Ajker Patrika

রামপুরা-বাড্ডায় গুলি চালানো সেনা কর্মকর্তাদের কেন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না—ট্রাইব্যুনালে নাহিদ

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
নাহিদ ইসলাম। ফাইল ছবি
নাহিদ ইসলাম। ফাইল ছবি

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘প্রত্যাশা অনুযায়ী মিডিয়ার সংস্কার হয়নি। ডিজিএফআই আগে যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করত, এখনো সেই চর্চা রয়েছে। মিডিয়া রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আমি দায়িত্বে থাকাকালে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন করেছিলাম। তাদের দায়িত্ব ছিল পুরো বিষয়টি সংস্কার প্রস্তাব করে সরকারের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা। আইন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিল, যারা ফ্যাসিবাদের দোসর সংবাদমাধ্যমের কর্মী, তাদের বিচারের আওতায় আনা।’

আজ বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি দেওয়ার পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নাহিদ এসব কথা বলেন। তিনি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সারা দেশে চালানো হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ জবানবন্দি দেন। এ মামলার আসামি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল পলাতক রয়েছেন। আর অপর আসামি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন রাজসাক্ষী হয়ে জবানবন্দি দিয়েছেন। এ নিয়ে এ মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন ৪৭ জন।

সেনাবাহিনীর প্রসঙ্গে নাহিদ বলেন, ‘সেনাবাহিনীর যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তাঁদের এক বছরেও গ্রেপ্তার করা হয়নি। আমি নিজে গুম কমিশনে অভিযোগ দিয়েছি। গুমের ঘটনা ও অভ্যুত্থানে রামপুরা-বাড্ডাসহ বিভিন্ন স্থানে সেনা কর্মকর্তারা গুলি চালিয়েছেন, তাঁদের কেন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না? এ বিষয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে—কোনো চাপ আছে কি না। তবে আমি আহ্বান জানাব, কোনো চাপ থাকলেও এগুলো বিবেচনায় না নিয়ে যাতে আইন ফলো করা হয় এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হয়।’

এর আগে ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দিতে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘গত বছরের ৪ আগস্ট শাহবাগে অবস্থান ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করি। ওই দিনই ৬ আগস্ট মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি ঘোষণা করি। তবে সরকার কারফিউ ঘোষণা করে এবং দেশব্যাপী ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। আমরা জানতে পারি, ৬ আগস্টের কর্মসূচি ব্যর্থ করার উদ্দেশ্যে সরকার ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হবে, আমাদের হত্যা বা গুম করা হতে পারে। এ জন্য আমরা মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি এক দিন এগিয়ে ৫ আগস্ট নির্ধারণ করি।’

নাহিদ বলেন, ‘৫ আগস্ট সারা দেশের মানুষ ঢাকায় আসতে থাকে। আমরা শাহবাগে অবস্থান করি। শহীদ মিনার ও চানখাঁরপুল এলাকায় আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানো হয়। সেনাবাহিনী একপর্যায়ে শাহবাগের রাস্তা ছেড়ে দিলে কিছুক্ষণের মধ্যে জনসমুদ্রে পরিণত হয়। আমরা শুনতে পাই, ঢাকার প্রবেশমুখগুলো দিয়ে লাখ লাখ মানুষ ঢাকায় প্রবেশ করেছে। আমরা মিছিল নিয়ে শাহবাগ থেকে গণভবনের উদ্দেশে রওনা দিই। পথিমধ্যে খবর পাই, গণবিক্ষোভের মুখে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে হেলিকপ্টারে করে পালিয়ে গেছে। ওই দিন সারা দেশে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের খবর পাই।’

নাহিদ ইসলাম আরও বলেন, ‘৫ আগস্ট সরকার পতনের পর সংবাদ সম্মেলন করে আমরা সমন্বয়কেরা সব রাজবন্দীর মুক্তির ও অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার গঠনের দাবি জানাই। আমরা আরও দাবি জানাই যে, কোনো ধরনের সেনাশাসন বা সেনাসমর্থিত শাসন আমরা মেনে নেব না। পুলিশ ও বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। এমনকি হেলিকপ্টার থেকেও গুলি চালানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা গুলি চালায় এবং নির্যাতন করে।’ সব হত্যাকাণ্ড ও নৃশংস ঘটনার জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পুলিশ ও বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যাঁরা প্রধান, তাঁদের দায়ী করেন নাহিদ ইসলাম। তিনি ট্রাইব্যুনালের কাছে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করেন।

আন্দোলন প্রসঙ্গে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘অন্য সমন্বয়ক ও ছাত্রনেতাদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে ২০ জুলাই কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিই। সব মিডিয়াতে ঘোষণাটি পাঠালেও কোনো ইলেকট্রনিক মিডিয়া তা প্রচার করেনি। সেদিন রাতে জানতে পারি যে, সরকার কারফিউ ঘোষণা করেছে। বন্ধুর বাসা থেকে রাত আড়াইটার দিকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে কয়েকজন আমাকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে, চোখে কালো কাপড় বেঁধে আটক করে প্রাইভেট কারে তুলে নিয়ে যায়। প্রাইভেট কারে উঠিয়েই আমাকে মারধর করতে থাকে। এরপর আমাকে একটি রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমাকে কিছুক্ষণ পরপর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের সময় হ্যান্ডকাফ ও চোখে কালো কাপড় বেঁধে রাখত। আন্দোলনে কারা জড়িত, কেন আন্দোলন বন্ধ হচ্ছে না—এসব জিজ্ঞাসা করত। নির্যাতনের ফলে আমি কয়েক দফা জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তারা জানায়, আমাকে গুম করা হয়েছে। আন্দোলন না থামালে কখনো বের হতে পারব না। ২৪ ঘণ্টা পর শেষরাতের দিকে আমাকে পূর্বাচল এলাকায় একটি ব্রিজের পাশে চোখ বাঁধা অবস্থায় রেখে চলে যায়।’

নাহিদ আরও বলেন, ‘আমি ঢাকার গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে ভর্তি হয়ে সংবাদ সম্মেলন করে গুম ও নির্যাতনের কথা প্রকাশ করি। হাসপাতাল থেকে জানতে পারি, অনেক সমন্বয়ককে গুম করা হয়েছে। সমন্বয়ক হাসনাত, সারজিস ও হাসিবকে ডিজিএফআই জোর করে তুলে নিয়ে তিনজন মন্ত্রীর সঙ্গে বসিয়েছে। সেই ছবি মিডিয়ায় প্রচার করা হয়। ২২ জুলাই ডিজিএফআই কর্মকর্তা লে. কর্নেল সারোয়ার হাসপাতালে গিয়ে আন্দোলন স্থগিত করতে চাপ দেয় এবং বলে—গুম হওয়া অন্য সমন্বয়কদের জীবিত ফেরত চাইলে আন্দোলন প্রত্যাহার করতে হবে। ২৩ জুলাই ডিজিএফআই ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে এবং আমাকে জোরপূর্বক হাসপাতাল থেকে সেখানে নিয়ে যায়। সেখানে আন্দোলন সমাপ্তির ঘোষণা দেওয়ার চাপ থাকলেও আমি আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিই। পরে ডিজিএফআই আমাকে হাসপাতালে ফেরত নিয়ে আসে।’

নাহিদ বলেন, ‘ডিজিএফআইয়ের কথামতো সংবাদ সম্মেলনে কথা না বলায় তারা আমাকে পুনরায় গুম করার হুমকি দেয়। ২৪ জুলাই সমন্বয়ক বাকের ও আসিফকে গুম অবস্থা থেকে মুক্তি দেওয়া হলে তারা এই হাসপাতালে ভর্তি হয়। তখন থেকে হাসপাতালকে সম্পূর্ণ নজরদারির মধ্যে রাখা হয়। হাসপাতালের ইন্টারনেট, টেলিফোন ও পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়। আমাদের মোবাইল কেড়ে নেওয়া হয়। আমাদের সঙ্গে কাউকে যোগাযোগ করতে দেওয়া হয়নি। ২৬ জুলাই ডিবি পরিচয়ে কয়েকজন ব্যক্তি হাসপাতালে গিয়ে আমাদের তিনজনকে ডিবি অফিসে তুলে নিয়ে যায়। সেখানে ডিবিপ্রধান হারুন আন্দোলন স্থগিত করতে বলে। অন্যথায় আমাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলা করা হবে বলে হুমকি দেয়। আমরা রাজি হইনি। পরদিন সমন্বয়ক হাসনাত ও সারজিসকে ডিবি অফিসে তুলে আনা হয়। পরে সমন্বয়ক নুসরাতকেও আনা হয়। সেখানে আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ ও শারীরিক নির্যাতন করে। আমাকে ওষুধ দেওয়া হয়নি। আমাদের অভিভাবকদেরও সেখানে নিয়ে আন্দোলন বন্ধ করার জন্য চাপ দেওয়া হয়।’

ডিবি অফিসের বর্ণনা দিয়ে নাহিদ বলেন, ‘আমরা আন্দোলন প্রত্যাহার না করলে আরও নারী সমন্বয়কদের তুলে নিয়ে নির্যাতনের হুমকি দেওয়া হয়। একপর্যায়ে আন্দোলন প্রত্যাহারের জন্য তাদের লিখিত একটি বক্তব্য আমাকে দিয়ে জোরপূর্বক পাঠ করিয়ে তা ভিডিও করে মিডিয়ায় প্রচার করা হয়। তারা আমাদের জানায়, প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে তুলে আনা, আটক রাখা ও নির্যাতন করা হয়েছে। ডিবিপ্রধান হারুন আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। আমরা প্রত্যাখ্যান করে আমরণ অনশন শুরু করি। আমরা প্রায় ৩০ ঘণ্টার বেশি সময় সেখানে অনশন করে অসুস্থ হয়ে পড়লে ১ আগস্ট ছেড়ে দেওয়া হয়। ওই দিন প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আমরা ছয়জন সমন্বয়ক জানাই, ডিবি অফিসে জোর করে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিই।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত