Ajker Patrika

এক আসনেই নাকাল ইসি

বিশেষ প্রতিনিধি, ঢাকা এবং সাঘাটা ও ফুলছড়ি (গাইবান্ধা) প্রতিনিধি
আপডেট : ১৩ অক্টোবর ২০২২, ০৯: ৪৮
এক আসনেই নাকাল ইসি

বিএনপি ভোটে নেই, ক্ষমতাসীনদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ঘরোয়া বিরোধী দল জাতীয় পার্টির প্রার্থী। তবু শেষ নামানো গেল না গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-ফুলছড়ি) আসনের উপনির্বাচন। অনিয়ম-অনাচার সামলাতে না পেরে ঘণ্টা ছয়েক ভোট নেওয়ার পর পুরো নির্বাচনই বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে নির্বাচন কমিশন।

চার প্রার্থীর ভোট বর্জনের পর গতকাল বুধবার বেলা আড়াইটার দিকে নির্বাচন কমিশন থেকে উপনির্বাচন স্থগিতের ঘোষণা দেওয়া হয়। এতে শুরুতে অবাক হয় আওয়ামী লীগ। পরে ফল ঘোষণার দাবিতে বিক্ষোভ, অবরোধ করে তাদের প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকেরা। আর জাপা তুলেছে ভোটের পুনঃ তফসিল ঘোষণার দাবি। ভোটের বাইরে থাকা বিএনপি বলছে, এটা নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা।

সকাল ৮টায় ভোট গ্রহণের পর এক এক করে ৫১ কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়। এরপর বেলা আড়াইটার দিকে পুরো ভোট স্থগিতের ঘোষণা দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। ঢাকা থেকে সেই ঘোষণায় তিনি বলেন, ‘নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ায় আমরা পরিশেষে সিদ্ধান্ত নিয়েছি…সমগ্র নির্বাচনী এলাকা, গাইবান্ধা-৫ নির্বাচনী এলাকার ভোট কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘কোনো একটি পক্ষ বা কোনো একজন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী প্রভাবিত করতে পারছেন। ফলে, আমাদের দৃষ্টিতে মনে হয়েছে, ভোট গ্রহণ নিরপেক্ষ হচ্ছে না।’

যদিও ভোট স্থগিত করাকে রহস্যময় বলে আখ্যায়িত করেছেন গাইবান্ধা-৫ আসনে নৌকার মনোনীত প্রার্থী, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাহমুদ হাসান রিপন। গতকাল বিকেলে সাঘাটায় সংবাদ সম্মেলনে ইসিকে নির্বাচন স্থগিতের কারণ পরিষ্কার করার আহ্বান জানান তিনি।

ভোট বন্ধ হওয়াকে গভীর ষড়যন্ত্র উল্লেখ করে রিপন বলেন, সব বিরোধী প্রার্থী মিলে এই ষড়যন্ত্র করেছেন। পুরো বিষয়টি অস্পষ্ট এবং ঘোলাটে। শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে এমন সিদ্ধান্ত কেন নেওয়া হলো, তা পরিষ্কার করার দাবি জানিয়েছেন।

ইভিএমের প্রথম পরীক্ষায় ব্যর্থ ইসি গত ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়া বর্তমান ইসি বারবার জোর গলায় বলছিল, ভোটে অনিয়ম রুখতে তাঁরা বদ্ধপরিকর। বর্তমান কমিশনের অধীনে প্রথম ভোটের পরীক্ষা ছিল গত ১৫ জুন। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনসহ (কুসিক) শতাধিক ইউনিয়ন পরিষদের ভোটের আগে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও সমর্থকদের আচরণে বেশ কিছু এলাকায় নির্বাচন স্থগিত করা হয়। তবে এই ইসির জন্য পুরো আসনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট গ্রহণ ছিল এবারই প্রথম। ভোট গ্রহণের দিন নির্বাচন স্থগিত করার ঘোষণার মধ্য দিয়ে এখন প্রশ্নের মুখে ইসি।

দেশের অন্যতম পুরোনো নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়েন্সের (ফেমা) প্রধান মুনিরা খান বলেন, ‘আজ পর্যন্ত এই নির্বাচনে যে খরচ হলো, কিন্তু তারা সফল হলো না। এর জবাবদিহি কার কাছে দেবে ইসি? সাধারণ ব্যালট যদি দখল করা যায়, ইভিএম থাকলেই দখল করা যাবে না, এ ধারণা তাদের কে দিল। ভোট যেভাবেই হোক। সুষ্ঠু ভোটের সদিচ্ছা এবং নিরপেক্ষ থাকার ইচ্ছাটাই বড়। কী করে সুষ্ঠু নির্বাচন করা যায়, এ বিষয়ে ইসিকে আরও সতর্ক হতে হবে।’
 
যা হলো এক উপনির্বাচনে গত ২২ জুলাই ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া মারা গেলে গাইবান্ধা-৫ আসনটি ফাঁকা হয়। সেই উপনির্বাচনে গতকাল সকাল ৮টা থেকে ভোট গ্রহণ শুরু হয়। সবগুলো কেন্দ্রের ভোট হচ্ছিল ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম)। সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন উপহার দিতে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্নের কথাও জানিয়েছিলেন রিটার্নিং কর্মকর্তা ও রাজশাহী আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম।

কিন্তু ভোট শুরুর দু-তিন ঘণ্টা পর সিসি ক্যামেরায় ভোটের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সিইসি হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের বলেন, ‘ভোট নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।

আমরা স্বচক্ষে গোপন কক্ষে অবৈধভাবে প্রবেশ করে ভোট দিয়ে দিতে দেখেছি। তাই কিছু কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ বন্ধ করা হয়েছে।’

এভাবে দুপুর পর্যন্ত মোট ৫১টি কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ বন্ধ করা হয় নানা অনিয়মের কারণে। এ উপনির্বাচনে সাঘাটা উপজেলায় ৮৮টি এবং ফুলছড়ি উপজেলায় ৫৭টিসহ মোট ১৪৫টি কেন্দ্র ছিল। ১ হাজার ২৪২টি সিসি ক্যামেরার আওতায় ছিল সবগুলো ভোটকেন্দ্র। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে অনেক কেন্দ্রে সিসিটিভি ক্যামেরার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার কথা ইসির কর্মকর্তারা সিইসিকে জানান।

দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে জাতীয় পার্টির এ এইচ এম গোলাম শহীদ রনজু (লাঙ্গল), বিকল্পধারা বাংলাদেশের জাহাঙ্গীর আলম (কুলা), স্বতন্ত্র প্রার্থী নাহিদুজ্জামান নিশাদ (আপেল) ও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান (ট্রাক) সাঘাটা উপজেলার বগারভিটা কেন্দ্রে একত্র হয়ে একযোগে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন। এতে ভোটের মাঠে যান শুধু একজন প্রার্থী— আওয়ামী লীগের মাহমুদ হাসান রিপন।

ভোট বর্জন করা প্রার্থীরা আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে কেন্দ্র দখল, জাল ভোট দেওয়া, ইভিএমে জালিয়াতিসহ নানা অভিযোগ তোলেন। পাশাপাশি ফের তফসিল ঘোষণা করে নতুন করে ভোট গ্রহণের দাবিও জানান তাঁরা।

সিইসির যত কথা নির্বাচনের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে কেন চলে গেল—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি, গোপন কক্ষে অন্যরা ঢুকছে, ভোট সুশৃঙ্খলভাবে হচ্ছে না। তবে কেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল, তা আমরা এখনো বলতে পারব না।’

নির্বাচনে যাঁরা অনিয়ম করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না—এ প্রশ্নে কাজী আউয়াল বলেন, এ বিষয়ে পুলিশ, জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।

ইভিএমের কোনো ‘দোষ’ দেখতে পাচ্ছেন না জানিয়ে সিইসি বলেন, ‘এখানে মানবিক যে আচরণ তা দেখিয়ে দিচ্ছে, একই রঙের পোশাক পরে আচরণবিধি লঙ্ঘন করে এসব করছে। এটা সুশৃঙ্খল ভোটের পরিপন্থী। এরাই ডাকাত, এরাই দুর্বৃত্ত।’

সিইসির মতে, ‘যারা আইন মানেন না, তারা দুর্বৃত্ত। আমরা যদি সংস্কৃতি ডেভেলপ (উন্নত) করতে না পারি, নির্বাচন কমিশন এখানে বসে বসে সুন্দর, সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে পারবে? এটা সম্ভব নয়।’

অবশেষে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় বেলা আড়াইটার দিকে উপনির্বাচনে ভোট গ্রহণ বন্ধ ঘোষণা করেন সিইসি। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে ভোট পর্যবেক্ষণের মনিটরিং সেলে বসে তিনি এ ঘোষণা দেন।
 
বিশেষজ্ঞ বললেন সংঘর্ষ নেই, নেই ভোটকেন্দ্রের অভিযোগ, তবু ইভিএমে ভোট নিতে ইসির এই ব্যর্থতাকে আস্থার সংকট হিসেবে দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তানজীম উদ্দীন খান। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘এখন যেহেতু দেশে গণতন্ত্রের লেশমাত্র নেই এবং সবকিছু ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত! সে রকম পরিবেশে বিশ্বাস কিংবা পারস্পরিক আস্থা থাকে না, আমাদের সংকট এখানে। যার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো মনে করছে, ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। ইভিএম হোক কিংবা অন্য পদ্ধতিতে হোক, সমস্যা সেখানে নয়। সমস্যা হলো অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের যে পরিবেশ, আস্থা ও বিশ্বাস থাকা দরকার, সেটি নেই।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‘ভারতে ঢুকে’ পাকিস্তানি সেনাদের গুলি, সীমান্তে সংঘাত গড়াল ষষ্ঠ দিনে

বন্ধুকে ছাত্রলীগ সাজিয়ে পুলিশে দিয়ে তাঁর প্রেমিকাকে ধর্ষণ করলেন ছাত্রদল নেতা

বিবাহিতদের পুলিশ ক্যাডারে না নেওয়ার প্রস্তাব র‍্যাব ডিজির

পেহেলগাম হামলা: ধরা খেয়ে গেল মোদির কাশ্মীর ন্যারেটিভ

পরিপাকতন্ত্রের ওষুধের পেছনেই মানুষের ব্যয় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত