত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাশিয়া সফরে গিয়ে এই প্রশ্নটিই তুলেছিলেন। ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে শুধু সমষ্টি দিয়ে কিছু গড়ে তোলা যায় কি না, অর্থাৎ সম্মিলিত নেতৃত্ব টিকতে পারে কি না, সে প্রশ্নই তুলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ব্যক্তি যদি বিকশিত না হয়, সমষ্টিই যদি চলার পথের অনুপ্রেরণা হয়, তাহলে ভিন্নমত, বহুমত টিকবে কী করে? আসলেই টেকেনি। কারণ, বহুমতকে প্রবলভাবে হত্যা করে একটিমাত্র মতকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট নেতারা। মুখে বলেছেন সম্মিলিত নেতৃত্ব, কিন্তু দাঁড় করিয়েছেন পার্টি-স্বৈরাচার। দেয়ালেরও কান আছে—এই কথায় বিশ্বাস ছিল সোভিয়েত জনগণের।
বিতর্কটি আগামী দিনের জন্য তোলা থাকল। বিশ্বের সবচেয়ে প্রগতিশীল একটি মতবাদ কী কারণে এক শ বছর পার হওয়ার আগেই মুখ থুবড়ে পড়ল, তা নিয়ে বহু তাত্ত্বিক আলোচনা আছে। সে আলোচনাগুলোর কোনো কোনোটায় সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের জন্য শুধু বাইরের শক্তির ষড়যন্ত্রকেই দেখা হয়। আমাদের দেশের মনীষীদের মধ্যেও এ রকম ঝোঁক দেখতে পাই। কিন্তু কী করে ভেতরের সংকটটা ভাঙনকে ত্বরান্বিত করেছে এবং সেটাই হয়ে উঠেছে ভাঙনের মূল কারণ—সে কথা বুঝতে হলে সে সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নে বসবাসকারী মানুষের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করা জরুরি। সে কাজটাই ক্রমান্বয়ে করা হবে।
৪. আমাদের দেশের তরুণেরাও শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে তোলার জন্য জীবনপণ করেছিল। শুধু আমাদের দেশেই নয়, পৃথিবীব্যাপী প্রগতিশীল মানুষ বলতে মার্ক্স-এঙ্গেলস-লেনিন-মাও-পড়া মানুষদেরকেই বোঝাত। আক্ষরিক অর্থেই এই মানুষেরা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়ে শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের অঙ্গীকার করেছিলেন। নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা ধীরে ধীরে সংকট মোকাবিলায় নিজস্ব-সৃষ্ট তত্ত্বকে প্রাধান্য দিতে থাকায় মূল আদর্শের জায়গায় যে বিচ্যুতি ঘটেছিল, প্রাথমিকভাবে তা কর্মীদের দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছিল। সামনে শোষণহীন সমাজের অপার সম্ভাবনা, ফলে ছোটখাটো ভুলত্রুটিকে আমলে না নেওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছিল। এই এড়িয়ে যাওয়াটাই কাল হয়ে উঠেছিল। মানুষ প্রশ্ন করতে ভুলে গিয়েছিল এবং একসময় প্রশ্ন করাকেই ভয়াবহ অপরাধ বলে গণ্য করা শুরু হলো।
সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি শহরে যখন পড়াশোনা করছি, তখন পিরিস্ত্রোইকা আর গ্লাসনোস্ত এসে কাঁপিয়ে দিয়েছে সোভিয়েত সমাজকে। হঠাৎ করে এতটা মুক্তির আস্বাদ পাওয়া ছিল বিরল ঘটনা। মানুষ যখন মুখ খুলতে শুরু করেছে, তখন আর কিছুই ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। সমাজে প্রচলিত সব অসংগতি নিয়ে যেমন মানুষ কথা বলেছে, তেমনি কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি যে রাগ, অভিমান ছিল, সেটাও ধীরে ধীরে প্রকাশ করেছে। পার্টির ভেতরেই ভিন্ন ভিন্ন মত জেগে উঠেছে। এই বিপুল পরিবর্তন মোকাবিলা করার মতো ক্ষমতা গরবাচোভের ছিল না। আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ তত দিনে পশ্চিমা দুনিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে।
কিন্তু কী করে এই ভাঙনটি এল? সেটাই তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে আলোচনার চেষ্টা করব।
তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় রুশ সাহিত্যের ইতিহাস ক্লাসে ছিলেন এক তরুণ শিক্ষক। তিনি বললেন, বিখ্যাত সোভিয়েত সাহিত্যিক কনস্তান্তিন সিমোনভকে একবার এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি এখন কী লিখছেন?’ সিমোনভ উত্তর দিয়েছিলেন, ‘এখনো ঠিক করিনি। পার্টি যে নির্দেশ দেবে, সেটাই লিখব।’
তখন গ্লাসনোস্তের কাল। তাই শিক্ষক এই কথাটি বলতে পেরেছিলেন। একজন সৃজনশীল মানুষ কী লিখবে, সেটাও নির্ভর করছে পার্টির সিদ্ধান্তের ওপর—এই কথাটি কিসের ইঙ্গিত দেয়, তা নিয়েও কথা বলব। আজকের নাতিদীর্ঘ লেখাটি শেষ করি ওই সোভিয়েতজীবনের একটি ঘটনা দিয়েই। তখন সদ্য সে দেশে গেছি। অন্য একটি শহর থেকে আমাদেরই এক বন্ধু ছুটিতে বেড়াতে এসেছে। কথা প্রসঙ্গে ও বলছিল, এখনো প্রেমের সিদ্ধান্ত নেয়নি। এ ব্যাপারে ও নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। পার্টি যে সিদ্ধান্ত দেবে, সেটাই সে মেনে নেবে।
ঘটনাটি সত্য। পার্টির প্রতি আনুগত্য ব্যক্তিজীবনকেও ধ্বংস করে দিচ্ছিল, এ কথা তখন অনেকেই বোঝেনি। আর তখনই মনে পড়েছে মেকিয়াভেলির কথা। রাষ্ট্রের ‘নিরাপত্তা’ ও ‘স্থিতিশীলতা’ রক্ষার জন্য শাসককে যেকোনো উপায় অবলম্বন করতে হবে, তা নৈতিক বা অনৈতিক যা-ই হোক না কেন। মেকিয়াভেলি মনে করেন মানুষ স্বার্থপর, ভিতু ও অবিশ্বাসী। তাই শাসককে মানুষের এই প্রকৃতি বুঝে কাজ করতে হবে। পৃথিবীজুড়েই কি এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে না?
আমি কি সমাজতন্ত্র নিয়ে নিরাশার কথা বলছি? একেবারেই না। কেন তা নিরাশার জন্ম দিল, সে কারণগুলো খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছি মাত্র। আর তা বিশ্লেষণ করতে গেলে দেখা যাবে, আমাদের দেশের স্বপ্নগুলোও কেন ভাঙতে থাকে, তার ইঙ্গিতও আমরা পেয়ে যাব।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

কোনও খোপে বেশি দিন আটকে থাকা চিন্তক রণজিৎ গুহের স্বভাব নয়। ১৯৯০-এর দশক থেকে আধুনিক ইউরোপীয় ইতিহাসবিদ্যার সর্বেশ্বরতার প্রতিকামী চিন্তার চর্চার ক্ষেত্র চিহ্নিত করতে গিয়ে তিনি হাজির হলেন সৃজনশীল ভাবনার অভিনব পরিসরে।
২৯ এপ্রিল ২০২৩
এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল বেশ খারাপ। বলা যায়, সন্তোষজনক নয়। যদিও পরীক্ষার ফল যে ভালো হবে, পাসের হার বেশি হবে, তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য কারণ বা উদ্যোগ কিন্তু ছিল না। বরাবরের মতো গত নয়-দশ মাসে তেমন কোনো উদ্যোগ, তৎপরতা চোখে পড়েনি।
১০ ঘণ্টা আগে
গরিব ও দরিদ্র মানুষদের জন্য সরকারি বরাদ্দকৃত ভিজিডি কার্ড (পরিবর্তিত নাম ভিডব্লিউবি) বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। আজকের পত্রিকায় ২১ অক্টোবর সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে।
১০ ঘণ্টা আগে
হাত-পা বেঁধে ইচ্ছেমতো পিটিয়েছে স্থানীয় লোকজন। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় সেই ছিনতাইকারীর। সেখানে ঘটনা থেমে থাকেনি, লোকটির শরীরে লবণ দিয়ে উল্লাস করতে থাকে জনতা। টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকায় প্রতিদিন গড়ে ২০টি করে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এটা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবস্থারই ইঙ্গিত দেয়।
১ দিন আগেস্বপ্না রেজা

এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল বেশ খারাপ। বলা যায়, সন্তোষজনক নয়। যদিও পরীক্ষার ফল যে ভালো হবে, পাসের হার বেশি হবে, তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য কারণ বা উদ্যোগ কিন্তু ছিল না। বরাবরের মতো গত নয়-দশ মাসে তেমন কোনো উদ্যোগ, তৎপরতা চোখে পড়েনি। রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে যত কথা উঠেছে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে যত চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়েছে, অনিয়মের বিরুদ্ধে যত আওয়াজ উঠেছে, শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত মান বৃদ্ধি ও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে তার ন্যূনতম আলাপ-আলোচনা হতে দেখা যায়নি। কারোর দৃষ্টি ও উৎসাহ এই বিষয়ে ছিল বলেও মনে হয়নি। দুঃখজনক হলেও বলতে হয় যে, রাষ্ট্র সংস্কারের চেতনায় শিক্ষাব্যবস্থাকে অচেতন অবস্থায় রাখা হয়েছে এবং সেটা বিগত সময়ের মতোই। এককথায়, আমাদের দেশে ক্ষমতাকেন্দ্রিক যাবতীয় কাজ, পরিকল্পনা, উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে উত্তম ও কার্যকর পদক্ষেপ কোনো রাজনৈতিক সরকারকেই নিতে দেখা যায়নি। যেটুকু নেওয়া হয়েছে তা অযোগ্য ও অদক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়ে করা হয়েছে বলে অনেকের অভিযোগ। ফলে ভালো ফল পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব থেকেই গেছে। মেধাসম্পন্ন যোগ্য নাগরিক নয়, বরং রাজনৈতিক দল ও তার দলীয় চেতনায় দেশ গড়ার অন্যতম উপায় বলে প্রতিষ্ঠার হীন চেষ্টা চালানো হয়েছে সব সময়ই।
এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার পাসের হার ৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ, যা গত ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ফল বলে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে জানা গেছে। সংবাদমাধ্যমে আরও জানা যায়, এই ফলকে শিক্ষার প্রকৃত চিত্র বলে উল্লেখ করেছেন স্বয়ং শিক্ষা উপদেষ্টা। এটা তাঁর কৃতিত্বের ঢেকুর কি না, নাকি সাধারণ জনগণের মতো হতাশার উক্তি, সেটা বলা মুশকিল। যদি কৃতিত্বের ঢেকুর এমন হয়, তাঁদের আমলে কড়াকড়ি তথা যথাযথভাবে পরীক্ষার উত্তরপত্র যাচাই করা হয়েছে, তাই পাসের হার কম হয়েছে এবং এটাই বাস্তবতা। তাহলে বলতেই হয় যে এটা নিঃসন্দেহে একটা খোঁড়া যুক্তি। যদি পাসের হার বেশি হতো তাহলে হয়তো এমন যুক্তি দেওয়া থেকে তিনি বিরত থাকতেন। উল্টো বলা হতো, যথাযথ ও উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থার উত্তম ফলাফল। সব সরকারই যেভাবে কৃতিত্ব নিতে উৎসাহ বোধ করে থাকে, সে রকমই ব্যাপারটা এবারও ঘটেছে।
তবে সাধারণ জনগণ ভাবছে অন্য কথা। তারা বলছে, পরীক্ষায় পাস না করার কারণ হতে পারে উপযুক্ত শিক্ষা অর্জন ও প্রস্তুতি ছাড়াই শিক্ষার্থীরা এবার পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছেন। সোজাসুজি বললে দাঁড়ায়, শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে লেখাপড়া করেননি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকে গেছেন বেশ অনেক দিন। তরুণ, কিশোর, যুবকদের মধ্যে অন্য ধরনের তাড়না লক্ষ করা গেছে, যা শিক্ষাসংক্রান্ত নয়। বরং স্কুলের প্রধান শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার ঘটনা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান ব্যক্তিকে জুতার মালা পরিয়ে দেওয়ার মতো চরম ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ দেখানো হয়েছে এই সময়ে। বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যুতে শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে ধরনের ধৃষ্টতা প্রদর্শন করেছে, তা অনাকাঙ্ক্ষিত ও রাষ্ট্রের জন্য এক অশনিসংকেত। সরকার এই হীন কর্মকাণ্ডকে রোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে বলা যায়।
একজন প্রবীণ শিক্ষাবিদ দুঃখ করে বলছিলেন তাঁর সাম্প্রতিক সময়ের অভিজ্ঞতার কথা। যুবকদের নিয়ে আয়োজিত এক সেমিনারে তাঁকে সম্মানিত বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি যুবকদের মাঝে উপস্থিত হয়ে প্রথমেই জানতে চাইলেন, বক্তব্য দেওয়ার আগে জানতে চাই, তোমরা কয়জন নিয়মিত ক্লাসে যাচ্ছ, হাত তোলো? কিন্তু কারোর তোলা হাত তিনি দেখেননি। অবাক হন। জানতে চান, একটা হাতও না দেখার কারণ কী? তাদের কয়জন বেশ গাম্ভীর্য নিয়ে বলে, তারা এখন দেশ গড়ার কাজে ব্যস্ত। সংস্কারকাজে জড়িত। রাষ্ট্র সংস্কার হলে তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরবে। প্রবীণ ভদ্রলোক ভেবে নিলেন, এই মুহূর্তে যুবকদের জ্ঞান দেওয়া বৃথা। বরং তারাই তাঁকে জ্ঞান দিতে বেশি আগ্রহী। এমন আয়োজনও নেহাত শোআপ। বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যে অবস্থা, জাতীয় পর্যায়ে ব্যবস্থাপনার যে চিত্র, তা শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি ও প্রসারে সহায়ক নয়। যোগ্য ও দক্ষ জনশক্তির যথেষ্ট অভাব এই সেক্টরে। এই অভাব নতুন নয়, পুরোনো। বর্তমান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যে সার্বিক পরিস্থিতি তার ওপর গবেষণা চালালে প্রকৃত অবস্থা বোঝা যাবে।
ফলাফলে দেখা গেছে, ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাসের হার মূলধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তুলনায় বেশি। এবার ২০২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পাসের চেহারা দেখতে পারেনি। এর কারণ অনুসন্ধান করতে না পারলে এবং যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হলে শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যকার দূরত্ব বাড়বে বৈকি, যা দেশকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে না, বরং প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। দেশের অস্তিত্ব সংকটের একটা কারণ হবে।
অটোপাসের দাবি কর্তৃপক্ষের মেনে নেওয়ার ঘটনাটি কখনোই উন্নত শিক্ষাব্যবস্থাকে সমর্থন করে না, শিক্ষিত এক জাতির পূর্বাভাস দেয় না। বরং শিক্ষাব্যবস্থাকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের প্রচণ্ড সুযোগ দেয়। অতীতে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও তার শিক্ষার্থীদের কবজা করার প্রবণতা সব সরকারের ছিল এবং এখনো আছে। কিন্তু অটোপাস দিয়ে শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করবার ঘটনা সম্ভবত এই প্রথম এবং সেটা রাজনৈতিক ইস্যুতে। যেখানে ২৪-এর আন্দোলনের শুরুটা ছিল মেধার যোগ্যতায় বিসিএসে নিয়োগের দাবিতে, যদিও সেই আন্দোলন পৌঁছে যায় শেষ অবধি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে। সেখানে অটোপাসের বিষয়টি মেধার গুরুত্বকে কোথায় নিয়ে যায় বা যাবে, সংশ্লিষ্টরা তা বুঝতে সক্ষম হয়েছিল কি না, প্রশ্ন থেকেই যায়। প্রশ্ন থাকে, নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন ও তার প্রত্যয়, সেখানে মেধা ও শিক্ষার বিকল্প কী? উত্তর, কোনো বিকল্প নেই। একটা শিক্ষিত জাতি একটা দেশকে যতটা নিরাপদ করে রাখতে পারে, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে, স্থায়িত্বশীল উন্নয়নকে দৃশ্যমান করে তুলতে পারে, অন্য কোনো মন্ত্র, থিওরি কিন্তু তা পারে না।
যদি শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি মনোযোগ ও গুরুত্ব না দেওয়া হয়, তাহলে একদিন পাসের হার .০৫-এ নেমে গেলে কেউ আর আশ্চর্য হবে না। তখন এটাকে বাস্তব চিত্র বলে কৃতিত্ব নেওয়ার পথও থাকবে না। একজন ক্ষমতাসীনের চেয়ে একজন মেধাবী শিক্ষিতের প্রয়োজন এই দেশে সবচেয়ে বেশি।
স্বপ্না রেজা,কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক

এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল বেশ খারাপ। বলা যায়, সন্তোষজনক নয়। যদিও পরীক্ষার ফল যে ভালো হবে, পাসের হার বেশি হবে, তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য কারণ বা উদ্যোগ কিন্তু ছিল না। বরাবরের মতো গত নয়-দশ মাসে তেমন কোনো উদ্যোগ, তৎপরতা চোখে পড়েনি। রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে যত কথা উঠেছে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে যত চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়েছে, অনিয়মের বিরুদ্ধে যত আওয়াজ উঠেছে, শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত মান বৃদ্ধি ও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে তার ন্যূনতম আলাপ-আলোচনা হতে দেখা যায়নি। কারোর দৃষ্টি ও উৎসাহ এই বিষয়ে ছিল বলেও মনে হয়নি। দুঃখজনক হলেও বলতে হয় যে, রাষ্ট্র সংস্কারের চেতনায় শিক্ষাব্যবস্থাকে অচেতন অবস্থায় রাখা হয়েছে এবং সেটা বিগত সময়ের মতোই। এককথায়, আমাদের দেশে ক্ষমতাকেন্দ্রিক যাবতীয় কাজ, পরিকল্পনা, উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে উত্তম ও কার্যকর পদক্ষেপ কোনো রাজনৈতিক সরকারকেই নিতে দেখা যায়নি। যেটুকু নেওয়া হয়েছে তা অযোগ্য ও অদক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়ে করা হয়েছে বলে অনেকের অভিযোগ। ফলে ভালো ফল পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব থেকেই গেছে। মেধাসম্পন্ন যোগ্য নাগরিক নয়, বরং রাজনৈতিক দল ও তার দলীয় চেতনায় দেশ গড়ার অন্যতম উপায় বলে প্রতিষ্ঠার হীন চেষ্টা চালানো হয়েছে সব সময়ই।
এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার পাসের হার ৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ, যা গত ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ফল বলে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে জানা গেছে। সংবাদমাধ্যমে আরও জানা যায়, এই ফলকে শিক্ষার প্রকৃত চিত্র বলে উল্লেখ করেছেন স্বয়ং শিক্ষা উপদেষ্টা। এটা তাঁর কৃতিত্বের ঢেকুর কি না, নাকি সাধারণ জনগণের মতো হতাশার উক্তি, সেটা বলা মুশকিল। যদি কৃতিত্বের ঢেকুর এমন হয়, তাঁদের আমলে কড়াকড়ি তথা যথাযথভাবে পরীক্ষার উত্তরপত্র যাচাই করা হয়েছে, তাই পাসের হার কম হয়েছে এবং এটাই বাস্তবতা। তাহলে বলতেই হয় যে এটা নিঃসন্দেহে একটা খোঁড়া যুক্তি। যদি পাসের হার বেশি হতো তাহলে হয়তো এমন যুক্তি দেওয়া থেকে তিনি বিরত থাকতেন। উল্টো বলা হতো, যথাযথ ও উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থার উত্তম ফলাফল। সব সরকারই যেভাবে কৃতিত্ব নিতে উৎসাহ বোধ করে থাকে, সে রকমই ব্যাপারটা এবারও ঘটেছে।
তবে সাধারণ জনগণ ভাবছে অন্য কথা। তারা বলছে, পরীক্ষায় পাস না করার কারণ হতে পারে উপযুক্ত শিক্ষা অর্জন ও প্রস্তুতি ছাড়াই শিক্ষার্থীরা এবার পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছেন। সোজাসুজি বললে দাঁড়ায়, শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে লেখাপড়া করেননি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকে গেছেন বেশ অনেক দিন। তরুণ, কিশোর, যুবকদের মধ্যে অন্য ধরনের তাড়না লক্ষ করা গেছে, যা শিক্ষাসংক্রান্ত নয়। বরং স্কুলের প্রধান শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার ঘটনা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান ব্যক্তিকে জুতার মালা পরিয়ে দেওয়ার মতো চরম ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ দেখানো হয়েছে এই সময়ে। বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যুতে শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে ধরনের ধৃষ্টতা প্রদর্শন করেছে, তা অনাকাঙ্ক্ষিত ও রাষ্ট্রের জন্য এক অশনিসংকেত। সরকার এই হীন কর্মকাণ্ডকে রোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে বলা যায়।
একজন প্রবীণ শিক্ষাবিদ দুঃখ করে বলছিলেন তাঁর সাম্প্রতিক সময়ের অভিজ্ঞতার কথা। যুবকদের নিয়ে আয়োজিত এক সেমিনারে তাঁকে সম্মানিত বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি যুবকদের মাঝে উপস্থিত হয়ে প্রথমেই জানতে চাইলেন, বক্তব্য দেওয়ার আগে জানতে চাই, তোমরা কয়জন নিয়মিত ক্লাসে যাচ্ছ, হাত তোলো? কিন্তু কারোর তোলা হাত তিনি দেখেননি। অবাক হন। জানতে চান, একটা হাতও না দেখার কারণ কী? তাদের কয়জন বেশ গাম্ভীর্য নিয়ে বলে, তারা এখন দেশ গড়ার কাজে ব্যস্ত। সংস্কারকাজে জড়িত। রাষ্ট্র সংস্কার হলে তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরবে। প্রবীণ ভদ্রলোক ভেবে নিলেন, এই মুহূর্তে যুবকদের জ্ঞান দেওয়া বৃথা। বরং তারাই তাঁকে জ্ঞান দিতে বেশি আগ্রহী। এমন আয়োজনও নেহাত শোআপ। বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যে অবস্থা, জাতীয় পর্যায়ে ব্যবস্থাপনার যে চিত্র, তা শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি ও প্রসারে সহায়ক নয়। যোগ্য ও দক্ষ জনশক্তির যথেষ্ট অভাব এই সেক্টরে। এই অভাব নতুন নয়, পুরোনো। বর্তমান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যে সার্বিক পরিস্থিতি তার ওপর গবেষণা চালালে প্রকৃত অবস্থা বোঝা যাবে।
ফলাফলে দেখা গেছে, ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাসের হার মূলধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তুলনায় বেশি। এবার ২০২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পাসের চেহারা দেখতে পারেনি। এর কারণ অনুসন্ধান করতে না পারলে এবং যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হলে শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যকার দূরত্ব বাড়বে বৈকি, যা দেশকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে না, বরং প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। দেশের অস্তিত্ব সংকটের একটা কারণ হবে।
অটোপাসের দাবি কর্তৃপক্ষের মেনে নেওয়ার ঘটনাটি কখনোই উন্নত শিক্ষাব্যবস্থাকে সমর্থন করে না, শিক্ষিত এক জাতির পূর্বাভাস দেয় না। বরং শিক্ষাব্যবস্থাকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের প্রচণ্ড সুযোগ দেয়। অতীতে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও তার শিক্ষার্থীদের কবজা করার প্রবণতা সব সরকারের ছিল এবং এখনো আছে। কিন্তু অটোপাস দিয়ে শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করবার ঘটনা সম্ভবত এই প্রথম এবং সেটা রাজনৈতিক ইস্যুতে। যেখানে ২৪-এর আন্দোলনের শুরুটা ছিল মেধার যোগ্যতায় বিসিএসে নিয়োগের দাবিতে, যদিও সেই আন্দোলন পৌঁছে যায় শেষ অবধি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে। সেখানে অটোপাসের বিষয়টি মেধার গুরুত্বকে কোথায় নিয়ে যায় বা যাবে, সংশ্লিষ্টরা তা বুঝতে সক্ষম হয়েছিল কি না, প্রশ্ন থেকেই যায়। প্রশ্ন থাকে, নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন ও তার প্রত্যয়, সেখানে মেধা ও শিক্ষার বিকল্প কী? উত্তর, কোনো বিকল্প নেই। একটা শিক্ষিত জাতি একটা দেশকে যতটা নিরাপদ করে রাখতে পারে, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে, স্থায়িত্বশীল উন্নয়নকে দৃশ্যমান করে তুলতে পারে, অন্য কোনো মন্ত্র, থিওরি কিন্তু তা পারে না।
যদি শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি মনোযোগ ও গুরুত্ব না দেওয়া হয়, তাহলে একদিন পাসের হার .০৫-এ নেমে গেলে কেউ আর আশ্চর্য হবে না। তখন এটাকে বাস্তব চিত্র বলে কৃতিত্ব নেওয়ার পথও থাকবে না। একজন ক্ষমতাসীনের চেয়ে একজন মেধাবী শিক্ষিতের প্রয়োজন এই দেশে সবচেয়ে বেশি।
স্বপ্না রেজা,কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক

কোনও খোপে বেশি দিন আটকে থাকা চিন্তক রণজিৎ গুহের স্বভাব নয়। ১৯৯০-এর দশক থেকে আধুনিক ইউরোপীয় ইতিহাসবিদ্যার সর্বেশ্বরতার প্রতিকামী চিন্তার চর্চার ক্ষেত্র চিহ্নিত করতে গিয়ে তিনি হাজির হলেন সৃজনশীল ভাবনার অভিনব পরিসরে।
২৯ এপ্রিল ২০২৩
ছোট ছিলাম যখন, তখন শোনা কথাগুলোকে অমূল্য মনে হতো। বুঝে না-বুঝে প্রচলিত কথাগুলোকেই বিশ্বাস করতাম। বয়স বাড়তে লাগল, বুঝতে পারলাম, জীবনে এমন অনেক কিছুই আছে, যা আদর্শবাদের সঙ্গে যায় না। বাস্তব একেবারে অন্য কিছু।
১০ ঘণ্টা আগে
গরিব ও দরিদ্র মানুষদের জন্য সরকারি বরাদ্দকৃত ভিজিডি কার্ড (পরিবর্তিত নাম ভিডব্লিউবি) বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। আজকের পত্রিকায় ২১ অক্টোবর সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে।
১০ ঘণ্টা আগে
হাত-পা বেঁধে ইচ্ছেমতো পিটিয়েছে স্থানীয় লোকজন। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় সেই ছিনতাইকারীর। সেখানে ঘটনা থেমে থাকেনি, লোকটির শরীরে লবণ দিয়ে উল্লাস করতে থাকে জনতা। টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকায় প্রতিদিন গড়ে ২০টি করে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এটা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবস্থারই ইঙ্গিত দেয়।
১ দিন আগেসম্পাদকীয়

গরিব ও দরিদ্র মানুষদের জন্য সরকারি বরাদ্দকৃত ভিজিডি কার্ড (পরিবর্তিত নাম ভিডব্লিউবি) বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। আজকের পত্রিকায় ২১ অক্টোবর সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে।
ঘটনাটি ঘটেছে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার সদর ইউনিয়নে। প্রকৃত দরিদ্র ব্যক্তিরা নয়, কার্ড পেয়েছেন ইউপি সদস্যের মেয়ে, প্রবাসীর স্ত্রী, চাকরিজীবীর পরিবার, এমনকি ১৫ বিঘা জমি ও পাকা বাড়ির মালিকেরাও। ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসক, সচিব এবং একজন বিএনপিপন্থী প্রভাবশালী ইউপি সদস্যের যোগসাজশেই এই অনিয়মের কালো অধ্যায় রচিত হয়েছে। ৭ থেকে ১০ হাজার টাকা ঘুষের বিনিময়ে প্রকৃত দুস্থদের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে, সচ্ছল পরিবারগুলোকে ভিজিডি কার্ড দেওয়া হয়েছে। নীতিমালার তোয়াক্কা না করে এই তালিকা প্রণয়ন শুধু নিয়ম ভঙ্গ করাই নয়, এটি অসহায় মানুষের মৌলিক অধিকার হরণের শামিল।
শুধু দুস্থ ব্যক্তিদের কার্ডের জন্য নয়, সরকারের পক্ষ থেকে দারিদ্র্য নিরসনে বিভিন্ন প্রকল্প, বিশেষ সম্প্রদায় বা পেশার জনগোষ্ঠীকে সহায়তা করাসহ নানা জনকল্যাণমূলক কাজেও এমন দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায়। বিধবা না হয়ে ভাতা উত্তোলন, ধনী হয়ে ভূমিহীনের জমি পাওয়া এবং প্রকৃত গৃহহীন মানুষ আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর না পাওয়াসহ নানা অভিযোগের খবর প্রতিনিয়ত পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
ঘটনাটি ঘটেছে মূলত নির্বাচিত চেয়ারম্যান না থাকায়। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর দেশের কোনো ইউনিয়ন পরিষদে এখন আর নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও সদস্য নেই। এই ইউনিয়নে প্রশাসকের দায়িত্ব পেয়েছেন উপজেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের এক কর্মকর্তা। অনির্বাচিত ব্যক্তির সাধারণ মানুষের প্রতি দায়বোধ থাকে না। সে জন্য অপকর্মটি এই প্রশাসকের মাধ্যমে সম্ভব হয়েছে।
সবার প্রত্যাশা ছিল, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটবে না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আগে যেমন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কেউ কেউ এসব করতেন, এখন সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কেউ কেউ একই কাজ করছেন। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হলো, তদন্ত চলাকালেই অনিয়মের মাধ্যমে কার্ড পাওয়া ব্যক্তিরা দুই মাসের চাল তুলে নিয়েছেন।
সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মূল লক্ষ্য হলো পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে মুক্তি দেওয়া। কিন্তু যখন সেই কর্মসূচি দুর্নীতি দ্বারা আক্রান্ত হয়, তখন সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ পূরণ করা সম্ভব হয় না।
যদি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারির মাধ্যমে অনিয়মকারীদের বিচারের আওতায় আনা হতো, তাহলে এ ধরনের দুর্নীতি কিছুটা কমত।
অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ করতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং জেলা প্রশাসকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তদন্ত প্রতিবেদন জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানো হয়েছে, কিন্তু এই ঘটনায় যাঁরা সরাসরি জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে বিভাগীয় ও ফৌজদারি ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। শুধু ইউপি সচিব ও মেম্বারকে দায়ী করে প্রশাসককে রেহাই দেওয়া হলে তা ভুল বার্তা দেবে। সব স্তরের জড়িত ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে যাঁরা অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। যথাযথ তদন্ত করে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

গরিব ও দরিদ্র মানুষদের জন্য সরকারি বরাদ্দকৃত ভিজিডি কার্ড (পরিবর্তিত নাম ভিডব্লিউবি) বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। আজকের পত্রিকায় ২১ অক্টোবর সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে।
ঘটনাটি ঘটেছে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার সদর ইউনিয়নে। প্রকৃত দরিদ্র ব্যক্তিরা নয়, কার্ড পেয়েছেন ইউপি সদস্যের মেয়ে, প্রবাসীর স্ত্রী, চাকরিজীবীর পরিবার, এমনকি ১৫ বিঘা জমি ও পাকা বাড়ির মালিকেরাও। ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসক, সচিব এবং একজন বিএনপিপন্থী প্রভাবশালী ইউপি সদস্যের যোগসাজশেই এই অনিয়মের কালো অধ্যায় রচিত হয়েছে। ৭ থেকে ১০ হাজার টাকা ঘুষের বিনিময়ে প্রকৃত দুস্থদের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে, সচ্ছল পরিবারগুলোকে ভিজিডি কার্ড দেওয়া হয়েছে। নীতিমালার তোয়াক্কা না করে এই তালিকা প্রণয়ন শুধু নিয়ম ভঙ্গ করাই নয়, এটি অসহায় মানুষের মৌলিক অধিকার হরণের শামিল।
শুধু দুস্থ ব্যক্তিদের কার্ডের জন্য নয়, সরকারের পক্ষ থেকে দারিদ্র্য নিরসনে বিভিন্ন প্রকল্প, বিশেষ সম্প্রদায় বা পেশার জনগোষ্ঠীকে সহায়তা করাসহ নানা জনকল্যাণমূলক কাজেও এমন দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায়। বিধবা না হয়ে ভাতা উত্তোলন, ধনী হয়ে ভূমিহীনের জমি পাওয়া এবং প্রকৃত গৃহহীন মানুষ আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর না পাওয়াসহ নানা অভিযোগের খবর প্রতিনিয়ত পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
ঘটনাটি ঘটেছে মূলত নির্বাচিত চেয়ারম্যান না থাকায়। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর দেশের কোনো ইউনিয়ন পরিষদে এখন আর নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও সদস্য নেই। এই ইউনিয়নে প্রশাসকের দায়িত্ব পেয়েছেন উপজেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের এক কর্মকর্তা। অনির্বাচিত ব্যক্তির সাধারণ মানুষের প্রতি দায়বোধ থাকে না। সে জন্য অপকর্মটি এই প্রশাসকের মাধ্যমে সম্ভব হয়েছে।
সবার প্রত্যাশা ছিল, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটবে না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আগে যেমন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কেউ কেউ এসব করতেন, এখন সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কেউ কেউ একই কাজ করছেন। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হলো, তদন্ত চলাকালেই অনিয়মের মাধ্যমে কার্ড পাওয়া ব্যক্তিরা দুই মাসের চাল তুলে নিয়েছেন।
সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মূল লক্ষ্য হলো পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে মুক্তি দেওয়া। কিন্তু যখন সেই কর্মসূচি দুর্নীতি দ্বারা আক্রান্ত হয়, তখন সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ পূরণ করা সম্ভব হয় না।
যদি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারির মাধ্যমে অনিয়মকারীদের বিচারের আওতায় আনা হতো, তাহলে এ ধরনের দুর্নীতি কিছুটা কমত।
অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ করতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং জেলা প্রশাসকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তদন্ত প্রতিবেদন জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানো হয়েছে, কিন্তু এই ঘটনায় যাঁরা সরাসরি জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে বিভাগীয় ও ফৌজদারি ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। শুধু ইউপি সচিব ও মেম্বারকে দায়ী করে প্রশাসককে রেহাই দেওয়া হলে তা ভুল বার্তা দেবে। সব স্তরের জড়িত ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে যাঁরা অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। যথাযথ তদন্ত করে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

কোনও খোপে বেশি দিন আটকে থাকা চিন্তক রণজিৎ গুহের স্বভাব নয়। ১৯৯০-এর দশক থেকে আধুনিক ইউরোপীয় ইতিহাসবিদ্যার সর্বেশ্বরতার প্রতিকামী চিন্তার চর্চার ক্ষেত্র চিহ্নিত করতে গিয়ে তিনি হাজির হলেন সৃজনশীল ভাবনার অভিনব পরিসরে।
২৯ এপ্রিল ২০২৩
ছোট ছিলাম যখন, তখন শোনা কথাগুলোকে অমূল্য মনে হতো। বুঝে না-বুঝে প্রচলিত কথাগুলোকেই বিশ্বাস করতাম। বয়স বাড়তে লাগল, বুঝতে পারলাম, জীবনে এমন অনেক কিছুই আছে, যা আদর্শবাদের সঙ্গে যায় না। বাস্তব একেবারে অন্য কিছু।
১০ ঘণ্টা আগে
এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল বেশ খারাপ। বলা যায়, সন্তোষজনক নয়। যদিও পরীক্ষার ফল যে ভালো হবে, পাসের হার বেশি হবে, তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য কারণ বা উদ্যোগ কিন্তু ছিল না। বরাবরের মতো গত নয়-দশ মাসে তেমন কোনো উদ্যোগ, তৎপরতা চোখে পড়েনি।
১০ ঘণ্টা আগে
হাত-পা বেঁধে ইচ্ছেমতো পিটিয়েছে স্থানীয় লোকজন। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় সেই ছিনতাইকারীর। সেখানে ঘটনা থেমে থাকেনি, লোকটির শরীরে লবণ দিয়ে উল্লাস করতে থাকে জনতা। টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকায় প্রতিদিন গড়ে ২০টি করে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এটা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবস্থারই ইঙ্গিত দেয়।
১ দিন আগেসম্পাদকীয়

গাজীপুরের টঙ্গীতে এক ছিনতাইকারীকে হাতেনাতে ধরে ফেলেছিল এলাকাবাসী। দুজন মিলে মোবাইল ছিনতাই করতে গিয়েছিল, তাদের একজন পালিয়ে গিয়েছিল, অন্যজনকে ধরে রশি দিয়ে হাত-পা বেঁধে ইচ্ছেমতো পিটিয়েছে স্থানীয় লোকজন। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় সেই ছিনতাইকারীর। সেখানে ঘটনা থেমে থাকেনি, লোকটির শরীরে লবণ দিয়ে উল্লাস করতে থাকে জনতা।
টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকায় প্রতিদিন গড়ে ২০টি করে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এটা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবস্থারই ইঙ্গিত দেয়। যদি প্রতিদিন ২০টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে তা প্রতিরোধ করা হয় না কেন? আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার মতো পর্যাপ্ত লোকবল কি নেই? ছিনতাইয়ের স্পটগুলো কি চিহ্নিত করা হয়েছে? এই দায় কার ওপর বর্তায়? যদি ছিনতাই রোধ করার মতো পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হতো এবং ছিনতাইকারীদের উপযুক্ত শাস্তি হতো, তাহলে এ পথ কেউ মাড়াত না। অবস্থাদৃষ্টে দেখা যাচ্ছে, সেই পরিবেশ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে সংশ্লিষ্টরা। আর তাই এখনো প্রতিদিন গড়ে ২০টা করে ছিনতাই হয়ে যাচ্ছে।
ছিনতাই করার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নয়। কিন্তু উত্তেজিত জনতা সেই সাজাই দিয়েছে ছিনতাইকারীকে। জনতা ছিনতাইকারীকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করেনি, বিচার চায়নি, বরং হাত-পা রশি দিয়ে বেঁধে বেদম প্রহার করেছে। এতটাই মেরেছে যে ঘটনাস্থলেই সে নিহত হয়েছে। নিহত হওয়ার পর মৃতদেহে লবণ ছিটিয়ে উল্লাস করেছে জনতা!
আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার এই দৃষ্টান্ত মোটেই সুখকর কিছু নয়। যারা হত্যা করে, তারাই হত্যাকারী। এই হত্যার দায় কি এই উল্লসিত জনতা দেবে? প্রশ্ন জাগে, মানুষ কেন এতটা অসহিষ্ণু হয়ে উঠল? কেন একজন মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে হবে? আইনের পথটি কি তাদের জানা নেই?
জানা আছে নিশ্চয়। কিন্তু দিনের পর দিন ছিনতাইকারীদের শাস্তি হচ্ছে না দেখে নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে। পুলিশ কিংবা নিরাপত্তারক্ষীরা যদি সতর্ক হয়ে ছিনতাইকারীদের পরিকল্পনা ভেস্তে দিতে পারত, ছিনতাইকারীরা যদি তাদের অপরাধের সাজা পেত, তাহলে হয়তো মানুষ নিজের হাতে আইন তুলে নিত না। কিন্তু এখন এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, যদি কেউ কাউকে ছিনতাইকারী বলে পেটাতে শুরু করে, তাহলে সমবেত জনতার প্রত্যেকেই খায়েশ মিটিয়ে পেটাতে থাকবে। কারও সাতে-পাঁচে নেই—এমন একজন নিরীহ মানুষও এই মবের হাতে প্রাণ হারাতে পারে।
ধরা যাক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর হয়ে ছিনতাইকারীদের ধরতে শুরু করল, তাতে কি জনতার এই উন্মত্ততা কমে যাবে? মনে হয় না। হিংস্রতা নিবারণের জন্য পারিবারিক শিক্ষা, সচেতনতা ইত্যাদির প্রয়োজন পড়ে। সৎ গুণাবলি তৈরি করতে হলে তো সেটার চর্চা দরকার। সেই চর্চাই তো কমে গেছে। একজন মানুষের মনে যদি হিংসা, ঘৃণা, ক্ষোভ জমা হতে থাকে, কমে যেতে থাকে ভালোবাসা, মানবতা—তাহলে সে মৃত মানুষের লাশ নিয়ে উল্লাসই করবে! এ এক ভয়াবহ বাস্তবতা!

গাজীপুরের টঙ্গীতে এক ছিনতাইকারীকে হাতেনাতে ধরে ফেলেছিল এলাকাবাসী। দুজন মিলে মোবাইল ছিনতাই করতে গিয়েছিল, তাদের একজন পালিয়ে গিয়েছিল, অন্যজনকে ধরে রশি দিয়ে হাত-পা বেঁধে ইচ্ছেমতো পিটিয়েছে স্থানীয় লোকজন। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় সেই ছিনতাইকারীর। সেখানে ঘটনা থেমে থাকেনি, লোকটির শরীরে লবণ দিয়ে উল্লাস করতে থাকে জনতা।
টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকায় প্রতিদিন গড়ে ২০টি করে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এটা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবস্থারই ইঙ্গিত দেয়। যদি প্রতিদিন ২০টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে তা প্রতিরোধ করা হয় না কেন? আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার মতো পর্যাপ্ত লোকবল কি নেই? ছিনতাইয়ের স্পটগুলো কি চিহ্নিত করা হয়েছে? এই দায় কার ওপর বর্তায়? যদি ছিনতাই রোধ করার মতো পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হতো এবং ছিনতাইকারীদের উপযুক্ত শাস্তি হতো, তাহলে এ পথ কেউ মাড়াত না। অবস্থাদৃষ্টে দেখা যাচ্ছে, সেই পরিবেশ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে সংশ্লিষ্টরা। আর তাই এখনো প্রতিদিন গড়ে ২০টা করে ছিনতাই হয়ে যাচ্ছে।
ছিনতাই করার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নয়। কিন্তু উত্তেজিত জনতা সেই সাজাই দিয়েছে ছিনতাইকারীকে। জনতা ছিনতাইকারীকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করেনি, বিচার চায়নি, বরং হাত-পা রশি দিয়ে বেঁধে বেদম প্রহার করেছে। এতটাই মেরেছে যে ঘটনাস্থলেই সে নিহত হয়েছে। নিহত হওয়ার পর মৃতদেহে লবণ ছিটিয়ে উল্লাস করেছে জনতা!
আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার এই দৃষ্টান্ত মোটেই সুখকর কিছু নয়। যারা হত্যা করে, তারাই হত্যাকারী। এই হত্যার দায় কি এই উল্লসিত জনতা দেবে? প্রশ্ন জাগে, মানুষ কেন এতটা অসহিষ্ণু হয়ে উঠল? কেন একজন মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে হবে? আইনের পথটি কি তাদের জানা নেই?
জানা আছে নিশ্চয়। কিন্তু দিনের পর দিন ছিনতাইকারীদের শাস্তি হচ্ছে না দেখে নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে। পুলিশ কিংবা নিরাপত্তারক্ষীরা যদি সতর্ক হয়ে ছিনতাইকারীদের পরিকল্পনা ভেস্তে দিতে পারত, ছিনতাইকারীরা যদি তাদের অপরাধের সাজা পেত, তাহলে হয়তো মানুষ নিজের হাতে আইন তুলে নিত না। কিন্তু এখন এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, যদি কেউ কাউকে ছিনতাইকারী বলে পেটাতে শুরু করে, তাহলে সমবেত জনতার প্রত্যেকেই খায়েশ মিটিয়ে পেটাতে থাকবে। কারও সাতে-পাঁচে নেই—এমন একজন নিরীহ মানুষও এই মবের হাতে প্রাণ হারাতে পারে।
ধরা যাক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর হয়ে ছিনতাইকারীদের ধরতে শুরু করল, তাতে কি জনতার এই উন্মত্ততা কমে যাবে? মনে হয় না। হিংস্রতা নিবারণের জন্য পারিবারিক শিক্ষা, সচেতনতা ইত্যাদির প্রয়োজন পড়ে। সৎ গুণাবলি তৈরি করতে হলে তো সেটার চর্চা দরকার। সেই চর্চাই তো কমে গেছে। একজন মানুষের মনে যদি হিংসা, ঘৃণা, ক্ষোভ জমা হতে থাকে, কমে যেতে থাকে ভালোবাসা, মানবতা—তাহলে সে মৃত মানুষের লাশ নিয়ে উল্লাসই করবে! এ এক ভয়াবহ বাস্তবতা!

কোনও খোপে বেশি দিন আটকে থাকা চিন্তক রণজিৎ গুহের স্বভাব নয়। ১৯৯০-এর দশক থেকে আধুনিক ইউরোপীয় ইতিহাসবিদ্যার সর্বেশ্বরতার প্রতিকামী চিন্তার চর্চার ক্ষেত্র চিহ্নিত করতে গিয়ে তিনি হাজির হলেন সৃজনশীল ভাবনার অভিনব পরিসরে।
২৯ এপ্রিল ২০২৩
ছোট ছিলাম যখন, তখন শোনা কথাগুলোকে অমূল্য মনে হতো। বুঝে না-বুঝে প্রচলিত কথাগুলোকেই বিশ্বাস করতাম। বয়স বাড়তে লাগল, বুঝতে পারলাম, জীবনে এমন অনেক কিছুই আছে, যা আদর্শবাদের সঙ্গে যায় না। বাস্তব একেবারে অন্য কিছু।
১০ ঘণ্টা আগে
এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল বেশ খারাপ। বলা যায়, সন্তোষজনক নয়। যদিও পরীক্ষার ফল যে ভালো হবে, পাসের হার বেশি হবে, তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য কারণ বা উদ্যোগ কিন্তু ছিল না। বরাবরের মতো গত নয়-দশ মাসে তেমন কোনো উদ্যোগ, তৎপরতা চোখে পড়েনি।
১০ ঘণ্টা আগে
গরিব ও দরিদ্র মানুষদের জন্য সরকারি বরাদ্দকৃত ভিজিডি কার্ড (পরিবর্তিত নাম ভিডব্লিউবি) বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। আজকের পত্রিকায় ২১ অক্টোবর সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে।
১০ ঘণ্টা আগে