Ajker Patrika

শৈশবে প্রযুক্তির ছোঁয়া মানসিক স্বাস্থ্য বদলে দিতে পারে চিরতরে

ফিচার ডেস্ক
আপডেট : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৭: ৩২
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

আমাদের সভ্যতার সবচেয়ে বড় একটি অর্জন প্রযুক্তি। একই সঙ্গে এর কিছু বিষয় আমাদের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বর্তমানে স্মার্টফোনের ব্যবহার নিয়ে নানান নেতিবাচক দিক আরও বেশি করে প্রকট হয়ে উঠছে। এমনকি আমরা শিশুদের খুব তাড়াতাড়ি এগিয়ে দিচ্ছি এমন এক জগতে, যার জন্য তারা প্রস্তুত নয়। একটা ছোট শিশুকে খাওয়ানোর জন্য মোবাইল কিংবা টেলিভিশনে কার্টুন দেখানো থেকে শুরু হচ্ছে শিশুদের মোবাইল ফোনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রথম ধাপ। এরপর প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে মোবাইল ফোন। কখনো তাদের নিরাপত্তা আবার কখনো লেখাপড়ার জন্য। কিন্তু গবেষণা বলছে, ১৩ বছর বয়সের আগে স্মার্টফোনের মালিকানা প্রাপ্তি প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের শুরুতে মানসিক সুস্থতা ও মনের স্বাস্থ্য হ্রাসের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।

জার্নাল অব হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ক্যাপাবিলিটিজ নামের একটি পিয়ার-রিভিউড জার্নালে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে এমনই একটি তথ্য। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সী এবং ১২ বা তার নিচের বয়সে প্রথম স্মার্টফোন পেয়েছিল, তাদের মধ্যে আত্মহত্যার চিন্তা, আগ্রাসী মনোভাব, বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্নতা, আবেগ নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতা এবং আত্মমর্যাদাহীনতার হার বেশি। গবেষণাটিতে ১ লাখের বেশি তরুণের মানসিক স্বাস্থ্যের তথ্য বিশ্লেষণ করেছেন গবেষকেরা। বিশ্বের সর্ববৃহৎ মানসিক স্বাস্থ্য ডেটাবেইসের কেন্দ্র স্প্যানিয়ান ল্যাবসের (Sapien Labs) গবেষকেরা বলছেন, দেখা গেছে, যেসব শিশু ১৩ বছরের নিচে স্মার্টফোন হাতে পেয়েছে, তারা পরবর্তী জীবনে মানসিক দিক থেকে আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। গ্লোবাল মাইন্ড প্রোজেক্টের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কল্যাণ রক্ষায় জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। গবেষণার প্রধান লেখক স্যাপিয়েন ল্যাবসের প্রতিষ্ঠাতা ও নিউরোসায়েন্টিস্ট টারা থিয়াগরাজান। তিনি বলেন, তথ্যগুলো দেখাচ্ছে যে, অল্প বয়সে স্মার্টফোনের মালিকানা এবং এর মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রবেশাধিকার পাওয়ার সঙ্গে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই মানসিক স্বাস্থ্য ও সুস্থতায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের সম্পর্ক রয়েছে।

ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

যেসব পরিসংখ্যান আমাদের থমকে দেয়

গবেষণায় দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে ১২ বছরের নিচের ১৭ শতাংশ শিশু ইতিমধ্যে একটি স্মার্টফোনের মালিক। এদিকে বিশ্বব্যাপী ৮-১২ বছর বয়সীদের মধ্যে ৫৬ শতাংশ শিশুর হাতে রয়েছে একটি স্মার্টফোন। বেশির ভাগ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ১৩ বছরের নিচে ব্যবহার নিষিদ্ধ বলা হলেও বাস্তবে এই নিয়ম কার্যকর হয় না। এদিকে স্মার্টফোন ব্যবহারের গড় বয়স ক্রমেই কমছে এবং অনেক শিশু প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটাচ্ছে ফোনে। এর নেতিবাচক প্রভাবগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলো হলো—অল্প বয়সে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রবেশ, সাইবার বুলিং, ঘুমের ব্যাঘাত ও পারিবারিক সম্পর্কে দুর্বলতা। আর এ বিষয়গুলো প্রাপ্তবয়স্ক বয়সে মানসিক সুস্থতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এটি শুধু প্রযুক্তি নয়, একটি জনস্বাস্থ্য সংকটের দিকেও নির্দেশ করছে।

ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

মানসিক স্বাস্থ্যে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব

২০০০ সালের শুরু থেকে স্মার্টফোনের সঙ্গে তরুণদের সংযুক্তি, শেখা ও আত্মপরিচয় গঠনের ধরনে পরিবর্তন এনেছে। কিন্তু এই সম্ভাবনার পাশাপাশি বেড়ে চলেছে উদ্বেগ। বিশেষ করে, এআইচালিত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যালগরিদম ক্ষতিকর কনটেন্ট ছড়িয়ে দেয়, সামাজিক তুলনা বাড়ায় এবং ঘুম ও সরাসরি সামাজিক যোগাযোগের বিকল্প হয়ে দাঁড়ায়। গবেষণায় ব্যবহার করা হয়েছে মাইন্ড হেলথ কোশেন্ট (Mind Health Quotient) নামের একটি স্কোরিং সিস্টেম। যা চারটি দিক অর্থাৎ সামাজিক, আবেগীয়, জ্ঞানমূলক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপরে তথ্য নিয়েছে। সেখান থেকে দেখা গেছে, যারা ছোটবেলায় ফোন পেয়েছে, তাদের স্কোর ছিল সবচেয়ে কম। ড. টারা থিয়াগরাজান জানান, যাদের হাতে খুব অল্প বয়সে স্মার্টফোন আসে, তাদের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠার সময় আত্মমর্যাদা হ্রাস, বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্নতা, আবেগের ভারসাম্য হারানো ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অতিরিক্ত সময় ব্যয়, সাইবার বুলিংয়ের শিকার হওয়া, রাত জেগে স্ক্রিনে আটকে থাকা এবং পারিবারিক সংযোগ দুর্বল হয়ে যাওয়া—এসবই তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যকে গোপনে দুর্বল করে দেয়। এর সবচেয়ে শক্তিশালীভাবে যুক্ত উপসর্গগুলো হলো আত্মহত্যার চিন্তা, আগ্রাসী মনোভাব, বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্নতা ও হ্যালুসিনেশন।

লৈঙ্গিকভিত্তিক প্রভাব নারীদের জন্য আরও গুরুতর

গবেষণায় দেখা গেছে, নারীরা যখন খুব কম বয়সে স্মার্টফোন পায়, তখন তাদের আত্মবিশ্বাস, আত্মসম্মান ও আবেগের স্থিতিশীলতা ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ছেলেদের ক্ষেত্রেও প্রভাব পড়ে। তবে তা বেশি হয়ে থাকে আচরণগত পরিবর্তন ও নিয়ন্ত্রণহীন আবেগের দিক থেকে।

ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

নীতিনির্ধারকদের করণীয় কী

বাবা-মা ও অভিভাবকদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব এখন সময়মতো ‘না’ বলা শেখা। সন্তানদের সঙ্গে প্রযুক্তি নিয়ে খোলা আলোচনা, পারিবারিক সময় বৃদ্ধি ও প্রযুক্তির বিকল্প তৈরি হতে পারে শিশুর সুস্থ ভবিষ্যতের ভিত্তি। এ ছাড়া কিছু বিষয়ের ওপর নজর দিতে হবে। যেমন—

স্মার্টফোন বয়সসীমা নির্ধারণের আইন। ১৩ বছরের নিচে স্মার্টফোন মালিকানা ও সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকসেস সীমিত করতে আইনি পদক্ষেপ প্রয়োজন।

স্কুলপর্যায় থেকে প্রযুক্তির নিরাপদ ব্যবহারে শিক্ষা দেওয়া জরুরি। শুধু কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, তা নয়; বরং কেন, কতটা ও কখন এই বোধ গড়ে তোলা দরকার।

প্রযুক্তি কোম্পানির জবাবদিহি

অ্যাপ ও সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে যেন তারা বয়স যাচাই ব্যবস্থা কঠোর করে।

কনটেন্ট ফিল্টারিং আরও কার্যকর করে।

প্রযুক্তি আমাদের জীবনের অঙ্গ হয়ে গেছে। একে অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রযুক্তির গোলাম বানিয়ে তুলছি কি না। ১৩-এর নিচে স্মার্টফোন হাতে পাওয়া হয়তো আজকের সমাজে সাধারণ হয়ে গেছে। কিন্তু এই ‘সাধারণ’ জিনিসটাই যখন মস্তিষ্কের গঠন, আত্মপরিচয় ও আবেগীয় স্বাস্থ্যকে ভেঙে দিচ্ছে, তখন সেটি আর সাধারণ থাকে না, তা হয়ে যায় সতর্কসংকেত।

সূত্র: স্যাপিয়েন ল্যাবস, সিএনএন, স্টার্সইনসাইডার

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত