Ajker Patrika

রোহিঙ্গা ঢলের আট বছর

সংকটের মধ্যেও প্রত্যাবাসনে মনোযোগী অন্তর্বর্তী সরকার

মাইনউদ্দিন শাহেদ, কক্সবাজার
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নিপীড়নের শিকার হয়ে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট এবং পরের কয়েক মাসে অন্তত ৮ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। রোহিঙ্গাদের এই ঢলের আট বছর হলেও একজন রোহিঙ্গাকেও স্বদেশে প্রত্যাবাসন করা সম্ভব হয়নি।

এর ওপর গত দেড় বছর রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দেশটির সরকারি বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সংঘাতের জেরে নিরাপত্তা ও খাদ্যসংকটে পড়ে মংডু টাউনশিপ এবং আশপাশের অন্তত দেড় লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। প্রায় প্রতিদিন বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি এবং কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্তের কোনো না কোনো পথ দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটছে।

নতুন আসা ১ লাখ ২৪ হাজারের মতো রোহিঙ্গার বায়োমেট্রিক নিবন্ধন সম্পন্ন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয়।

চলতি বছরের এপ্রিল মাসের শুরুতে নিবন্ধিত ৮ লাখ রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই-বাছাই করে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে সম্মতি জানায় জান্তা সরকার। জান্তা সরকারের সম্মতি থাকলেও আরাকান আর্মিই এখন প্রত্যাবাসনে বড় বাধা বলে জানান রোহিঙ্গা নেতারা। তাঁরা বলেছেন, রাখাইনের ৮৫ শতাংশ এলাকা এখন আরাকান আর্মি নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের জাতিগত বিরোধ রয়েছে। ফলে তাদের সম্মতি ছাড়া রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরানো সম্ভব নয়।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরে পরিবার নিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন আবুল কাসেম (৫০)। তিনি উখিয়ার বালুখালী ১৭ নম্বর ক্যাম্পের একটি ব্লকের মাঝির দায়িত্বে আছেন। আবুল কাসেম বলেন, ‘রাখাইনে প্রত্যাবাসনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। সেখানে আরাকান আর্মি হত্যা ও নির্যাতন চালাচ্ছে। যারা সেখানে আছে তারাও পালিয়ে আসছে।’ এই রোহিঙ্গা নেতা বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার আমাদের মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছে। এখানেও তো আমরা বন্দীজীবন কাটাচ্ছি।’ দীর্ঘদিন দেশে ফিরতে না পেরে তাঁদের সন্তানেরাও হতাশ বলে জানান উখিয়ার বালুখালী আশ্রয় শিবিরের আরেক মাঝি নুর মোহাম্মদ। তিনি বলেন, ‘আমাদের সন্তানেরা ক্যাম্পে বড় হচ্ছে। শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত। ফলে অনেকে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এই প্রজন্মকে বাঁচাতে হলে আমাদের নিজভূমিতে ফিরিয়ে নিতে হবে।’ রাখাইনে নিরাপত্তা নিশ্চিত না করলে প্রত্যাবাসন সম্ভব নয় মন্তব্য করে এই রোহিঙ্গা নেতা বলেন, ‘আমরা সম্মানের সঙ্গে নাগরিকত্ব চাই।’

উখিয়ার লম্বাশিয়া ক্যাম্পের মাঝি ছৈয়দ কাসেম বলেন, ‘আট বছর ধরে আমরা শুধু আশ্বাস শুনে যাচ্ছি। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুই করা যায়নি। এই দীর্ঘ সময়ে আমাদের সমস্যা আরও জটিল হয়েছে। স্থানীয়দের সঙ্গে সম্পর্কে টানাপোড়েন, অপরাধ ও হতাশা বেড়েছে। তাই আর দেরি না করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে।’

সংকটের মধ্যেও প্রত্যাবাসনে মনোযোগ অন্তর্বর্তী সরকারের ২০২৩ সালের নভেম্বরে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সঙ্গে আরাকান আর্মির যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভেঙে যাওয়ার পর রাখাইনের রোহিঙ্গা-অধ্যুষিত টাউনশিপগুলোয় হামলা শুরু হয়। হামলার মুখে আবারও রোহিঙ্গারা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে। এর মধ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশ সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান নিয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, যেকোনো সময় তারা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে। ১৭ আগস্ট ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত রোহিঙ্গাবিষয়ক জাতীয় টাস্কফোর্সের (এনটিএফ) এক সভায় বিষয়টি জানানো হয়।

আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিচ অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মো. জুবায়ের বলেন, আরাকান আর্মি জাতিগত নিধন চালাচ্ছে। রাখাইনে এখনো ৩ লাখের মতো রোহিঙ্গা আছে। তারা চরম খাদ্য ও নিরাপত্তাসংকটে পড়েছে। নির্যাতনের ভয়ে তারা বাড়ি থেকে বের হতে পারছে না।

কক্সবাজার রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গা-সংকট দিন দিন প্রকট হচ্ছে। তারা মাদক ও মানব পাচার, অপহরণ, হত্যাসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। এ অবস্থার পরিবর্তনে প্রত্যাবাসনের বিকল্প নেই।

গত ১৪ মার্চ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসকে নিয়ে রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবির পরিদর্শন করেছিলেন। ওই দিন প্রায় ১ লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে তাঁরা ইফতারে অংশ নিয়েছিলেন। তাঁদের ওই সফরের পর রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরার বিষয়টি নানা পর্যায়ে আলোচনায় এসেছে।

কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার এবং অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ মিজানুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসন ও সহায়তা নিশ্চিত করতে বর্তমান সরকার আন্তর্জাতিক মহলে মনোযোগ বাড়াতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। কক্সবাজারে তিন দিনের আন্তর্জাতিক সম্মেলন তারই একটি অংশ। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা-সংকটের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও দাতাগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের সহায়তায় এগিয়ে এলেও বৈশ্বিক নানা সমস্যার কারণে মনোযোগ হারিয়েছে। এখন সরকার মনোযোগ বাড়াতে উদ্যোগ নিয়েছে।

এদিকে রোহিঙ্গা ঢলের আট বছর পূর্তিতে আজ উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরে সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। নতুন ও পুরোনো মিলিয়ে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবির এবং নোয়াখালীর ভাসানচরে অন্তত ১৪ লাখ রোহিঙ্গা গাদাগাদি করে বসবাস করছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মালয়েশিয়ায় স্থায়ী বসবাসের সুযোগ, আবেদন ফি মাত্র ১৪ হাজার টাকা

বিএসএফের হাতে আটক বাংলাদেশি পুলিশ কর্মকর্তার পরিচয় মিলেছে

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কাইরান কাজীর বিষয়ে ইলন মাস্কের মন্তব্যে বিস্ময়

অমীমাংসিত বিষয় সমাধানে পাকিস্তানের দাবি নাকচ করল সরকার

১৫ বছর যাদের জন্য লড়াই করলাম, তারা এখন আমাকে ধাক্কা দেয়: রুমিন ফারহানা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত