Ajker Patrika

জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া

সরকারকে প্যাকেজ প্রস্তাব দেবে ঐকমত্য কমিশন

  • ভোটের দিনক্ষণ নিয়ে মতৈক্য হয়নি।
  • পরবর্তী জাতীয় সংসদ দ্বৈত ভূমিকা রাখবে।
  • সংবিধান বা সনদ বাস্তবায়ন আদেশের পক্ষে বিশেষজ্ঞরা।
  • গণভোটের দিনক্ষণ সরকারের ওপর ছাড়তে চায় কমিশন।
‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ০৯: ৩৮
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক। ফাইল ছবি
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক। ফাইল ছবি

রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের বিষয়ে একমত হলেও ভোটের দিনক্ষণ নিয়ে এক জায়গায় আসতে পারেনি। এই অবস্থায় বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে একটি প্যাকেজ প্রস্তাব দেবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।

কমিশনের প্রস্তাবের মধ্যে থাকবে প্রথমে বিশেষ আদেশ জারি করা, যার ভিত্তিতে গণভোট অনুষ্ঠিত হবে এবং পরবর্তী জাতীয় সংসদকে দ্বৈত ভূমিকায় নিয়ে যাওয়া। এই সংসদ একই সঙ্গে সংবিধান সংস্কার পরিষদ সভা এবং নিয়মিত জাতীয় সংসদের ভূমিকা পালন করবে। কিন্তু গণভোটের দিনক্ষণ কমিশন সরকারের ওপর ছেড়ে দেবে বলে জানা গেছে।

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে গতকাল বুধবারও কমিশনের সঙ্গে সংলাপ করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। ওই বৈঠকেও তারা একমত হতে পারেনি। বেলা তিনটায় বিরতি দিয়ে রাত সোয়া ১১টায় বৈঠক শেষ হয়। বৈঠকে সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গণভোট কখন এবং কী আদেশে হবে, সেটি নিয়ে মতভেদ দেখা যায়। বিএনপি ভোটের দিন গণভোট চেয়েছে। জামায়াত এবং এনসিপি চায় সংবিধান বা জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট।

বৈঠকের সমাপনী বক্তব্যে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা আজ সারা দিনের আলোচনার সারাংশ নিয়েছি এবং বিশেষজ্ঞদের মতামতের আলোকে সরকারকে দ্রুত পরামর্শ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।’

অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, বিশেষজ্ঞরা সর্বসম্মতভাবে পাঁচটি প্রস্তাব দিয়েছেন। মতগুলো হলো জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের জন্য একটি বিশেষ আদেশ জারি করতে হবে; ওই আদেশের মাধ্যমেই গণভোট আয়োজন করতে হবে; গণভোটে দুটি আলাদা প্রশ্ন রাখতে হবে, যাতে ঐকমত্য ও মতবিরোধ—উভয় বিষয় স্পষ্ট হয়; নির্বাচনের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার পরিষদ এবং ১৩তম জাতীয় সংসদ গঠন করতে হবে; গণভোটে অনুমোদনের পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জুলাই সনদে বর্ণিত সংস্কার সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

কমিশনের আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে দুটি প্রস্তাব উঠে এসেছে। একাধিক দল জাতীয় নির্বাচনের দিনই পৃথক ব্যালটে গণভোট নেওয়ার পক্ষে, আর কয়েকটি দল নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছে। তবে কমিশনের মতে, সবাই একমত যে সংসদকে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য সংবিধানের কাঠামোগত পরিবর্তনের ক্ষমতা দেওয়া উচিত।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে ১৫ অক্টোবর। এর মধ্যে তারা জুলাই সনদের ওপর একটি স্বাক্ষরদান অনুষ্ঠান আয়োজন করতে চায়। অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমরা আগামী এক-দুই দিনের মধ্যে চূড়ান্তভাবে মতামত সমন্বয় করে সরকারকে পরামর্শ দেব; পাশাপাশি অংশগ্রহণকারী সব রাজনৈতিক দল ও জোটকে অবহিত করা হবে।’

এর আগে জাতীয় নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে গণভোট দেওয়ার পক্ষে মত তুলে ধরে বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, জাতীয় নির্বাচনের অল্প সময় বাকি আছে। এর আগে গণভোটের মতো মহাযজ্ঞ আয়োজন করা সম্ভব নয়। এতে অতিরিক্ত অর্থও খরচ হবে। তাঁরা মনে করেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট করার প্রস্তাব জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করার প্রয়াস হবে।

সনদের অঙ্গীকারে আরেকটি বিষয় যুক্ত করতে হবে, তা হলো যেসব দলের যে যে বিষয়ে ভিন্নমত আছে, সেগুলো তারা নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ করবে। জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হলে সেই দল তাদের ভিন্নমত অনুসারে প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে পারবে।

সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, জুলাই জাতীয় সনদের গাঠনিক ক্ষমতা জনগণের কাছ থেকেই আসবে এবং সেই ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যম হবে গণভোট। তাঁর মতে, গণভোটের মাধ্যমে জনগণ যদি সনদ অনুমোদন করে, তাহলে পরবর্তী সংসদের দায়িত্ব হবে সনদের ঘোষিত দফাগুলো বাস্তবায়ন করা।

সংসদের প্রথম অধিবেশনের মধ্যে সনদ বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা দিলে তা বাস্তবে জটিল হতে পারে বলেও মনে করেন সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি প্রস্তাব দেন, ‘যথাশীঘ্র সম্ভব’ বাক্যটি উল্লেখ করে সংসদকে প্রয়োজনীয় সময় দেওয়ার সুযোগ রাখতে হবে, যাতে নিয়ম পরিবর্তন ও আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যায়।

উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি সনদ গৃহীত হওয়ার পরই বিবেচনা করা যেতে পারে বলে মত দেন সালাহউদ্দিন। নোট অব ডিসেন্ট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভিন্নমত বা আপত্তি থাকলেও তা জুলাই সনদের অংশ হিসেবে গণভোটে যাবে এবং ভবিষ্যতে কোনো দল জনগণের ম্যান্ডেট পেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারবে।

আলোচনায় অংশ নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধি আইনজীবী শিশির মনির বলেন, বিশেষ সংবিধান আদেশ বা জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের প্রয়োজন আছে। এই আদেশে গণভোটের কথা বলা থাকবে। তফসিলে জুলাই সনদ থাকবে। আদেশের ভিত্তিতে গণভোট হবে। আর আগামী সংসদের দুটি ক্ষমতা থাকবে—একটি সাধারণ সংসদের ক্ষমতা, অন্যটি কনস্টুয়েন্ট পাওয়ার বা গাঠনিক ক্ষমতা। সংসদের প্রথম অধিবেশনে এই ক্ষমতা থাকবে। দ্বিতীয় অধিবেশন থেকে সাধারণ সংসদ কাজ করবে। এভাবে হলে সংস্কার টেকসই হবে।

এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, সংস্কারগুলো আগামীতে প্রশ্নবিদ্ধ হবে বা বাতিল হবে, এমন প্রক্রিয়ায় যাওয়া ঠিক হবে না। টেকসই করার বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ নামে একটি আদেশ দেওয়া উচিত। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করা হবে কি না, এই প্রশ্নে গণভোট দেওয়া এবং আগামী সংসদকে বিশেষ কনস্টুয়েন্ট পাওয়ার দেওয়া লাগবে।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটের দিন গণভোট আয়োজনের পক্ষ মত দিয়েছে গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, সিপিবি, বাসদ, বাংলাদেশ জাসদ, এলডিপি। গণতন্ত্র মঞ্চ সংবিধান বা জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের ভিত্তিতে গণভোট চেয়েছে। একই সঙ্গে সনদে উল্লেখ থাকবে, আগামী জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনের নাম হবে সংবিধান সংস্কার সভা এবং নোট অব ডিসেন্টের বিষয়টি আলোচনার মাধ্যমে সমাধান। সিপিবি-বাসদসহ সমমনা দলগুলো সংবিধান আদেশের বিপরীতে ১৯৯১ সালের গণভোট আইন অনুযায়ী ভোটের দিন গণভোট করার প্রস্তাব করে।

বিএনপির সমমনা দলগুলো অধ্যাদেশের মাধ্যমে ভোটের দিন গণভোট করার প্রস্তাব দেয় এবং নিয়মিত সংসদের সংবিধান-সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলো সুরাহা করার প্রস্তাব দেয়।

এদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকের আগে বুধবার দুপুর ১২টা থেকে প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করে কমিশন। সেখানে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিভিন্ন উপায় নিয়ে কথা বলেন।

বিশেষজ্ঞরা জানান, অধ্যাদেশের অধীনে গণভোটের আয়োজন করলে জটিলতা তৈরি হতে পারে। কারণ, অধ্যাদেশ পরবর্তী সংসদ অধিবেশনের ৩০ দিনের মধ্যে সংসদে পাস করতে হয়। কোনো কারণে সেটি না হলে অধ্যাদেশটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। তাই জুলাই ঘোষণাপত্রের অধীনে সংবিধান বা জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের অধীনে গণভোট করার পক্ষে মত দেয়। পরবর্তী সংসদকে নিয়মিত সংসদের সংবিধান সংস্কার পরিষদের ক্ষমতা দিতে পরামর্শ দেওয়া হয়; যেটিই সমাধান বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

কমিশনের একজন বিশেষজ্ঞ নাম প্রকাশ না করার শর্তে আজকের পত্রিকাকে বলেন, শুরুতে কমিশন একসঙ্গে গণভোট এবং সংসদ নির্বাচন আয়োজনের পরামর্শ দিলেও এখন তারা বিষয়টিকে ‘প্র্যাকটিক্যাল ইস্যু’ হিসেবে সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দিতে চাইছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত