Ajker Patrika

আমার বাচ্চারা সব পুড়ে মারা যাচ্ছে, আমি কীভাবে সহ্য করি—মৃত্যুর আগে স্বামীকে বলেন মাহরীন চৌধুরী

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ২২ জুলাই ২০২৫, ১৯: ২৮
মাহরীন চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত
মাহরীন চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত

গতকাল সোমবার (২১ জুলাই) উত্তরা মাইলস্টোন স্কুলে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমানটি যখন বিধ্বস্ত হয়, তখনো সম্পূর্ণ অক্ষত ও সুস্থ ছিলেন মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সমন্বয়ক সাহসী শিক্ষিকা মাহরীন চৌধুরী। কিন্তু তিনি বিপদ দেখে সরে যাননি, নিজের সন্তানের মতো করেই বুক আগলে বাঁচাতে চেয়েছিলেন ছাত্র-ছাত্রীদের। নিজের প্রাণ বিলিয়ে দিয়ে তিনি অনেক শিশুর প্রাণ বাঁচিয়েছেন।

ঢাকার জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় গতকাল সোমবার (২১ জুলাই) রাতে মারা যান মাহরীন চৌধুরী। তাঁর শরীরের ১০০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছিল বলে আবাসিক সার্জন শাওন বিন রহমান জানান। লাইফ সাপোর্টে নেওয়ার আগে স্বামী মনছুর হেলালের সঙ্গে তাঁর শেষ কথা হয়েছিল।

আজ মঙ্গলবার গ্রামের বাড়ি নীলফামারীর জলঢাকা পৌরসভার বগুলাগাড়িতে জানাজার আগে বিমান দুর্ঘটনায় মাইলস্টোনের শিক্ষিকা মাহরীন চৌধুরীর কীভাবে বিমানের আগুন থেকে অনেক শিক্ষার্থীকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন বিলিয়ে দিলেন, সেই সাহসিকতার বর্ণনা তুলে ধরেন তাঁর স্বামী।

মনছুর হেলাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘যেই জায়গাটায় ওরা দাঁড়ায়, ঠিক যেদিক দিয়ে বাচ্চারা বের হবে, ওখানে সরাসরি এসে বিমানটি ক্রাশ করছে, তারপরে এক্সপ্লোশন হয়ে ভেতরে ঢুকে গেছে, ক্লাসরুমে, কিছু বাচ্চা ওখানে ঔনডেড হইছে। ও ওর বাচ্চাদের বাঁচাইতে গিয়া সে...কিছু বাচ্চাকে সে বের করেও নিয়া আসছে।’

বার্ন ইনস্টিটিউটের আইসিউতে তাঁর সঙ্গে মাহরীনের শেষ কথা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার সাথে তার আইসিইউতে যে কথা হইছে, আমি তাকে বললাম, তুমি কেন এ কাজ করতে গেলা? বলে আমার বাচ্চারা আমার সামনে সব পুইড়া মারা যাচ্ছে, আমি এটা কীভাবে সহ্য করি। ও সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে, কিছু বাচ্চা বের করছে, আরও কিছু বাচ্চা বের করার চেষ্টায় ছিল।’

ঠিক এমন সময় বিকট শব্দে আরেকটি বিস্ফোরণ হয়। আর তাতেই ৪২ বছর বয়সী মাহরীনের পুরো শরীর পুড়ে যায় জানিয়ে মনছুর হেলাল বলেন, ‘পা থেকে মাথা পর্যন্ত সব পুড়ে শেষ। শুধু বেঁচে ছিল, একটু কথা বলতে পারছে। আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে নেওয়ার আগে বলল, আমার ডান হাতটা শক্ত করে ধরো। ভাই, হাত ধরা যায় না, সব পুড়ে শেষ। ও বলল, তোমার সাথে আর দেখা হবে না।’

মনছুর হেলাল। ছবি: আজকের পত্রিকা
মনছুর হেলাল। ছবি: আজকের পত্রিকা

স্বামীর হাত ধরে মাহরীন তখন বলছিলেন, ‘আমার বাচ্চাদের দেখো।’ জবাবে মনছুর হেলাল বলেন, ‘তোমার বাচ্চাদের এতিম করে গেলা!’

মাহরীন তখন বলেন, ‘কী করব, ওরাও তো (মাইলস্টোনের শিক্ষার্থীরা) আমার বাচ্চা, সবাই পুড়ে মারা যাচ্ছে, আমি কীভাবে সহ্য করব? রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সবাই সহযোগিতা করেছে, কিন্তু তাকে বাঁচাইতে পারলাম না। .. বলে আমার খুব খিদা লাগছে আমারে কিছু খাওয়াও, আমি ভাই তিন ফোঁটা পানি ছাড়া কিচ্ছু দিতে পারি নাই। ডাক্তার বলে, ভাই শক্ত কিছু দিলেই বুকে আটকায়ে মারা যাবে। ভাই, কী যে কষ্ট ভাই! ”

মাহরীনের ছোট ভাই মুনাফ মজিব চৌধুরী বোনের মৃত্যুর খবর দিয়ে ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মাহরীন আপু (মাহরীন চৌধুরী) আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি আমার বড় বোন। যিনি আমাকে মায়ের মতো করে বড় করেছেন। তিনি মাইলস্টোন স্কুলের কো-অর্ডিনেটর ছিলেন। ভবনে আগুন লাগার সময় তিনি সবার আগে নিজে বের হননি, বরং যতজন ছাত্রছাত্রীকে পারা যায়, বের করে আনার চেষ্টা করেছেন। এতে তাঁর শরীরের ১০০ শতাংশ পুড়ে যায়। আজ রাতে আমার প্রিয় বোনের জন্য দোয়া করবেন দয়া করে। তিনি রেখে গেছেন তাঁর দুই ছেলে—আমার দুটি ভাগনে। আমরা এখনো হাসপাতালে থেকে তাঁর মরদেহ বুঝে পাওয়ার অপেক্ষায় আছি।’

মাহরীন চৌধুরী নীলফামারীর জলঢাকার মৃত মহিতুর রহমান চৌধুরীর মেয়ে এবং জলঢাকা বগুলাগাড়ী স্কুল অ্যান্ড কলেজের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি। নিজ গ্রামে শিক্ষানুরাগী হিসেবে পরিচিত ছিলেন মাহরীন চৌধুরী। আজ সকাল থেকে জেলার জলঢাকা পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বগুলাগাড়ী গ্রামে তাঁকে দাফনের প্রস্তুতি শুরু হয়।

মাহরীন চৌধুরীর প্রতিবেশী আব্দুল জব্বার আজকের পত্রিকা'কে বলেন, দুই ঈদ ও মাঝেমধ্যে গ্রামে আসতেন মাহরীন। এ সময় এলাকার গরিব মানুষকে আর্থিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কালভার্ট নির্মাণেও সহযোগিতা করেছেন। তিনি শিক্ষানুরাগী হিসেবে বগুলাগাড়ী স্কুল অ্যান্ড কলেজের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি হিসেবে তাঁকে মনোনীত করেছে এলাকাবাসী।

নিহতের স্বামী মনছুর হেলাল বলেন, ‘ক্লাস শেষে শিক্ষার্থীদের নিয়ে বের হওয়ার সময় বিমান দুর্ঘটনাটি ঘটে। এ সময় মাহরীন সামান্য আঘাত পায়। কিন্তু ২০ থেকে ২৫ জন শিক্ষার্থী ভেতরে আটকা পড়ে যায়। সে শিক্ষার্থী আটকা পড়ার বিষয়টি মোবাইলে আমাকে জানায় এবং তাদের উদ্ধারে ভেতরে ঢুকে পড়ে। শিক্ষার্থীদের উদ্ধারে সময় সে অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ৯টার পর মারা যায়।’

আরও খবর পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

খালার সঙ্গে শত্রুতা মুহাম্মদ ইউনূসের, আমি ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’: টিউলিপ সিদ্দিক

এনসিপি নেতার বাড়িতে কাফনের কাপড়, চিরকুটে লেখা—‘প্রস্তুত হ রাজাকার’

৪০ পুলিশ কর্মকর্তার পদক প্রত্যাহার, অর্থ ফেরতের নির্দেশ

গণশুনানিতে দুদক চেয়ারম্যানের প্রতি ক্ষোভ দেখালেন মৎস্যচাষি

‘কাল দেখা হইবে, ভালো থাকিস’—ছেলেকে বলেছিলেন গণপিটুনিতে নিহত প্রদীপ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত