Ajker Patrika

দেশের রাজনীতিতে বিদেশিদের তৎপরতা: কার লাভ, কার ক্ষতি

গোলাম ওয়াদুদ, ঢাকা
দেশের রাজনীতিতে বিদেশিদের তৎপরতা: কার লাভ, কার ক্ষতি

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দোরগোড়ায়। সংবিধান মেনে আগামী ডিসেম্বরের শেষে অথবা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন হওয়ার কথা। নির্বাচনকে সামনে রেখে এরই মধ্যে সব দল মাঠ দখলে ব্যস্ত। সরকার ও বিরোধী দল সবারই চাওয়া অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। তবে সুষ্ঠু নির্বাচন কীভাবে নিশ্চিত হবে সেটা নিয়েই চলছে নানা আলাপ। সরকারি দল বলছে, তাদের অধীনেই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। অন্যদিকে মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ অন্যরা বলছে—২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন আমরা দেখেছি, সেই অভিজ্ঞতা থেকে স্পষ্ট বলা যায় এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তাই তারা নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না—এই বক্তব্যে এখন পর্যন্ত অনড়। 

রাজনীতির এমন পরিস্থিতিতে প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কথা বলা শুরু করেছে। এরই মধ্যে গত ১২ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা ঘুরে গেছে। সরকার প্রধান ও বেশ কয়েকজন মন্ত্রী, সরকারের একজন উপদেষ্টা ও নাগরিক সমাজের কয়েক জনের সঙ্গে বৈঠক করে গেছেন তাঁরা। 

এ ছাড়া দুই সপ্তাহের জন্য এখন বাংলাদেশে অবস্থান করছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ছয় সদস্যের একটি পর্যবেক্ষক দল। তাঁরা আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে একের পর এক বৈঠক করছেন। তাঁরা বিভিন্ন পক্ষের অবস্থান বুঝে নির্বাচনের সম্ভাব্য পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার চেষ্টা করছেন। ফিরে গিয়ে যে রিপোর্ট দেবেন তার ওপর ভিত্তি করে ইইউ আগামী নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাবে কি না সিদ্ধান্ত নেবে। 

যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও বেসামরিক নিরাপত্তাবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি আজরা জেয়া ও দেশটির দক্ষিণ এশিয়া–বিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু সরকারের বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে বৈঠক করে ফিরে যাওয়ার পর দেশের রাজনীতিতে একেকজন একেক কথা বলছেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনেক নেতা মনে করছেন তাঁরা সফল হয়েছেন। তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে সরকার সুষ্ঠু নির্বাচন করবে। তাঁরা এটা মেনে নিয়ে ঢাকা ছেড়েছেন। অন্যদিকে বিএনপি ও অন্য বিরোধী দলগুলো বলছে, এই বৈঠকগুলোতে ভিন্ন বার্তা দিয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্র। যার ফলে আরও চাপে পড়েছে সরকার। 

অন্যান্য রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করে ইইউ প্রতিনিধি দল। ছবি: পিআইডিআওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মার্কিন প্রতিনিধিদের বৈঠকের বিষয়ে গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমেরিকা সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বললেও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলেনি। বন্ধু দেশ হিসেবে এ রকম নির্বাচন তাঁদের কাম্য। তাঁরা সফট টোনে বলে গেছেন। এখানে কাউকে ধমক দিয়ে বা ভিসা নীতি আসবে, নিষেধাজ্ঞা আসবে, এটা না করলে ওইটা হবে, এ ধরনের উক্তি তাঁরা করেননি। তাঁরা সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলেছেন। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলেননি।’ 

আওয়ামী লীগ এখানেই তাঁদের সফলতা দেখছেন। তাঁরা বলার চেষ্টা করছেন, এত দিনে রাজনীতির মাঠে চাউর হয়েছিল যে, আজরা জেয়া এসে সরকার পতনের কথা বলবেন। নিরপেক্ষ সরকারের কথা বলবেন। কিন্তু তিনি তা বলেননি। উনি সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলেছেন। আর সুষ্ঠু নির্বাচন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও অঙ্গীকার। অতএব এখানে জয় হয়েছে আওয়ামী লীগের। অন্যদিকে বিএনপি বলছে, চাপে পড়েছে সরকার। 

বিদেশিদের আসা-যাওয়া এবং কথাবার্তা আমাদের দলগুলো নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করছে বলে মত দিয়েছেন বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের সভাপতি এবং ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘তাঁরা কেন এখানে একের পর এক আসছেন—সেটার মর্মার্থটা যদি অনুধাবন করতে পারি তাহলে আমরা বুঝতে পারব তারা কী চান, কী তাঁদের প্রত্যাশা। আমাদের মতো ব্যাখ্যা করে এ সমস্যার সমাধান হবে না, সেটা আমরা দেখেই ফেলেছি। কাজেই আমাদের ব্যাখ্যা তাঁদের প্রত্যাশার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হবে সেই রকম মনে করার কারণ নেই। কেন তাঁরা আসছেন, কী প্রত্যাশা করেন, তার মর্মার্থটা যৌক্তিকভাবে উপলব্ধি করতে পারলেই সমস্যার সমাধান সম্ভব।’ 

মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি আজরা জেয়া বলে গেছেন, ‘জনগণকে তাঁদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে।’ এ বক্তব্যের বার্তা পরিষ্কার। আপনারা যে যাই বলেন, সেটা না। জনগণ স্বাধীনভাবে ভোট দিয়ে তাদের মতামত প্রকাশ করুক। সেটার ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব আসুক। এটাই তাঁদের বার্তা। এমনটাই মনে করেন সাবেক কূটনীতিক এম হুমায়ুন কবির। 

এদিকে দেশে ফিরে যাওয়ার আগে এক সাক্ষাৎকারে আজরা জেয়া বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের উন্নয়নের অংশীদার হিসেবে আগামী নির্বাচনে ‘সহায়ক ভূমিকা’ রাখতে চায়। এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর বার্তা পরিষ্কার করেছেন। 

অন্যান্য রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি জাতীয় পার্টির সঙ্গে বৈঠক করে ইইউ প্রতিনিধি দল। ছবি: পিআইডিতাঁরা স্পষ্ট করে বলে গেছেন যে, তাঁরা কোনো একক দলের পক্ষে নন, তাঁরা একটি অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র চান। ফলে তাঁদের বক্তব্যে যেমন আওয়ামী লীগের খুশি হওয়ার কারণ নেই, তেমনি বিএনপিরও বেশি আনন্দিত হওয়ার সুযোগ নেই। 

এই অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র ফেরানোর দায়িত্ব এ দেশের রাজনীতিকদেরই। তাঁরা যদি মার্কিন প্রতিনিধি দলের এই বার্তা বুঝতে না পারেন বা বুঝেও না বোঝার ভান করেন তাহলে আখেরে ক্ষতি এ দেশের রাজনীতির, ক্ষতি দেশের জনগণের। 

এদিকে ইইউ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে দুই দল জাতির কাছে ভিন্ন ভিন্ন বার্তা দিচ্ছে। আওয়ামী লীগ বলছে, বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনি কাঠামোর ভিত্তিতে নির্বাচন চায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। বাংলাদেশ সরকারও অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে অঙ্গীকারবদ্ধ। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা সংলাপ নিয়ে তাঁদের সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি বলেও জানায় দলটি। 

এদিকে বিএনপি বলছে, ইইউ প্রতিনিধি দল আসার উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার—বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন হয় না, এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না, সম্ভব না। কারণগুলো অনেক এবং তা সবারই জানা। যে কারণে তাঁরা আসছেন। 

অন্যদিকে এক কাঠি সরেস জাতীয় পার্টি। তাঁরা প্রতিনিধি দলকে জানিয়েছেন, ৩০০ আসনে নির্বাচন করার পরিকল্পনা তাদের। 

মাঠে রয়েছে জামায়াতে ইসলামীও। তাদের নিবন্ধন বাতিলের বিষয়টি উচ্চ আদালতে ঝুলে আছে। সুপ্রিম কোর্টে এখনো বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়নি। জামায়াতের সঙ্গেও বৈঠক করেছে ইইউ প্রতিনিধি দল। জামায়াত তাঁদের জানিয়েছে, এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। 

দেশের রাজনৈতিক দলগুলো যদি মতৈক্যে পৌঁছাতে না পারে তাহলে সংকট আরও বাড়বে। আর সংকট বাড়লে কেউই লাভবান হবে না বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশের জনগণ চায় তাদের ভোটাধিকার। সবার অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন এখন জনগণের একমাত্র চাওয়া। আর এই চাওয়া পূরণের জন্য ত্রাতা হয়ে আসতে হবে এ দেশের রাজনীতিবিদদেরই। যার যার মতো অনড় অবস্থায় না থেকে সবারই ছাড় দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। এই সংকট উতরানোর এটাই একমাত্র উপায়। 
 
লেখক: সহ সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

তোরা যারা রাজাকার, সময় থাকতে বাংলা ছাড়: ফেসবুকে বাকের মজুমদার

সমাবেশে দলীয় স্লোগান ও জাতীয় সংগীত পরিবেশনে বাধা দেওয়া প্রসঙ্গে এনসিপির বিবৃতি

কঠোর হচ্ছে যুক্তরাজ্যের অভিবাসন নীতি, স্থায়ী বসবাসের আবেদনে অপেক্ষা ১০ বছর

যুদ্ধ বলিউডের সিনেমা নয়: ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান

রাজপথের চাপে কোনো বিচার করা সম্ভব নয়: চিফ প্রসিকিউটর

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত