Ajker Patrika

জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর

জুলাই সনদে এখনো অনিশ্চয়তা

  • দুই দিন পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে সনদ স্বাক্ষর।
  • দলগুলোর মতপার্থক্য দূর করতে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে ঐকমত্য কমিশন।
  • আপত্তিসহ সনদে স্বাক্ষর করবে না, জানিয়েছে কয়েকটি বামপন্থী দল।
তানিম আহমেদ, ঢাকা 
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

দীর্ঘ সংলাপের পর অবশেষে চূড়ান্ত হয়েছে জুলাই জাতীয় সনদ। ওই সনদে স্বাক্ষরের সম্ভাব্য দিনক্ষণও ঠিক হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবায়ন নিয়ে এখনো এক জায়গায় আসতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। এ অবস্থায় পিছিয়ে দেওয়া হয় তারিখ। দলগুলোর মতপার্থক্য দূর করতে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা অব্যাহত রেখেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এতেও কাটছে না সব দলের স্বাক্ষর নিয়ে অনিশ্চয়তা।

১৫ অক্টোবর জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠিত হবে—গত বৃহস্পতিবার এমনটাই জানিয়েছিল ঐকমত্য কমিশন। কিন্তু গত শনিবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকের পর জানানো হয়, সর্বসাধারণের অংশগ্রহণের জন্য বুধবারের পরিবর্তে সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবারে স্বাক্ষর অনুষ্ঠান হবে। যদিও সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা গেছে, বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে মতপার্থক্য কমানোর জন্যই দুই দিন পেছানো হয়েছে।

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দুই ধাপের সংলাপের ভিত্তিতে জুলাই জাতীয় সনদ তৈরি করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন, যেখানে ৮৪টি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। যার মধ্যে দলগুলোর আপত্তির (নোট অব ডিসেন্ট) কথা উল্লেখ করা আছে। সিপিবি, বাসদ, বাসদ (মার্ক্সবাদী), বাংলাদেশ জাসদসহ বামপন্থী দলগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে আপত্তিসহ জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে না তারা। অন্যদিকে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ অন্য দলগুলো স্বাক্ষরে ইতিবাচক থাকলেও জুলাই জাতীয় সনদের চূড়ান্ত ভাষ্য ও বাস্তবায়নের সুপারিশ দেখে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে পারে।

তবে সব দলের স্বাক্ষর নিয়ে সংশয় নেই বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। দলগুলোকে স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অংশ নিতে আমন্ত্রণ পত্র পাঠাবেন বলে জানান তিনি। আলী রীয়াজ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘দলগুলোর বক্তব্য আমরা আমলে নিয়েছি। জাতীয় সনদে ভিন্নমত থাকবে। সেটার কারণ সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কী কারণে আপত্তি, সেটা উল্লেখ করেছি। ফলে দলিলে দলগুলোর অবস্থান সুস্পষ্টভাবে লেখা থাকবে। ফলে আমরা আশা করি এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত সব রাজনৈতিক দল সনদে স্বাক্ষর করবে।’

জুলাই সনদকে বিএনপি ইতিবাচকভাবে দেখছে বলে জানিয়েছেন দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি গত শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারিত সময়ের আগেই এই সনদের বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হবে।

জুলাই সনদে স্বাক্ষরে জামায়াত ইতিবাচক হলেও দলীয় ফোরামে আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চান বলে জানিয়েছেন দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘স্বাক্ষরের বিষয়ে আমরা এখনো চূড়ান্ত করিনি। এখনো তো সময় আছে। তাড়াহুড়ো নেই। দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।’

এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, ‘জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ও আপত্তি বিবেচনা করে এনসিপি জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে। কিন্তু সনদের মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়নে গড়িমসি করলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করব।’

বর্তমানে বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হয়েছে। জুলাই জাতীয় সনদে মূলনীতির অংশে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতি’ উল্লেখ থাকার কথা বলা হয়েছে। বিদ্যমান চার মূলনীতি বাদ দেওয়ার বিপক্ষে সিপিবি, বাসদ, বাসদ-মার্ক্সবাদী, গণফোরাম, বাংলাদেশ জাসদ। তারা সনদে আপত্তির বিষয়গুলো থাকলে স্বাক্ষর না করার কথা বলছে। এ ছাড়া কমিশনের নতুন প্রস্তাবিত সংবিধানের ৪ (ক) অনুচ্ছেদ বাতিলের বিপক্ষেও দলগুলো। যেখানে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি (ছবি) অপসারণের কথা বলা আছে। বিষয়গুলো নিয়ে আজ দলগুলো বৈঠক করবে বলে জানা গেছে।

বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুল রশীদ ফিরোজ বলেন, ‘জুলাই জাতীয় সনদের চূড়ান্ত ভাষ্য আমাদের মনমতো হলে স্বাক্ষর করব, না হলে করব না।’

বাংলাদেশ জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য মুশতাক হোসেন বলেন, ‘জুলাই সনদে যদি সর্বসম্মতভাবে একমত হওয়া বিষয়গুলো থাকে, তাহলে আমরা স্বাক্ষর করব। নোট অব ডিসেন্টসহ সনদে আমরা স্বাক্ষর করব না।’

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে তৃতীয় ধাপে পাঁচ দিন সংলাপ করে কমিশন। সেখানে গণভোটের বিষয়ে দলগুলো একমত হলেও দিনক্ষণ নিয়ে দ্বিমত ছিল। বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল ভোটের দিন গণভোট চেয়েছে। অন্যদিকে জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দল ভোটের আগেই গণভোট চেয়েছে।

গণভোটের প্রশ্ন নিয়েও দলগুলোর মতভিন্নতা আছে। কমিশন প্রথমে ‘একমত ও আপত্তি’ নিয়ে দুটো প্রশ্নে গণভোট করার চিন্তা করেছিল। দুটি আলাদা প্রশ্নে জানতে চাওয়া হবে এগুলোর বাস্তবায়ন চান কি না। তবে এখন কমিশন একটি প্রশ্ন রাখার চিন্তা করছে। সূত্র জানায়, সেটি হলো পুরো জুলাই সনদ বাস্তবায়ন চান কি না? সেখানে ভিন্নমতসহ যেসব সিদ্ধান্ত আছে, সেগুলোও থাকবে। যদি ‘হ্যাঁ’ ভোট জয়ী হয়, তাহলে ৮৪টি প্রস্তাবে যেভাবে ঐকমত্য কমিশন সিদ্ধান্ত দিয়েছে, সেভাবেই বাস্তবায়ন করা হবে। ভিন্নমত সে ক্ষেত্রে গুরুত্ব পাবে না। তবে এ বিষয়ে এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। জুলাই ঘোষণাপত্রের অধীনে বিশেষ আদেশের ভিত্তিতে এ গণভোট করার সুপারিশ করবে কমিশন।

বিএনপি, জামায়াত, এনসিপির মধ্যে মতপার্থক্য দূর করতে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করছে কমিশন। এর মধ্যে গত শনিবার ও গতকাল রোববার জামায়াতের সঙ্গে দুই দফা বৈঠক করে কমিশন। এ ছাড়া শনিবার এনসিপির সঙ্গে এবং গতকাল বিএনপির সঙ্গে বৈঠক হয়। এসব বৈঠকেও গণভোটের বিষয়ে অবস্থান পরিবর্তন করেনি দলগুলো। তবে, কমিশন আশা করছে, গণভোটের ভিত্তি, গণভোটের বিষয় ও সময় নিয়ে দলগুলোর মতভিন্নতা কমে আসবে। কমিশন চারটি বিষয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে, গণভোট করা, কিসের ভিত্তিতে গণভোট, গণভোটে কী থাকবে এবং গণভোট কখন হবে।

গতকাল দুপুরে কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে ভোটের দিন গণভোটের পক্ষে দলটির যুক্তি আবারও তুলে ধরেন তিনি। সেখানে একই দিন গণভোট করলে রাষ্ট্রের অর্থ সাশ্রয় হবে বলেও জানান তিনি। আর জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট হলে ভোট গ্রহণের হার কম হবে বলেও যুক্তি দেন সালাহউদ্দিন।

এ দিন বিকেলে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ ও আইনজীবী শিশির মনিরের সঙ্গে কমিশনের সদস্যরা দ্বিতীয় দিনের বৈঠক করেন। সেখানে নেতারা ভোটের আগে গণভোটের পক্ষে দলটির যুক্তি আবারও তুলে ধরে বলে জানা গেছে। বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ‘গণভোটের বিষয়ে আমাদের অবস্থানের পরিবর্তন হয়নি। নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবিতে আমরা কর্মসূচি দিয়েছি।’

অনানুষ্ঠানিক আলাপের বিষয়ে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমরা দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রেখেছি, যাতে করে মতপার্থক্য কমিয়ে এনে দ্রুত সনদ বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হওয়া যায়।’

গণভোটের পরেও জুলাই সনদ সংবিধানসংক্রান্ত বিষয়গুলো সমাধানে পরবর্তী জাতীয় সংসদকে দ্বৈত ক্ষমতার সুপারিশ করবে কমিশন। সূত্রে জানা গেছে, সংবিধান সংস্কার পরিষদের ছয় মাসের সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার পক্ষে তারা। তা না হলে সংস্কার ঝুলে যাবে। কমিশন মনে করে, প্রথম অধিবেশনে সংবিধানসংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো পাস করার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা ঠিক হবে না। এ ক্ষেত্রে সংসদ গঠিত হওয়ার বা আগামী সংসদের প্রথম বৈঠকের দিন থেকে পরবর্তী ১৮০ দিনের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করার সময় বেঁধে দেওয়ার কথা ভাবছে কমিশন। দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনে এ সময় আরও বাড়ানো বা কমানো যেতে পারে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

১৫ সেনা কর্মকর্তাকে রাখা হতে পারে সাবজেলে

‘কলিজা ছেঁড়ার’ হুমকি সারজিসের: ৮ মিনিট বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের কারণ জানাল নেসকো

শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা, স্বজনদের সঙ্গে মরদেহ খোঁজেন অভিযুক্ত তরুণ

অবৈধ ভাটা বন্ধ না হলে উপদেষ্টা রিজওয়ানাকে চেয়ারে রাখব না— হুঁশিয়ারি এনসিপি নেতার

ক্ষোভ ঝাড়তে গিয়ে উপমা ব্যবহার করেছি, সেটা উচিত হয়নি—‘কলিজা ছেঁড়া’ মন্তব্যের ব্যাখ্যায় সারজিস

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত