Ajker Patrika

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ৩৯ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ

‘সরকারের বেতন খাস না? গুলি করবি না কেন’—এসআই আশরাফুলকে এডিসি আখতারুল

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২২: ১০
‘সরকারের বেতন খাস না? গুলি করবি না কেন’—এসআই আশরাফুলকে এডিসি আখতারুল

মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচিতে চানখাঁরপুলসংলগ্ন বংশাল ও চকবাজার এলাকা থেকে আসা ছাত্র-জনতা শাহবাগের দিকে যেতে চাইলে সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) আখতারুল ইসলামের নির্দেশে সাউন্ড গ্রেনেড ও শটগান দিয়ে ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। এপিবিএন পুলিশকে দিয়ে শটগান ফায়ার করে ছাত্র-জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করা হয়। ওই সময় এডিসি আখতারুল বলেন, ‘তোমাদের যাদের কাছে পিস্তল ও চায়না রাইফেল আছে, তারা আন্দোলনকারীদের প্রতি ফায়ার করে তাদেরকে মেরে ফেলো।’

আজ সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ সাক্ষ্য দেওয়ার সময় এসব কথা বলেন আন্দোলনের সময় দায়িত্ব পালন করা পুলিশ কর্মকর্তা আশরাফুল ইসলাম।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় জুলাই–আগস্টে সারা দেশে চালানো হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আজ বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ এই সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। আজ আশরাফুল ছাড়াও সাক্ষ্য দেন আন্দোলনে অংশ নেওয়া চট্টগ্রাম কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মোহাম্মদ হাসান এবং গাজীপুরের কোনাবাড়ী এলাকার বাসিন্দা সোহেল মাহমুদ। এ মামলায় এ পর্যন্ত সাক্ষ্য দিয়েছেন মোট ৩৯ জন।

মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলায় শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে গত ১০ জুলাই অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। একপর্যায়ে এই মামলায় দোষ স্বীকার করে ঘটনার সত্যতা উদ্‌ঘাটনে রাজসাক্ষী (অ্যাপ্রোভার) হতে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের আবেদন মঞ্জুর করেন ট্র্যাইব্যুনাল।

সাক্ষ্য গ্রহণের পর তাঁদের জেরা করেন পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। এ মামলায় সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন আসামি থেকে রাজসাক্ষী হয়ে এরই মধ্যে সাক্ষ্য দিয়েছেন।

আজ পুলিশের এসআই মো. আশরাফুল ইসলাম তাঁর জবানবন্দিতে বলেন, ‘গত বছরের ৫ আগস্ট ৬০-৬৫ জন পুলিশ এডিসি শাহ্ আলম মোহাম্মদ আখতারুল ইসলাম স্যার, এসি ইমরুল স্যার, ইন্সপেক্টর মো. আরশাদ হোসেনের নেতৃত্বে ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ডিউটিতে পৌঁছাই। সেখানে পৌঁছে এসি ইমরুল স্যারসহ কয়েকজন কয়েকটি সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করলে আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ওই সময় এডিসি আখতারুল স্যারের নির্দেশে কয়েকজন আন্দোলনকারীকে গ্রেপ্তার করে প্রিজন ভ্যানে শাহবাগ থানায় পাঠানো হয়। এডিসি আখতারুল স্যারের নির্দেশে এসি ইমরুল স্যার, ইন্সপেক্টর আরশাদ স্যার, ১৫-২০ জন এপিবিএন সদস্য, ডিএমপির ১০-১৫ জন সদস্যের সঙ্গে আমিসহ আমার সঙ্গে থাকা কনস্টেবল পিয়াস, আসিফ, আকাশ ও নাসিরুল পায়ে হেঁটে সাড়ে ১০টার দিকে চানখাঁরপুলে পৌঁছাই।’

আশরাফুল বলেন, ‘চানখাঁরপুলসংলগ্ন বংশাল ও চকবাজার এলাকা থেকে আসা ছাত্র-জনতা মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচিতে শাহবাগের দিকে যেতে চাইলে এডিসি আখতারুল ইসলাম স্যারের নির্দেশে কোনো প্রয়োজন ছাড়া সাউন্ড গ্রেনেড, গ্যাস গান ও শটগান দিয়ে ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। এই গুলি করা হয় চানখাঁরপুল মোড়ে। এপিবিএন পুলিশকে দিয়ে শটগান ফায়ার করে ছাত্র-জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করা হয়। ওই সময় এডিসি আখতারুল বলেন, ‘‘তোমাদের যাদের কাছে পিস্তল ও চায়না রাইফেল আছে, তারা আন্দোলনকারীদের প্রতি ফায়ার করে তাদেরকে মেরে ফেলো।’’

আশরাফুল আরও বলেন, ‘তখন আমিসহ আরও কয়েকজন এই অবৈধ আদেশ পালন না করলে তিনি আমাদের অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতে থাকেন। তিনি আমাদের হুমকি দিয়ে বলেন, ‘‘তোরা সরকারের বেতন–রেশন খাস না? গুলি করবি না কেন? তোদের চাকরি খেয়ে দেব।’’ তারপরও আমি আমার পিস্তল দিয়ে ফায়ার করা থেকে বিরত থাকি। এরপর কনস্টেবল মো. নাসিরুল ইসলাম এডিসি আখতারুলের সরবরাহ করা অতিরিক্ত গুলি ব্যবহার করে রাস্তায় বসে চায়নিজ রাইফেল দিয়ে আন্দোলনকারীদের টার্গেট করে বারবার ফায়ার করতে থাকে। এ সময় এডিসি আখতারুল ইসলাম এপিবিএন পুলিশের একজন কনস্টেবলের হাত থেকে চায়নিজ রাইফেল কেড়ে নিয়ে এপিবিএন পুলিশের কনস্টেবল সুজন হোসেনের হাতে দেয়। যার হাত থেকে চায়নিজ রাইফেল কেড়ে নেওয়া হয়, সে গুলি করা থেকে বিরত ছিল।’

আশরাফুল বলেন, ‘কনস্টেবল সুজন হোসেন চানখাঁরপুল মোড়ে কখনো দাঁড়িয়ে, কখনো শুয়ে, কখনো হাঁটু গেড়ে বসে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে চায়নিজ রাইফেল দিয়ে গুলি করতে থাকে। তা ছাড়া এপিবিএনের কনস্টেবল ইমাজ হোসেন ইমন তার নামে ইস্যু করা চায়নিজ রাইফেল দিয়ে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি করে। আমি দেখতে পাই, গুলিতে বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারী গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় পড়ে গেলে অন্য আন্দোলনকারীরা তাদের ধরাধরি করে নিয়ে যাচ্ছে। তারপর এসি ইমরুল স্যার, ইন্সপেক্টর আরশাদ স্যার এপিবিএনের পাঁচ-সাতজন সদস্য নিয়ে নাজিমুদ্দিন রোডের বিভিন্ন গলিতে গুলি করতে করতে প্রবেশ করলে আমরা চায়নিজ রাইফেলের গুলির শব্দ শুনতে পাই। এরপর শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন শুনতে পেয়ে দুপুর আড়াইটার দিকে চানখাঁরপুল এলাকার পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তখন এডিসি আখতারুল স্যারের নির্দেশে টিএসসি মোড় হয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হয়ে শাহবাগ থানার পেছন দিক দিয়ে থানায় প্রবেশ করি।’

আন্দোলনে গুলিতে আহত চট্টগ্রাম কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ হাসান জবানবন্দিতে বলেন, তাঁর শরীরে শটগানের ১১টি গুলি লাগে। তিনটি এখনো ভেতরে রয়েছে। তিনি বলেন, গত বছরের ১৬ জুলাই চট্টগ্রামের মুরাদপুর এলাকায় যুবলীগ নেতা নুরুল আযিম রনির নেতৃত্বে হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর, শৈবাল দাস, সুমন, সাবেক মেয়র আজম নাছিরসহ আরও অনেকে তাঁদের লক্ষ্য করে গুলি করতে থাকেন। রনির হাতে পিস্তল, বাবরের হাতে শটগান ও অন্যদের হাতে দেশীয় অস্ত্র ছিল। ওই ঘটনায় আন্দোলনকারী ফয়সাল আহমেদ শান্ত নিহত হন। পরে জানতে পারেন, সন্ত্রাসীরা ওয়াসীম আকরাম নামের একজন আন্দোলনকারীকে মুরাদপুর এলাকায় কুপিয়ে এবং ফারুক নামের একজন কাঠমিস্ত্রীকে গুলি করে হত্যা করেছে।

হাসান আরও বলেন, ‘১৮ জুলাই চট্টগ্রাম নতুন ব্রিজ এলাকায় অবস্থান কর্মসূচি ছিল। সেখানে ওই সময় প্রায় ২ হাজার আন্দোলনকারী অবস্থান করছিল। আমাদের সামনে বাকুলিয়া ও কর্ণফুলী থানার পুলিশ এবং তাদের পেছনে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ছিল। পুলিশ আমাদের লক্ষ্য করে সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার সেল ছুড়লে আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই। পরে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ সদস্যরা আমাদের লক্ষ্য করে শটগান দিয়ে গুলি করলে আমি পিঠে গুলিবিদ্ধ হই। প্রথমে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাওয়ার সময় গেটে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও পুলিশ প্রবেশে বাধা দেয়। পরে বেসরকারি পার্কভিউ হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিই। সেখানে ডাক্তারেরা আটটি গুলি বের করেন এবং এখনো তিনটি শরীরে আছে (এ সময় সাক্ষী গুলিবিদ্ধ ক্ষতস্থান ট্রাইব্যুনালকে দেখান)।’ তিনি হত্যা ও নির্যাতনের জন্য শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনার ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের কঠিন শাস্তির দাবি করেন।

এ ছাড়া গাজীপুরের কোনাবাড়ী এলাকার বাসিন্দা সোহেল মাহমুদ তাঁর জবানবন্দিতে বলেন, ‘আমি ৫ আগস্ট সকালে বাড়ির পাশে শরীফ মেডিকেলের সামনে যাই। সে সময় কারফিউ ও মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি চলছিল। সেখানে গিয়ে দেখি, হাজার হাজার লোক বিজয় মিছিল নিয়ে শরীফ মেডিকেলের দিকে আসছে। মিছিলকে লক্ষ্য করে পুলিশ টিয়ার শেল নিক্ষেপ ও গুলি করলে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। আমিসহ কিছু লোক আমার বাড়িতে আশ্রয় নিই। আমি আমার চাচাতো ভাইয়ের বাড়ির ছাদে উঠে দেখতে পাই, কয়েকজন পুলিশ গ্যারেজ থেকে একজনকে তুলে নিয়ে যায় এবং তাকে আমার বাড়ির সামনের কবরস্থানের কাছে নিয়ে গুলি করে। সে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। পুলিশ লাশটিকে থানার দিকে নিয়ে যায়। পুলিশ সদস্যদের মধ্যে ওসি আশরাফ ও ডিবির এসি ছিল। পরে জানতে পারি, যে গুলি করেছে, তার নাম কনস্টেবল আকরাম। আর যাকে গুলি করেছে, তার নাম হৃদয়। পরদিন সকালে জানতে পারি, পুলিশ লাশ নিয়ে পালিয়ে গেছে। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামালসহ অন্যান্য মন্ত্রী এবং স্থানীয় পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা দায়ী। আমি ট্রাইব্যুনালের কাছে সুষ্ঠু বিচার চাই।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত